আর তিনটি টেস্ট ম্যাচ বাকি। ডন কোণঠাসা। অস্ট্রেলিয়া ০-২ পিছিয়ে।
ডন ব্র্যাডম্যান রুখে দাঁড়াল।
অস্ট্রেলিয়া মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ জিতল ৩৬৫ রানে। ডন দিয়েছিল ২৭০ রানের একটি ইনিংস।
সবাই জানে ডন বিরাট ব্যাটসম্যান। তারা এবার জানল, ডন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন অধিনায়কও। ডন টসে জেতে। অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিনে ৬ উইকেটে ১৮১ রান করল। নামল বৃষ্টি। দ্বিতীয় দিনে লাঞ্চের পর ৯ উইকেটে ২০০ রান উঠতেই ডন প্রথম ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেয় (তার রান ১৩)। উইকেটের অবস্থা খুবই খারাপ। এই উইকেটে ইংল্যাণ্ডকে উড়িয়ে দেওয়া যায় কিন্তু তাতেই আবার অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে হবে দ্বিতীয় ইনিংসে। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধাজনক হবে না। ডন তার বোলারদের বলল, ‘উইকেট চাই না। ওরা ব্যাট করে যাক। শুধু রান ওঠা বন্ধ রাখো। এখুনি এই উইকেটে আমরা ব্যাট করতে চাই না।’
একটু দেরিতেই অ্যালেন ডনের মতলবটা বুঝে ফেলে। ৯ উইকেটে ৭৬ রানেই সেইংল্যাণ্ডের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে। আর আধ ঘণ্টা আগে ঘোষণা করলে অস্ট্রেলিয়া যথেষ্ট বিপদে পড়ত। অ্যালেন অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাট করতে নামাল দিনের শেষাশেষি।
উইকেটের অবস্থা তখনও বেশ খারাপ, আকাশে মেঘ, আলোও কম। ডন বরাত ঠুকে একটা কান্ড করল। নিয়মিত দুই ওপেনারকে না পাঠিয়ে দুই বোলার ওরিলি এবং ফ্লিটউড স্মিথকে পাঠাল ব্যাট করতে।
ডন খোলাখুলিই ফ্লিটউড স্মিথকে বলল, ‘এই উইকেটে তুমি একটি মাত্র উপায়েই নিজেকে আউট করতে পারো, যদি বল মারতে যাও। কিন্তু ভালো উইকেটেই তুমি বল মারতে পার না, কাজেই এই উইকেটে তোমার ঘাবড়াবার কিছু নেই, বল মারবার সুযোগই পাবে না।’
ওরিলি প্রথম বলেই আউট। নামল আর এক স্পিনার ওয়ার্ড। বাকি সময়টা সেউইকেট কামড়ে পড়ে রইল। ফ্লিটউড স্মিথ অপরাজিত রইল শূন্য রানে এবং দু-দিন পর সোমবারে তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হতে সেপ্রথম বলে ব্যাট ঠেকিয়েই আউট হয়ে যায়। উইকেট ইতিমধ্যে স্বাভাবিক হয়ে ব্যাটসম্যানের সহায়ক। ডন আউট হয় পঞ্চম দিন সকালে ২৭০ রান করে। তখন সেসামান্য ‘ফ্লু’-য়ে ভুগছে। এই রানের জন্য তার সময় লাগে ৪৫৮ মিনিট। ষষ্ঠ উইকেটে সেআর ফিঙ্গলটন (১৩৬) তোলে ৩৪৬ রান। এটা আজও বিশ্ব টেস্ট রেকর্ড।
জেতার জন্য ইংল্যাণ্ডের দরকার ৬৮৯ রান। লেল্যাণ্ড ১১১ করলেও ইংল্যাণ্ড হেরে যায় ৩৬৫ রানে। প্রথম দুটি টেস্টে পরাজয়ের পর ডন আরও ১৭ বার অধিনায়ক হয়ে আর মাত্র একটি টেস্ট ম্যাচে পরাজিত হয়েছিল, ১৯৩৮ ওভাল টেস্টে। তৃতীয় টেস্ট ম্যাচের পর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড কিছু ‘রটনা’ বিষয়ে ভর্ৎসনা করেছিল চারজনকে ডাকিয়ে এনে। এরা হল— ম্যাককেব, ওরিলি, ফ্লিটউড স্মিথ এবং ও’ব্রায়েন।
চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ অ্যাডিলেডে। যদি অস্ট্রেলিয়া এটি হারে তা হলে ‘রাবার’ হারবে। ডন দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করল ৪৩৭ মিনিট ধরে তার ২১২ রানের জন্য। সেজানে, বড়ো রান তাকে করতেই হবে, নয়তো জেতার আশা নেই। তাই সাবধানে, সময় নিয়ে, খুঁটে খুঁটে রান তুলল। ২১২ রানে চার মাত্র ১৪টি। অসাধারণ সংযত এই ইনিংসে সেএক বারও তার বিখ্যাত হুক স্ট্রোক ব্যবহার করেনি। ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে এটি তার সপ্তম দ্বিশত রান।
ইংল্যাণ্ড ৩৮২ রান তুলে টেস্ট ম্যাচটি জেতার জন্য খেলা শুরু করে ১৪৮ রান তুলল তিন উইকেটে। খেলা তখন ষষ্ঠ দিনে, হ্যামণ্ড দারুণভাবে ব্যাট করে যাচ্ছে। সাত উইকেটে ২৩৪ রান তোলা কিছু অসম্ভব নয় ইংল্যাণ্ডের পক্ষে। ডনের কপালে উদবেগের রেখা ফুটে উঠল। পরাজয় বোধ হয় আর এড়ানো গেল না। হ্যামণ্ড, একমাত্র হ্যামণ্ডই হচ্ছে সবথেকে বড়ো সমস্যা।
ফ্লিটউড স্মিথের হাতে বলটি তুলে দিয়ে ডন তাকে বলল, এই ম্যাচের ভাগ্য তোমার হাতে তুলে দিলাম। তাই শুনে কী যে হয়ে গেল এই ল্যাটা গুগলি বোলারটির! তার ফ্লাইট করা বল, হ্যামণ্ড ফরোয়ার্ড খেলতে পা বাড়াল। বলটি অফ স্টাম্পের বাইরের দিকে ভেসে গিয়ে মাটিতে পড়েই স্পিন করে ঢুকে এল প্যাড ও ব্যাটের ফাঁক দিয়ে। হ্যামণ্ড বোল্ড। শুধু ম্যাচটিরই নয়, সিরিজের ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে গেল ওই একটি বলে। ইংল্যাণ্ড ১৪৮ রানে হেরে গেল। এখন সিরিজের ফল ২-২।
পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ মেলবোর্নে। ডন টসে জিতল এবং প্রথম দিনে অস্ট্রেলিয়ার হল তিন উইকেটে ৩৪২ রান। তৃতীয় উইকেট জুড়িতে ডন ও ম্যাককেব তুলল ২৪৯ রান। পরদিন ডন ১৬৯ রানে বোল্ড ফার্নেসের বলে মোট ২১০ মিনিট ব্যাট করে। এক বারের জন্যও সেজমি থেকে তুলে বল মারেনি। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে উঠল ৬০৪ রান। ইংল্যাণ্ড ২৩৯ রান করে ফলো অনে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত ইনিংস ও ২০০ রানে হেরে যায়। ০-২ পিছিয়ে থেকে অস্ট্রেলিয়া ৩-২ ম্যাচে সিরিজ জেতে এবং অ্যাসেজও।
ডন দুটি শূন্য করলেও মরসুমে একশোর উপর ইনিংস ছয়টি, তার মধ্যে তিনটি দ্বিশতের। সিরিজে ৯ ইনিংসে ৮১০ রান, ৯০ গড় এবং শতাধিক রানের ইনিংস তিনটি। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়করূপে প্রথম সিরিজে ডন সফল হয়েছে।
১৩. ‘সেনাপতি’ ব্র্যাডম্যান
ব্যাটিংয়ে যেমন, অধিনায়কত্বেও ডন ততখানিই বিরাট হয়ে ওঠে। সেনাপতিরা যুদ্ধের জন্য যেভাবে তৈরি হয়, পরিকল্পনা ছকে ডনও ম্যাচের আগে তাই করত। যেভাবে সেনাধ্যক্ষরা তাদের বাহিনী সমাবেশের পরিকল্পনা করে, ডনও সেইভাবে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের স্ট্রোকের ছক ও তালিকা পর্যালোচনা করে তার ফিল্ড সাজাবার ছকটি তৈরি করে নিত। সেনাপতিদের মতোই আলাদা আলাদা যুদ্ধের ফলের থেকে চূড়ান্ত জয়ের দিকেই তার নজর থাকত। নির্দিষ্ট কোনো টেস্ট জয়ের থেকে তার চিন্তা নিবদ্ধ থাকত রাবার জয়ের দিকে। তার চিন্তাপদ্ধতি যে ফলপ্রসূ হয়েছিল সেটা তার অধিনায়কত্বের পাঁচটি টেস্ট সিরিজের ফল থেকেই বোঝা যায়। চারটিতে অস্ট্রেলিয়া জয়ী, একটি অমীমাংসিত। চারটি জয়ের তিনটি ইংল্যাণ্ডের ও একটি ভারতের বিরুদ্ধে, অমীমাংসিত সিরিজটি ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে। ডন কখনো রাবার হারেনি। তার অবসর নেওয়ার পাঁচ বছর পর ইংল্যাণ্ড প্রথম রাবার জেতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে।