দেরাদুনের মানুষ দেবেশ কাশ্যপ নিজে একজন প্রকৃতি প্রেমিক। উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটা প্রকৃতি সংরক্ষণ উদ্যোগের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তাদের নানান ভাবে সাহায্য করেন। পোচারদের হাতে ফরেস্টগার্ডদের এই অসহায় মৃত্যু তাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল, তাই তিনি নিজে থেকেই এই কেসটার তদন্তভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
প্রমিতের সঙ্গে দেবেশ কাশ্যপের আগে থেকেই যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। প্রমিত ঘরে ঢোকা মাত্র তিনি সাদরে তাকে ডেকে বসালেন। জানালেন, গতকালই পোস্টমর্টেম আর ফরেনসিকের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। সেসবের থেকে এমন কিছুই জানা যায়নি যা ঘটনাটার ওপর নতুন করে আলোকপাত করে। জানা জিনিসকেই ওইসব রিপোর্ট কনফার্ম করেছে মাত্র। যেমন হাই ভেলোসিটি বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে ওই তিনজনের। বুলেটগুলো এসেছে ভুটান সীমান্তের নো-ম্যান ল্যান্ডের দিক থেকে। প্রত্যেকের জন্যে একটাই বুলেট–যেন বুলেটের গায়ে বাবুয়া বিমলদের নাম লিখে পাঠানো হয়েছিল।
কাশ্যপ সাহেব চিন্তিত মুখে বলে চললেন বুঝলেন মিস্টার ব্যানার্জি, অ্যাকচুয়াল ওয়ারফেয়ারের সময় ফাইটার-প্লেন বম্বিং শুরু করার আগে মার্কার-প্লেন টার্গেটের কাছে উজ্জ্বল। আলোর বোমা ফেলে চলে যায়, যাতে বহুবারদের টার্গেটে হিট করতে অসুবিধে না হয়। ভেবেছিলাম এক্ষেত্রেও বাবুয়া কিম্বা সন্দীপদের ওপর কেউ জোরালো আলো ফেলেছিল; ওদের এক্সপোজ করে দিয়েছিল নদীর উলটোদিকে অপেক্ষা করে থাকা টেররিস্টদের কাছে। কিন্তু বোধহয় আমার সেই চিন্তা ঠিক ছিল না।
প্রমিত মাথা নীচু করে মন দিয়ে কাশ্যপ সাহেবের কথা শুনছিল। সে কোনও মন্তব্য করল না।
কাশ্যপ সাহেব বলে চললেন–ভেবেছিলাম ডেড বডিগুলোর আশেপাশে রিভারবেডের বালিতে পায়ের ছাপ পাব। বিশ্বাসঘাতকের পায়ের ছাপ। কিম্বা রঙমশালের মতন কোনও আলো ছড়ানো জিনিসের অবশিষ্টাংশ। কিন্তু না। কিচ্ছু পাইনি। আই ওয়াজ রং। আমার ট্রেইটর থিয়োরি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
প্রমিত মুখ তুলে বলল, কিছু মনে করবেন না কাশ্যপ সাহেব। আপনি যদি বিমল, বাবুয়া আর সন্দীপের ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানতেন তাহলে শুরুতেই ট্রেইটর থিয়োরি নাকচ করে দিতেন।
একজন অর্ডারলি ট্রেতে করে দুটো প্লেটে আলুর পরোটা, সজি আর আচার নিয়ে ঘরে ঢুকল। সঙ্গে ধূমায়িত চা। দেবেশ কাশ্যপ ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসে বেরোবেন এবং বোঝাই যাচ্ছে প্রমিতকে না খাইয়ে তিনি ছাড়বেন না। প্রমিতেরও বেশ খিদে পেয়েছিল। সে বেশি ভদ্রতা না করে প্লেট টেনে নিল।
দেবেশ কাশ্যপ একটুকরো পরোটা মুখে পুরে বললেন, তাই! কেমন ছিল ওদের ব্যাকগ্রাউন্ড?
প্রমিত খেতে খেতেই বলে চলল–আমি আর চিফ কনজার্ভেটর অফ ফরেস্ট অরিন্দম বসু সারা ভারতের ফরেস্ট সার্ভিস ক্যাডার থেকে খুঁজে খুঁজে ওই তিনজনকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা ছিল যাকে ইংরিজিতে বলে হ্যান্ড-পিক।
বাবুয়াকে নিয়ে এসেছিলাম মধ্যপ্রদেশ থেকে। ওর আসল নাম ছিল বাবুলাল মুন্ডা। বস্তারের একটা জঙ্গলঘেরা গ্রামেই ও জন্মেছিল। জঙ্গলকে তাই ও হাতের পাতার মতন চিনত। জঙ্গলের ভেতরে ওর চলাফেরা ছিল ঠিক চিতাবাঘের মতন দ্রুত কিন্তু নিঃশব্দ। কানহার জঙ্গলে পোচারদের সঙ্গে বাবুয়ার যুদ্ধটা ছিল প্রায় একার যুদ্ধ। ফরেস্ট সার্ভিসের লোকেরাও অনেকে পয়সার লোভে পোচারদের সাহায্য করত। তবু লড়াইটাতে বাবুয়াই জিতছিল।
সন্দীপ সিং ইউ পির ছেলে কুমায়ুনের। করবেট ন্যাশনাল পার্কের পোচাররা শুধু সন্দীপকে খুন করবার জন্যেই তিন তিনবার স্টাফ কোয়ার্টারে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে সন্দীপকে খুন করা তো দূরের কথা, ওকে দেখতে পাওয়াও অসাধ্য ব্যাপার ছিল। পোকামাকড়ের মতন ক্যামুফ্লেজিং জানত সন্দীপ। গাছের গুঁড়ির গায়ে কিম্বা শুকনো পাতার স্কুপের মধ্যে চোখের পলক ফেলবার আগে হারিয়ে যেত ও। অনুসরণকারীরা সন্দীপের অবস্থান টের পেত অনেক দেরিতে। ততক্ষণে সন্দীপের রিভলবারের বুলেট তাদের পিঠে ঢুকে গেছে।
আর বিমল? বিমল বর্মনকে খুঁজতে বেশি দূরে যেতে হয়নি। ও ছিল কাজিরাঙায়। বিমলের স্পেশালিটি ছিল বুশ-ক্র্যাফট। একটা ভাঙা গাছের ডাল কিম্বা মাড়িয়ে যাওয়া পাতার। চিহ্ন ধরে কেউটে সাপের মতো বুকে হেঁটে এগিয়ে যেত বিমল। তাকে ফলো করত বাকি ফরেস্ট গার্ডরা। আর এইভাবে একসময় ওরা ঠিক পৌঁছে যেত চোরা শিকারিদের কোনও লুকনো ডেরায়। অতর্কিত আক্রমণে পাকড়াও করে ফেলত তাদের। চোরাশিকারিদের পেতে রাখা লুকনো ফাঁদ বা বুবি ট্র্যাপ খুঁজে বার করার কাজেও বিমলের এই আশ্চর্য বুশ-ক্র্যাফট কাজে লাগত। বিমল যেন গন্ধ শুঁকেই বার করে ফেলত কোথায় গভীর গর্তের ওপর লতাপাতার পাতলা আস্তরণ বিছিয়ে ওরা তৈরি করেছে হাতি মারার মরণফাঁদ কিম্বা কোথায় বাঘের যাতায়াতের পথে গাছের ডালের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা আছে লুকনো বন্দুকের ট্রিগার যাতে পা দিলেই গুলি ছুটবে আর মুখ থুবড়ে পড়বে বনের রাজা। এমন কত ফাঁদ যে খুঁজে বার করে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে বিমল, কত বন্যপ্রাণী যে ওর জন্যে পুরো আয়ুটা জুড়ে বেঁচে থাকতে পেরেছে, তার হিসেব নেই।
পেপার ন্যাপকিনে আঙুলের ডগাগুলো মুছে নিয়ে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল প্রমিত। তারপর বলল, বুঝতেই পারছেন কাশ্যপসাহেব, এই তিনজনকে জঙ্গলের রাস্তায় অনুসরণ করা মানে আত্মহত্যা করা। যে কাজ শঙ্খচূড় সাপে পারেনি, হাতিতে পারেনি, চিতাবাঘে পারেনি, সে কাজ কেমন করে কোনও মানুষে পারবে বলুন তো?