যে প্রশ্নটার উত্তর প্রমিত এবং রতন বৈদ্য কেউই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা হল, অমন কুয়াশা আর অন্ধকারের মধ্যে শু্যটাররা কেমন করে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা বিমল, সন্দীপ, বাবুয়াদের দেখতে পেল? নাইট ভিশন টেলিস্কোপিক সাইট-এর কথা একবার ওদের মাথায় এসেছিল। কিন্তু ওরা জানত পৃথিবীর আধুনিকতম টেলিস্কোপিক সাইটের রেঞ্জও ওই দূরত্বের দশভাগের একভাগ।
জিপের দিকে ফিরতে ফিরতে প্রমিত বলল, কয়েকটা ব্যাপার মাথায় ঢুকছে না মিস্টার বৈদ্য।
কী বলুন তো? বছর চল্লিশের বুদ্ধিমান মানুষটি বললেন।
আজ দিনের আলোয় আমরা এতক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম। শুধু আমরা কেন, সকাল থেকে অজস্র গ্রামবাসীও ঘুরে গেছে ওখানে। কিন্তু একটাও গুলি ছুটে আসেনি।
আজ বলে নয়, এত বছরের মধ্যে কোনওদিন ওইদিকের পাহাড় থেকে গুলি ছুটে আসেনি–না দিনে, না রাতে। না আসাটাই স্বাভাবিক। দুদিকের তীরভূমির মধ্যে যা দূরত্ব তাতে গুলি ছুঁড়লে গুলির অপব্যয়। টার্গেটকে যেখানে দেখতে পাওয়া যায় না সেখানে যা হয় আর কি।
আজ প্রথম ওদিক থেকে গুলি ছুটে এল, তাও রাতে। এবং সেই গুলি টার্গেটে হিট করল। তার মানে ওরা কি দিনের চেয়ে রাতে ভালো দেখতে পাচ্ছে? যদি কোনও যন্ত্রের সাহায্যে এমন ক্ষমতা ওরা পেয়ে থাকে, তাহলে সেই যন্ত্র দিনের বেলায় ব্যবহার করছে না কেন? তাহলে তো অনেক বেশি শিকার পেয়ে যেত। আরও অনেকগুণে টেরিফাই করে দিতে পারত আমাদের।
রতন বৈদ্য বললেন, জানি না এর উত্তর কবে খুঁজে পাব। তবে আপাতত আজ থেকেই আপনি ওদিকের জঙ্গলে, মানে যেখান থেকে ভুটান পাহাড় দেখা যায় সেদিকে লোক যাতায়াত বন্ধ করে দিন। দিনে এবং রাতে।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রমিত বলল এটাই পোচাররা অনেকদিন ধরে চাইছিল– আমাদের ভয় পাইয়ে দিতে, আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে। আমি ওদের চারজনকে নিয়ে একটা ফাইট দিচ্ছিলাম। যুদ্ধটা আজকে শেষ হয়ে গেল। শুধু যদি বুঝতে পারতাম, কোন অস্ত্রের কাছে হারলাম!
.
০২.
বাবুয়া সন্দীপেরা যেদিন খুন হল তার পরে আরও চারটে দিন কেটে গেছে। মাঝের দিনগুলোয় মিডিয়ায় প্রবল হইচই হয়েছে ব্যাপারটা নিয়ে। উত্তরবঙ্গে তো বটেই, কলকাতার কাগজগুলোতেও একসঙ্গে তিনজন ফরেস্টগার্ডের খুন হওয়ার খবর যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রমিতকে প্রথম দুদিনে বেশ কয়েকবার টিভি ক্যামেরা ফেস করতে হয়েছে। প্রত্যেকবারই প্রবল। অস্বস্তি নিয়ে সে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিল। মিডিয়ার সামনে নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় মনে হয়েছিল তার।
সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রমিতের প্রশ্নোত্তরের পালাটা ছিল মোটামুটি এইরকম—
কারা মারল ওই তিনজনকে?
প্রমিত জানাতে বাধ্য হয়েছিল, এর উত্তর সে জানে না।
পরের প্রশ্ন–এই ঘটনার পরে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট কর্মীদের সুরক্ষার জন্যে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে?
প্রমিত বলেছিল, আপাতত আমরা নাইট-পেট্রোলিং বন্ধ রাখছি।
প্রমিতের এই উত্তর শুনে সাংবাদিকদের মুখগুলো বাঁকা হাসিতে ভরে গিয়েছিল। ছদ্ম বিনয়ের সঙ্গে তারা প্রশ্ন করেছিল তাহলে কি স্যার মাথায় যন্ত্রণা হলে মাথাটা কেটে ফেলাই একমাত্র রেমিডি? নাইট-পেট্রোলিং বন্ধ হয়ে গেলে বন্যপ্রাণীগুলোকে চোরাশিকারিদের হাত থেকে কে বাঁচাবে?
টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল প্রমিতের। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল–এই বনকে আমি আপনাদের থেকে কম ভালোবাসি না। গত দুবছর আমি ঘরবাড়ি ছেড়ে এই জঙ্গলে দিন রাত পড়ে থেকেছি সে শুধু মাইনের টাকা কটার জন্যে নয়, ওই ভালোবাসার টানে। বলতে ইচ্ছে করছিল–যে তিনটে ছেলের খুন হওয়ার খবর পেয়ে আপনারা আজ এখানে এসেছেন, তাদের আমিই সারা ভারতের ফরেস্ট সার্ভিস থেকে বেছে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। রাতের পর রাত আমি ওদের সঙ্গে এই জঙ্গলের রাস্তায় গুঁড়ি মেরে হেঁটেছি, ওদের এই জঙ্গল চেনাবার জন্যে। একটা পাঁউরুটি ছিঁড়ে চারজনে ভাগ করে খেয়েছি; একই বোতল থেকে জল। একটা বোল্ডারে হেলান দিয়ে বসে চারজনে সারারাত রিভারবেডের ঘাসজমির দিকে চেয়ে থেকেছি, যাতে বন্য জন্তুরা নিরাপদে গ্রেজিং করে ভোরবেলা জঙ্গলে ফিরে যেতে পারে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব? এইভাবে যেখানে টেররিস্টরা নিখুঁত লক্ষে মানুষ মারছে, সেখানে রাতের পর ওদিকে কারুর পা ফেলা মানে তো আত্মহত্যা করা।
সেসব কিছুই বলেনি প্রমিত। সরকারি কর্মীর আচরণবিধি মেনে শান্ত থেকেছে। বলেছে, আর একটু সময় দিন আমাদের। এভরিথিং উইল কাম আন্ডার কন্ট্রোল।
বলেছে বটে এ কথা। কিন্তু সে নিজেও জানে না কেমন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে হরিণডুবি বিট-কে, বক্সা টাইগার রিজার্ভকে।
তবে গতকাল থেকেই প্রমিত বুঝতে পারছিল যে, মিডিয়ার কৌতূহল অনেক কমে এসেছে। স্বাভাবিক। এক খবর নিয়ে বেশিদিন বাণিজ্য হয় না।
প্রমিত আজ সকাল নটা নাগাদ নিজের মারুতি জিপসিটা নিয়ে জলপাইগুড়ি গিয়েছিল। গিয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলার ডেপুটি সুপারিন্টেডেন্ট অফ পুলিশ দেবেশ কাশ্যপের ফোন পেয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। দশটার মধ্যে দেবেশ কাশ্যপের বাংলোয় পৌঁছিয়ে গিয়েছিল প্রমিত। বাংলোতেই আসতে বলেছিলেন কাশ্যপসাহেব। সেখানেও তাঁর একটা অফিস আছে, ডিস্ট্রিক্টের। যে-কোনও বড় মাপের অফিসারের যেমন থাকে।