আমি একটু অফিসিয়াল কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম।
মুখের সামনে থেকে কাগজটা সরিয়ে প্রমিত দেখল ইতিমধ্যে বিনতা মেহরা সোজা হয়ে বসেছেন। আঁচল টাঁচলও যথাস্থানে ফিরে এসেছে। প্রমিত তার চোখে চোখ রেখে বলল, অফিসিয়াল কাজ? তাহলে বাড়িতে কেন? দশটার পর অফিসে আসবেন।
প্লিজ, ব্যানার্জি সাহেব। নটায় বাগডোগরা থেকে ফ্লাইট। আমাকে আজ কলকাতায় পৌঁছতেই হবে। সেইজন্যই বাধ্য হয়ে আপনাকে বাড়িতে ডিস্টার্ব করলাম। তাছাড়া আমাদের কথার মধ্যে এমন কিছু প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে, যেগুলো অফিসের কলিগদের সামনে বলাটা মুস্কিল হবে।
প্রমিত স্বভাবতই ভদ্রলোক। বেশিক্ষণ অভদ্রতা করতে পারে না। তার ওপর ভদ্রমহিলা অল্প দু-একটা কথাতেই তার মনে কৌতূহল জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সে বলল, বেশ বলুন, কী বলবেন।
বিনতা মেহরা প্রথমে একটা অত্যন্ত দামি কাগজে ছাপা ব্রশিওর প্রমিতের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি জানেন নিশ্চয়ই, মারমেড বিজনেস গ্রুপের নানান ফিল্ডে ব্যবসা আছে। তার মধ্যে একটা হল হোটেলের ব্যবসা। আমাদের স্টার হোটেল সারা ভারতের সবকটা বড় সিটিতেই ছড়ানো আছে। এমনকি দুবাই আর সিঙ্গাপুরেও আমাদের হোটেল রয়েছে। এই ব্রশিওরটায় আপনি সেগুলোর ডিটেইলস্ পাবেন।
প্রমিত ব্রশিওরটা উলটেপালটে দেখে একটু অবাক হয়েই বলল, কিন্তু আমার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?
সেটাই এক্সপ্লেন করছি। রিসেন্টলি আমরা একটা নতুন ভেঞ্চারে নেমেছি। আমরা না বলে আমি বলাই ভালো। কারণ, মারমেডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে আমার আত্মীয়েরা থাকলেও হেমিংওয়ে টুরর্স-এর মালিকানা আমার নিজের। হ্যাঁ, আমার নতুন প্রোজেক্টের নাম দিয়েছি হেমিংওয়ে ট্যুর। ভালো হয়নি? আমার এক প্রফেসর বন্ধু আছেন, বাঙালি। উনিই নামটা সাজেস্ট করলেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে না কি খুব জঙ্গল ভালোবাসতেন।
ও, এটা কি জঙ্গলের সঙ্গে রিলেটেড কোনও প্রোজেক্ট না কি?
এগজ্যাক্টলি মিস্টার ব্যানার্জি। আপনি ঠিক ধরেছেন। এইজন্যে বাঙালিদের আমি এত ভালোবাসি। এত শার্প দিমাগ হয় আপনাদের। আমার বন্ধুদের মধ্যে মেজরিটিই বাঙালি।
প্রমিত বুঝতে পারছিল না এর মধ্যে শার্প দিমাগের কি দেখলেন বিনতা মেহরা। তবে তেল দেওয়ার চেষ্টাটা সে দিব্যি বুঝতে পারছিল, এবং সেইজন্যেই আশঙ্কিতও হচ্ছিল। কি জানি এর পরে কী ধরনের রিকোয়েস্ট আসবে। সে চুপ করে থেকে বিনতাকে কথা বলে যেতে দিল। বিনতা বলে চললেন–
অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম ব্যাপারটা নিশ্চয় আপনি জানেন। আফটার অল, জাঙ্গল ইজ ইয়োর ব্রেড অ্যান্ড বাটার। হেমিংওয়ে ট্যুরিজম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর কন্ডাক্ট করে। আমাদের মেজরিটি ক্লায়েন্টস হল ফরেনার্স। তাদের আমরা ভারতের বনে, জঙ্গলে, দুর্গম পাহাড়ে, অজানা সমুদ্রতটে বেড়িয়ে আনি। দে ডু নট সিক কমফর্টস্। ওরা শুধু অ্যাডভেঞ্চার চায়। নির্জন তুষারপ্রান্তরে তাঁবুর মধ্যে শুয়ে কল্পনা করবে, তাঁবুর বাইরে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে ইয়েতি। ব্রিটিশ আমলের পরিত্যক্ত ফরেস্ট বাংলোয় রাত্রিবাস করবে; বাঘের গর্জনে মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যাবে। এইরকম সব খেয়াল আর কি।
প্রমিত একটু একটু আন্দাজ করতে পারছিল বিনতা মেহরা কোনদিকে কথাটিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
একটু চুপ করে থেকে বিনতা সরাসরি সেই প্রসঙ্গে চলে এলেন ব্যানার্জি সাহেব। আপনার এই বক্সা প্রোজেক্টের সীমানায় এমন একটা জায়গা রয়েছে যেটার মতন অপূর্ব অ্যাডভেঞ্চার স্পট আর হয় না। ঘন জঙ্গল আর নদীর মাঝখানে টিলার মাথায় প্রাচীন কেল্লা। সামনে ওয়াটার হোল। সেখানে সন্ধেবেলা হাতি, গউর, সম্বর-হরিণ অ্যান্ড ওয়াইল্ড বোরস্ সবাই জল খেতে আসে। রাত নামলে এমন নিঃশব্দ হয়ে যায় চারিদিক যে, গাছের পাতা খসে পড়ার আওয়াজও স্পষ্ট শোনা যায়। অ্যান্ড অ্যাবাভ অল, দেয়ার ইজ আ মিথ–ওই কেল্লাটাকে ঘিরে একটা অদ্ভুত লোককথা চালু আছে যে, একদিন ওই কেল্লার রাজা আবার ফিরে আসবেন। সেই রাজা, যিনি মারা গেছেন আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, তাই না? মাই ক্লায়েন্টস উড পে এনিথিং…জাস্ট এনিথিং ফর হ্যাঁভিং চান্স টু স্পেন্ড আ নাইট দেয়ার। মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি আমাকে ওই শিরোমণির গড়ে একটা হোটেল খোলার ব্যবস্থা করে দিন। বড় কিছু নয়, জাস্ট কটেজেস।
প্রমিতের হতবাক মুখের দিকে চেয়ে মাঝখানেই কথা থামিয়ে দিয়েছিলেন বিনতা মেহরা। তারপর আস্তে আস্তে জিগ্যেস করলেন, কী হল মিস্টার ব্যানার্জি? আমি কি অ্যাবসার্ড কোনও প্রোপোজাল দিয়েছি?
নিজেকে সামলাতে পারেনি প্রমিত। ক্রোধে আর ঘৃণায় হিস হিস করে উঠেছিল তার গলার স্বর। সেইভাবেই বলেছিল–অ্যাবসার্ড কথা বলেছেন কি না সেটা আপনি নিজে বুঝতে পারছেন না? আপনি জানেন না, বক্সা একটা ন্যাশনাল পার্ক, এর সীমানার অংশটুকু বাদ দিলে, বাকি যে কোনও জায়গায়, যে-কোনও রকমের কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি আইনত নিষিদ্ধ? আপনি জানেন না, একসময়ে ওই বনের মধ্যে ডলোমাইটের খনি ছিল, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? আলিপুরদুয়ার থেকে জয়ন্তী গ্রাম অবধি রেললাইন ছিল, তাও একই কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইসব বড় বড় প্রোজেক্ট গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, আর আজ আপনি ফরেনার্সদের সার্কাস দেখাবার জন্যে সেই জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু ফেলতে চাইছেন! সাহস তো কম নয় আপনার!