প্রথম মিনিট পাঁচেক ডনের অনিশ্চিতভাবে কাটল। বরাবরই দেখা গেছে এইরকমই তার হয়। ফাস্ট বোলার জিম স্মিথের একটা আউট সুইঙ্গারের বাতাসও ডনের স্টাম্পে ছোঁয়া দিল। অস্ট্রেলীয়রা তো তাই দেখে শিউরে উঠল। এরপরই ডন নিজমূর্তি ধারণ করে। প্রতিটি স্ট্রোকে আশ্চর্য নিখুঁত সময় বিচার, প্রতিটি স্ট্রোকে ওস্তাদের স্পর্শ। জিম স্মিথের ফাস্টবল, ওয়াল্ডার রবিন্সের স্লো বল, ইয়ান পিবলসের গুগলি, প্রহারে প্রহারে জর্জরিত হল। ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে ড্রাইভ, পিছিয়ে গিয়ে পুল। যেখানে খুশি সেবল পাঠাল। লোকে যা দেখতে মাঠে আসে তাই দেখা গেল : ব্র্যাডম্যান তার স্বমহিমায়।
দিনের শেষ বলটিতে এক রান নিয়ে ডন ঠিক ১০০ রানে পৌঁছোয়, সময় লাগে ৭৫ মিনিট। তার কয়েকটি শতরানের থেকে সময়টা একটু বেশিই লাগল। এতে আছে ১৯টি চার। পরদিন সে১৬০ রানে আউট হয়। এজন্য মোট সময় লাগে ১২০ মিনিট। লর্ডসে প্যাভিলিয়নের সামনে জ্যাক হিউম ঝাঁপিয়ে পড়ে অসাধারণ ক্যাচ নিয়ে তাকে আউট করে।
বেচারা ডন। এই খেলার পর আবার শ্রান্তি তাকে চেপে ধরল। নটিংহামে প্রথম টেস্টে সেকরল ২৯ ও ২৫। এই টেস্টে এক জনও শতরান করেনি। অস্ট্রেলিয়ার চিপারফিল্ড জীবনের প্রথম টেস্ট খেলায় ৯৯ রানে আউট হয়। ইংল্যাণ্ড দলে নবাগত ফাস্ট বোলার স্কুলশিক্ষক কেনেথ ফার্নেস দুই ইনিংসে পাঁচটি করে উইকেট পায়। খেলা শেষের ১০ মিনিট আগে ওরিলির বলে মিচেল এলবিডব্লু আউট হওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ২৩৮ রানে জেতে।
ইংল্যাণ্ডে তখন খেলার মাঠ দড়ি দিয়ে ঘেরা থাকত। খেলার শেষদিকে দর্শকরা উত্তেজনাবশে এগিয়ে আসায় দড়ি ঝুলে পড়েছিল, দেখাও যাচ্ছিল না। খেলা শেষ হতেই খেলোয়াড়রা ছুটে ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছিল, তখন পায়ে দড়ি আটকে ডন পড়ে যায়, তার ওপর আর একজন এসে পড়ে এবং ঊরুতে আঘাত পায়। পরের ম্যাচে সেরানার নিয়ে ব্যাট করে এবং তার পরের ম্যাচে খেলতে পারেনি।
লর্ডসে দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া হারল ইনিংস ও ৩৮ রানে। ডনের রান ৩৬ ও ১৩। ইংল্যাণ্ড ৪৪০ রান করার পরই বৃষ্টি এবং ভিজে পিচে হেডলি ভেরিটির মারাত্মক স্পিন অস্ট্রেলিয়াকে অসহায় করে দেয়। ম্যাচে ভেরিটি ১৫টি উইকেট পায়, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮-৪৩। প্রথম ইনিংসে খেলতে নেমেই ফার্নেসের বলে ডন পর পর তিন বলে তিনটি ৪ ও একটি ২ নেয় প্রথম ওভারেই। গিয়ারির বলে ৪। গিয়ারির বদলে ভেরিটি আসতেই তিন বলে আবার তিনটি ৪। ভেরিটির হাতেই ক্যাচ তুলে দিয়ে সেফিরে যায়। কার্ডাস লিখলেন :
ব্র্যাডম্যানের এই ৩৬ রান লিডসে তার ৩৩৪ রানের থেকেও অনেক বেশি মহীয়ান। প্রতিটি স্ট্রোকের পিছনে ছিল প্রেরণা, ছিল সৌন্দর্য যা পৌরুষের চূড়ায় পৌঁছোনো জীবন থেকেই বিচ্ছুরিত হয়।
১৯৩০-এ ডন মে মাসের মধ্যেই হাজার রান সম্পূর্ণ করেছিল। ১৯৩৪-এর জুন মাসের শেষে তার রান দাঁড়াল মাত্র ৭৬০। লর্ডসের ব্যাটিং ছাড়া বলার মতো রান আর সেকরেনি। সাধারণ লোক জানে না ডন কী অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ডন কখনো আলোচনা করত না।
জুলাই এল এবং স্বাস্থ্য তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখল। ম্যাঞ্চেস্টারে তৃতীয় টেস্ট ম্যাচ এসে পড়ল। কিপ্যাক্স অসুস্থ, খেলল না। ডন ও চিপারফিল্ডের গলায় ব্যথা। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল বুঝি ডিপথেরিয়া। সেই অবস্থাতেই ডন খেলে এবং ৩০ রান করে। ম্যাচের মীমাংসা হয়নি।
এরপর ওরা এল লিডসে। ডনের প্রিয় মাঠ। এখানে স্মৃতি হয়ে আছে তার সেরা ইনিংসগুলির কয়েকটি। মাঠটিকে দেখেই বোধ হয় ডন তাজা বোধ করেছিল। ইয়র্কশায়ারের সঙ্গে খেলা। অস্ট্রেলিয়ার এক উইকেটে ১৬ রান, ডন উইকেটে এসে যোগ দিল উডফুলের সঙ্গে। কয়েক মিনিট যথারীতি সেব্যাটে লাগাম পরিয়ে রাখল। তারপরই খসে গেল লাগাম। টগবগ করে উঠল স্কোরবোর্ড—২৫ মিনিটে ৫০, ১০০ মিনিটে ১০০ রান। পরের ১৫ মিনিটে আরও ৪০ রান। ১১৫ মিনিটে নেওয়া তার ১৪০ রানে দুটি ৬, বাইশটি ৪। বোলারদের মধ্যে অবশ্যই ভেরিটিও ছিল। কোনো বোলারের কাছে অপদস্থ হলে ডন শোধ না নিয়ে ছাড়ত না।
লিডসেই চতুর্থ টেস্ট ম্যাচ। ডন তখন অপ্রতিরোধ্য মেজাজে এসে গেছে।
প্রথম ব্যাট করে ইংল্যাণ্ড চমৎকার উইকেটে ২০০ রানে আউট হয়ে যায়। দিনের শেষদিকে অস্ট্রেলিয়া ৩৭ রানে হারায় ব্রাউনকে। নৈশ প্রহরীরূপে উইকেটকিপার ওল্ডফিল্ড আসে এবং দু-রান পরেই আউট হয়ে ফিরে যায়। উডফুল নামে এবং বাওয়েস সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বোল্ড করে। অস্ট্রেলিয়ার তিন উইকেটে ৩৯ রান। এর পরের উইকেট পড়ে পরদিনের খেলা শেষের দশ মিনিট আগে যখন ভেরিটির বল হুক করতে গিয়ে পন্সফোর্ডের পায়ে লেগে বেল পড়ে যায়। তখন তার রান ১৮১।
আর ব্র্যাডম্যান? দ্বিতীয় দিন শেষে ২৭১ অপরাজিত। তৃতীয় দিনে বোল্ড হয় বাওয়েসের বলে, তখন তার রান ৩০৪। সময় লেগেছে ৪২০ মিনিট। তাতে আছে দুটি ৬, তেতাল্লিশটি ৪।
সাধারণ লোক ধরে নিল ডন আবার তার নিজের খেলা ফিরে পেয়েছে। কিন্তু ডনের সতীর্থরাই জানে কী অসম্ভব কষ্ট তাকে করতে হল। দীর্ঘ ইনিংস খেলার ধকল শুধুই মনের জোরে সহ্য করারও একটা সীমা আছে। ড্রেসিং রুমে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রা পোশাক খুলিয়ে ডনকে বাচ্চা ছেলের মতো কোলে করে মালিশের টেবলে শুইয়ে দেয়। নড়াচড়ার ক্ষমতা তার আর ছিল না। একটা বড়ো ইনিংস খেলা মজবুত লোকের পক্ষেও যে কী পরিশ্রমের ব্যাপার— যে খেলেনি তার পক্ষে বোঝা সহজ নয়। ১৯৩৮-এ ৩৬৪ রানের টেস্ট রেকর্ড করার পর লেন হাটন বলেছিল আবার যে কোনোদিন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে পারব, মনে হচ্ছিল না।