ওদের খুন করবার একমাত্র উপায় ছিল যেভাবে করা হয়েছে ঠিক সেইভাবেদূর থেকে, অন্ধকারের আড়াল নিয়ে, কাপুরুষের মতন। না, কাশ্যপসাহেব, কোনও ট্রেইটর ওদের ধারে কাছে ছিল না। এমন কি, যে লোকটা রিভারবেড়ে দাঁড়িয়ে ফাঁকা বুলেটের আওয়াজ করেছিল, সে-ও যে বহু আগেই চম্পট দিয়েছিল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ওরা পৌঁছনো অবধি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে বিমল বাবুয়াদের হাত থেকে সে বাঁচত না। আমরা তখন একটাই লাশ পেতাম, তিনটে নয়।
দ্যাটস্ ট্রু। এনি ওয়ে, আমরা কিন্তু সেই কানা গলিতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনও ব্রেক থ্র পেলাম না। চিন্তিত মুখে বললেন কাশ্যপ সাহেব। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, মিস্টার ব্যানার্জি! আপনার সেই রিসর্ট-ওয়ালির কী খবর? মিসেস বিনতা মেহরা?
আমার রিসর্ট-ওয়ালি বলবেন না স্যার, প্লিজ। মুখটা তেঁতো করে বলল প্রমিত। বিনতা মেহরা যে জগতে চলাফেরা করে, তার দশমাইলের মধ্যে পৌঁছবার ক্ষমতা এই সামান্য সরকারি চাকুরে প্রমিত ব্যানার্জির নেই। আর তার সে ইচ্ছাও নেই।
মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কিন্তু তাকে তো প্রমিত ব্যানার্জির কাছে আসতে হয়েছিল। আর একটা ইনফর্মেশন আপনাকে দিয়ে রাখি। বিনতা মেহরার অনেকগুলো পরিচয়ের মধ্যে একটা হল, সে আদমখোর। মানুষখেকো। পুরুষমানুষ অবশ্যই। হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান দেখলে বিনতা তার জাতপাত, অর্থগৌরব কিছু দেখে না। আপনি বিনতাকে পছন্দ নাও করতে পারেন, কিন্তু আপনাকে ওর অপছন্দ হবার কোনও কারণ দেখছি না।
প্রমিত দেবেশের কথায় হাসতে পারল না। ব্যাজার মুখে বলল, ওনার কাজটা করে দেওয়ার জন্যে প্রচন্ড পলিটিকাল প্রেসার আসছে। তবে যতক্ষণ চিফ কনজার্ভেটরের চেয়ারে অরিন্দম বসু আছেন, আর এখানে আপনি আছেন, ততক্ষণ মিসেস মেহরার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু আমরাই যদি না থাকি?
কাশ্যপসাহেবের কথায় অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল প্রমিত। মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কি জানেন তো মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি যাদের ওপর ভরসা করছেন তাদের পারচেজ হয়তো করা যায় না, কিন্তু সরিয়ে দেওয়া তো যায়? যে গভর্মেন্ট-সার্ভেন্ট পথের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার এফিসিয়েন্সির ওপরে একটা কালো দাগ লাগিয়ে তাকে ট্রান্সফার করিয়ে দেওয়াটা ইন্ডিয়ায় খুব পপুলার গেম। বিনতা মেহরাদের মতন লোকেরা এই খেলাটা খুব ভালো জানে। আর সেই কিস্তিমাতের লক্ষেই বোড়ের একটা চাল হয়তো তিনজন ফরেস্টগার্ডের মৃত্যু।
কথাটা উড়িয়ে দিতে পারল না প্রমিত। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিডিয়ার অস্বাভাবিক মাতামাতির কথা। কলকাতার কাগজগুলো কেমন করে সেদিন ওই রিমোট জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাটার কথা অত তাড়াতাড়ি জানতে পেরেছিল? কেউ কি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে ওদের টিপস দিয়েছিল? সম্ভব, সবই সম্ভব।
ওদের ব্রেকফাস্ট হয়ে গিয়েছিল। পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিক রিপোর্টের একটা করে কপি ব্রাউন খামে ভরে প্রমিতের হাতে তুলে দিলেন দেবেশ কাশ্যপ। তারপর হ্যাঁঙ্গার থেকে নিজের ইউনিফর্মের টুপিটা নিয়ে মাথায় ঠিক করে বসাতে বসাতে আগের কথার সূত্র ধরেই বললেন, আমি কিন্তু সন্দেহের আওতা থেকে ওই মহিলাকে বাদ দিচ্ছি না মিস্টার ব্যানার্জি। এই জঙ্গলে যদি টেররিস্টদের সাহায্যকারী কেউ থাকে, তাহলে এভরি পসিবিলিটি যে সেটা ওই মহিলা। বিকজ শী হ্যাঁজ হেভি স্টেক ইন দ্যা অ্যাফেয়ার।
বাংলো থেকে বেরিয়ে দেবেশ কাশ্যপ আর প্রমিত ব্যানার্জি যে যার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের গাড়িতে ওঠার আগে কাশ্যপ নীচু স্বরে প্রমিতকে বললেন, যদি সন্দেহজনক কিছু দ্যাখেন বা শোনেন, তা হলে আমাকে ওভার ফোন জানাবেন।
নিশ্চয়ই। বলল প্রমিত। তারপর সে নিজের জিপসি জিপের দরজা খুলে ভেতরে উঠে বসল। জিপসি রওনা দিল আলিপুরদুয়ারের দিকে। লম্বা সফরটার বেশিরভাগ জুড়ে তার মাথার মধ্যে খেলা করতে থাকল কাশ্যপ সাহেবের ঢুকিয়ে দেওয়া সন্দেহটা।
বিনতা মেহরা…বিনতা মেহরা! সত্যিই কি ওই সুন্দরী মহিলাটির এই হত্যালীলায় কোনও হাত আছে? সে-ই কি নাচাচ্ছে মিডিয়াকে?
প্রমিতের মনে পড়ে গেল, মাত্রই পনেরো দিন আগে ওই মহিলার সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের কথা।
.
০৩.
সেদিন প্রমিত বিনতা মেহরাকে চোখে দেখার আগে তার শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেয়েছিল।
ভোরবেলা আলিপুরদুয়ারের প্রান্তসীমার নির্জন এক মাঠ থেকে প্রতিদিনের মতন ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ সেরে, ততোধিক নির্জন রাস্তা ধরে নিজের কোয়ার্টারে ফিরছিল প্রমিত। তার। পরিধানে ছিল দুধ সাদা টি-শার্ট আর গাঢ় নীল টেনিস-শর্টস্। ব্যায়ামের পরে তখন তার শিরায় শিরায় জোরদার রক্ত সঞ্চালন, ফলে মেজাজ ছিল ফুরফুরে। বড় বড় স্টেপ ফেলে হাঁটতে হাঁটতে প্রমিত শুনছিল রাস্তার দুপাশের বিশাল বিশাল গাছগুলোর ডালপালার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা অজস্র পাখির বৃন্দগান। বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিল সে–তাজা অক্সিজেনের জন্যে তো বটেই, তবে তার চেয়েও বেশি শিশু ফুলের গন্ধের জন্যে। রাস্তার ধারের দানবাকৃতি শিশু গাছগুলোয় ফুল এসেছিল। ঈশ্বরের প্রসাধনীর মতন গুঁড়ো-গুঁড়ো মিহি সবুজ ফুলে ছেয়েছিল গাছতলা।