কিন্তু আমি তো যতদূর জানি, শিরোমণির গড় ফ্রিঞ্জ এরিয়ার মধ্যে পড়ছে। ওসব জায়গায় বিজনেস-অ্যাক্টিভিটি বারণ নয় তো?
বারণ নয়, বাট ইন রেস্ট্রিক্টেড ম্যানার। নিয়ন্ত্রিতভাবে বিজনেস অ্যাক্টিভিটি চলতে পারে। তাও, সেইসব ব্যবসা যেগুলো ইকো-ফ্রেন্ডলি। যেগুলোর মধ্যে দিয়ে লোকাল পিপলের কিছু লাভ হয়। আর আপনি যা করতে চাইছেন তা তো স্ট্রেটওয়ে বনকে ধ্বংস করা।
তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। শিরোমণির গড় সম্বন্ধে লোকাল পিপলের মনে স্ট্রং সেন্টিমেন্ট কাজ করে–জানেন সে কথা? ওটা ওদের কাছে তীর্থস্থান। কোনওভাবেই ওই জায়গার…
বিনতা মেহরা প্রমিতকে তার কথার মধ্যে বাধা দিয়ে বললেন, ফরগেট বাউট লোকাল পিপল। ও ব্যপারটা আমি দেখে নেব।
তার মানে? প্রমিত বিনতার মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইল।
এই পৃথিবীতে সমস্ত কিছুই পারচেজেবল মিস্টার ব্যানার্জি। তীর্থস্থানও তার বাইরে পড়ে না। নাউ টেল মি অ্যাবাউট ইয়োর প্রাইস-সিলিং।
অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে প্রমিত বিনতার দিকে চেয়ে রইল। এই মহিলা কি জানেন, ইনি কী বলছেন?
বিনতার মধ্যে অবশ্য কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি এমন একটা খেলা খেলছেন যে খেলায় সম্ভবত আজ অবধি তিনি কখনও হারেন নি। তাই চোখের পাতাটি অবধি না ফেলে, অত্যন্ত সহজ সুরে তিনি বললেন, আপনাকে আমি এই প্রোজেক্ট থেকে যা ইনকাম হবে স্ট্রেট অ্যাওয়ে তার টেন পার্সেন্ট দেব। মাসে এক লাখের কম হবে না।
গেট আউট!
আরও বেশি দিতে পারতাম, কিন্তু আপনাদের এখানকার সবকটা রাজনৈতিক দলের নেতারা বখরা চেয়ে বসে আছে। তবে আমি বলছি, দুবছরের মধ্যে দ্যা অ্যামাউন্ট উইল বি ডাবল।
আই সে গেট আউট!
মার্কামারা হাস্কি গলায় বিনতা বললেন, উত্তেজিত হচ্ছেন কেন মিস্টার ব্যানার্জি? আপনাকে দিয়ে কাজটা না হলে অন্য কাউকে দিয়ে করাব। মাঝখান থেকে আপনি একটা হ্যান্ডসাম অফার মিস করবেন। ভেবে দেখুন।
আমিও আপনাকে বলে দিচ্ছি মিসেস মেহরা, আজকের পরে আর কোনদিন বক্সা টাইগার রিজার্ভের বাউন্ডারির মধ্যে আপনাকে দেখতে পেলে ট্রেসপাসিং-এর জন্যে ফাটকে পুরে দেব। নাউ, গেট লস্ট।
শান্তভাবেই সোফা ছেড়ে উঠে বিনতা মেহরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। প্রমিত অবাক হয়ে দেখল, তিনি গেটের সামনে পৌঁছন মাত্র যে সাদা টয়োটা-টা রাস্তার বাঁক ঘুরে তার সামনে এসে দাঁড়াল, সেটা তার খুব চেনা। এখানকার এক পাওয়ারফুল ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে সে ওই গাড়িটায় চড়ে ঘুরতে দেখেছে।
সেদিনই প্রমিত বুঝতে পেরেছিল, শিরোমণির গড়ে হোটেল বানানোর স্কিমটা বিনতা মেহরা খুব সহজে ছাড়বে না। লড়াইটা সে চালিয়ে যাবে, কারণ তার পেছনে সৈন্যদল রয়েছে।
আর প্রমিত জানে না সে পেছনে কতজনকে পাবে, কতজন শিবির বদলে চলে যাবে উলটোদিকে। এ দেশে সরকারের পক্ষ নিয়ে লড়তে গেলে যেমনটা হয়।
হঠাই প্রমিতের জিপটা প্রচন্ড দুলে উঠল। সেই ঝাঁকুনিতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এল প্রমিত। দেখল জিপ ডিমা নদীর শুকনো খাত পেরোচ্ছে। এখন এই হেমন্তের শেষে নদীর বুকে একফোঁটাও জল নেই। নুড়িপাথরের ওপর দিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে জিপ। তবে বর্ষার ফ্ল্যাশ ফ্লাডে এই শুকনো নদীরই যে কি রূপ হয়, তা মনে করিয়ে দেবার জন্যেই যেন অনতিদূরে বালির চড়ায় সার সার কয়েকটা কংক্রিটের থাম দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওই থামগুলোর মাথায় কয়েকবছর আগেও একটা ব্রিজ ছিল। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমিত রাজাভাতখাওয়ায় পৌঁছে গেল। তিন বছর আগে, প্রথম দর্শনেই, আরণ্যক এই ছোট্ট শহরটার শান্ত রূপ প্রমিতকে মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতা আজও তার কাটে নি। শহরে ঢুকবার একটু আগে রাস্তা আর রেললাইনের মাঝখান দিয়ে একটা ছোট ঝোরা বয়ে চলে, নাম চৈতন্যঝোরা। যাতায়াতের পথে প্রত্যেকবারই প্রমিত জিপ থামিয়ে ওই ঝোরার ধারে একটা বড় পাথরের ওপর কিছুক্ষণ বসে। তাকে ঘিরে ল্যানটানা আর বন-ধুতরোর ঝোপে মধ্যে কলকল করে ঘুরে বেড়ায় বুলবুলি পাখির ঝাঁক। পাথরে ধাক্কা খেয়ে চৈতন্যঝোরার জল শিরশির শব্দে বয়ে যায়। প্রজাপতিরা নির্ভয়ে গায়ে মাথায় এসে বসে। সারাদিনের সমস্ত গ্লানি মন থেকে ধুয়ে চলে যায়।
প্রমিতের ড্রাইভার অশোক রাই নেপালি ছেলে, তবে শিলিগুড়িতে জন্ম এবং কর্ম বলে জলের মতন বাংলা বলে। প্রমিতের এই জায়গাটা সম্বন্ধে অনুরাগের কথা সে জানে। চৈতন্যঝোরার কাছে এসে সে ঘাড় ঘুরিয়ে জিগ্যেস করল, দাঁড়াব স্যার?
দাঁড়া। প্রমিত জিপের দরজা খুলে মাটিতে পা দিয়ে মাথার ওপর দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল।
ঠিক তখনই দুজন লোক একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
.
০৪.
আলিপুরে আপনার অফিসে গিয়ে শুনলাম জলপাইগুড়ি গেছেন। জানি, এই পথ দিয়েই ফিরবেন। তাই অপেক্ষা করছিলাম। দুজনের মধ্যে যে ছেলেটির বয়েস একটু বেশি, সে এগিয়ে এসে কথাগুলো বলল। বলল, প্রমিতের প্রায় গায়ের ওপর দাঁড়িয়ে। দাঁড়াবার ভঙ্গিতে আর চোখের চাউনিতে পরিষ্কার ঔদ্ধত্য ফুটে বেরোচ্ছে।
ছেলেটিকে প্রমিত খুব ভালো করে চেনে। ওর নাম মধু…মধু বর্মন।
যে-কোনও রিজার্ভ ফরেস্টেরই দুটো ভাগ থাকে–একটা ফ্রিঞ্জ-এরিয়া বা প্রান্তিক অঞ্চল, আরেকটা কোর-এরিয়া বা কেন্দ্রীয় অঞ্চল। বক্সা টাইগার রিজার্ভও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু পাখি, হরিণ, বাঁদর, আর ছিটকে আসা হাতির পাল ছাড়া বক্সার প্রান্তিক অঞ্চলে বিপন্ন প্রজাতির বণ্যপ্রাণী বিশেষ থাকে না। তাই বনদফতর এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রিতভাবে কিছু মানুষকে বসবাস আর কৃষিকাজের সুযোগ দেয়। যে আসে তাকেই যে দেয় এমন নয়। তাদেরই দেয়, যারা বনদফতর তৈরি হবার আগে থেকে তো বটেই, ভারতরাষ্ট্র তৈরি হবারও অনেক আগে থেকে, হয়তো রামায়ণ মহাভারতের যুগ থেকেই পুরুষানুক্রমে এই অরণ্যে বসবাস করে আসছে। সারা ভারতের সমস্ত বনভূমিতেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এমন বনবাসীদের অস্তিত্ব রয়েছে। আর্য ঋষিদের রচিত মহাকাব্যগুলোতে এদেরই কিরাত, রাক্ষস প্রভৃতি নামে দেগে দেওয়া হয়েছে। বনবাসকালে আর্য রাজকুমারদের প্রধান প্রমোদ তথা কর্তব্য ছিল এই অনার্য কিরাত বা রাক্ষসদের নিধন করা।