যাই হোক, তারপরে রাজা শিরোমণির এক পত্নীর অনাচারের কারণে দেবতা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আদিবাসীদের এত বড় রাজ্যপাট ছারখারে গেল।
তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়। শেষ কথা হচ্ছে, রাজা শিরোমণি তার অভিশাপের মেয়াদ শেষ হলে আবার ফিরে আসবেন।
কোথায় ফিরবেন, তা তো দ্যুতি এতদিনে জেনেই ফেলেছে–ওই শিরোমণির গড়ে, যেখানে চালতা গাছে চালতা পাকলে বুনো হাতিদের মহোৎসব শুরু হয়। সাঁই সাঁই শব্দে বনভূমি সচকিত করে এক ডাল থেকে আর এক ডালে উড়ে যায় গ্রেট হর্ণবিল। সেই শিরোমণির গড়েই না কি ফিরে আসবেন রাজা শিরোমণি। তাঁর সঙ্গে ফিরে আসবে পাইক বরকন্দাজ কামান মশাল; আলো হাসি গান; আদিবাসীদের সুসময়।
গল্পের এই জায়গাটায় পৌঁছে দ্যুতি একটু হেসে ফেলেছিল। বুড়ির সেটা চোখ এড়ায়নি। সে প্রশ্ন করল হাসছ কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
দ্যুতি এই সব গল্পের পেছনে ক্রিয়াশীল মনটাকে বুঝবার জন্যেই এখানে এসেছে। তাই বলল, না, বিশ্বাস হচ্ছে না তো। অতদিন আগে মরে যাওয়া মানুষজন ফেরে কখনও? তোমার বরও তো মরে গেছে। সে কি ফিরবে?
শোনো বেটি! রাজ্য শিরোমণির কথা আলাদা। হাত মুখ নেড়ে বলল বুড়ি। আমি নিজে দেখেছি…
কী দেখেছ?
দেখেছি রাজা শিরোমণি স্বর্গ থেকে এসে তার দুর্গবাড়িটি ঠিকঠাক আছে কি না দেখে যাচ্ছেন।
দ্যুতি আবার হেসে বলল। কীরকম দেখলে রাজা মশাইকে? গায়ে সোনার জামা? মাথায় হিরের মুকুট?
না না। সেসব এখন আসবে কোত্থেকে? তিনি এখনও শরীর ফিরে পাননি তো। অভিশাপ কাটেনি কি না।
তাহলে?
দেখলাম তার চলার পথে পায়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে–আলোয় আলোয়।
দ্যুতির শরীরটা এই কথায় মুহূর্তের মধ্যে শক্ত হয়ে গেল। সে গলা নামিয়ে বলল, কী দেখলে? আলোয় আলোয় পায়ের ছাপ? কখন দেখলে? কোথায়?
কি বলব, যারেই বলি কেউই বিশ্বাস তো করে না। এই তো গতবছর শ্রাবণ মাসের ঘটনা। গিয়েছিলাম শিরোমণির গড়ে বলি চরাতে, নাতি হয়েছিল তো তাই। আমাদের এই গ্রাম থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটুখানি তো পথ, তাই দেরি করেই বেরিয়েছিলাম। তারপর ফেরার সময় কি বৃষ্টিটাই যে নামল, ভাবলাম একটু অপেক্ষাই করে যাই, বৃষ্টিটা একটু ধরুক। এই করতে করতে অন্ধকার নেমে এল। তখন দেখলাম আর দেরি করা ঠিক হবে না। বেরিয়ে পড়লাম।
গড়ের পেছনদিকটায় একটা খুঁড়িপথ আছে, একেবারে নদীর বুকে গিয়ে মিশেছে। ওই রাস্তাটায় গেলে পথ অনেকটা কম হয়। সমস্যা একটাই, পুরনো দিনের পাথর বাঁধানো রাস্তা তো, বৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর পেছল আর এবড়ো খেবড়ো হয়ে রয়েছে। তা, যাই হোক, রাজা শিরোমণির নাম নিয়ে ওই রাস্তাতেই পা ফেললাম, আর তার একটু পরেই দেখলাম…। বুড়ি কথা থামিয়ে শিউরে উঠল।
কী দেখলে?
দেখলাম অনেকটা দূরে ওই রাস্তাতেই একটা একটা করে পরিষ্কার পায়ের ছাপ ফুটে উঠছে–যেমন জোনাকিপোকার আলো হয় না, ঠিক সেরকম আলোয় গড়া পায়ের ছাপ। একটা দুটো তিনটে…এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আর পেছনের পায়ের ছাপগুলো একটু বাদে মুছে যাচ্ছে। আমি তো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লাম….
মাসি! গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে দ্যুতি আর বুড়ি দুজনেই চমকে উঠল। রূপেন শইকিয়া কখন যে তার কাজ সেরে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ওদের দুজনের মধ্যে কেউই তা খেয়াল করেনি। তিনিই বললেন, এসব কি আজেবাজে গল্প শোনাচ্ছ দিদিমণিকে?
দ্যুতি প্রতিবাদ করল–না না। এই গল্পগুলোই তো আমি শুনতে চাই। এগুলোই আমার গবেষণার বিষয়।
ঠিক আছে, আবার পরে এসে শুনবে। আজ আমাকে অন্য এক জায়গায় যেতে হবে। তুমি এখন উঠে এস। রূপেনের এই স্বভাববিরোধী তিক্ত সুরে দ্যুতি বেশ অবাক হল। তবে সে আর তর্কও করল না। নোটবুক বন্ধ করে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রূপেনের পেছন পেছন তার গাড়িতে এসে বসল।
দ্যুতিকে হরিণডুবি বাংলোয় নামিয়ে দিয়ে রূপেন আবার কোথায় যেন বেরিয়ে গেলেন। দ্যুতি ঘড়ি দেখল, মাত্র সাড়ে তিনটে বাজে। সে ঠিক পনেরো মিনিট সময় কাটাল বারান্দায় এক কোণায় রূপেন শইকিয়ার গাছ গাছড়ার স্যাম্পেল প্যাকেটগুলো যেখানে জড়ো করা রয়েছে, সেইখানে। সেখান থেকে নিজের হ্যান্ডব্যাগটার মধ্যে একটা বড় প্যাকেট পুরে নিয়ে বাংলোর চৌহদ্দি পেরিয়ে দ্রুত পায়ে হরিণডুবি গ্রাম পেরোল। গ্রাম পেরিয়ে একেবারে হরিণডুবি বিট অফিসের দরজায় পৌঁছে দ্যুতি কড়া নাড়ল।
বিট অফিসার সজল দত্ত দ্যুতিকে দেখে বেশ অবাক হয়েই জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার ম্যাডাম, কোনও প্রবলেম হল না কি?
দ্যুতি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে এক মুহূর্ত ভাবল, যে কাজটা করতে চলেছে সেটা ঠিক হচ্ছে কি না। তার চোখে ভেসে উঠল প্রমিতের উদভ্রান্ত মুখটা, কপালে ব্যান্ডেজ। সে মনস্থির করে নিয়ে সজলবাবুকে বলল, না, প্রবলেম কিছু নয়। একবার আর টি সেটে আমাকে ব্যানার্জি সাহেবের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে হবে।
অফিসের বাইরের একজনের কথায় রেডিয়ো ট্রান্সমিটার চালু করবে কি না সে ব্যাপারে সজল দত্ত একটু ইতস্তত করছিলেন। দ্যুতি বলল, বিশ্বাস করুন ব্যাপারটা খুব জরুরি। তা না। হলে এরকম রিকোয়েস্ট করতাম না।
ঠিক আছে। ভেতরে আসুন। সজল দত্ত দ্যুতিকে পাশে বসিয়ে আলিপুরদুয়ার অফিসের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলেন–