০. মুখবন্ধ
১৯৩৮ ওভাল টেস্ট ম্যাচের রিপোর্টে উইজডেন লেখে :
তৃতীয় দিন চা-এর সময় হ্যামণ্ড নিশ্চয়ই ইনিংস ঘোষণা হয়তো করত না, যদি বিপক্ষ অধিনায়কের দুর্ঘটনা না ঘটত।
স্কোরবোর্ডে ইংল্যাণ্ডের তখন ৯০৩-৭ এবং ‘বিপক্ষ অধিনায়ক’ ডন ব্র্যাডম্যান পায়ের গোছ মুচড়ে যাওয়ায় আর ব্যাট করতে পারবে না নিশ্চিতভাবে তা জানার পরই হ্যামণ্ড ইনিংস ঘোষণা করে। সেজানত, ডন যদি ব্যাট করতে পারত তাহলে ন-শো রানেও ইংল্যাণ্ড নিরাপদ নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ইটালিতে মুসোলিনির পতন ঘটেছে কিন্তু হিটলারের জার্মানি তখনও লড়ে যাচ্ছে। কমন্স সভায় এক সদস্য বক্তৃতা করতে উঠে বললেন, ‘পন্সফোর্ডকে আমরা অল্পেই আউট করেছি, এবারে ব্র্যাডম্যান।’ সভায় কারোরই এই রূপক হৃদয়ঙ্গমে অসুবিধা হয়নি। নির্দয়ভাবে বোলারদের নিষ্পেষণ করেছে যে ভয়ংকর ডিকটেটর, তার নাম ব্র্যাডম্যান।
ব্র্যাডম্যানের প্রথম ইংল্যাণ্ড সফর ১৯৩০-এ। নটিংহামে প্রথম টেস্টে করে ১৩১। সেযখন ব্যাট করছে নেভিল কার্ডাস জিজ্ঞাসা করলেন সিডনি বার্নেসকে, ‘দেখে কী মনে হচ্ছে?’ বার্নেস জবাব দেন, ‘একথা বলব না যে, আমি যখন দারুণভাবে বল করছি তখন ওকে আউট করতে পারতাম না। তবে আমাকে অত্যন্ত দারুণভাবে বল করতে হত।’ বার্নেস ২৭ টেস্টে ১৮৯ উইকেট নিয়েছেন ১৬.৪৩ গড় রানে, এক সিরিজে ৪৯ উইকেট ১০.৯৩ গড়ে। বার্নেসের ‘অত্যন্ত দারুণ’ অতিমানবদের জন্য।
১৯৭৪ সালে ব্র্যাডম্যানের ১৯৩৬-৩৭ টেস্ট রেজার লণ্ডনে বিক্রি হয়েছে ৭০০ গিনিতে, স্বাক্ষরিত ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ বইয়ের কপি ১৫০ পাউণ্ডে।
কয়েকটি ব্যাপার মাত্র উল্লেখিত হল ডন ব্র্যাডম্যান কী ধরনের শ্রদ্ধা, ভয়, বিহ্বলতা আকর্ষণ করেছে বোঝাতে। শেষ টেস্ট ইনিংস খেলেছে ১৯৪৮-এ কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রবাদে পরিণত হয়ে, প্রবাদের নিজস্ব ভঙ্গি অনুসারে ক্রিকেটার হিসাবে মানবিক আবেদন থেকে চ্যুত হয়েছে। ওর সম্পর্কে এমন একটা ধারণা গড়ে উঠেছে যাতে মনে হয় ডন যেন যান্ত্রিক ব্যাটসম্যান, নিজের হৃদয়হীন টেকনিকের দাস, ক্রিকেট থেকে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা ও মহান অনিশ্চয়তা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, রান যোগ দেওয়ার এমন একটি যন্ত্র। এই ধারণাটা, ডনের দক্ষতার ওস্তাদিকে মর্যাদায় ভূষিত করে বটে কিন্তু অপ্রত্যক্ষভাবে ধারণাটা ভুলও। কেননা এর মধ্যে মোটেই ধরা পড়ে না তার চমৎকারিত্বের ধারাবাহিকতা বা স্ট্রোকের গভীর ব্যাপ্তি। উইকেটে ব্র্যাডম্যান বিরস, কল্পনাবোধহীন এবং ব্যক্তিগত স্পর্শরহিত এই ধারণাটাও মিথ্যা।
ব্র্যাডম্যান যেভাবে ক্রিকেট মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে, তার আগে বা পরে কেউ সেভাবে পারেনি। অবিশ্বাস্য তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা। জ্যাক হবসও ধারাবাহিক সাফল্যে দীপ্যমান, ডা. গ্রেসকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে খামখেয়ালি পিচের, কিন্তু ব্র্যাডম্যান সকলের মাঝে একা দাঁড়িয়ে। কিশোর উপন্যাসের কোনো লেখকও তার নায়ককে এইরকম বিস্ময়কর সাফল্য দিতে সাহস পাবে না। ব্র্যাডম্যান যা করেছে : ইংল্যাণ্ডে প্রথম ম্যাচে ২৩৬; আগন্তুক প্রথম ব্যাটসম্যান মে মাসের মধ্যে ১০০০ রান; ইংল্যাণ্ডে প্রথম টেস্টে ১৩১, লর্ডসে প্রথম খেলায় ২৫৪; একপক্ষ পরেই লিডসে একদিনে ৩০৯ এবং লাঞ্চের আগে ১০৫ (সবই ২২ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে); এবং ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত এইভাবেই প্রতি দ্বিতীয় ম্যাচে এবং প্রতি তৃতীয় ইনিংসে একটি শতরান দ্বারা ১১৭টি শতরান করেছে যতদিন-না অবসর নিয়েছে। সব রকমের ম্যাচে ৬৬৯ ইনিংসে রান ৫০,৭৩১; গড় ৯০.২৭। শুধু প্রথম শ্রেণির ম্যাচেই ২৮,০৬৭ রান ৩৩৮ ইনিংসে, গড় ৯৫.১৪ এবং টেস্ট ম্যাচে করেছে ৬,৯৯৬ রান, ৮০ ইনিংসে গড় ৯৯.৯৪। স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো হিসাব। ৮০ টেস্ট ইনিংসের ৬৩টি ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে খেলায়। অবশ্যই বলা দরকার— ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে, যেখানে ঝুড়ি ঝুড়ি রান জমা, সেখানে খেলেনি; নিউজিল্যাণ্ডেও না।
শুধু পরিসংখ্যানেই ব্র্যাডম্যানের অবিসংবাদী বিরাটত্বের কাহিনি বিধৃত। কিন্তু তার প্রচন্ড ক্ষমতার একটি দিক মাত্র এই পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়। ওর সঙ্গে যারা ব্যাট করেছে বা বিরুদ্ধে বল ও ফিল্ড করেছে অথবা খেলা বোঝেন এমন লোকেরা যাঁরা ওর খেলার টেকনিক বিশ্লেষণ করেছেন, তাঁরাই বুঝতে সক্ষম কী প্রচন্ড বৈপ্লবিক আধিপত্য ব্র্যাডম্যান ক্রিকেটে এনেছিল। এখনকার টেস্ট ম্যাচে রান তোলার হার অর্ধেক করে দিয়েছে যেসব বোলিং কৌশল, ফিল্ড সাজানোর ছক বা উইকেট তৈরির পদ্ধতি, তার হদিশ খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, ব্র্যাডম্যানের দ্রুত রান তোলার ভগ্নাংশ মাত্র কমাবার প্রয়াসে বোলারদের দ্বারা এইসব ব্যাপার সেই আমলেই শুরু হয়েছিল। ট্রাম্পার, ম্যাককেব বা মে যে-অর্থে ক্ল্যাসিকাল, ব্র্যাডম্যান তা নয়। ওর দেহের গঠন দোহারা, পেশিসমন্বিত এবং কবজিতে নমনীয়তা। অথচ সূক্ষ্ম, স্নিগ্ধ আলতো ছোঁয়ার সেইসব মার (দলীপ সিংহজির ধরনে), যাতে মনে হয় মাঠের ওপর সম্মোহন ছড়াচ্ছে কোনো জাদুদন্ড— এমন কিছু ডনের ব্যাটিংয়ে ছিল না। হয়তো কোনো বোলারের মনে হল ম্যাকার্টনির রক্ষণ ভেদ করে স্টাম্পে বল প্রায় লাগিয়ে ফেলেছে এবং এইরকম মনে হতে হতেই সেদেখল ব্যাটের শেষ মুহূর্তের একটা মোচড়ে বিদ্যুৎগতিতে বল বাউণ্ডারির দিকে চলেছে। সোবার্সের ক্ষেত্রেও বোলারদের এইরকম মনে হতে পারে কিন্তু ব্র্যাডম্যানের ক্ষেত্রে নয়। ক্রিকেটে এমন কোনো স্ট্রোক নেই যা মারতে পারত না, কিন্তু বাস্তববোধে ভরা ছিল তার পা থেকে চুলের ডগা।