ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খেলায় ডন ৩৫৭ রান করল— মেলবোর্ন মাঠে ডনের সর্বোচ্চ রান। শুরু করেছিল ধীরে, দেড়শো মিনিটে প্রথম শতরান; ১১৫ মিনিটে দ্বিতীয় ও ১২১ মিনিটে তৃতীয় শতরান; বাকি ৫৭ রান ৩০ মিনিটে।
ডন যে আবার নিজের খেলা ফিরে পেয়েছে তাতে কারুর আর সন্দেহ রইল না। পরের খেলা নিউ সাউথ ওয়েলসের বিরুদ্ধে সেশূন্য করল।
ডনের অধিনায়কত্বে সাউথ অস্ট্রেলিয়া অপরাজিত থেকে শেফিল্ড শিল্ড জিতল। নয় বছর পরে প্রথম জয়। ভিক রিচার্ডসন, ক্ল্যারি গ্রিমেট প্রমুখ ছয় জন প্রবীণ ও দক্ষ ক্রিকেটার দলে নেই, তবু ডন দমেনি। নতুন ছেলেদের নিয়ে শিল্ড জিতল দলের মধ্যে প্রেরণাসঞ্চার করে।
মরসুমের শেষ খেলায় টাসমানিয়ার বিরুদ্ধে ডন করল ৩৬৯। অ্যাডিলেড মাঠের সর্বোচ্চ রান, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে যেকোনো ব্যাটসম্যানেরও সর্বোচ্চ রান। এই মাঠেই ৩৫ বছর আগে ক্লেম হিলের অপরাজিত ৩৬৫ রানের রেকর্ড ডন ভেঙে দিল। হিল টেলিগ্রাম পাঠালেন : ‘খুদে শয়তান, আমার রেকর্ডটি ভাঙার জন্য অভিনন্দন’। ডনের এই রাজ্য রেকর্ডটি ভাঙার চেষ্টা করেছিল ব্যারি রিচার্ডস ১৯৭০-৭১ মরসুমে পার্থে, করেছিল ৩৫৬। ডন তার ৩৬৯ রান তুলেছিল এইভাবে—
তৃতীয় উইকেটে ডন ও হ্যামেন্স (১২১) যোগ করে ২৫৬ রান। চারটি ৬ ও ছেচল্লিশটি ৪ ছিল ডনের ইনিংসে। নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মরসুমে ডন দুটি ত্রিশত-সহ ১,১৭৩ রান করে ১৩০.৩৩ গড় রেখে।
ইংল্যাণ্ড ১৯৩৬-৩৭ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ায় দল পাঠাবার তোড়জোড় করছে। ব্র্যাডম্যান যে আবার তার নিজের খেলা ফিরে পেয়ে গেছে এটা ওরা জেনেছে। তাদের বোলাররা তছনছ হবে এবং বিরাট রানের স্কোরের পিছনে তাদের ব্যাটসম্যানদের ধাওয়া করার কাজ বরাদ্দ হবে—এ সম্পর্কে ইংল্যাণ্ড নিশ্চিত। তাহলেও ইংল্যাণ্ড অখুশি হয়নি। ডনকে বাদ দিয়ে তখন ক্রিকেটের আর থাকে কী?
১৯৩৬-৩৭ ডনের পক্ষে গর্বের মরসুম। উডফুল অবসর নিয়েছে, রিচার্ডসন দলভুক্ত হয়নি—ডনকে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক করা হল। একজন টেস্ট নির্বাচকের মৃত্যু হওয়ায় সেনির্বাচক পদেও অধিষ্ঠিত হল। এরপর ভূমিষ্ঠ হল ডনের প্রথম সন্তান।
অধিকাংশ খেলোয়াড়ের মতো ডনও চেয়েছিল ছেলে হোক। ছেলেটিকে সেক্রিকেট শেখাবে, মস্ত খেলোয়াড় হবে তারই মতো। ‘গাবি’ অ্যালেনের এমসিসি দল সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার জন্য অ্যাডিলেডে পৌঁছোবার আগের রাত্রে জেসি উপহার দিল ডনকে প্রথম সন্তান—একটি ছেলে। হইচই পড়ে গেল চারিদিকে। অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেল।
কিন্তু ডাক্তার আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন ডনকে। ‘মিস্টার ব্র্যাডম্যান আপনার স্ত্রী ভালো আছেন, কিন্তু ছেলেটি বঁাচবে কি না বলতে পারছি না।’
সেই রাত্রে এমসিসি সদস্যদের নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, ডনও উপস্থিত। আগামীকাল সেসাউথ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব করবে আগন্তুকদের বিরুদ্ধে। এ সভায় তাকে তো হাজির হতেই হবে। পিতা হওয়ার জন্য সেখানেও তাকে অভিনন্দিত করা হল। ডন হাসিমুখে তা শুনল। কিন্তু মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদবেগ। কোনোদিন কখনো সেতার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার ব্যাপারগুলি সাধারণ্যে প্রকাশ করেনি। আজও করল না। সেই সভায় কেউ জানলও না তখন কষ্টে ডনের বুক ফেটে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে ডনের সদ্যোজাত ছেলেটি মারা গেল। অ্যাডিলেড মাঠের পতাকা অর্ধনমিত হল খেলা শুরুর সময়। খেলার মতো অবস্থা ডনের ছিল না, তাই খেলেনি।
হ্যামণ্ড দারুণভাবে সফরে খেলেছে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দুটি, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও দুটি—পর পর চার ইনিংস শতরান। কিন্তু বাকি ইংরেজ ব্যাটসম্যানরা স্পিন বোলিংয়ে সুবিধা করতে পারছে না। তাহলেও ব্রিসবেনে প্রথম টেস্ট ম্যাচ ইংল্যাণ্ড চার দিনেই জিতল ৩২২ রানে। ডন ২৪টি টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে ১৪টিতে টসে হারে। তার প্রথমটি ঘটে প্রথম অধিনায়কত্বেই। এই ম্যাচে প্রথম দিনের প্রথম বলেই ইংল্যাণ্ডের ওয়ার্দিংটন ক্যাচ আউট হয় ওল্ডফিল্ডের হাতে— বোলার ম্যাককরমিক। ডনের রান ৩৮ ও ০। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া আউট হয় ৫৮ রানে।
ফিঙ্গলটন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে পর পর তিনটি টেস্ট ইনিংসে শতরান করে এসে ব্রিসবেনে প্রথম ইনিংসে ১০০ রান তুলে নতুন টেস্ট রেকর্ড করে। এখন রেকর্ড এভার্টন উইকসের—পর পর পাঁচটি টেস্ট ইনিংসে শতরান। চতুর্থ ও পঞ্চমটি হয় কলকাতায় ১৯৪৮-৪৯ এ।
সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে ডন আবার টসে হারল এবং অস্ট্রেলিয়াও—ইনিংস ও ২২ রানে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে রান ৮০। দুই ইনিংসে ডনের ০ রান ও ৮২। বৃষ্টি এই দুটি পরাজয়ের কারণ। আধশুকনো চটচটে পিচে ডনের ব্যাটিং দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। তার ওপর নবীন অধিনায়কের ঘাড়ে জাতীয় দল পরিচালনায় দায়িত্ব, মনের মধ্যে সন্তানবিয়োগের দুঃখের বোঝা।
ডনের দল পরিচালনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হল। দলের সদস্যদের সঙ্গে তার মতবিরোধ ও ঝগড়ার কথা রটল। শোনা গেল কেউ কেউ অসহযোগিতা করছে। ডন অস্বীকার করল সব কিছু। সর্বসম্মতিক্রমে ডন অধিনায়ক পদ পায়নি। উডফুলের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রথম উইকেটের জুড়ি পন্সফোর্ডও অবসর নেয়। নয়তো পন্সফোর্ডই অধিনায়ক হত। বাকি থাকে দুই দাবিদার— ভিক রিচার্ডসন (ইয়ান ও গ্রেগ চ্যাপেলের দাদামশাই) এবং ডন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে রিচার্ডসনের অস্ট্রেলীয় দল দুর্দান্তভাবে ৪-০ ম্যাচে সিরিজ জিতে এসেছে। কিন্তু তা হলেও নির্বাচকরা তাঁকে দল থেকেই বাদ দেয় যেহেতু সেদলভুক্ত হবার মতো ভালো খেলছেন না। ডন সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা— ব্যাট হাতে ডনের ক্ষমতার তুলনা হয় না, কিন্তু ভালো অধিনায়ক হবার মতো যথেষ্ট সামাজিক সেনয়। কিন্তু কিছু-একটা করব বললে ডন যে তাতে সফল হবেই, এটা আর কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনল না।