তাই বলে খেলার মাঠে দর্শকের কমতি হল না। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের খেলা দেখতে মাঠ ঠিকই ভরে গেল। বলা বাহুল্য, প্রধান আকর্ষণ ডন। ইংল্যাণ্ডে তখন সেঅসম্ভব খ্যাতিমান। ‘হুজ হু’ পরিচিতি গ্রন্থে ডনের জন্য তখন ২১ লাইন বরাদ্দ অর্থাৎ হিটলারের থেকে আট লাইন কম, স্ট্যালিনের থেকে সতেরো লাইন বেশি। ডনের পায়ে পায়ে তখন ছেলের পাল ঘোরে। রাস্তায় লোকজন দাঁড়িয়ে গিয়ে তাকায়। হোটেলে অনেকেই দেখা করতে আসে পুরোনো বন্ধুর ভান করে।
জাহাজে ডন ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই কাটায়। তার উপর এক দুর্ঘটনা, দলের সবথেকে ছোটো সিডনি বার্নেস পিছল ডেকে পড়ে গিয়ে কবজির হাড় ভাঙে জিব্রাল্টারে। জুনের শেষে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ শেষ হওয়ার পর বার্নেস সফরে প্রথম ব্যাট করে। জাহাজে অসুস্থ হয়ে বিছানায় কাটালেও ডন মানসিক বিশ্রাম নেয়নি। কাগজ-পেনসিল নিয়ে বোলিং প্ল্যান ছকেছে, ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের স্কোর আর কীভাবে তারা আউট হয়েছে তাই নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে, বিভিন্ন ধরনের উইকেটে ও বিভিন্ন ধরনের বোলারের বিরুদ্ধে তাদের দক্ষতা সম্পর্কিত রিপোর্টও গভীর মনোযোগে পড়েছে। জাহাজে সামাজিকতা রক্ষার জন্য মেলামেশার থেকেও তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল এই কাজগুলি করা।
ডন ইংল্যাণ্ডে খেলতে ভালোবাসে। অস্ট্রেলিয়ার থেকে ইংলিশ উইকেট মন্থর। তার ব্যাটিং প্রধানত পিছিয়ে গিয়ে খেলার ওপরই ভিত্তি করে, ফলে মন্থর উইকেট তার স্টাইলেরই উপযোগী। ইংল্যাণ্ডের মৃদু কোমল আলোয় বল দেখতেও তার সুবিধা হয়।
যথারীতি সফরের প্রথম খেলা উরস্টারে। প্রথম দুটি সফরের মতো ডন এবারও সফর শুরু করল দ্বিশত রান দিয়ে। ২৯০ মিনিটে ২৫৮ রান, তাতে ৩৩টি চার। উরস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে প্রথম দুটি সফরে করেছিল ২৩৬ ও ২০৬। এই ত্রি-সাফল্যের জন্য সেখানকার এক চিনামাটির দ্রব্যনির্মাতা বিশেষ এক ফুলদানি তৈরি করে ডনকে উপহার দেয়। সেটির একদিকে আঁকা আছে উরস্টার মাঠের ছবি— দর্শকরা, নদীতীরের গাছের সারি, অনবদ্য উরস্টার ক্যাথিড্রাল এবং উইকেটে ব্যাটিংরত ডন ব্র্যাডম্যান। অন্য দিকে উৎকীর্ণ আছে প্রশংসাবাক্য।
সফর শুরু করে ২৭ মে পর্যন্ত ডন সাতটি ম্যাচে এক ইনিংস করে খেলে সাত ইনিংসে করে ১,০২১ রান। মরসুমের শুরু থেকে মে মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে হাজার রান এখন পর্যন্ত সাত জন পূর্ণ করতে পেরেছে। কিন্তু ডনের মতো দু-বার (১৯৩০ ও ১৯৩৮) কেউ পারেনি। অন্য ছয় জন হলেন— গ্রেস (১৮৯৫), টম হেওয়ার্ড (১৯০০), ওয়ালি হ্যামণ্ড (১৯২৭), চার্লি হ্যালোজ (১৯২৮), বিল এডরিচ (১৯৩৮) ও গ্লেন টার্নার (১৯৭৩)। এঁদের মধ্যে গ্রেস, হ্যামণ্ড ও হ্যালোজ ছাড়া বাকি সবাই এপ্রিল থেকে ব্যাটিং শুরু করেন। গ্রেস সবথেকে দ্রুত, ২২ দিনে হাজার রান করেন।
ডনের ১৯৩৮-এর স্কোর : ২৫৮, ৫৮, ১৩৭, ২৭৮, ২, ১৪৩ ও ১৪৫ = ১,০২১ রান। ডনের হাজার রান পূর্ণ হয় হ্যামশায়ারের সঙ্গে খেলায়। ১৯৩০-এর মতো এবারও বৃষ্টি সম্ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাকে এই সাফল্য অর্জন করতে হয়েছে। পরের ম্যাচ মিডলসেক্সের সঙ্গে। তাদের বিল এডরিচের এখন পর্যন্ত ৯৮১ রান ১৩ ইনিংস খেলে। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া তারপর মিডলসেক্স ব্যাট করে এবং এডরিচ ৯ রান করে আউট হয়। আর মাত্র দশটি রান যদি দ্বিতীয় ইনিংসে পায় তাহলে সেঅসাধারণ সম্মান অর্জন করবে।
কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংস খেলার সুযোগ মিডলসেক্স পাবে কি! নির্দয় কঠিন চরিত্ররূপে অভিহিত ডন ওকে সুযোগ দেবার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে দিল মাসের শেষ দিনে ৩১ মে। দর্শকরা প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। তারা চেঁচামেচি করে ডনের আদ্যশ্রাদ্ধ শুরু করে দেয়। তারপর যখন বুঝল ডন কেন ইনিংস ঘোষণা করেছে, তখন আবার চিৎকার ডনকে সাধুবাদ জানিয়ে। এডরিচের প্রতিটি স্ট্রোকে তারা উল্লাসে ফেটে পড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত সেঅপরাজিত রইল ২০ রানে। অর্থাৎ ৩১ মে এডরিচের ১,০১০ রান।
এই খেলাতেই ডনের পিঠে আবার যন্ত্রণা শুরু হয়। ডাক্তারের উপদেশে প্রথম টেস্ট ম্যাচ পর্যন্ত সেবিশ্রাম নেয়। অবশ্য তখন সেজানত না এই যন্ত্রণাটাই তার খেলোয়াড় জীবনকে সংক্ষেপিত করবে। তবে প্রথম টেস্ট পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়াটা ভালোই হয়েছিল, কেননা তার সহনশক্তি ও মনোনিবেশ ক্ষমতা আবার যাচাই হয় এই টেস্ট ম্যাচে।
নটিংহামে নিখুঁত ব্যাটিং উইকেটে হ্যামণ্ড টসে জেতে। মাত্র এক রানের জন্য চার্লি বার্নেট রেকর্ড বইয়ে তিন অস্ট্রেলীয়— ট্রাম্পার, ম্যাকার্টনি ও ব্র্যাডম্যানের পাশে নিজেকে রাখতে পারেনি। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনে লাঞ্চের আগে বার্নেট ৯৯ রানে অপরাজিত থাকে। অস্ট্রেলীয়রা তাকে কিছুতেই শতরান পূর্ণের জন্য একটি রান করতে দেয়নি।লাঞ্চের পর অবশ্য বার্নেট ১২৬ রান করে আউট হয়। হাটন ও কম্পটনের এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলা। এরা দুজনেই শতরান করে যথাক্রমে ১০০ ও ১০২ এবং তারপরও এডি পেন্টার ২১৬ রানে অপরাজিত থাকে। ইংল্যাণ্ড ইনিংস হ্যামণ্ড ৮ উইকেটে ৬৫৮ রানে ঘোষণা করে দেয়।
অস্ট্রেলিয়া জবাব দিল ৪১১ রান করে। ২৪৭ রানে পিছিয়ে অর্থাৎ ফলো অন এড়ানো গেল না। ডন করেছিল ৫১ কিন্তু স্ট্যানলি ম্যাককেবের ২৩২, ডনের মতে স্তম্ভিতকারী ইনিংস, এমন অসাধারণ ব্যাটিং আর কখনো দেখা যায়নি। অস্ট্রেলিয়া ছয় জনকে হারিয়ে ১৯৪, ম্যাককেবকে খেলতে হয়েছিল উইকেট-কিপার বেন বার্নেট ও তিন বোলার ওরিলি, ম্যাককরমিক ও ফ্লিটউড স্মিথকে জুড়ি নিয়ে। যতক্ষণ সেউইকেটে ছিল অস্ট্রেলিয়ার ওঠে ৩০০ রান, তার মধ্যে ২৩০ মিনিটে তার নিজেরই ২৩২। তাতে ৩৪টি চার ও ১টি ছয় অর্থাৎ ১৪২ রান এসেছিল ৩৫টি স্ট্রোক থেকে। খেলা দেখতে দেখতে ডন আর পারছিল না মাঠের দিকে তাকাতে। অকল্পনীয় অসম্ভব ব্যাটিংয়ের মহিমায় তার দু-চোখ জলে ভরে গেছল। নেভিল কার্ডাস তাঁর অনুপম গদ্যে ডনের মতো একই কথা বলেছেন :