ডন ইংল্যাণ্ডের বিজয় রুখতে পারেনি, কিন্তু সেই জয় সর্বত্রই ক্রিকেটারদের মুখ বিস্বাদে ভরিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে এমসিসি এই সফরের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি জানতে পেরেছে। তারা ফতোয়া জারি করল, যেকোনো ধরনের বোলিং ‘যা বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে সরাসরি আক্রমণ, তা খেলার প্রেরণার প্রতি অপরাধ।’
এমসিসি পরে একথাও মেনে নিল যে, ‘গত ক্রিকেট মরশুমে বোলার কতৃক ব্যাটসম্যানের প্রতি কখনো কখনো সরাসরি আক্রমণ ঘটেছে, এমন ঘটনারও প্রমাণ মিলেছে।’
অবশেষে আঘাতের উদ্দেশ্যে বোলিংয়ের বিরুদ্ধে আইন রচিত হয়। যদি এ ধরনের বোলিং চলতে দেওয়া হত, সন্দেহ নেই তাহলে ক্রিকেট খেলাটাই ধ্বংস হত। বডিলাইনের উৎপত্তিও কিন্তু সম্ভব হত না যদি প্রতিপক্ষ ক্রিকেটাররা ডনকে এত বিরাটভাবে এবং এত সম্মানভরে স্বীকার করে না নিত।
ওই মরসুম সম্পর্কে উইজডেন লিখল :
এ ধরনের বোলিং পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়—প্রধানত ব্র্যাডম্যানের রান সংগ্রহ প্রবণতাকে খর্ব করার কথা ভেবেই—যাকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা ও দর্শকরা একযোগে ধিক্কৃত করে এবং যখন এর সম্পর্কে আসল সত্যটি এইদেশে শেষপর্যন্ত জানা গেল, তখন ঘরের লোকেরা—তার মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত খেলোয়াড়—বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ভাবে, রাবার জয়ের বিনিময়ে এই বৈরিতালাভ সত্যিই কি লাভজনক হয়েছে!
বডিলাইনের প্রয়োগ সম্পর্কে ক্রিকেট দুনিয়ার অপছন্দ এমনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, জার্ডিন পরের বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রায় আর খেলেননি। তবে পরবর্তীকালে চমৎকার এক ব্যাপার ঘটে।
১৯৩২-এ অস্ট্রেলিয়ায় যে-লোকটি সবথেকে ঘৃণ্যরূপে গণ্য হয়েছিল, সেই লারউড ১৮ বছর পর ১৯৫০ সালে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং সম্মানিত নাগরিকরূপে সেখানে গণ্য হন। তিক্ততা এই ১৮ বছরে ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু অন্যান্য বহু টেস্ট ক্রিকেটারের মতো, ডন ১৯৩২-এর স্মৃতি রোমন্থনে এখনও অনাগ্রহী।
সারা অস্ট্রেলিয়া ১৯৩২-এ সফরকারী ইংরেজ ক্রিকেটারদের ধিক্কার দিল। আশঙ্কা করা হল জনতা হয়তো মাঠে নেমে এসে ওদের মারধর করতে পারে, তাই সর্বত্র ওদের বিশেষ পুলিশ প্রহরায় রাখা হল। খবরের কাগজে তীব্র কশাঘাত হানা হল ইংরেজদের প্রতি এবং এক-এক সময়ে মনে হচ্ছিল আর বুঝি কখনো টেস্ট খেলা হবে না।
সব কিছুর মূলে : তথাকথিত ‘বডিলাইন বোলিং।’ বলগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ইংল্যাণ্ডের ফাস্ট বোলারদের, বিশেষ করে নটিংহ্যামশায়ারের নানকার্গেটের প্রাক্তন কয়লাখনি শ্রমিক হ্যারল্ড লারউড দ্বারা, যার তুল্য ফাস্ট বোলার তখনও দেখা যায়নি।
এই বিতর্কমূলক বোলিংয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ডন ব্র্যাডম্যান নামক রান সংগ্রাহক অতিমানবকে পরাজিত করা। ডনকে থামানোর জন্যই এই বোলিং পদ্ধতির উদ্ভাবন। গুণের স্বীকৃতি, অবাঞ্ছনীয়ভাবে হলেও, এমন বিরাট ভঙ্গিতে খুব কম লোককেই জানানো হয়েছে।
বডিলাইনটা কী? আজও এই নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। তবে মূলত ব্যাপারটা শর্টপিচে ফাস্ট বোলিং। মতলব : জমিতে বাম্প করে বল তোলা এবং লেগ-সাইডে তখন ছয় থেকে আট জন লোক রাখা হয়।
তর্কটা হল, লেগ স্টাম্প না ব্যাটধারী, লক্ষ্যবস্তু কোনটি? অস্ট্রেলীয়দের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, এই বোলিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যাটধারীকে ভয় পাইয়ে তার মনে এমন এক উদবেগ এনে দেওয়া যাতে সেতার উইকেটের নিরাপত্তার থেকেও বেশি চিন্তা করে নিজের দেহের নিরাপত্তা সম্পর্কে; ব্যাটধারীকে লক্ষ করেই এই বল করা হয় এবং আউট হওয়া নয়তো আঘাত নেওয়া এই দুইয়ের একটি ছাড়া তার আর কিছু করার থাকে না। নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত, অব্যর্থ লক্ষ্য, লারউডের বলের গতি ঘণ্টায় ৯৫ মাইলের মতো। সুতরাং মানুষ আঘাত পেয়েছে, উইকেট হারিয়েছে, এবং সন্ত্রস্ত অস্ট্রেলীয়রা কোমরে-বুকে প্যাড পরেছে।
প্রথম টেস্টে ডন খেলতে পারেনি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট বোর্ড আপত্তি জানিয়ে বলল, খবরের কাগজে ডন লিখতে পারবে না। ডন বলল, চুক্তি করেছি যখন তা রক্ষা করব। তাই নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। অবশেষে খবরের কাগজটিই জানাল, ডনকে লিখতে হবে না। এই নিয়ে ডনকে প্রচুর মানসিক টানাপোড়েন সহ্য করতে হয়।
এরপর শারীরিক ধকল, এমসিসি-র বিরুদ্ধে অস্ট্রেলীয় একাদশের পক্ষে খেলার জন্য সিডনি থেকে পার্থ পাঁচ রাত ট্রেনে কাটিয়ে ডনকে পুরো দু-দিন ফিল্ড করতে হয়। তারপর বৃষ্টিভেজা উইকেটে ৩ ও ১০ রান করে আবার সিডনিতে ফিরেই ডন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খেলতে নামে। সে-খেলায় ডন ১৯৫ মিনিটে ২৩৮ করে এবং প্রথম শতরানটি ৭০ মিনিটে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২ অপরাজিত। বিপক্ষে বোলার ছিল ফ্লিটউড-স্মিথ। এরপর ডনের শরীর পরিশ্রমের ধকল নিতে পারছিল না। তবু মেলবোর্নে গিয়ে আবার এমসিসি-র বিরুদ্ধে আর একটি ম্যাচ খেলে এবং রান করে ৩৬ ও ১৩। দু-বারেই আউট হয় লারউডের বলে। এই ম্যাচে জার্ডিন বডিলাইন আক্রমণের চেহারাটি প্রথম দেখালেন। খেলা, ট্রেনভ্রমণ এবং তর্কবিতর্ক—এই তিনের চাপ ফুটে উঠল নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে এমসিসি-র খেলাটিতে। ডন করল ১৮ ও ২৩।
ডন বোর্ডকে জানাল, তার শরীর টেস্ট ম্যাচ খেলার উপযুক্ত নেই। ডাক্তার জানাল ওর পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। সিডনিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচটি সেদেখল দর্শকাসন থেকে। দেখল ম্যাককেবের অপরাজিত অসাধারণ ১৮৭, দেখল লারউডের অনবদ্য ফাস্ট বোলিং, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে দীর্ঘক্ষণের প্রচন্ড গতি বলের দ্বারা ২৮ রানে পাঁচটি উইকেট পাওয়া ১৮ ওভারে। অস্ট্রেলিয়া হারল ১০ উইকেটে।