একবার অপাঙ্গে প্রমিতের দিকে চেয়ে দেবেশ কাশ্যপ কথাটা শেষ করলেন মিস্টার ব্যানার্জি তোমাকে যাই বোঝান, ওনার কোয়ার্টারে রাত কাটানোটাও তোমার পক্ষে ইকুয়ালি বিপজ্জনক।
ছিঃ! লজ্জায় দু-হাতে মুখ ঢাকল দ্যুতি।
.
১৬.
পরের দেড়খানা দিন প্রমিত, দ্যুতি এবং সর্বোপরি দেবেশ কাশ্যপের প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। শুধু পুলিশ নয়, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট এমনকি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সকে অবধি চেতিয়ে তুলে বিভিন্ন কাজে লাগানো–এটা খুব সহজ কথা নয়।
বড় সাফল্য এল মধু বর্মন ধরা পড়ায়। তাকে জয়গাঁর একটা বস্তি থেকে তুলে আনল জলপাইগুড়ি পুলিশ। ইন্টারোগেট করলেন দেবেশ কাশ্যপ নিজে।
ইতিমধ্যে হরিণডুবির জঙ্গলে মারা পড়ল একটা টাস্কার, অর্থাৎ দাঁতাল হাতি, যার দাঁত দুটো চোরাশিকারিরা কেটে নিয়ে গেছে।
দেড়দিনের মাথায়, দুপুরের দিকে একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছোকরা হরিণডুবি বনবাংলোয় এসে রূপেন শইকিয়ার খোঁজ করল। রূপেন সেই মুহূর্তে বাংলোয় ছিলেন না। ছেলেটা অপেক্ষা করে রইল। রূপেনের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। ছেলেটা তাকে দেখেই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখে তার কানে কানে কি সব বলে চট করে কেটে পড়ল।
ছেলেটা চলে যাওয়ার পরে দেখা গেল রূপেন শইকিয়া কিছুক্ষণ থম হয়ে বসে রইলেন। তারপর বাংলোর বেয়ারাকে ডেকে বললেন ঘর থেকে তার জিনিসপত্রগুলো বারান্দায় বের করে দিতে। তিনি তখনই বেরিয়ে পড়বেন।
একটু পরে দেখা গেল হরিণডুবি বনবাংলোর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রূপেন শইকিয়া বোলেরোর পেছনের দরজাটা খুলে সেখানে তার সংগৃহীত গাছপালার স্যাম্পেলের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে রাখছেন।
কিছুক্ষণ ধরে একটা অন্য গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। দূর থেকে জঙ্গলের পথ ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছিল গাড়িটা। রূপেন শইকিয়া, কি জানি কেন, কাজ সারতে সারতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেইদিকে তাকাচ্ছিলেন। তার ভঙ্গিতে স্পষ্ট উদ্বেগ।
একটা বাঁক ঘোরার পরেই জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে গাড়িটা উঠে এল বাংলোর সামনের সোজা রাস্তাটায়। গাড়িটা নয়, গাড়িদুটো। একটা প্রমিতের জিপসি, আরেকটা পুলিশের উইলি জিপ। দুটো গাড়ি এসে বোলেরোর দুপাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। একটা গাড়ি থেকে নেমে এল প্রমিত এবং দ্যুতি, আরেকটা থেকে দেবেশ কাশ্যপ। তাদের দেখে গাড়ির ডিকিতে মাল তোলা বন্ধ রেখে, রূপেন শইকিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তার মুখে বেশ চওড়া হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আরে কী ব্যাপার? এই বিকেলে সবাই একসঙ্গে জঙ্গলে? এটা তো পিকনিকের সময় নয়।
কেন নয়, মিস্টার শইকিয়া? জঙ্গলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা প্রমিত ব্যানার্জি যখন নিজেই উপস্থিত, তখন এনি টাইম ইজ পিকনিক টাইম। চলুন!
শেষ শব্দটার মধ্যে এমন একটা আদেশের সুর ছিল যে, রূপেনের ঠোঁট থেকে হাসিটা সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল। তার জায়গায় জেগে উঠল স্পষ্ট প্রতিরোধ।
কোথায় যাব? দেখছেন না, আমি এখন বাড়ি রওনা হচ্ছি? যাওয়া টাওয়া সব আবার পরের বার হবে, নেক্সট টাইম। দেবেশ কাশ্যপের প্রতি তাচ্ছিল্যটা জোরদার করতেই যেন রূপেন বাঁ-হাতের এক জোরালো ধাক্কায় বোলেরোর পেছনের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল। তারপর ঘাড় উঁচু করে এগিয়ে গেল গাড়ির সামনের দিকে, ড্রাইভারের সিটের দিকে।
পেছন থেকে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বাড়ি গিয়ে এখন কি কিছু লাভ হবে মিস্টার শইকিয়া?
মানে? রূপেনের প্রত্যয়ী ভঙ্গিটা এই একটা কথাতেই বদলে গেল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন দেবেশ কাশ্যপের দিকে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?
মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, বলতে চাইছি, এখন বাড়ি ফিরে তো মোটেই শান্তি পাবেন না। শুনলাম, ওরা আপনার বাড়ির সমস্ত ফার্নিচার এদিক থেকে ওদিক করে দিয়েছে, আলমারি থেকে সমস্ত কাগজ মেঝেতে নামিয়ে ফেলেছে, এমন কি বিছানার গদিগুলো অবধি না কি মাঝখান থেকে চিরে ফেলেছে।
কারা? অদ্ভুত ফ্যাসফ্যাঁসে গলায় জিগ্যেস করলেন রূপেন শইকিয়া। তার চওড়া কাঁধ দুটো এই মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে শরীরের দুপাশে ঝুলে পড়েছে। শীতের দিনেও ঘাম ফুটে উঠেছে কপালে।
সে কি, আপনি এখনও জানেন না! সি বি আইয়ের গোয়েন্দারা। ওরা কাল মাঝরাত থেকে আপনার গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া আর ইটানগরের তিনটে বাড়িতেই রেইড শুরু করেছে। আপনি যে ব্যাঙ্কের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটাবেন, তার উপায়ও ওরা রাখেনি। সেখানেও আপনার তিনটে ব্যাঙ্কের লকার খুলে ওরা, মানে সি বি আইয়ের লোকেরা সব গয়নাগাটি, ক্যাশ টাকা এইসবের লিস্ট বানাচ্ছে।
তাই বলছিলাম কি এখন বাড়ি না ফিরে যদি একটু আমাদের সঙ্গে পিকনিক-ই করে। আসেন, তাহলে কেমন হয়?
কাশ্যপের চোখের ইশারায় জিপ থেকে দুজন বন্দুকধারী কনস্টেবল নেমে এসে রূপেনের দুদিকে দাঁড়াল। তবে বলপ্রয়োগের দরকার পড়ল না। রূপেন নিজে থেকেই তাদের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে জিপের পেছনের সিটে বসলেন। সামনের সিটে ড্রাইভারের আসনে বসলেন দেবেশ কাশ্যপ, তার পাশে একটু ঠাসঠাসি করেই প্রমিত আর দ্যুতি। প্রমিতের আর রূপেনের গাড়িদুটো হরিণডুবি বাংলোর সামনেই দাঁড়িয়ে রইল।