জিপটা রওনা হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরে রূপেন ডাকলেন, কাশ্যপ সাহেব! দেখা গেল তার গলায় পুরোনো দাপটের অনেকটাই আবার ফিরে এসেছে।
বলুন! বললেন দেবেশ কাশ্যপ।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি এটাই যে, আমার দুটো বাড়ি আর তিনটে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে? ধনী হওয়াটা কি ক্রিমিনাল অফেন্স, যে আমাকে এইভাবে পুলিশ পাহারায় গাড়িতে তুললেন?
দেবেশ কাশ্যপ বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ক্রিমিনাল অফেন্সের অভাব কি, মিস্টার শইকিয়া? এখানে আসার আগে অবধি টেলিফোনে গুয়াহাটি থেকে যেটুকু জানতে পেরেছি, বলি। আপনার তিনসুকিয়ার বাড়ির একটা লুকনো সেলার থেকে চারটে চিতার চামড়া পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে একটা দুষ্প্রাপ্য ক্লাউডেড লেপার্ডের। সম্ভবত নামডাফা স্যাংচুয়ারি থেকে জন্তুটাকে মেরেছিল আপনার পোষা চোরাশিকারিরা। গুয়াহাটির বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে গন্ডারের খড়গ আর হরিণের শিং।
তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার দেখা গেছে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে। দেখা গেছে ফরেস্ট প্রোডাক্ট রফতানি করে আপনার ব্যাবসায় যে পরিমান বিদেশী টাকা এসেছে অত পরিমাণ মাল আপনি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে কেনেনই নি। তাহলে কিসের জন্যে টাকাটা পেলেন? জন্তুর চামড়া বিক্রি করে কি?
আবার উল্টো দিকে, ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে আপনি বহু টাকা পেমেন্ট করেছেন চীন আর প্যালেস্টাইনের কয়েকটা কোম্পানির নামে। ওই টাকা না কি আপনি দিয়েছিলেন ওদের কাছ থেকে মেশিন-পার্টর্স আমদানি করেছিলেন বলে। অথচ আপনার কোনও কারখানাই নেই।
চীন আর প্যালেস্টাইন থেকে কী নিয়ে এসেছিলেন মিস্টার শইকিয়া? এ কে ফর্টিসেভেন? ইনস্যাস?
আপনার দুপাশে পুলিশ বসিয়ে রাখাটা কি জাস্টিফাই করতে পারলাম, মিস্টার শইকিয়া? না না। আপনাকে এখনই এর কোনোটার ব্যাখ্যা দিতে হবে না। জেলখানায় বসে এসবের বিশ্বাসযোগ্য উত্তর বানানোর চেষ্টা আপনি করবেন। ও, বলা হয়নি বুঝি, আপনার অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আমার পকেটেই রয়েছে।
রূপেন শইকিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তা হলে অ্যারেস্ট করে কোর্টে প্রোডিউস করলেই ভালো হত না? অ্যাটলিস্ট আমার উকিলের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা পেতাম। তা না করে, এখন কোন ছেলেখেলা করবার জন্যে আমরা নদীর দিকে যাচ্ছি? তেঁতো স্বরে জিগ্যেস করলেন রূপেন শইকিয়া।
সত্যিই ততক্ষণে গাড়িটা জঙ্গল ভেঙে সেই রাস্তাটায় এসে উঠেছে, যার শেষ মাথায়, বনের শেষে, জয়ন্তীর জলের চিকিমিকি দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। জঙ্গল জেগে উঠছে। শুরু হয়ে গেছে নাইটজারদের অবিরাম টঙ্ক টঙ্ক চিৎকার, ঝিঁঝিপোকাদের কনসার্ট। শিরোমণির গড়ের দিক থেকে একবার একটা দাঁতালের ক্রুদ্ধ চিৎকারও শুনতে পাওয়া গেল।
ওই নদীর কিনারাতেই গত পনেরোদিনে চারটে মানুষ খুন হয়েছে। এইরকম অন্ধকারের মধ্যেই।
গাড়িটা সেই কিনারা থেকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে দেবেশ কাশ্যপ ঘুরে তাকালেন রূপেন ইকিয়ার দিকে। তারপর বললেন, মিস্টার শইকিয়া, আরও একটা ক্রিমিনাল অফেন্সের কথা আপনাকে বলা হয়নি। সেইটা বলব বলেই এখানে নিয়ে এলাম আপনাকে। দেখুন, আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই ঘন জঙ্গলে ঢাকা টিলাটা, যার মাথায় শিরোমণির গড়ের ধ্বংসাবশেষ। আপনার সামনে কুয়াশায় মোড়া জয়ন্তী নদীর বিস্তীর্ণ চর। নদীর ওপাড়ে এক পাল প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে ভুটান পাহাড়ের সারি, উত্তুরে হাওয়া যেন ওদেরই নিশ্বাস। এই তো সেই রঙ্গমঞ্চ, যেখানে আপনি এক নারকীয় নাট্যপালার সূচনা করেছিলেন।
সুন্দর এগিয়ে চলেছিল সেই নাটকটা। আপনি যেমনটা ভেবেছিলেন সেইভাবেই নিশ্চয় শেষ হত। শুধু গন্ডগোলটা কোথায় হয়ে গেল জানেন? আপনার স্ক্রিপ্টে নাম ছিল না এমন একটি চরিত্র মাঝখান থেকে ঢুকে পড়ল। একটি নারী চরিত্র নাম দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত, দ্যুতি। সে আসার পরেই গল্পটা আপনার হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল।
এইখানে দাঁড়িয়ে, এই মুহূর্তেই আমরা আপনার সেই নাটকটার ওপর যবনিকা ফেলব। আর নাটকের শেষ সংলাপগুলো শুরু করার সম্মান আর কে-ই বা পেতে পারে, দ্যুতি ছাড়া?
নাও দ্যুতি শুরু কর!
.
১৭.
দ্যুতি বলল, ডক্টর শইকিয়া, আপনাকে কিছু শেখানোর স্পর্ধা আমার নেই। আপনার পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। শুধু আমার ধারণাগুলো সত্যি কি না সেটুকু জানবার জন্যেই আপনাকে এই কথাগুলো বলছিঃ
আপনিও নিশ্চয় ক্লাসরুমে আপনার ছাত্রছাত্রীদের কখনও শুনিয়েছেন স্টারইয়া লাডোগার জ্বলন্ত রাজহাঁসের গল্প, কিম্বা নিউগিনির সমুদ্রতটে জ্বলন্ত পায়ের ছাপের রহস্য। অবাক ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে ক্লাসের শেষদিকে এসে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন এই আপাত অলৌকিক ব্যাপারগুলোর পেছনে কেমনভাবে কাজ করেছিল এক ন্যাচারাল ফেনোমেনন, যার নাম বায়োলুমিনিসেন্স।
বায়োলুমিনিসেন্স বা জৈবপ্রভা জীবজগতের এক আশ্চর্য ঘটনা। এই পৃথিবীতে প্রায় এগারোশো প্রাণী এবং উদ্ভিদ নিজেদের শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরণ করতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ জোনাকি।
এই ধরণের জীবদের মধ্যে সংখ্যায় যারা সবচেয়ে বেশি তাদের নাম পেরিডিনিয়ান– সমুদ্রে বসবাসকারী খুব ছোট একধরনের উদ্ভিদ। উত্তেজিত হলে পেরিডিনিয়ানের শরীর থেকে উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয়। অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে একটা জাহাজ যখন এগিয়ে যায়, তখন কখনও কখনও দেখা যায় তার দুধারে জলতল আলোয় ঝলমল করে উঠছে। এ আর কিছুই নয়, কোটি কোটি উত্তেজিত পেরিডিনিয়ানের জৈবপ্রভা। রাতের সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে ডুবুরিরা মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হয়ে দেখেন তাদের হাত পায়ের প্রত্যেকটা নড়াচড়ায় কেমন করে আলোর ঢেউ ফুলে ফেঁপে উঠছে। এ-ও ওই পেরিডিনিয়ানের ম্যাজিক।