তার অধিনায়কত্ব সম্পর্কে সমালোচনা যে একেবারেই হয়নি, তা নয়। প্রায়শই তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি শোনা যেত সেটি হল— বড়ো বেশি শক্তভাবে সেক্রিকেট খেলে, প্রতিপক্ষকে একটুও ছাড় দেয় না, নির্দয় কৌশল অবলম্বন করে।
ডন স্বীকার করে নির্দয়ভাবেই সেখেলে এবং খেলে শুধুমাত্র জয়ের জন্য। খেলা যদি জয়ের জন্য না হয় তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলে আর কিছু থাকে না। যে-পন্থায় সেখেলে সেটা যদি কারুর পছন্দ না হয় তাহলে প্রতিকারের একমাত্র উপায় আইন বদল করা। কেননা সেসবসময় আইন অনুযায়ীই খেলে।
ক্রিকেট আইন ডন ভালোই জানে। ১৯৩৩-এ সেআম্পায়ারিং পরীক্ষা পাস করে। এটা সেকরে এইজন্য যে, তার ধারণা প্রত্যেক খেলোয়াড়েরই উচিত নিজের খেলার সবরকম বিষয় সম্পর্কে যতটা সম্ভব শিখে রাখা। এই একই যুক্তিতে সেক্রিকেটের ইতিহাস পড়েছে এবং ক্রিকেটের শুরুর আমলের বহু গল্প ও ঘটনায় নিজের পুঁজিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ক্রিকেটে অজস্র মজার ঠাট্টা আছে। তার একটি হল, অধিনায়কের প্রথম কর্তব্য টসে জেতা। ডন এই কর্তব্যটি কিন্তু খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি। যত-না সেটসে জিতেছে হেরেছে তার বেশি। ১৯৩৮ সিরিজে তো সব ক-টি টেস্টেই টসে হারে। তবে যে-টেস্টে সেটস জিতেছে সেই টেস্ট হারেনি। এই ব্যাপার যেন ইঙ্গিতে জানায়, তার সিদ্ধান্তগুলি গভীর বিচারবোধপ্রসূত। আর ক্রিকেটে কত যে সিদ্ধান্ত অধিনায়ককে নিতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। অধিনায়কের পরিপ্রেক্ষিত থেকে যে-অসুবিধাটিসবথেকে বড়ো সেটি হল—তার সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়ে যাওয়ার পর এবং প্রযুক্ত হওয়ার পর খেলায় সেগুলি সাফল্যের বা অসাফল্যের আলোকে সংবাদপত্র ও জনসাধারণ সেগুলির বিচার ও সমালোচনা করে। সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যা ঘটবে সেগুলি জানার আগেই অধিনায়ককে কিন্তু তার সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলতে হয়।
ডনকে আর একটি জিনিস আবিষ্কার করতে হয়েছে—একই সঙ্গে দর্শকদের তুষ্টিসাধন ও ম্যাচ জেতা। দর্শকরা চায় ঘটনা, ব্যাটসম্যান বল পেটাচ্ছে এবং আউট হয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রয়োজনে বহুক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানকে শিকড় গাড়তে হয়। তখনই শুরু হয় অসন্তুষ্টির বিক্ষোভধ্বনি। ডন কিন্তু বরাবরই চেয়েছে দর্শকদের খুশি করতে। সেমনে করে লোকে খেলা দেখার জন্য যখন পয়সা খরচ করে মাঠে আসছে তখন অর্থদাতা এই পৃষ্ঠপোষকদের উত্তেজক কিছু-একটা অবশ্যই প্রাপ্য যাতে তাদের পয়সা উশুল হয়—এবং তার বেশিরভাগ ইনিংস থেকেই তারা তা পেয়েছে। মন্থর গতিতে সেজীবনে খেলেনি, যদি-না খেলতে বাধ্য হয়েছে। আবার খেলায় যে-পন্থা প্রয়োগের জন্য মস্তিষ্কের নির্দেশ পেত তা অমান্য করে দর্শকের মনোরঞ্জনে কখনোই মেতে ওঠেনি। তার কাছে প্রথম কথা—ম্যাচ জিততে হবে।
ঠিক কোন সময়ে বোলার বদল করতে হবে, দর্শকরা যাকে চায় সেই সেরা বোলারটিকে দিয়ে বল করিয়েই যাবে কি না অথবা পরে কোনো সময়ে ব্যবহার করানোর জন্য এখন তাকে বোলিং থেকে সরিয়ে রাখবে কি না এইসব সিদ্ধান্ত সবসময় নেওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। উইকেট পেলেও দীর্ঘসময় তাকে দিয়ে বল করালে হয়তো সফরের বাকিটুকুর জন্য সেঅকেজো হয়ে পড়তে পারে। মোটকথা অধিনায়ক যে-সিদ্ধান্তই নিক দেখা যাবে তার থেকেও বেশি বিজ্ঞ স্ট্যাণ্ডের দর্শকরা এবং খবরের কাগজের কিছু পন্ডিত সমালোচক।
অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংক্রম সাজাবার ব্যাপারে ডনকে মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ব্যাটিংক্রম বদল করার জন্য মাঝে মাঝে তাকে এই বলে সমালোচনা করা হয় যে, যাতে ভিজে উইকেটে তাকে ব্যাট করতে না হয় তাই সেব্যাটিংক্রম বদলাত। কথাটা মিথ্যা নয়। উইকেট শুকিয়ে উঠে রান তোলার অবস্থায় না আসা পর্যন্ত ডন নিজেকে সরিয়ে রাখত। ডন জানত এজন্য তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু নিজের ব্যাটিং গড় বৃদ্ধি করতে কি নিজেকে জাহির করতে সেতা করেনি।
দলের দরকার রান। নি:সন্দেহে ডন দলের সেরা ব্যাটসম্যান। এবং রান পাওয়ার সম্ভাবনা তারই বেশি। সুতরাং নিজেকে সেসর্বোত্তম সুযোগ অবশ্যই দেবে। এই যুক্তিগুলি সেছেঁকে বার করে নেয় ঠাণ্ডা মাথায়, আবেগের বশবর্তী না হয়ে এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা সরিয়ে রেখে। তার কাছে সব কিছুর আগে অস্ট্রেলিয়া। যে-সিদ্ধান্ত তার কাছে সঠিক মনে হবে, তাতে পৌঁছে গেলেই ডন তা আর কোনোক্রমেই বদলায় না। সেটা নিজের কোলে ঝোল টানার মতো দেখায় যদি দেখাক, তবু সেঅটল থাকবে।
ফিল্ডারদের মাঠে সঠিক জায়গায় রাখার জন্য অনেক সময় ব্যয় করত। যেখানে সেচায় ঠিক সেই জায়গাটিতে, এক ইঞ্চি এধার-ওধার নয়। তাদের দাঁড় করাতে খুঁতখুঁতানির অন্ত ছিল না। তার একটিই কথা, ‘দশ ফুটের জন্য বল ফসকানো যতটা খারাপ, তিন ইঞ্চির জন্য ফসকানো ততটাই খারাপ।’ বোলারদের সঙ্গে সেএত বার শলাপরামর্শ করত যে একে ‘ব্র্যাডম্যানের লিগ অফ নেশনস বৈঠক’ বলা হত। কিন্তু তা থেকে সেফল পেত।
মাঠের বাইরে ও ভিতরে, নির্বাচক ও অধিনায়করূপে ডন সৃজন-গঠন ও প্রশিক্ষণ দ্বারা যা করেছে তারই চূড়ান্ত রূপ ১৯৪৮-এর অস্ট্রেলীয় দল। সর্বকালের অন্যতম সেরা দল।