মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ডন খেলতে নামল। তার আগে ডনকে অনেকেই হুঁশিয়ার করে দেয়, ‘তোমার জন্য ইংল্যাণ্ড ফাস্ট বোলারদের এনেছে। তোমার ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ ডন শুনেছে, এমসিসি-দল অস্ট্রেলিয়ায় আসার পথে জাহাজে রোজই শলাপরামর্শ করত। প্রধানত ডনকে রোখার জন্যই হত শলাপরামর্শ। সেজানত তার ১৯৩০ সফরের প্রতিটি ইনিংস তন্নতন্ন করে ওরা বিশ্লেষণ করেছে তাকে অকেজো করার পথ খুঁজে বার করতে।
ওদের বিশ্বাস, শুধু ডনকে যদি বড়ো রান তোলা থেকে নিবৃত্ত করা যায়, তাহলেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব। ওরা খুঁজেপেতে দেখল ডনের একমাত্র দুর্বলতা, শক্ত পিচে খাঁটি ফাস্ট বোলিংয়ে। তারা এর সঙ্গে মেলাল লেগ থিয়োরিকে।
সমুদ্রতীরে এক বন্ধুর নির্জন সৈকতাবাসে ডন তার পরিকল্পনা তৈরি করল একাকী সারারাত।
সেব্যাটিং মধ্যমণি। সুতরাং লারউডের বজ্র থেকে সরে যাওয়া বা শুধুই ব্যাট দিয়ে আটকানো তার পক্ষে শোভা পায় না। ওসব কাজ বোলাররা করবে, তাকে করতে হবে রান। তাই সেপদ্ধতি বার করল : উইকেট থেকে সরে গিয়ে বল মারতে চেষ্টা করবে অফ-সাইড ফিল্ডের দিকে।
তার মানে, বোলারকে তখন অফ-সাইড জোরদার করতে হবে। যদি তা করে তাহলে তাকে লেগ-সাইড ফিল্ড কমজোরি করতে হবে। তাহলে ডন স্বাভাবিক ব্যাটিংয়ে ফিরে আসতে পারবে।
ঝুঁকি নিয়ে, বে-কেতাবি খেলা। কিন্তু তা ছাড়া উপায় নেই। এখনকার মতো এটাই যা-কিছু কাজের ছক।
মেলবোর্নে ডন যখন ব্যাট হাতে নামল, জনতা তুমুল অভিনন্দনে ফেটে পড়ল। অস্ট্রেলিয়ার ওস্তাদ নেমেছে। প্রথম টেস্ট হারের শোধ নেবেই নেবে। জনতার দারুণ প্রত্যাশা।
ডন ক্রিজের দিকে এগোচ্ছে। হারবার্ট সাটক্লিফ বলল, ‘কী দারুণভাবে স্বাগত জানাচ্ছে।’
‘যখন ফিরব, তখনও এটা এইরকম দারুণ থাকবে কি?’ গম্ভীর স্বরে ডন বলেছিল।
থাকেনি। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে অসাড় স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে ডন হেঁটে ফিরেছিল প্যাভিলিয়নে। বাওয়েসের প্রথম বল শর্টপিচ। ডন পুল করতে চেষ্টা করল এবং বলটিকে টেনে আনল লেগস্টাম্পে। প্রথম বলেই আউট ডনের জীবনে এই প্রথম এবং এই শেষ বারই ঘটল। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে সেআউট হয় দ্বিতীয় বলে।
অস্ট্রেলিয়ার দুঃসময়ে তার নায়ক দেশকে ডুবিয়ে দিল। সাফল্যের এইটাই জরিমানা; যদি একশোর কম রান করে তাহলে ধরে নেওয়া হয় ডন ব্যর্থ হয়েছে। অন্যান্য সাধারণ ব্যাটধারীকে আর ডনকে মাপার মানদন্ড এক নয়।
কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে ডন যথারীতি আবার নিজের খেলায় ফিরে এসে ১০৩ করল দলের ১৯১ রানের ইনিংসে। বডি লাইন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এই টেস্টে তা কার্যকরী হয়নি। আগের সপ্তাহে বৃষ্টি হওয়ায় উইকেট অস্বাভাবিক মন্থর ছিল বাউন্সারের পক্ষে।
ডন আবার বিগ্রহরূপে পূজিত হল। মাঠেই চাঁদা তুলে ডনকে দিল দর্শকরা। তাই দিয়ে সেমস্ত এক পিয়ানো কিনেছিল। পিয়ানোবাদনেও ডন রীতিমতো দক্ষ। অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় টেস্ট ১১১ রানে জিতেছিল।
অ্যাডিলেডে তৃতীয় টেস্টে বডি-লাইনের ঝড় মাতন তুলল। এমন বিশ্রীভাবে আর কখনো টেস্ট খেলা হয়নি। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক বিল উডফুল দু-বার আঘাত পেলেন লারউডের বাউন্সারে। ওল্ডফিল্ড মুখে আঘাত পেয়ে অবসর নেন। ডন আট রান করে কট হয় লারউডের বলে।
গ্রীষ্মের শুষ্ক দিনে, ইংরেজ বোলিং পদ্ধতির বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ ছড়িয়ে পড়ল মাঠ ঘিরে। দ্বিতীয় ইনিংসে ডন খেলতে নামল চোয়াল শক্ত করে। এবার সেতার পরিকল্পনা অনুযায়ী উইকেট থেকে পিছিয়ে গিয়ে অফের দিকে বল মারার চেষ্টা করতে লাগল। এভাবে খেলার জন্য অরক্ষিত থাকছিল তার স্টাম্প। দর্শকরা হইচই শুরু করে; তারা বুঝতে পারছে না ডনের এভাবে খেলার কী মানে হয়। দেখে মনে হচ্ছিল সেযেন বলের লাইন থেকে সরে যেতে চাইছে।
ডন মাথাখারাপের মতো ইনিংস খেলল। কেতাবে আছে এমন মার বোধ হয় সেএকটিও মারেনি।
বার বার সেক্রস ব্যাট চালাল কিন্তু রানও করল। খেলার যোগ্য বলগুলিকে সেপিটিয়ে ছাতু করল।
শর্ট-স্কোয়্যার লেগে ক্যাচ পাওয়ার জন্য জার্ডিন নিজে দাঁড়ালেন। ঝিকিয়ে উঠল ডনের চোখ। কয়েক মিনিট পরেই সেঘুরিয়ে বল মারল প্রচন্ডভাবে। কোনোক্রমে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে ইংরেজ অধিনায়ক নিজেকে রক্ষাকরলেন। জায়গাটা ছেড়ে আর একজনকে দাঁড় করিয়ে জার্ডিন সরে গেলেন। ডন রসিকতা করছে কি না সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না।
লারউডের জায়গায় ল্যাটা স্পিনার হেডলি ভেরিটি আসতেই ডন তাকে সদস্য স্ট্যাণ্ডে তুলে দেয় এবং এক বৃদ্ধা অল্পের জন্য রক্ষা পায়। এক ঘণ্টা উইকেটে থেকে ডন ৬৬ রান করে ভেরিটির বলে তার হাতেই কট হয়।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়াকে দ্বিতীয় পরাজয় থেকে রক্ষার জন্য এই প্রয়াস যথেষ্ট নয়। ইংল্যাণ্ড ৩৩৮ রানে জেতে। এই টেস্ট শেষ হওয়ার আগেই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড নজীরবিহীন এক টেলিগ্রাম লণ্ডনে এমসিসি-র কাছে পাঠায়। তাতে বলা হল :
বডিলাইন বোলিং এমন আকার নিয়েছে যে, ক্রিকেটের সর্বোত্তম স্বার্থের পক্ষে তা মারাত্মক হয়ে উঠেছে। ব্যাটধারীদের দেহকে রক্ষাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় করে তুলেছে।
এতদ্বারা খেলোয়াড়দের মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ এবং সেইসঙ্গে চোট-আঘাত ঘটছে। যদি-না এখুনি বন্ধ করা হয় তাহলে এটা অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে বর্তমান প্রীতির সম্পর্ককেক্ষুণ্ণ করবে।