নিউগিনির সমুদ্রতটে ঢেউয়ের সঙ্গে সেদিন অমন কোটি কোটি পেরিডিনিয়ান আছড়ে পড়েছিল। যখনই কোনও জেলে তাদের মাড়িয়ে গেছে তখনই তাদের উত্তেজিত শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে। আমাদের বেচারা নৈশ প্রহরীটি তাকেই ভেবেছে দানবের পায়ের ছাপ।
পেরিডিনিয়ানের মতনই উজ্জ্বল আলো ছড়াতে পারে নানা ধরনের ব্যাঙের ছাতা, বা ফাঙ্গাস। অন্ধকার নামার পরে অনেকসময়ে একটা পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িকে হঠাৎ দেখলে মনে হয় তার গায়ে আগুন ধরে গেছে। তা নয়, আসলে ওই গুঁড়ির গায়ে গজিয়ে ওঠা ছত্রাকরা ছড়িয়ে দিচ্ছে জৈবপ্রভা।
এমনই ছত্রাক নিশ্চয় গজিয়ে উঠেছিল যাজকের দেখা সেই রাজহাঁসটার বাসায়। সেই ছত্রাক থেকে পাখিটার পালকে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল আলো ছড়ানো গুড়ো। সাধারন বুনো হাঁসটাকেই সেই আলো যাজকের চোখে বানিয়ে দিয়েছিল যমদূত।
ডক্টর শইকিয়া, এই জঙ্গলের আদিবাসীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। আপনি তাদের ঘরের লোক। কাজেই শিরোমণির গড় সম্বন্ধে নানান অলৌকিক গল্প আপনার অজানা থাকতেই পারে না। আপনিও কখনও না কখনও নিশ্চয় শুনেছিলেন ওই ধ্বংসাবশেষের পথে ফুটে ওঠা জ্বলন্ত পায়ের ছাপ কিম্বা আলোকিত ছেটখাটো প্রাণীদের কথা।
আপনি নিশ্চয় খেয়াল করেছিলেন যে আলোকিত বাঘ কিম্বা হাতি দেখতে পাওয়ার কথা ওরা কেউ বলে না। বলে বেজি কিম্বা সাপের কথাযারা মাটির সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে চলাফেরা করে।
দুইয়ে দুইয়ে চার করতে আপনার সময় লাগেনি। আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিরোমণির গড়ের পেছনের ওই পরিত্যক্ত পেছল পথে নিশ্চয় এমন কোনও উদ্ভিদের আবাদ আছে যারা বায়োলুমিনিসেন্ট; উত্তেজিত হলে জোরালো আলো ছড়ায়। আপনি খুঁজে বার করেছিলেন সেই উদ্ভিদ। খুব ছোট একধরনের ফাঙ্গাস, লালে আর খয়েরিতে মেশানো রঙ। মাটিতে পড়ে থাকলে মাটির থেকে আলাদা করে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু চাপ দিয়ে যদি একে ডলে দেওয়া হয় তাহলে কিছুক্ষণের জন্যে তীব্র লাল আলো ছড়িয়ে দেয় এই কণাগুলো। আর যখন অনেক এমন ফাঙ্গাস একসঙ্গে দলে যায় তখন মনে হয় যেন আগুন ধরে গেল সেই জায়গায়।
আমার ধারণা এই প্রজাতিটি বক্সার এই অঞ্চলে ছাড়া আর কোথাও হয় না। আপনিই এর আবিষ্কারক। কিন্তু আপনি বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে একে তুলে ধরলেন না। আবিষ্কারকের সম্মানের চেয়ে বড় প্রলোভন কাজ করল আপনার মনে। আপনি একে ব্যবহার করলেন মানুষ মারার ফাঁদ পাতবার কাজে। এমন এক জায়গায় এই ছত্রাককে ছড়িয়ে দিলেন, যেখান দিয়ে ফরেস্টগার্ডরা বুকে হেঁটে যাবেই। যাতে যায় সেই ব্যবস্থাও করলেন, দুবার ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলেন ওই ফাঙ্গাসের আবাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আপনার ফাঁদে পা দিল বিমল বাবুয়ারা।
ওরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সাবধানে এগিয়ে গেল। সামনে ফাঁকা রিভারবেড। ওখানে চারিদিক না দেখে বেরিয়ে পড়া যাবে না। ওরা শুয়ে পড়ল, ক্রল করে এগিয়ে গেল নদীর সীমানা অবধি। না, কেউ কোথাও নেই। ওরা উঠে দাঁড়াল।
ওরা অবাক হয়ে দেখল, ওদের শরীরের সামনের দিকটা আগুনের মতন উজ্জ্বল লাল আভা ছড়াচ্ছে কাঁধ থেকে পা অবধি।
উল্টোদিকের পাহাড়ে নিশ্চয় অত্যাধুনিক রাইফেল নিয়ে তৈরিই ছিল ঘাতকের দল। বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই তাদের বুলেট এসে শুইয়ে দিল তিন ফরেস্টগার্ডকে।
.
এবার আমি বলি। বললেন দেবেশ কাশ্যপ। কারণ, এই কথাগুলো আজকেই গুয়াহাটি থেকে আসা রিপোর্টে জানতে পেরেছি। দ্যুতি বা প্রমিত এখনও জানে না।
বিনতা মেহরার বিয়ের আগের নাম বিনতা বড়ুয়া। উনিও অসমের মেয়ে। বিয়ের পরেও মারমেড গ্রুপের নর্থ-ইস্টের প্রোজেক্টগুলোই উনি দেখতেন। সম্ভবত এই সময়েই আপনার সঙ্গে ওনার আলাপ, এবং আলাপ থেকে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের মধ্যে কোথাও প্রেম ছিল না, ছিল বিশুদ্ধ লেনাদেনার সম্পর্ক। শারীরিক লেনদেন এবং আর্থিক। বিনতার সুপুরুষে আসক্তি সর্বজনবিদিত, আর আপনি যে সুপুরুষ এ কথা তো অন্ধেও স্বীকার করবে। আর্থিক লেনদেনের পুরো হিসেবটা এখনও পাই নি। তবে বিনতাদের এক্সপোর্ট হাউসের মাধ্যমেই যে পশু-চামড়ার বেশ কিছু গোপন কনসাইনমেন্ট বাইরে গেছে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।
বিনতার উপকার করার জন্যে ততটা নয়, যতটা আপনি হরিণডুবির ভরাডুবি ঘটানোর জন্যে বিনতাকে এখানে টেনে এনেছিলেন। হ্যাঁ, আপনিই ওকে শিরোমণির গড়ের বর্ণনা দিয়েছিলেন; ওর মাথায় ঢুকিয়েছিলেন এখানে অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম গড়ে তোলার মতলব। আপনাদের সার্ভিস-প্রোভাইডারদের কাছ থেকে মোবাইলের যে কলগ পেয়েছি, তার থেকে সেরকমই জানা যাচ্ছে। আপনি চেয়েছিলেন বক্সা টাইগার রিজার্ভের আঁটোসাঁটো দেওয়ালে একটা বড় ফাটল ধরাতে। সেই ফাটলটাই হত ওই হেমিংওয়ে রিসর্ট। ভবিষ্যতে ওই পথেই আপনার চোরাকারবার আরও মসৃণ হয়ে উঠত।
একই মতলবে আপনি দলে টেনেছিলেন ড্রাগ ব্যবসায়ী মধু বর্মনকে। মধু আর বিনতার জোড়া আক্রমনের সামনে ধ্বসে যাক বক্সার প্রতিরোধ–এটাই ছিল আপনার মনোগত বাসনা।
মধুকে ইন্টারোগেট করেছি। ওই ফাঙ্গাসের গুঁড়ো মধুই আপনাকে জঙ্গল থেকে জোগাড় করে দিত। তার বিনিময়ে আপনি ওকে পয়সা দিতেন। প্রচুর পয়সা। সেরকমই এক লেনদেনের সময়ে বেচারি গুলাবি শিরোমণির গড়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে তাকে মরতে হল। এই সবই মধুকে ইন্টারোগেট করে জানতে পেরেছিলাম।