সন আঠেরোশো চৌষট্টি। রাশিয়ার স্টারইয়া লাডোগার সেন্ট জর্জ চার্চের এক ব্যাভিচারী যাজক পানশালা থেকে আকণ্ঠ মদ খেয়ে চার্চে ফিরছিলেন। রাত হয়ে গেছে অনেক। চারিদিকে নিকষ অন্ধকার।
যাজকের পা টলছে। মনে তার প্রচণ্ড পাপবোধ। চার্চের প্রধান রোজই তাকে এই ব্যাভিচারের জন্যে তিরস্কার করছেন, ভয় দেখাচ্ছেন নরকবাসের, তবু তিনি কিছুতেই নেশা আর নারী থেকে দূরে থাকতে পারছেন না। ঈশ্বর তার এই জীবনধারাকে ক্ষমা করবেন?
ভাবতেই ভাবতেই তিনি যেন তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলেন। অন্ধকার দিগন্ত থেকে একটা আগুনের গোলা নিঃশব্দে কিন্তু প্রচণ্ড গতিতে সেই যাজকের দিকে ভেসে এল।
শয়তান! শয়তানই নিশ্চয় তার অনুচরকে পাঠিয়েছে তাকে টেনে হিঁচড়ে নরকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। যাজক তৎক্ষণাৎ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে উচ্চৈঃস্বরে প্রার্থনা শুরু করে দিলেন– হে প্রভু, রক্ষা কর, রক্ষা কর এই পাপীকে।
সেই প্রার্থনার জেরেই নিশ্চয়, আগুনের গোলাটা তাকে না ছুঁয়ে একটু দূর দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে অন্য দিগন্তে মিলিয়ে গেল। যাবার সময় খুব কাছ থেকে একবার তার চেহারাটা দেখতে পেয়েছিলেন সেই যাজক হাঁসের মূর্তি ধরে এসেছিল শয়তানের অনুচর। জ্বলন্ত এক রাজহাঁস।
দ্বিতীয় গল্পটাও অনেকটা একই রকমের। সেই রাশিয়ান যাজকের মতোই আতঙ্কে অধীর হয়ে গিয়েছিল এক ডাচ নৈশপ্রহরী। সময়টা উনবিংশ শতকের গোড়ায়। পাপুয়া নিউগিনিতে তখন ওলন্দাজরা সবে উপনিবেশ গড়ে তুলছে, আর নখে দাঁতে তাদের বাধা দিচ্ছে সেখানকার স্বাধীনতাপ্রিয় আদিবাসীরা। যখন তখন ডাচদের গড়ে তোলা ছোট শহরগুলোকে বিষাক্ত তীরধনুক নিয়ে আক্রমণ করছে তারা। তাদের ভয়েই শহরগুলোর সীমানার বাইরে সারা রাত নৈশপ্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এই গল্পের নায়ক ছিল তেমনই এক নৈশপ্রহরী।
সেই রাতটা ছিল মেঘে ঢাকা। চোখের দৃষ্টি চলে বেশি দূর। তাহলেও সেই নৈশপ্রহরীর একটুও অসুবিধে হল না পায়ের ছাপগুলো দেখতে।
কেন হবে? সেগুলো যে আগুন দিয়ে আঁকা পায়ের ছাপ। একটা একটা করে অমন জ্বলন্ত পায়ের ছাপ সমুদ্র থেকে উঠে ভিজে বালির বালিয়াড়ি পেরিয়ে আসছে শহরের দিকে। এ কোন অশরীরি সামুদ্রিক দানব তাদের শহরকে গিলে খেতে আসছে! প্রাণভয়ে চিৎকার করতে করতে প্রহরীটি শহরের লোকজনকে সতর্ক করতে দৌড়ল।
.
গল্প শেষ করে দ্যুতি মুচকি হেসে প্রমিতকে বলল, এরকম গল্প তুমি কদিন আগে একবার শোনোনি?
প্রমিত বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। সোনারু মাঝির মুখে। সে শিরোমণির গড়ের পেছনদিকের রাস্তায় কখনও কখনও আলোমাখা বেজি কিম্বা সাপকে দৌড়োদৌড়ি করতে দেখেছে।
আমিও আজ এরকম একটা গল্প শুনেছি, মিনাজুড়ি গ্রামের এক বুড়ির কাছ থেকে। সে ওই একই রাস্তায় জ্বলন্ত পায়ের ছাপ দেখেছিল।
আমি বোধহয় এই গল্পগুলোর রেলেভ্যান্স একটু একটু ধরতে পারছি। জ্বলন্ত পায়ের ছাপ..জ্বলন্ত প্রাণী। জ্বলন্ত মানুষ হতে পারে না? যদি হয় তাহলে তো সে সহজ টার্গেট। রাতের টার্গেট, ইয়েস! রাতের টার্গেট। এরকম কি হতে পারে দ্যুতি? উত্তেজিত দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতির সামনে ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করলেন। কিন্তু দ্যুতি উত্তর দেওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল।
কাশ্যপসাহেব উত্তর দিলেন হ্যালো। তারপর কিছুক্ষণ ওদিককার কথা মন দিয়ে শুনলেন। শেষকালে বললেন, আচ্ছা সামন্ত, তুমি নিজেই তাহলে প্যাকেটটা একবার আমার কোয়ার্টারে নিয়ে চলে এসো।
ফোনটা নামিয়ে রেখে কাশ্যপসাহেব দ্যুতির দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললেন, ইনক্রেডিবল। ইনস্পেক্টর সামন্তকে বলেছিলাম, মধু বর্মনের ঘরগুলো থেকে যে সব মাল সিজ করা হয়েছে, তার মধ্যে এই ডেসক্রিপশনের গুড়ো আছে কি না দেখতে। বলছে, আছে। নিয়ে আসছে।
দ্যুতি একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ওদের পোশাকেও এই গুঁড়োর চিহ্ন পাওয়া যাবে– বিমল বাবুয়াদের শার্টের বুকে। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, সত্ত্বার করার আগে যদি বিনতা মেহরার নগ্ন পিঠটা খুঁজে দেখা হত তাহলে সেখানেও পাওয়া যেত। আই অ্যাম সিওর অফ ইট। যখন গুলি চলে, তখন উনি ন্যুড ছিলেন। তাই ওনার পোশাকে নয়, ত্বকেই থাকত এই জিনিসটার রেসিডিউ।
আই হ্যাভ গট ইয়োর পয়েন্ট। বললেন দেবেশ কাশ্যপ।
মি টু। প্রমিত বলল তার মানে এই গুড়োটাই আলোকিত করে দিয়েছিল ওদের। কিন্তু এটা কী জিনিস দ্যুতি? কোথায় পেলে এই জিনিস?
কোথায় পেলাম? কাউকে বোলো না যেন। আজ আমাকে হরিণডুবি বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে মিস্টার শইকিয়া কোথায় যেন চলে গেলেন। সেই সময়টা কাজে লাগিয়ে আমি ওনার গাছ-গাছড়ার স্যাম্পেলের প্যাকেটগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে এটা পেয়ে গেলাম আর কি। জানতাম অবশ্য, পাবো।
আর জিনিসটার পরিচয়?
বলছি, দাঁড়াও।
আমি একটু ইন্টারাপট করছি, দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতিকে বললেন। এটাকে আমার আদেশ। বলেই ধরতে পারো। এখন থেকে যতক্ষণ না পুরো অপারেশনটা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তুমি, তুমিই বলছি, আমার মেয়ের সঙ্গে এই বাড়িতেই থাকবে। ও তোমার সমবয়সি, কাজেই কোনও অসুবিধে হবে না।
এখানে থাকতে বলছি কারণ, তোমাকে এখন এক দুদিন আমাদের খুব দরকার, অথচ হরিণডুবিতে তোমার ফিরে যাওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে। আর…