অনেকে বলেন ব্র্যাডম্যান কেতাব-ছাড়া। এ কথাটাও ঠিক নয়। তার ব্যাটিং জমাট বনিয়াদের ওপর গড়া। দুই পায়ের মাঝে সেব্যাট রাখত, স্টান্সটা অস্বাভাবিক; এবং বঁা-হাত বেশ খানিকটা তফাতে থাকত হ্যাণ্ডেলের ডান দিকে, এটা কেতাব-ছাড়া। ওর মারাত্মক পুল দ্রুত জমিমুখীন করায় এইভাবে ব্যাট ধরাটা দ্বিগুণ কার্যকরী হয়। কেতাব-বহির্ভূত কিছু যদি থেকে থাকে, তা ওর দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যরা যে গুডলেংথ বলকে বিপজ্জনক সন্দেহ করবে, ব্র্যাডম্যান সেটিকে ঘৃণাভরে শাস্তি দেবে। ওর কাছে গুডলেংথ নামক কোনো ব্যাপারই ছিল না। অকল্পনীয় আত্মবিশ্বাস, অসাধারণ বিচারবোধ, অসম্ভব রানের ক্ষুধা, অনতিক্রমণীয় মানসিক স্থৈর্য ও আত্মশৃঙ্খলা। যদি আভাস দেওয়া হত, (এবং এইসব আভাস কখনোই তার কান এড়াত না) অমুক বোলার তাকে বুঝে ফেলেছে, তাহলে সেই বোলারের ধ্বংসই আমন্ত্রণ করা হত।
কেউ কেউ বলেন, এখনকার আঁটো বঁাধুনির অধিনায়কত্বের বিরুদ্ধে ব্র্যাডম্যান টিকতে পারত না। চক্রাকারে সাজানো আধুনিক ফিল্ড, যার উদ্দেশ্য অক্ষম করে দেওয়া এবং অধুনা যা বহুল প্রচলিত, ব্র্যাডম্যানকে নাকি তা সীমিত করে দিত। আসলে ব্র্যাডম্যান মুচকি হেসে এই চ্যালেঞ্জ নিত। এই চক্রাকার ফিল্ড সেদেখেছে, কঠোর অধিনায়কদের বিরুদ্ধেও খেলেছে। ফিল্ড কীভাবে সাজানো হবে সেটা ব্র্যাডম্যানই ঠিক করে দিত, এটা ছিল তার কাছে মর্যাদার প্রশ্ন। বিপক্ষ অধিনায়করা বস্তুত তার ব্যাটিংয়ের সময় হাস্যকর হয়ে পড়ত। ব্র্যাডম্যানের বাউণ্ডারি-প্রবাহ রোধ করতে অধিনায়ক হয়তো এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ফিল্ডসম্যান সরালেন। অবধারিত সেই সরানো জায়গা দিয়ে ব্র্যাডম্যান পরের বলটি পাঠাবেই এবং একগাল হাসবে। জনতার এটা ভালো লাগত। বলের কাছে পৌঁছোতে তার ফুটওয়ার্ক ছিল বিদ্যুৎগতির, তাকে আটকে রাখা ছিল দুঃসাধ্য। পলকের মধ্যে চক্রাকার ফিল্ডের চাকার স্পোকগুলোকে সেবেঁকিয়ে দিত। বডিলাইন তাকে কিছুটা দমিয়েছিল বটে (তবু গড় ৫০-এর উপর), কিন্তু সেটা মূলত ছিল দৈহিক আক্রমণ এবং অপরোক্ষে ব্র্যাডম্যানের বিরাটত্বের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। তার সেরা বছর ১৯৩০-এইংল্যাণ্ডে এক সিরিজে ৯৭৪ রান। ৪০ বছর বয়সে ১৯৪৮-এ যখন শেষ বার ইংল্যাণ্ডে খেলতে আসে তখন খুনি মেজাজটা অনেক কোমল, তবু ১১টি শতরান করেছে। ১৯৫৬-এ ওভালে অস্ট্রেলীয় এক ইনিংসে দশ জনকেই জিম লেকার আউট করে সারের পক্ষে বল করে এবং ওল্ড ট্র্যাফোর্ড টেস্টে ১৯জনকে। ১৯৪৮-এ ব্র্যাডম্যান প্রায় ১,০০০ রান তোলে সেই ম্যাচগুলিতে, যাতে লেকার খেলেছে। এক বারও সেব্র্যাডম্যানের উইকেট পায়নি। তার ফুটওয়ার্ক ৪০ বছর বয়সেও স্পিনারদের খুন করেছে।
ব্র্যাডম্যানকে সর্বকালের সর্বোত্তম ব্যাটসম্যান বলতে অনেকেরই আপত্তি। কারণ একটিই : ‘স্টিকি’ উইকেটকে সেচাকর বানাতে পারেনি। এই একটি ব্যাপার ধন্দ হয়ে রয়ে গেছে ব্র্যাডম্যানের খেলার মধ্যে। দেখা গেছে তার বিজয়রথের চাকা মাঝে মাঝেই বসে গেছে সেইসব বৃষ্টিভেজা পিচে, যা মালিদের তদবিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে অসুবিধাজনক লেংথ থেকে ফাস্ট বলকে ফণা তুলতে বা স্পিনিং বলকে আরও মোচড় দিয়ে লাফিয়ে উঠতে প্ররোচিত করে। এই কারণেই ব্র্যাডম্যানকে বড়ো ব্যাটসম্যান বলার সময় হারবার্ট সাটক্লিফ সবসময় সযত্নে যোগ করতেন, ‘ভালো উইকেটে’।
টেস্টে এক দিনে ৩০০ রান করা ছাড়াও ব্র্যাডম্যান ছয় বার দ্বিশতাধিক রান করেছে এক দিনে। অথচ বৃষ্টিভেজা পিচে ইংরেজ বোলাররা ২০০-র কম রানে অস্ট্রেলীয় দলের ইনিংস যেসব খেলায় শেষ করে দেয়, তার ১৫টিতে ব্র্যাডম্যান খেলেছে। এই ১৫ ইনিংসে মাত্র চার বার সে১৫ রান অতিক্রম করে। যে লোক ১৯২৭ থেকে ১৯৪৮, ক্রমান্বয়ে একটির পর একটি বিস্ময় তৈরি করে গেছে, যে লোক অলৌকিক ফুটওয়ার্ক ও দৃষ্টিশক্তি নিয়ে জন্মেছে, স্পিন বোলিং জয় করতে সেকেন কবচকুন্ডলহারা কর্ণের মতো অসহায় হয়ে পড়ে বৃষ্টিভেজা পিচে! এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, বৃষ্টিভেজা পিচ ক্রিকেটের যাবতীয় স্বাভাবিক ব্যাপারেরই একটি অংশ এবং বিরাট ব্যাটসম্যান অবশ্যই জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি থাকবে যখন স্টিকি পিচের চ্যালেঞ্জ আসবে।
সি বি ফ্রাই এ সম্পর্কে লিখছেন :
মনে হয় যেন, নিখুঁত ফাস্ট উইকেটে বিরাটভাবে রান তোলার জন্য তার ক্ষমতা সম্পর্কে এবং সেই কাজের উপযোগী করে গড়ে তোলা নিজস্ব স্টাইলে সে(ব্র্যাডম্যান) এতই নিশ্চিত—যে স্টাইল খারাপ উইকেটে সফল হতে পারে না—তাই অস্বাচ্ছন্দ্যকর পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য স্টাইলের অদলবদল করাটা সেঘৃণিত কাজ মনে করত। টেকনিক বদল করলে খারাপ উইকেটে সেও যে কত ভালো খেলোয়াড় হত, তা আমি জানি। বিপজ্জনক উইকেটের জন্য দরকারি এমন কিছুই নেই যা কিনা ও নিজের খেলার অঙ্গীভূত করতে না পারত। সোজা বলের বিরুদ্ধে যেমনটি, ব্রেক করা বলের বিরুদ্ধেও নিখুঁতভাবে সেই ডিফেন্সই সেগড়ে তুলতে পারত…
এ সম্পর্কে ব্র্যাডম্যান কী বলে? তার ধারণা, স্টিকি উইকেট তো ব্যাটিংয়ের বিজ্ঞানকে পরিহাসের বস্তু করে তোলে। তাহলে তো ছেঁড়া টেবিলে নামি খেলোয়াড়রা বিলিয়ার্ডস খেলবে আশা করতে হয়। তার বক্তব্য, সেজানে বৃষ্টিভেজা নরম পিচে কদাচিৎই ব্যাট করতে হবে। সুতরাং শক্ত পিচে খেলার জন্য যে-টেকনিকটি সেরা, তাই সেপ্রয়োগ করে এবং তাতেই সেঅভ্যস্ত। এর মধ্যে স্টিকি উইকেটের টেকনিককে নাক গলাতে দিতে রাজি নয়। এবং এই টেকনিক অনায়ত্ত রেখেই সেটেস্ট ক্রিকেটে হ্যামণ্ডের থেকে সাতটি ও হাটনের থেকে দশটি বেশি শতরান করেছে এবং ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে তার ৩৭টি ম্যাচে ১৭টি অস্ট্রেলীয় জয়ের মধ্যে ১৩টিতে দিয়েছে শতরান এবং ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে হেরে যাওয়া তার ১১টি ম্যাচে দিয়েছে দুটি শতরান।