কিন্তু রাস্তা থেকে নিজের বাড়ির বারান্দায় পা দেওয়া মাত্র অন্য এক অচেনা গন্ধের ধাক্কায় প্রমিতের বুক থেকে ফুলের গন্ধ মুছে গেল। অবাক প্রমিত বুঝতে পারল সেই সুগন্ধ ভেসে আসছে তারই পরদাফেলা ড্রইংরুমের অন্দর থেকে।
পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকল প্রমিত। সোফায় এক বছর পঁয়ত্রিশের দীর্ঘাঙ্গী মহিলা বসেছিলেন। প্রমিতকে দেখে তিনি কেবল হাতের ওয়াইল্ডলাইফ ম্যাগজিনটা কোলের ওপর ভাঁজ করে রাখলেন, আর কিছু না।
নমস্কার করলেন না। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন না। প্রমিতের ঘরে তার উপস্থিতির কোনও ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না। শুধু চর্চিত হাস্কি গলায় জিগ্যেস করলেন, আপনি ডি এফ ও, মিস্টার ব্যানার্জি?
তার প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই প্রমিত একটা জিনিস খেয়াল করেছিল–মহিলার অঙ্গে সেই মুহূর্তে যত টাকার জিনিস ছিল তত টাকা অনেক মধ্যবিত্ত সারা জীবন চাকরি করে জমাতে পারে না। সোনালি জরির কাজ করা ঘিয়ে সিল্কের শাড়িটার দাম সে আন্দাজ করতে পারল না, তবে মহিলার হাতে, কানে এবং আঙুলে যে রত্নপাথর আর প্লাটিনামের হালকা গয়না গুলো আছে সেগুলোর দাম সব মিলিয়ে লাখ পাঁচেক টাকার কম হবে না। বাঁ-হাতের মুঠোয় আলতো করে ধরে রাখা ওয়েফার থিন মোবাইলটার দামও নিঃসন্দেহে লাখের ঘরে। ঘড়ির ব্র্যান্ডটা দূরে দাঁড়িয়ে ঠিক বুঝতে পারল না প্রমিত, তবে তার ডায়াল এবং স্ট্র্যাপে গাঁথা হিরেকুচির ঝলক তার চোখ এড়ালো না। আর সোফায় নামিয়ে রাখা হোয়াইট লেদারের পার্স আর পায়ের কাছে খুলে রাখা একই রঙের স্লিপার, দুটো জিনিসের ওপরেই ক্রিশ্চিয়ান ডিয়রের পৃথিবীবিখ্যাত লোগগা। শুধু ওই দুটো জিনিসের দামে একটা ভারতীয় মোটরগাড়ি কেনা যায় মনে মনে ভাবল প্রমিত।
আরেকটা জিনিসও না ভেবে পারল না প্রমিত, মহিলা কাকে দেখাবার জন্যে এই জনবিরল মফস্বলে এত সাজগোজ করে বেরিয়েছেন? যে সাজ পার্কস্ট্রিটের সন্ধেবেলায় চলে তা কি আলিপুরদুয়ারের ভোরবেলায় পরা যায়!
একেই ইংরিজিতে বলে স্টিংকিং রিচ। এনার গা থেকে পয়সার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, এবং রুচিহীনতার সেই দুর্গন্ধ শানেল ফাইভের সুগন্ধেও ঢাকা যাচ্ছে না।
প্রমিত খেয়াল করল মহিলার ঠোঁটে একটা হাসি ফুটে উঠেছে। বাঁকা হাসি। হাসিটার মানে বুঝতে অসুবিধা হল না প্রমিতের। কোনও শিকারি যখন একইসঙ্গে নিজের সাফল্যের আনন্দ আর নিহত শিকারের প্রতি করুণায় হাসে, তখন দুরকম হাসি মিশে গিয়ে এই হাসিটা তৈরি হয়। এই মহিলা যিনিই হন, ইনি প্রমিতকে তার সামনে এরকম বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছেন সেও তার নিত্য নতুন শিকারের তালিকায় এক নতুন সংযোজন, আর ওনার এই ভাবনাটা শুধু পয়সা থেকে আসছে না। পয়সা ছাড়াও ওনার অন্য অস্ত্র আছে। ওনার যৌবন। সে যৌবনে হয়তো সামান্য ভাটার টান লেগেছে, তবুও তা মোহিনী। আর সেটা উনি বিলক্ষণ জানেন। স্বেচ্ছাস্থলিত আঁচলের আড়াল থেকে জেগে থাকা বুকের গভীর খাঁজ, স্লিভলেস ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে থাকা দুই সুডৌল বাহু এবং নাভি থেকে নীবিবন্ধ অবধি বিস্তৃত মাখনরঙের উপত্যকা–এই সবই ওনাকে আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে। উনি আলুলায়িত ভঙ্গিতে বসে এই মুহূর্তে শরীরের সেই মাদক মানচিত্রের ওপর প্রমিতের চোখের দ্রুত নড়াচড়া দেখছেন, উপভোগ করছেন। ভাবছেন প্রমিত ঘায়েল হয়েছে।
কিন্তু সেই ভাবনাটা ভুল। আকর্ষণ নয়, প্রমিতকে প্রথম থেকেই ওনার উপস্থিতি বিকর্ষণ করছিল। ভালো লাগছিল না প্রমিতের। কেন, তা সে ঠিক বলতে পারবে না। হয়তো ওনার নিজের সম্বন্ধে অত্যন্ত নিশ্চিত ভঙ্গিটাই এর কারণ, কিম্বা পয়সা দেখানোর নির্লজ্জ ধরণটা।
যাই হোক, ওনার এই আত্মবিশ্বাসটা ভেঙে দেওয়া দরকার–প্রমিত ভাবল।
সে তাই উলটোদিকের সোফায় বসে সকালের নিউজপেপারটা হাতে তুলে নিল, তারপর সেটাকে মুখের সামনে মেলে ধরল। সেই অবস্থাতেই নিস্পৃহ গলায় জবাব দিল, হ্যাঁ, আমিই ডি এফ ও, প্রমিত ব্যানার্জি। আপনার পরিচয়টা? কাগজের আড়াল থেকেও প্রমিত অনুভব করতে পারছিল ভদ্রমহিলার মুখের ভাব কত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
ডেলিবারেট অপমানটা সামলাতে একটু সময় নিলেন ভদ্রমহিলা, তবে একটুই। বোঝা যায় প্রতিদিন বহু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সামলে উনি অভ্যস্ত। বড় জোর দশ সেকেন্ড চুপ করে থেকে তারপর উত্তর দিলেন, আমি বিনতা মেহরা। আমার নাম আপনি শুনে থাকবেন। মারমেড বিজনেস গ্রুপ..ওটা আমাদেরই। আমার স্বামী অতুল মেহরা ছিলেন ওই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা।
পরিচয়টা শুনে প্রমিত মনে মনে একটু সচকিত হলেও শরীরী ভাষায় সেটাকে ফুটে উঠতে দিল না। একইভাবে কাগজটা মুখের সামনে ধরে রাখল। মারমেড গ্রুপের নাম কে না জানে? হেৰ্থ-চেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ইমপোর্ট এক্সপোর্ট, হোটেল, এবং সর্বোপরি কনস্ট্রাকশন বিজনেস–বহু ব্যবসার মালিক ওই গ্রুপ। অতুল মেহরা নামটা বছর দুয়েক আগে অবধি খবরের কাগজে প্রায় রোজই দেখা যেত। ছবিও কখনও সিএম-এর সঙ্গে, কখনও পি এম-এর। তারপরেই মারা যান ভদ্রলোক। কিন্তু প্রমিত যতদূর মনে করতে পারছে, তিনি তো মারা গেছেন বেশ বুড়ো বয়সেই। সত্তরের ওপরে বয়েস হয়েছিল। ইনি তো তাহলে সেই বৃদ্ধের তরুণী ভায্যাই ছিলেন দেখা যাচ্ছে।