মধু যেটা ভুল করেছিল সেটা হল, ও গোঁয়ারের মতই সবই চেয়েছিল। নিজের ড্রাগের ব্যবসার জন্যে জঙ্গলের প্রহরাহীন পথ, বিনতার আর আপনার ব্যবসার হিস্যা…আর বিনতার শরীর।
তাই, আমার ধারণা মধু বর্মনকে আপনিই ফাঁসিয়েছেন। এর পেছনে শুধু ব্যবসায়িক আক্রোশ নয়, যৌন ঈর্ষাও কাজ করেছিল। মধুরও ধারণা তাই।
আর তারপর আপনি হঠাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু মধু নয়, বিনতাও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। কারণ বিনতার ডানহাত মধুকে আপনি ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। অথচ শিরোমণির গড় নিয়ে প্রমিত ব্যানার্জিকে চাপে ফেলার মতন জায়গায় আপনি নিজে নেই, সেখানে আপনাকে প্রকৃতিবান্ধব ভাবমূর্তি বজায় রেখে চলতে হয়। আপনার ভয় হল, বিনতা যদি কোনোভাবে আপনার আসল রূপটা আমাদের কাছে প্রকাশ করে দেন? অবশ্য বিনতা মেহরা শুধু আপনার চোরাশিকারের ব্যবসার কথা আর টেররিস্টদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগের কথাটাই জানতেন। বিমল বাবুয়াদের আপনি কিভাবে মেরেছিলেন, তা উনি জানতেন না। জানলে নিজে মরতেন। না।
সাধারনত খুন করলে সবারই ধরা পড়ার একটা ভয় থাকে। সেটাই অনেক সময় ক্রাইমটা ঘটিয়ে ফেলার থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে। আপনি কিন্তু একেবারে নিশ্চিত ছিলেন যে, কেউ আপনাকে ধরতে পারবে না। কারণ, গুলি চলছে কোথা থেকে, আর আপনি কোথায়? অতএব আপনি নিশ্চিন্তে চতুর্থ খুনটির প্রস্তুতি নিলেন।
কিন্তু বিনতার তো কম্যান্ডো ট্রেনিং নেই। সে স্বেচ্ছায় ওই ফাঙ্গাস আবাদের ওপর বিমল বাবুয়াদের মতন বুকে হেঁটে কোথাও যাবে না। তাহলে উপায়?
এক ধরণের মাকড়শার কথা শুনেছি যাদের মধ্যে স্ত্রী-প্রাণীটি সঙ্গমের শেষে পুরুষটিকে মেরে ফেলে। আপনি কাছাকাছি একটা কাজ করলেন। এমন জায়গায় বিনতা মেহরার সঙ্গে মিলিত হলেন যাতে মিলনের শেষে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আলোয় ঝলমল করে উঠল তার আদুল পিঠ। তারপরে যা হল আমরা সকলেই জানি।
বিনতার শরীর থেকে সংগৃহীত যে স্পার্মের স্যাম্পেল আমাদের কাছে রাখা আছে, পরশু অবধি জানতাম না কোন পুরুষের স্পার্মের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখব। এখন জানি।
জঙ্গলের রাত গাঢ় হয়ে উঠছিল। জেগে উঠছিল জঙ্গল। জেগে উঠছিল ঝিঁঝির শব্দে, হাতির চিৎকারে। জেগে উঠছিল দেবেশ কাশ্যপের জিপের আশেপাশের ঝোঁপঝাড় থেকে ভেসে আসা নানান নিশাচর প্রাণীর যাতায়াতের খসখসানিতে।
বিশাল বিশাল শাল সেগুনের গুঁড়িগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে নদীর চরের নীলচে কুয়াশা হুহু করে ঢুকে আসছিল অরণ্যের অন্দরে। দ্যুতি তার ওড়নাটা কান মাথা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে প্রমিত অবাক হয়ে ভাবল, এই ক্ষীণজীবী মেয়েটাই কি এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল! আশ্চর্য!
.
আপনি কিছু বলবেন না মিস্টার শইকিয়া? কোনও ফাঁক নেই, কোনও ভুল নেই আমরা এতক্ষণ যা বললাম তার মধ্যে?
রূপেন শইকিয়া উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি সেইভাবেই তাকিয়ে রইলেন। তার শরীর একটুও নড়ল না। দেবেশ কাশ্যপের এই প্রশ্নে শুধু তার ঠোঁটদুটো নড়ে উঠল–
আমার একটা আট বছরের মেয়ে রয়েছে জানেন? সে তার বাবাকে ভাবে সুপারম্যান। পৃথিবীর যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে একা লড়ে যেতে পারে।
আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন আমি সামান্য একজন স্কুলশিক্ষক। তবু অনুরাধা, মানে আমার স্ত্রী প্রচণ্ড গর্বিত হয়েছিল একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষের স্ত্রী হতে পেরে। আজও সে আমার ধনদৌলত নয়, আমার বিদ্যার গরবেই গরবিনী।
আমার বৃদ্ধ বাবা এখনও বেঁচে আছেন। জীবনে যত জনহিতকর কাজ করেছি, বিশ্বাস করুন, তার সবটাই ফাঁকি ছিল না। সবটাই যে নিজের ধান্দায় করেছি তা নয়। অনেকটাই করেছি বাবাকে খুশি করার জন্যে।
এমন কি বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, টেররিস্টদের সঙ্গে প্রথম যখন যোগাযোগ করি সেটাও ওদের আদর্শের প্রতি সহমর্মিতা থেকে, অন্য কিছু নয়।
কিন্তু তারপরে কী যে হয়ে গেল! পয়সার নেশা ভূতের মতন ঘাড়ে চেপে বসল। আর তার সঙ্গে ছিল আপনাদের বোকা বানাবার নেশা। এই যে নিজে আড়ালে থেকে একটা আস্ত সাম্রাজ্য শাসন করছি, পুলিশ মিলিটারি সবাইকে ঘোল খাওয়াচ্ছি–এত ভালো লাগত এই ব্যাপারটা যে কি বলব।
হ্যাটস অফ টু ইউ দ্যুতি। ইনফর্মেশন অনেকের কাছেই থাকে। কিন্তু সেই ইনফর্মেশনগুলোকে কাজে লাগাতে পারে কজন? তুমি যে এত তাড়াতাড়ি বায়োলুমিনিসেন্সের ব্যাপারটা ধরে ফেলবে বুঝিনি। তোমার চেহারার মধ্যে এমন একটা সাদামাটা ব্যাপার আছে যেটা খুব মিসলিডিং। আমি…আমি স্বীকার করছি, তোমাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিলাম। না হলে নিজেই কখনও তোমাকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরি? সেটাই আমার একমাত্র ব্লান্ডার।
তবু তুমিও একটা খুব ভাইটাল ব্যাপার ধরতে পারোনি দ্যুতি। সেটা ধরতে পারলে তোমরা বুঝতে পারতে আমারও একজন বস রয়েছেন। তিনি তোমাদেরও বস। ডাবল-এজেন্ট কথাটা শুনেছ? তিনি সেই ডাবল-এজেন্ট।
দ্যুতি, প্রমিত এবং দেবেশ কাশ্যপ একসঙ্গে বলে উঠলেন–কে?
আমি বললেই কি বিশ্বাস করবে? প্রমাণ লাগবে না? প্রমাণ রয়েছে ওইখানে। ওই ঘাসজমির মধ্যে, যেখানে বিনতা গুলি খেয়ে ছিটকে পড়েছিল। মিস্টার কাশ্যপ, অনুমতি দিন, একবার নামি। আপনি, আপনার গার্ডরাও চলুন না আমার সঙ্গে। পালাতে তো পারব না।