স্যার, মিস সেনগুপ্ত একটু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান, ওভার।
হ্যাঁ, ওনাকে দিন। কী ব্যাপার দ্যুতি?
দ্যুতি বলল, তুমি এক্ষুনি একবার আসতে পারবে?
কেন? কী ব্যাপার?
এখন কিছুই বলতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস কর, ব্যাপারটা খুব জরুরি। তুমি প্লিজ একবার এসো।
বেশ, আসছি। তুমি বাংলোতেই ওয়েট করো।
দ্যুতি হ্যান্ডসেটটা দত্তবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। প্রমিত বলল, ঠিক আছে দত্তবাবু, ওভার।
ওভার অ্যান্ড আউট।
দত্তবাবু বড় বড় চোখ করে দ্যুতির চলে যাওয়াটা দেখলেন। ব্যানার্জি সাহেবকে তুমি তুমি করে কথা বলছেন এই ম্যাডাম! চলে আসতে বলছে ওনার সঙ্গে দ্যাখা করবার জন্যে! ইসসস ছি ছি ছি। আগেই বোঝা উচিত ছিল। উচিত ছিল এক দুটো বড় সাইজের দেশি মুরগি বাংলোর রান্নাঘরে পাঠানো। অবশ্য সেরকম কিছু করলে, আর ব্যানার্জির্সাহেব সেটা জানতে পারলে, নিশ্চয় গালাগাল দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিতেন। এরকম অবস্থায় কী যে করণীয়? বুঝে উঠতে পারছিলেন না সজল দত্ত।
.
ঘন্টাখানেক পরে হরিণডুবি বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রমিতও একই কথা বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তার সামনেই দাঁড়িয়েছিল দ্যুতি। সারাদিন জঙ্গলের গ্রামে গ্রামে ঘোরার পরিষ্কার ছাপ তার চেহারায়। বোঝাই যাচ্ছে ফিরে এসে হাত মুখটা অবধি ধোয়নি। তবু প্রমিতের কথার কোনও জবাব না দিয়ে, তার হাত ধরে টানতে টানতে সে প্রমিতকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে এসে বলল, উঠে পড়ো। নিজেও এক মোচড়ে ড্রাইভিং-সিটের উলটোদিকে দরজাটা খুলে, প্রায় লাফ মেরেই গাড়িতে উঠে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, চল, চল, স্টার্ট দাও। একদম সময় নেই।
কোথায় যাব এবং কিসের সময় নেই?
যেতে যেতে সব বলেছি। তুমি আলিপুরদুয়ার চলো। কাশ্যপসাহেবের অফিসে। ওখানে গিয়েই সব বলব। তখনই বুঝবে, কেন বলছি একটুও সময় নেই।
দিন পনেরো আগে যে আত্মমগ্ন, থতোমতো খাওয়া মেয়েটাকে প্রথমবার তার অফিসের ভেতরে দেখেছিল, সেই মেয়েটাই যে কেমন করে এত বদলে গেল, তা ভেবে পায়না প্রমিত। দ্যুতিকে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছিল। তার গলায় ফুটে বেরোচ্ছিল কর্তৃত্বের সুর। সেই সুরকে প্রমিত উপেক্ষা করতে পারেনা। সে গাড়িতে স্টর্ট দিয়েছিল। কিন্তু তখনই দ্যুতি তার হাত চেপে ধরে বলেছিল, একমিনিট। একটা ভুল হয়ে গেছে। গাড়িটা একবার থামাও।
অবাক প্রমিত গাড়ি থামাতেই দ্যুতি আবার লাফ মেরে দৌড়ে ঢুকে গিয়েছিল বাংলোর মধ্যে। একটু বাদেই ফিরে এসেছিল।
কী ভুলে গিয়েছিলে? প্রশ্ন করল প্রমিত।
বাংলোর কেয়ারটেকারকে বলে এলাম, রূপেন শইকিয়া ফিরে এলে তাকে বলতে যে আমার জ্যাঠামশাই, মানে যিনি তোমাদের বড়সাহেব, তিনি হঠাৎ কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ারে এসেছেন অফিসের কাজে, এবং আমাকে দেখতে চেয়েছেন। তুমি তাই গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে এসেছ। একটু কাঁচা মিথ্যে হয়ে গেল, কিন্তু এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো কিছু মাথায় এল না।
.
১৫.
দ্যুতি আর প্রমিত যখন জলপাইগুড়িতে দেবেশ কাশ্যপের বাংলোয় পৌঁছল, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। কাশ্যপ সাহেবকে রাস্তা থেকেই প্রমিত ফোন করে জানিয়েছিল যে তারা আসছে। তাই তিনি আর অন্য ভিজিটর রাখেননি।
তিস্তার বাঁধের ধারে সাহেবি আমলের বিশাল বাংলোটার বাগানে একটা মস্ত অর্জুন গাছ। তার ডাল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় উড়ে যাচ্ছিল নৈশ অভিযানে।
দ্যুতি তাড়াতাড়ি প্রমিতের সঙ্গে কাশ্যপসাহেবের ড্রইংরুম কাম অফিসে ঢুকে পড়ল।
তিনজনে সোফায় বসার পর দ্যুতি তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বার। করে দেবেশ কাশ্যপের হাতে দিল। প্যাকেটটার ভেতরে লাল আর খয়েরি মেশানো অদ্ভুতদর্শণ কিছুটা গুঁড়ো পদার্থ ছাড়া আর কিছু নেই।
কী এটা? দেবেশ কাশ্যপ হাতের তালুর ওপর সেই গুঁড়ো কিছুটা ঢেলে নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এলেন। তারপর সাবধানে গন্ধ শুঁকেও দেখলেন। শেষকালে হতাশ হয়ে বললেন, নাঃ, আমি তো বুঝতে পারছি না এটা কী।
প্রমিত হাতটা বাড়িয়েছিল। তার হাতে গুঁড়োটা চালান করে দিয়ে দেবেশ কাশ্যপ আবার বললেন, এটা কি জিনিস ম্যাডাম?
বলছি। তার আগে আপনি আমার একটা উপকার করুন।
বলুন।
আপনি বলেছিলেন মধু বর্মনের ডেনগুলোতে আপনারা রেইড করেছিলেন। আপনার লোকদের বলুন ওইসব জায়গায় যা কিছু পেয়েছে তার মধ্যে ঠিক এইরকম গুঁড়ো ভরতি প্যাকেট ছিল কি না জানাতে। যদি পেয়ে থাকে তাহলে সেটাকে যেন যত্ন করে রেখে দেয়।
সামনের কফিটেবল থেকে ল্যান্ডফোনটা তুলে নিয়ে দেবেশ কাশ্যপ কাকে যেন ঠিক সেইরকম নির্দেশ দিলেন। তারপর ফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, আর?
বিমল, বাবুয়া, সন্দীপ আর মিসেস মেহরার জামাকাপড় এখনও পুলিশ কাস্টডিতেই থাকার কথা। ওগুলোকে আবার ফরেনসিক এক্সামিনেশনের জন্যে পাঠাতে হবে।
কী দেখতে হবে?
দেখতে হবে, ওই সব পোশাকে এই গুঁড়ো জিনিসটার কোনও ট্রেস পাওয়া যায় কি না।
আবারও ফোনে কিছু নির্দেশ গেল। তারপর দেবেশ কাশ্যপ দ্যুতিকে বললেন, নাউ ইট ইজ ইয়োর টার্ন টু এক্সপ্লেইন! এসব কী হচ্ছে একটু বুঝিয়ে বলুন দয়া করে।
বলছি কাশ্যপসাহেব। তার আগে দুটো গল্প বলি। গল্পদুটো শুনেছিলাম কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে, বটানির পাস ক্লাসে। নন্দিনী ম্যাডাম আমাদের বটানির একটা অদ্ভুত ফেনোমেনন বোঝাতে গিয়ে এগুলো বলেছিলেন। ভাগ্যিস বলেছিলেন। তাই তো ব্যাপারটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।