১৯৩২-এ অস্ট্রেলিয়ায় যে-লোকটি সবথেকে ঘৃণ্যরূপে গণ্য হয়েছিল, সেই লারউড ১৮ বছর পর ১৯৫০ সালে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সম্মানিত নাগরিকরূপে সেখানে গণ্য হন। তিক্ততা এই ১৮ বছরে ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু অন্যান্য বহু টেস্ট ক্রিকেটারের মতো, ডন ১৯৩২-এর স্মৃতি রোমন্থনে এখনও অনাগ্রহী।
১১. ‘ব্র্যাডম্যান মৃত’
ডন ১৯৩৩-৩৪ মরশুমে প্রায় মারা গিয়েছিল।
মরশুম শুরুতেই সেদেখল পিঠে একটি ব্যথা চাগিয়ে উঠছে। একটা ইনিংস ব্যাট করলে আগের থেকে অনেক বেশি ক্লান্ত লাগে। তার মানে ক্লান্তি নামার আগেই তাড়াহুড়ো করে তাকে রান তোলার কাজ সারতে হচ্ছে। যত রান করা দরকার ততটুকু হয়ে গেলেই ইচ্ছে করে ক্যাচ তুলে বা উইকেট ছেড়ে দিয়ে সেচলে আসত। অপ্রয়োজনেও ব্যাট করে যাওয়া বা মনোনিবেশ করে থাকা আর তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না।
ডনের বিচারবোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সেবুঝতে পারত ঠিক কত রান তাকে করতে হবে ম্যাচ জেতার জন্য। কিন্তু এইভাবে তার পক্ষে বেশিদিন খেলে যাওয়া সম্ভব নয়। আগের মরসুমের বডিলাইনের ঝঞ্ঝাট সেপোহাতে পেরেছিল যেহেতু স্ত্রী তার চিঠিপত্র লেখালেখি এবং খবরের কাগজের ও বেতারের প্রবন্ধগুলির কাঠামো তৈরিতে সাহায্য করেছিল। বেশিরভাগ ক্রিকেটারই যা করে, অর্থাৎ অন্যে তাদের প্রবন্ধগুলি লিখে দেয় আর তারা শুধু নিজের নামটুকু সেই লেখার উপরে বসিয়ে দেন, ডন কিন্তু এই অশরীরী লেখকদের লেখাকে কখনোই নিজের নামে চালায়নি। নিজের লেখা সেনিজেই লিখত।
অ্যাডিলেডে সেবিশেষজ্ঞদের দিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাল। তারা বলল, অত্যধিক চিন্তা ও পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে পড়ছে; দেহে ও মনে সেনি:শেষ হয়ে আসছে; তার উচিত সুযোগ পেলেই বিশ্রাম নেওয়া আর সহজ ও হালকাভাবে সব কিছুকে গ্রহণ করা।
ডন তাই করার চেষ্টা করল। একটা বড়ো রকমের সিদ্ধান্ত সেতখন নিল। এই সময় সারাদিনে তার প্রতিটি মুহূর্তই ভরে ছিল ক্রিকেটে। ক্রিকেট খেলা, ক্রিকেট নিয়ে কাগজে লেখা, ক্রিকেট সম্পর্কে বেতারে বলা, ক্রিকেটের সরঞ্জামগুলি খেলে দেখিয়ে-শুনিয়ে তা বিক্রি করা। তখন ক্রিকেটই তার পেশা এবং নেশা। জীবনটা যেন ক্রমশ সংকীর্ণ একঘেয়ে এবং একপেশে হয়ে যাচ্ছে। হাঁফ ছাড়া যাচ্ছে না, বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। সেঠিক করল, তার এমন একটা কাজ চাই যার সঙ্গে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ক্রিকেটকে সেরুটি সংগ্রহের হাতিয়ার না করে শুধুই খেলার ব্যাপার করে রাখবে ঠিক করল। এইভাবে তাহলে আবার সেক্রিকেটের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাবে।
যে ক্রিকেট সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠানে সেচাকরি করত সেটা ছেড়ে দিল, ক্রিকেট বিষয়ে বক্তৃতা দেবার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করল। চাকরি নিল অ্যাডিলেডে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের একজন সদস্যের শেয়ার দালালির অফিসে। খুব-একটা অবাক হবার মতো ব্যাপার এটা নয়। স্কুলে অঙ্কে দারুণ মাথা ছিল ডনের। আর একবগ্গা মাথামোটা খেলোয়াড়দের মতো তার মাথাটা মোটেই বুদ্ধিহীন ছিল না।
বিচারবোধসম্পন্ন বহু বিখ্যাত লেখক ডন সম্পর্কে বলেছেন, সেযে-কাজই বেছে নিক-না তাতে সেসফলই হবেই যেহেতু সফল হবার জন্য তার সংকল্প, একমুখীনতা এবং কাজের প্রতি মনোনিবেশ অত্যন্ত প্রবল এবং প্রগাঢ়। এবার থেকে ডন তার ব্যাবসায়িক জীবন ও ক্রিকেট জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগল। অফিসে লেনদেনের কথা ছাড়া ক্রিকেট নিয়ে একটি কথাও বলত না, শুনতেও চাইত না। টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে বাড়ির ফোন নম্বরটা সেবাদ দিয়ে দিল যাতে বাড়িতে তাকে কেউ ব্যাঘাত না করে। আর সুযোগ পেলেই সেবিশ্রাম নিত।
১৯৩৪-এ এল ডনের দ্বিতীয় ইংল্যাণ্ড সফর। ডনকে অস্ট্রেলীয় দলের সহ-অধিনায়ক করা হল। সেবুঝতে পারল তাকে ভবিষ্যৎ অধিনায়করূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অস্ট্রেলীয় দল ইংল্যাণ্ডে পৌঁছোল। তারা ওয়েম্বলিতে এফএ কাপ ফাইনাল দেখল, প্রধানমন্ত্রী র্যামসি ম্যাকডোনাল্ডের ভোজের আমন্ত্রণ রক্ষা করল। কিন্তু ডন তার শরীর সম্পর্কে বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না, অধিনায়ক বিল উডফুলকে সেজানাল, প্রথম ম্যাচে তাকে যেন বাদ দেওয়া হয়। উডফুল তাকে বলল, এটা করা ঠিক হবে না, কেননা ইতিমধ্যে চারদিকে গুজব রটেছে যে, ডনের শরীর ভেঙে গেছে, না খেললে গুজবটা সত্য প্রমাণিত হবে। দলের মনোবলও যথেষ্ট ধাক্কা খাবে। তা ছাড়া দর্শকও কমে যাবে, তাতে আয়ও কমে যাবে।
সুতরাং ডন খেলল। দ্রুত ২০৬ করল। এবং শুরুতেই এতটা শক্তিক্ষয়ের ফলে শ্রান্তি তাকে এমনভাবে চেপে ধরল যে, সেই মে মাসের শেষাশেষি একটি পঞ্চাশ রানের ইনিংস ছাড়া আর কিছু সেকরতে পারল না। এর মধ্যে আবার স্কোরবুকে দুটি শূন্যও তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছে।
এরপরই এল লর্ডসে মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে, আকর্ষণীয়তার দিক থেকে তার জীবনের একটি অদ্বিতীয় ইনিংস—অন্তত ডন নিজে তাই মনে করে। আগের ম্যাচে হাম্পশায়ারের বিরুদ্ধে শূন্য করেছে। সুতরাং মনে মনে ডন নিজের সম্পর্কে যথেষ্ট নড়বড়ে ছিল। অনবরত শ্রান্তি এবং যন্ত্রণার তাড়া খেয়ে সেমনমরা হয়ে পড়েছিল।
মিডলসেক্স ২৫৮ রানে ইনিংস শেষ করে। অস্ট্রেলিয়া উডফুল ও পন্সফোর্ডকে হারাল শূন্য রানে। এইবার ডনকে অস্ট্রেলিয়ার দরকার, ভীষণভাবে দরকার। ম্যাচ জেতার মতো রান তাকে করতে হবে, করতেই হবে। এবং সেকরল।