ব্যাটিংয়ে নতুন ও বৈপ্লবিক পথ নির্দেশ করেছিলেন রঞ্জিত সিংহজি : ‘পিছিয়ে খেলো নয়তো ড্রাইভ।’ এর পরই বলের পিচের দিকে ঝুঁকে পড়া বাতিল হয়ে যায় বা ক্রমশ হতে থাকে। সি বি ফ্রাই লিখলেন :
পা বাড়িয়ে খেলতেই হবে, এই অযৌক্তিক ধারণাটি নিখুঁত ক্রিকেটে অত্যন্ত মারাত্মক। একমাত্র দৈত্য ছাড়া আর কারও পক্ষে বঁা-পা বাড়িয়ে ঝুঁকে, গুড লেংথ ফাস্ট বলের পিচের দু-ফুটের মধ্যেও পৌঁছোনো সম্ভব নয়। বোলার যেটা করতে চায় বা করবার জন্য চেষ্টা করে, সেটা হল ব্যাটসম্যান যেন তার বোলিংয়ের পিচের দিকে পা বাড়িয়ে ঝোঁকে।
ব্র্যাডম্যান যখন মধ্যাহ্নে দীপ্যমান তখন কদাচিৎ তাকে ক্রিজ থেকে পা বাড়িয়ে সামনে ঝুঁকতে দেখা গেছে। ফুটওয়ার্ক তার শরীরকে নিয়ে গেছে বলের কাছে, বলের পিচের উপরে। তার পূর্ববর্তী কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষেই এতটা করা সম্ভব হয়নি। টেকনিককে আরও এগিয়ে এনে ব্র্যাডম্যান নতুন কোনো অধ্যায় সংযোজিত করেনি। আবিষ্কৃত যাবতীয় নিয়মকে সমন্বিত করে ব্যাটসম্যানশিপকে জ্যাক হবস এমন এক জায়গায় নিয়ে যান, যেখান থেকে আর এগিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় এবং আজও তার প্রয়োজন হয়নি। ব্র্যাডম্যানের অবদান— অতন্দ্র প্রহরা ও নতুন এক মিতাচার।
‘স্টাইল না কার্যকারিতা, কোনটা নিয়ে ব্যস্ত হবে?’ প্রশ্নটা স্বয়ং ব্র্যাডম্যানেরই। নিজেই বলেছে, ‘কার্ডাস লিখেছিলেন, ইগলের ওড়া আধুনিক জেট প্লেনের থেকে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর, কিন্তু কে যে দ্রুতগামী তাতে কারও সন্দেহ নেই।’
ব্র্যাডম্যান এমনই প্রতিভাসম্পন্ন যে, ইচ্ছা করলে সেতার ব্যাটিংকে সৌকুমার্যে ভূষিত করার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারত। কিন্তু এ ব্যাপারে তার বাস্তববোধ ছিল অতি সজাগ। বোলারদের সম্পর্কে দুটি মূল জিনিস সেজানত :কেউই ব্যাটের পুরো মুখের সঙ্গে অনবরত মোলাকাত পছন্দ করে না; কেউই সাধারণভাবে গুড লেংথ বোলিং পলকের ফুটওয়ার্কে ওভারপিচ বলে রূপান্তরিত দেখতে পছন্দ করে না। বাউণ্ডারি-ফেন্সে বলের সংঘর্ষের শব্দ শুনতে সেভালোবাসত; স্কোরবোর্ডে তার নামের পাশে রানের সংখ্যা ঘুরতে দেখলে খুশি হত; বোলারদের খুন করায় এবং বিপক্ষ অধিনায়কের মুখ বিমূঢ় করে তোলায় তার আনন্দ হত।
সূক্ষ্ম আলতো মিহি মার ছিল না; কিন্তু ব্র্যাডম্যানের সেরা দিনগুলিতে প্রত্যেক বোলার, প্রত্যেক ফিল্ডসম্যান, প্রত্যেক দর্শক অনুভব করত— তার হাতের জিনিসটি ব্যাট নয় কুঠার এবং তা থেকে ঝরে পড়ছে বোলারের রক্ত। দয়া জানত না। একটি শতরানে কদাচ সেতৃপ্ত হয়েছে। দুশো, তিনশো এমনকী চারশো রানেও পৌঁছোতে চায় সে। কুইন্সল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে ৪৫২ করেও ব্যাট সমর্পণ করেনি। দর্শকদের কাছে তার আবেদনের প্রচন্ডতা ও ক্ষিপ্ততা এখনও কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। স্কোরবোর্ডে তার নাম ওঠামাত্র যে-গর্জন মাঠ ঘিরে ধ্বনিত হত, তা নিছকই পূর্ব-অনুমিত হর্ষধ্বনি। ব্র্যাডম্যান কদাচিৎ তার ‘বাহিনী’কে হতাশ করেছে।
ব্র্যাডম্যান যেমন বোলারের শিরঃপীড়ার, তেমনই অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানের মানসিক শান্তি হরণের কারণ। একগাল হাসি নিয়ে সেগার্ড নেবে, সাজানো ফিল্ড দেখবে, ট্রাউজার্সে হ্যাঁচকা টান দেবে, ব্যাট হাতে তৈরি হয়ে দাঁড়াবে এবং তারপর তীক্ষ্ণস্বরে ‘রাইট’ বলেই প্রথম বল থেকে প্রথম রানটি নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়বে। এটাকে সেঅভ্যাসে পরিণত করেছিল। তারপর কখন যেন সে২০, ৩০, ৪০, ৫০ এবং অবশ্যম্ভাবী শতরানে পৌঁছে যেত। সেএকাই খেলে যেত এবং অন্যপ্রান্তের ব্যাটসম্যান ক্রমশই হীনতা ভাবে মধ্যে ডুবত। সব কিছুই যেন অতি সহজ, এইরকমভাবে ব্যাপারটাকে সেসবার চোখে প্রতিভাত করাত এবং ঘড়িকে আর একটি উৎখাতযোগ্য শত্রু বিবেচনা করত। তার আমলে বহু ব্যাটসম্যান তার বিরাট ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়ে অনুযোগ করেছে, অন্য সকলের থেকে ব্র্যাডম্যান বেশি ফুলটস ও শর্টপিচ বল পেয়েছে। তারা এটাই বোঝাতে চায়, ওর কপালটা ভালো। অবশ্যই সেভাগ্যক্রমে বলগুলি পেত না। আসলে যেভাবে সেচেয়েছে বোলাররা সেইভাবেই বল করেছে। সব কিছু তারই ইচ্ছানুযায়ী হত। তার ফুটওয়ার্ক, নিজের ওপর অগাধ আস্থা, তছনছ করে দিত বোলারদের; তাদের সম্মোহিত করত এবং তারা বুঝে উঠতে পারত না ওকে ঠাণ্ডা করার জন্য কোথায় বল ফেলতে হবে।
বোলিংয়ে বিপ্লবের কারণ হয়েছিল ব্র্যাডম্যান। লারউডকে ফলাগ্রে রেখে জার্ডিনের পরিকল্পনা—লেগসাইডে ফাস্ট বোলিং, মাথার উচ্চতায় বল লাফাবে, লেগসাইড ঘিরে ফিল্ডসম্যান—ছকা হয়েছিল তার ব্যাটিং গড়কে সম্ভব হলে অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য। সফল হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই (আট ইনিংসে ৫৬.৫৭ গড় রান)।কিন্তু ব্র্যাডম্যান যেভাবে এই বোলিংয়ের—লারউডের জীবনের দ্রুততম অধ্যায়—মোকাবিলা করেছিল, কোনো যুগের কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে তা সম্ভব হত না। আশ্চর্যজনক এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ সেই মোকাবিলা! হয়তো বেপরোয়াও। কিন্তু অবস্থা বিচারে আর কী পন্থা নেওয়া যেতে পারে! সাহস এবং মৌলিকতা তখন দরকার ছিল। ব্র্যাডম্যান তা দেখিয়েছিল। লেগসাইডে দেওয়া লারউডের বল অন-এর দিকে সরে এসে অফ-এ মারা এবং এমন দ্রুততম বলকে, যা অস্ট্রেলিয়াবাসীরা আগে কখনো দেখেনি। লারউড ও লেগ-ফিল্ডের বিরুদ্ধে পরিকল্পনার দ্বারা ইচ্ছানুযায়ী সুদীর্ঘ ইনিংস গড়ার বা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কোনো যৌক্তিক উপায় সম্ভবপর ছিল না। ১৯৩২-৩৩-এ জার্ডিনের নিষ্ঠুর চ্যালেঞ্জের সামনে ব্র্যাডম্যান যে চোখ-ধাঁধানো উদ্ভাবনক্ষমতা, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে সংকল্প, চারিত্রিক কাঠিন্য দেখিয়েছিল, তার সারা জীবনে এর থেকে বিস্ময়কর আর কিছু সেকরেনি।