ইতিমধ্যে দুই দলের সম্পর্কে প্রীতির লেশটুকুও আর নেই। পরে আরও খারাপ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা যখন ব্যাট করছে, কোনো কোনো অস্ট্রেলীয় ফিল্ডসম্যানকে দেখা গেল উইকেটের দিকে বল ছোড়ার সময় যেন প্রতিযোগিতা করেই চেষ্টা করছে যাতে তা ব্যাটধারীকে আঘাত করে। পালটা জবাব দিতে ইংরেজদেরও মাঝেমধ্যে বাউন্সার দেওয়া হয় বটে কিন্তু উডফুলের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, ‘প্রতিশোধ নয়।’
অস্ট্রেলীয়দের সম্পর্কে লারউডের কয়েকটি মন্তব্যও অবস্থার অবনতি ঘটায়। সেবলে, ডন ভয় পেয়ে গেছে আর উডফুলের নড়াচড়া এমনই মন্থর যে, যে-বল লাফিয়ে উঁচু হয়ে ওঠেনি তাতেও সেমাথা নীচু করেছে।
ইংল্যাণ্ড দলের সবারই কিন্তু এই পদ্ধতির বোলিংয়ে সায় ছিল না। এই সফরের ১৪ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ওয়াল্টার হ্যামণ্ড বলেন :
আমি সর্বতোভাবে এর নিন্দা করি। বডি-লাইন বিপজ্জনক। আমি বিশ্বাস করি, নিছক সৌভাগ্যবশতই বডি-লাইনে কেউ মারা যায়নি। যদি এটাকে চলতে দেওয়া হত তাহলে আমি খেলা থেকে বিদায় নিতাম।
কিন্তু লণ্ডনে ক্রিকেটের মাতব্বররা ভেবেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠানো খবরে বাড়াবাড়ি রয়েছে, এমনটা হতেই পারে না। ভালোমতো তদন্ত না করে তারা তখুনি ব্যবস্থা নেবার কোনো দরকার আছে মনে করলেন না। এদিকে লারউড ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠতে লাগল। তার বলের গতি দ্রুত থেকে আরও দ্রুত হচ্ছে। খেলার পর তার শ্রান্ত তপ্ত শরীরে বরফ ঘষে দিত সতীর্থরা। বল করার সময় তার বঁা-পা এত জোরে পড়ত যে তার বুট ফেটে যেতে লাগল। নিজেকে নি:শেষ করে, ক্ষমতার শেষ প্রান্তে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে লারউড এমনভাবে বল করে যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সেনিজেকেই বোল্ড আউট করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার রোদে-পোড়া পাথুরে জমিতে বল ডেলিভারির সময় তার বঁা-পা এত কঠিনভাবে ফেলার জন্য গোড়ালিটা প্রায় থেঁতলেই গেছিল। সফর থেকে ফিরে আর সেঅত জোরে বল করতে পারেনি। আটাশ বছর বয়সেই লারউড শেষ হয়ে যায়।
তার বলের গতি অস্ট্রেলীয়দের আপত্তির কারণ ছিল না। তাদের বক্তব্য, সেই গতিকে ব্যাটধারীদের জখম করবার জন্য ব্যবহার করাটাই আপত্তিকর।
ইংল্যাণ্ড চতুর্থ টেস্ট ৬ উইকেটে জিতে ‘রাবার’ পায় প্রধানত লারউডের জন্য। সিরিজে ডন আট ইনিংস থেকে চার বার আউট হয় লারউডের বলে। সেরান করে— ০ ও ১০৩*, ৮ ও ৬৬, ৭৬ ও ২৪, ৪৮ ও ৭১। প্রতি ১০০ বলে ৭৫ রান করে।
সন্দেহ নেই, যে-কাজের জন্য বডিলাইন বোলিংয়ের উদ্ভাবন, তা সম্পন্ন হয়েছিল সফলভাবেই। ডনকে খর্ব করে তার রানের গড়কে (৫৬.৫৭) সাধারণ খেলোয়াড়ের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পেরেছিল। ডনের জীবনে এমনটি শুধু এই এক বারই ঘটে।
বস্তুত বডিলাইন বল খেলা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রথাসিদ্ধ ব্যাটিং— আক্রমণেই হোক বা রক্ষণেই হোক, এর বিরুদ্ধে অক্ষম হয়ে পড়েই। ব্যাটসম্যান যদি মেরে খেলতে চায় তাহলে সাধারণত লেগ ফিল্ডে কট হবে। আর যদি তা না করে, বোল্ড অথবা আহত হবে।
বডিলাইন চূর্ণ করা সম্ভব কি না সেটা দেখা আর সম্ভব হল না যেহেতু এই একটি মরসুমেই তার উদয় ও অস্ত ঘটেছিল।
যেভাবে ডন বডিলাইন খেলার চেষ্টা করে বা তার সচরাচর অভ্যস্ত মোটা অঙ্কের রান করতে না পারার জন্য তাকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এতে সেমনে আঘাত পায়। তার বক্তব্য : ‘আর কেউ কি এর থেকে কিছু ভালো করেছে?’
নিশ্চয়ই ডনের থেকে কেউ ভালো পারেনি। সিরিজে আট ইনিংসে তার রান ৩৯৬, গড় ৫৬.৫৭। যারা পাঁচটি টেস্টই খেলেছে তাদের থেকে ডনের চার টেস্টে রান বেশি, কিন্তু তার সবথেকে বড়ো মুশকিল, ‘ভেলকিওয়ালা’ হিসাবে এখন তার গায়ে ছাপ পড়ে গেছে। তার কাছ থেকে সবাই এখন একটা-কিছু ভেলকি আশা করে।
ডন ইংল্যাণ্ডের বিজয় রুখতে পারেনি, কিন্তু সেই জয় সর্বত্রই ক্রিকেটারদের মুখ বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে এমসিসি এই সফরের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি জানতে পেরেছে। তারা ফতোয়া জারি করল, যেকোনো ধরনের বোলিং ‘যা বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে সরাসরি আক্রমণ, তা খেলার প্রেরণার প্রতি অপরাধ।’
এমসিসি পরে একথাও মেনে নিল যে, ‘গত ক্রিকেট মরশুমে বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের প্রতি কখনো কখনো সরাসরি আক্রমণ ঘটেছে, এমন ঘটনারও প্রমাণ মিলেছে।’
অবশেষে আঘাতের উদ্দেশ্যে বোলিংয়ের বিরুদ্ধে আইন রচিত হয়। যদি এ ধরনের বোলিং চলতে দেওয়া হত, সন্দেহ নেই তাহলে ক্রিকেট খেলাটাই ধ্বংস হত। বডিলাইনের উৎপত্তিও কিন্তু সম্ভব হত না যদি প্রতিপক্ষ ক্রিকেটাররা ডনকে এত বিরাটভাবে এবং এত সম্মানভরে স্বীকার করে না নিত।
ওই মরসুম সম্পর্কে উইজডেন লিখল :
এ ধরনের বোলিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়—প্রধানত ব্র্যাডম্যানের রান সংগ্রহ প্রবণতাকে খর্ব করার কথা ভেবেই—যাকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা ও দর্শকরা একযোগে ধিক্কৃত করে এবং যখন এর সম্পর্কে আসল সত্যটি এইদেশে শেষপর্যন্ত জানা গেল, তখন ঘরের লোকেরা—তার মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত খেলোয়াড়—বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবে, রাবার জয়ের বিনিময়ে এই বৈরিতালাভ সত্যিই কি লাভজনক হয়েছে!
বডিলাইনের প্রয়োগ সম্পর্কে ক্রিকেট দুনিয়ার অপছন্দ এমনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, জার্ডিন পরের বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় আর খেলেননি। তবে পরবর্তীকালে চমৎকার এক ব্যাপার ঘটে।