ডন অবশ্য ফিল্ড করতে নামে। কিন্তু আবার বিপত্তি বঁাধায় ঊরুতে পেশিতন্তু ছিঁড়ে ফেলে। মাঠ থেকে নার্সিং হোম তাকে যেতে হয়। তার ফলে তিন সপ্তাহ তার খেলা বন্ধ থাকে। ওভালে পঞ্চম টেস্টের আগে ডন একটিও প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেনি। এই সময়টায় সেইংল্যাণ্ডপ্রবাসী এক ধনী অস্ট্রেলীয় ডাক্তারের গ্রামের বাড়িতে কাটায়—জনতা, ক্রিকেটার, খবরের কাগজের লোকেদের থেকে দূরে নি:সঙ্গ শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে, পাখি আর কাঠবিড়ালিদের ব্যস্ততার মধ্যে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে উদবিগ্ন টেলিগ্রাম পাঠাল ডনের স্ত্রী জেসি। কাগজে স্বামীর শরীরের খবর পড়ে ব্যস্ত হয়ে লিখেছে—ইংল্যাণ্ডে আসবে কি না। ডন টেলিগ্রামে জানাল, ওসব কিছু না। ব্যস্ত হতে হবে না।
তারপর পঞ্চম টেস্ট ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া জিতল ৫৬২ রানে। ইংল্যাণ্ড ভুল করল ৪৭ বছরের ফ্র্যাঙ্ক উলিকে দলভুক্ত করে। ওরিলির বল খেলার মতো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। উইকেট-কিপার লেসলি এমস খেলার মাঝে কোমরের ব্যথায় আক্রান্ত হয়। উলি তার জায়গা নেয় (বাই রান হয়েছিল ৩৭টি)। বাওয়েসও খেলার মধ্যে অসুখে পড়ে।
পন্সফোর্ড ২৬৬, ব্র্যাডম্যান ২৪৪। দ্বিতীয় উইকেট পার্টনারশিপে ওরা ৪৫১ রান তুলে বিশ্বরেকর্ড করে। ৬২ বছর পর এটি ভাঙে শ্রীলঙ্কার জয়সূর্য ও মহানামা ভারতের বিরুদ্ধে ৫৭৬ রান যোগ করে।
অস্ট্রেলিয়া ‘রাবার’ জিতল। ডন এরপর আরও দুটি শতরান করল। ফোকস্টোনে ইংল্যাণ্ড একাদশের বিরুদ্ধে ১০৫ মিনিটে অপরাজিত ১৪৯। ফ্রিম্যানের ছয় বলের একটি ওভারে তিনটি ৬ ও তিনটি ৪ নিয়ে সে৩০ রান তোলে। তারপর স্কারবরোয় লেভিসন গাওয়ারের বোলারদের (ফার্নেস, বাওয়েস, নিকলস ও ভেরিটি) বিরুদ্ধে ১৩২ রান। ব্রাউন ৩ রান করে আউট হওয়ার পর ডন খেলতে নেমে লাঞ্চের আগেই ফিরে আসে ১৩২ রান নিয়ে। সফরে তার মোট রান ২,০২০। গড় ৮৪.১৬।
দু-সপ্তাহ পরই সারা অস্ট্রেলিয়া স্তব্ধ প্রস্তরবৎ হয়ে শুনল, ডন মারা গেছে।
গুজবটা যদিও গুজবই কিন্তু ডন তখন গুরুতর অসুস্থ। দেশে ফেরার জন্য অস্ট্রেলীয় দল লণ্ডনে তোড়জোড়ে ব্যস্ত। তখন এক বিকেলে ডন পেটে অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করে। ডাক্তার এলেন। পরীক্ষা করে থমথমে হয়ে গেল মুখ! পরদিন সকালেও এলেন এবং ডনকে জানালেন যন্ত্রণার কারণ অ্যাপেন্ডিসাইটিস! এখুনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্যবস্থা মানে অপারেশন। তার আগে আর একজন বড়ো ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনিও একমত, এটা থাণ্ডারস্টর্ম অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এখুনি অপারেশন দরকার। তাই করা হল। তা ছাড়া পাকস্থলীর আবরণ ঝিল্লির প্রদাহেও ডন ভুগছিল।
জীবন-মৃত্যুর আলো-আঁধারিতে ডনকে কিছু সময় কাটাতে হয়েছে। সারা অস্ট্রেলিয়ায় গির্জায় গির্জায় যখন ডনের জন্য প্রার্থনা হচ্ছে তখন তার স্ত্রী অ্যাডিলেড থেকে পার্থ রওনা হয়েছে ইংল্যাণ্ডগামী জাহাজ ধরার জন্য। ১৩ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ৩১ দিন পর জেসি লণ্ডন পৌঁছোয়।
লণ্ডনে ডনের ভক্তরা হাসপাতালে বার বার ফোন করে জানাচ্ছে, দরকার হলে তারা রক্ত দিতে রাজি।
শত শত টেলিগ্রাম আসছে, এমনকী ইংল্যাণ্ডের রাজা-রানিও পাঠিয়েছেন। প্রচুর চিঠি আসছে নানান চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে। ডনের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় শুধু জ্যাক হবস ও ‘প্লাম’ ওয়ার্নারকে। তাঁরা গল্প করেন ক্রিকেটের।
ডন কিন্তু খুব ঘাবড়ায়নি। সেবিকা থার্মোমিটারে তার তাপ নিলে, ডন ঠাট্টা করত, ‘স্কোর কত হল, আজ একশো পেরিয়েছি কি?’ সেবিকার মুখ দেখে সেবুঝতে পারত অনুমানটা সঠিক করতে পেরেছে কি না।
জেসি যেদিন লণ্ডন পৌঁছোয়, তার আগের দিন ডন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। নট আউট রয়ে গেল ডন, কিন্তু এ যাত্রা আউট হতে হতে বেঁচে গেল। চোখ দুটো গোলমাল শুরু করেছে তাই পড়াশুনোর জন্য তাকে চশমা পরতে হল কিছু দিন। দেশে ফেরার আগে ডন ও জেসি লম্বা ছুটি কাটাল স্কটল্যাণ্ড ও দক্ষিণ ফ্রান্সে। ওরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় ফিরল তখন সেখানে ক্রিকেট মরসুম। কিন্তু ডাক্তারের হুকুমে তার ক্রিকেট খেলা একদমই বারণ। দেশের বাড়ি বাওরালে গিয়ে সেক্রিকেট মরসুমটা কাটাল প্রাকৃতিক পরিবেশে।
তিন মাস সেকোনোরকম খেলায় নামেনি শুধুমাত্র একটু-আধটু গলফ খেলা ছাড়া। গলফকে হালকা পরিশ্রমের খেলা হিসাবেই ধরা হয়। কিন্তু ডনের এমনই স্বভাব যখন যা ধরবে, গভীর মনোনিবেশে তা করবেই। একটা ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ফেলল!
১৯৩৫-এ ডন সিডনি থেকে অ্যাডিলেডে এসে শেয়ার দালালির নতুন কাজে যোগ দিল আর আবার শুরু করল ক্রিকেট খেলা, তার নতুন রাজ্য সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে।
১২. অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক
ডাক্তারের নিষেধে ১৯৩৫-৩৬-এ ডন অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেল না। সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্য দলের অধিনায়কত্ব সেগ্রহণ করল (শেফিল্ড শিল্ডে তার প্রথম অধিনায়কত্ব) এবং আবার সগৌরবে ফিরে আসার কাজে মন দিল।
প্রথমে তার প্রাক্তন রাজ্য দল নিউ সাউথ ওয়েলসের বিরুদ্ধে করল ১১৭। অসুস্থতার পর প্রথম খেলা। প্রচন্ড লড়াই করতে হল তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে। পেশিগুলো কিছুতেই সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে চাইছিল না। তার ওপর বেশিরভাগই এক রান নিতে হচ্ছিল। কিন্তু পরের খেলায় কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে তার শরীর আবার হারানো ছন্দ ও সামঞ্জস্য ফিরে পায়, সহজেই সে২৩৩ রান করে।