ক্রিকেট খেলা এবং ক্রিকেট সমস্যার সমাধান, অধিনায়কের কাজের একটা অংশ মাত্র। মাঠের বাইরে আছে ডিনার, সংবর্ধনা, করমর্দন এবং বক্তৃতা। ডনের পক্ষে কঠিন বোধ হয়েছিল বক্তৃতা করা ব্যাপারটা। সেযে গ্রামের সাধারণ ঘরের ছেলে, গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করেছে যৎসামান্য, এটা সবসময়ই তার মনে থাকত। তাকে অধিনায়ক মনোনীত করা হয়েছে তার ক্রিকেটদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার জন্য, ডিনার সভায় সরল বক্তৃতা বা লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য নয়। ডনের কাছে এসব ব্যাপার অস্বস্তিকর বোধ হত, মাঝে মাঝে সেফেটে পড়ত।
অথচ এসব ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া হত, ডন ডিনার সভার বক্তৃতায় সমানে পাল্লা দেবে অন্যান্য সহ-বক্তাদের সঙ্গে। অন্যান্যরা বলতে পেশাদার বক্তা— সাধারণত কোনো ক্রিকেটরসিক বিচারপতি, কুইনস কাউন্সিলের কেউ, মন্ত্রীসভার বা পার্লামেন্টের কোনো সদস্য, এরাই। এমন পরিস্থিতি প্রায়ই দেখা দিত, বিশেষত ইংল্যাণ্ড সফরকালে। সেখানে খেলার জন্য ডনকে যতটা সময় খরচ করতে হত, খেলার কাজ বাদে অন্যান্য ব্যাপারেও ততটা বা তার থেকে বেশিই সময় তাকে দিতে হত। এসব ব্যাপার শুরু হয়ে যেত ইংল্যাণ্ড পৌঁছানো মাত্র জাহাজঘাটায় খবরের কাগজের এবং নিউজরিল ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো থেকে।
তারপর অস্ট্রেলিয়া হাউসে সংবর্ধনা। সেখানে হাইকমিশনারের সঙ্গে ডনকে নানাবিধ আলাপ করতে হবেই এবং অন্তত শ-দুয়েক অভ্যাগতের সঙ্গে করমর্দন, কখনো ডনের মনে হত এইসব হস্তচূর্ণকারী সংবর্ধনার পর আর বোধ হয় কখনো সেব্যাট ধরতে পারবে না।
তারপর আরও ফোটোগ্রাফার ও রিপোর্টারদের সঙ্গে মোলাকাত। কসরত করে মুখের হাসি জিইয়ে রাখা, ভদ্র ও বিনীত থাকা, বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিপূর্ণ বা উদ্ধত কি নির্বোধ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাওয়া।
তারপর নাগাড়ে লাঞ্চ আর ডিনার। লাঞ্চ ব্রিটিশ স্পোর্টসমেনস ক্লাবে; ডিনার হাউস অফ কমন্সে (প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ); লাঞ্চ ক্রিকেট রাইটার্স ক্লাবে (এবং যেন মনে থাকে, যে-লোকটি কাগজে চুটিয়ে আক্রমণ করেছিল তার সঙ্গে দারুণ হেসে কথা বলতে হবে); ডিনার স্টক এক্সচেঞ্জে (শেয়ার বাজারের লোকদের ব্যাপার তাই ডনের ভালোই লাগত)। লাঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ জার্নালিস্টদের সঙ্গে (আরও সাংবাদিক); ডিনার ম্যানসন হাউসে লর্ড মেয়র অফ লণ্ডনের আমন্ত্রণে; লাঞ্চ রয়াল এম্পায়ার সোসাইটিতে…
কাউন্টি ম্যাচ খেলার জন্য সফরকালে এই একই ছকে ব্যাপারগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটত এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রে সবাই ধরে নিত ডন ঝকমকে দুর্দান্ত বক্তৃতা করবে। বহু সময় তাকে প্রিন্স ফিলিপ বা লর্ড অ্যাটলি বা লর্ড বার্কেটের আগে বা পরে বক্তৃতা করতে হয়েছে। কিন্তু আগে যতটা তার বুক টিপটিপ করত পরবর্তীকালে ডনকে আর উদবিগ্ন হতে হয়নি কেননা বক্তৃতা সেচমৎকারভাবেই করতে পারত। বক্তৃতাশেষে তার উদ্দেশ্যে যে প্রবল অভিনন্দন ধ্বনিত হত, ডনের প্রায়ই সন্দেহ হত এটা বোধ হয় নিছকই সৌজন্যমূলক। আসলে কিন্তু তা খাঁটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই।
বক্তৃতার মধ্যে গল্প ঢুকিয়ে বা নিজের সম্পর্কে ছোটোখাটো তথ্য সরবরাহ করে ডন আসরকে হাসাতে পারত। ১৯৩৮-এ এমসিসি সভাপতি এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বল্ডুইন ভোজসভায় জানান, শৈশবে তাঁর স্বপ্ন ছিল কামার হওয়ার। ডন বলল, ‘আমার স্বপ্ন ছিল বাড়ি রং করার মিস্ত্রি হওয়ার, আমরা দুজনেই তাতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে মনে হয় না নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে এখন কেউ আবার রাজি হব।’
সান্ধ্য সম্মিলনে যোগ না দেওয়ার বা তাড়াতাড়ি সম্মিলন থেকে চলে যাওয়ার জন্য লোকেরা যখন ডনের অসামাজিকতা বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তখন সেহোটেলে নিজের ঘরে একা বসে পরবর্তী বক্তৃতা কী বিষয়ে বলবে, আগের বক্তৃতা বা সাক্ষাৎকারে বলা হয়নি এমন কিছু জিনিস আর আছে কি না ইত্যাদি নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। ভেবেচিন্তে কিছু-একটা ঠিক করার পর আছে চিঠির উত্তর দেওয়া। রাত দুটোতিনটে বেজে যেত উত্তর লিখতে। ছোটো ছেলেমেয়েদের চিঠিগুলোতার জন্য আলাদা করে রাখা হত। ডন ব্যক্তিগতভাবে সেগুলির উত্তর দিত। ইংল্যাণ্ড সফরে ডন দিনে গড়ে একশোটি ব্যক্তিগত চিঠি পেত। চিঠিগুলিতে তার স্বাক্ষর চাওয়া থেকে শুরু করে এই রকমের অদ্ভুত অনুরোধও থাকত : ‘২৫ বছর আগে আমার ভাই অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। তার কোনো খবর আমায় দিতে পারেন কি? তার নাম ডন স্মিথ, বেশ লম্বা, গোঁফও আছে। আপনি নিশ্চয়ই তাকে চেনেন।’ ডন একবার একটি চিঠি পায় যার খামে ঠিকানার বদলে আঁটা ছিল তার মাথা থেকে নাক পর্যন্ত মুখের ছবি ও লেখা ছিল, ‘ইংল্যাণ্ডে কোথাও খেলছেন?’ চিঠিটি লর্ডসে ডনের হাতে পৌঁছেছিল।
ডনের সই সবাই চায়। ডন কিন্তু একটি সই সযত্নে রেখে দিয়েছে— ডব্লি জি গ্রেসের এক ভক্ত এটি তাকে উপহার দিয়েছে। গ্রেসের নামে একটি চেক, পিছনে গ্রেসের স্বাক্ষর। চেকটি ১৯০৭ সালের অর্থাৎ ডনের জন্মের আগের বছরের।
তবে ডন সবথেকে খুশি হত বিদেশি ছেলেদের চিঠি পেয়ে। ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সিংহল, এমনকী আমেরিকা, হল্যাণ্ড, ডেনমার্ক থেকেও ছেলেরা তাকে লিখত।
সন্ধ্যাটা এইভাবে কাটিয়ে ক্লান্ত ডন বিছানায় প্রায় লুটিয়েই পড়ত। ঘুমোবার আগে তার শুধু মনে পড়ত, আবার কাল সকালে রিপোর্টাররা ছেঁকে ধরবে, ফোটোগ্রাফাররা ঘেরাও করবে, আরও চিঠির উত্তর দিতে হবে, আরও বক্তৃতা; আর নিতে হবে দল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত, আর খেলতে হবে ক্রিকেট—আরও ক্রিকেট।
১৪. ইংল্যাণ্ডে তৃতীয় বার
ডন যখন অস্ট্রেলীয় দল নিয়ে ১৯৩৮-এ ইংল্যাণ্ডে এল তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালোছায়া ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে। জাহাজে আসার সময় নেপলস বন্দরে তারা গুনল ৩৬টি ডেস্ট্রয়ার, ৮টি ক্রুজার ও ৭২টি সাবমেরিন। ডকের ধারে কুচকাওয়াজে ব্যস্ত নাবিকরা। লণ্ডনে পার্কে ও খেলার মাঠে বিমান আক্রমণ আশ্রয়স্থল তৈরি হচ্ছে, ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে।