প্রমিত দেবেশ কাশ্যপের অফিসে এসে পৌঁছল সন্ধেবেলা। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, তার চুলে বহুক্ষণ চিরুনি পড়েনি, শার্টের পেছনদিকটা ট্রাউজারের কোমর থেকে বেরিয়ে এসেছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। এমনকী দেবেশ কাশ্যপ যখন তার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন তখন সে সেটাকে উলটোদিক করে ধরিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল।
দেবেশ কাশ্যপ তার অবস্থা দেখে বেশ জোর গলাতেই হেঁকে উঠলেনকাম অন ম্যান! এত ভেঙে পড়ছেন কেন?
ভেঙে পড়ব না? কী বলছেন আপনি? আমার চাকরির জায়গাটাতো বধ্যভূমি হয়ে গেল–কিলিং-ফিল্ড! পাঁচটা মার্ডার হল গত এক মাসে!
তো? মার্ডারগুলো আপনি করেছেন না কি? নিজেকে এত রেসপন্সিবল করবেন না তো।
প্রমিত কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, কিন্তু কাশ্যপ সাহেব, একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছেন? যে দুজন মানুষকে আমরা টেররিস্টদের ডানহাত বাঁহাত ভেবেছিলাম। তারা দুজনেই শেষ হয়ে গেল। তার মধ্যে বিনতা মেহরা তো সরাসরি টেররিস্টদের গুলিতেই খুন হলেন। আর মধু বর্মন না পাত্তা।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কে সেই ইনসাইডার? বিমল বাবুয়াদের ফাঁদে ফেলার জন্যে কে সেদিন নদীর চরে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করেছিল? কে আপনাকে খবর দিয়েছিল ড্রাগ পাচারের? কে ছিল বিনতার গোপন প্রেমিক, যে বিনতাকে দূরের বন্দুকবাজদের নিশানা বানিয়ে দিল?
আর সবচেয়ে বড় যে প্রশ্ন, যার সমাধান করতে পারলে আমার মনে হয়ে অন্য সবকটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব, সেটা হল, কেমনভাবে অন্ধকারেই সহজ হচ্ছে মানুষ মারার কাজ?
দেবেশ কাশ্যপের কাছে, বোঝাই যাচ্ছে, এর কোনওটারই উত্তর ছিল না। তিনি বললেন, বিনতার আত্মীয়েরা বোধহয় পলিটিক্যাল প্রেশার ক্রিয়েট করছে। শুনছি অপারেশন অল-ক্লিয়ারের ঢঙে ভারত ভুটান যৌথবাহিনী মিলে জয়ন্তীর ওপারের পাহাড়গুলোয় কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করবে।
প্রমিত বলল, তাতেও কিন্তু আমাদের ঘরের কাছের বিশ্বাসঘাতকটির গায়ে হাত পড়বে না। আর সে যতদিন থাকবে ততদিন এই টাইগার-রিজার্ভের পশুপাখি, গাছপালা এবং মানুষ কেউই নিরাপদ নয়। তাকে ধরার কাজটা আপনাকে আমাকেই করতে হবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমিত বলল, গত কয়েকদিনে ফ্রিঞ্জ এরিয়া একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আমি ভাবছিলাম আর দুয়েকদিন দেখে গ্রামবাসীদের জঙ্গলে যাতায়াতের পারমিশন দেব। বুঝতেই পারছেন, পাতা কুড়োনোর কিম্বা জড়িবুটি সংগ্রহের কাজ বন্ধ থাকলে ওদের পেট চলে না। ভাবছিলাম নাইট-পেট্রোলিংটাও আবার চালু করে দেব। ফরেস্ট গার্ডদের বুঝিয়েছিলাম, আমি নিজেও তাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, যে বিমল বাবুয়াদের মৃত্যু একটা স্ট্রে ইনসিডেন্ট, হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। বারবার ওরকম ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু বিনতা মেহরার একইভাবে খুন হওয়াটা আমার সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল।
আমি অনির্দিষ্টকালের জন্যে নাইট-পেট্রলিং বন্ধ করে দিয়েছি।
আর জানেন, গত পনেরোদিনের মধ্যে পোচাররা একটা দাঁতাল হাতি আর তিনটে চিতাকে মেরেছে? প্রমিতের গলা ভারী হয়ে এল। সে আস্তে আস্তে দেবেশ কাশ্যপের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিল।
.
১৪.
গল্প এখানে হাওয়ায় ওড়ে, গল্প এখানে মাটির নীচ থেকে ব্যাঙের ছাতার মতন মাথা ফুড়ে ওঠে।
দ্যুতি মিনাজুড়ি গ্রামের একটা ভাঙাচোরা মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে গল্প শুনছিল। গল্প বলছিল এক খুনখুনে বুড়ি। তার বয়েস কত হবে তা সে নিজেও ঠিক বলতে পারছিল না, তবে এটা বলতে পারল যে কুচবিহারের রাজকন্যা মহারানী গায়ত্রীদেবীর বিয়ের বছরেই তারও বিয়ে হয়েছিল। নতুন বরের হাত ধরে এই জঙ্গল ভেঙে পায়ে হেঁটে সে কুচবিহার গিয়েছিল রাজকীয় বিয়ে দেখতে।
সে তো একাত্তর বছর আগের ঘটনা। বুড়ির বয়েস তাহলে আশির অনেকটাই ওপরে।
দ্যুতিকে কী গল্প শোনাচ্ছিল বুড়ি? শোনাচ্ছিল সেই একই গল্প যা একটু ওলোটপালট হয়ে এখানকার সব আদিবাসীদের মুখে মুখেই ফেরে–সেই অতীত গৌরবের গাথা, রাজা শিরোমণির অতিবিস্তৃত রাজ্যপাটের কথা।
সেল-ফোনের এমনিতে কোনও উপযোগিতা নেই এখানে, তবু দ্যুতি সেই যন্ত্রটাকে এনেছিল টেপ-রেকর্ডার হিসেবে কাজে লাগাবে বলে। কিন্তু ব্যাটারি চার্জ করার সুযোগ না থাকায় সেই কাজেও ভেবে চিন্তেই লাগাতে হয়। এই মুহূর্তেই যেমন, দ্যুতি মোবাইল অফ রেখে তার নোটবুকে বুড়ির কথার নোট নিচ্ছিল।
ঘরের আধো অন্ধকার দাওয়ায় বসে বুড়ি গল্প বলছে, আর বাইরে হেমন্তের দুপুরে নদীর চরে একজোড়া টিটিভ পাখি তীব্র স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা ব্যাপার দ্যুতি এই কদিনে বুঝে ফেলেছে, এখানকার সবকটা গ্রামই তৈরি হয়েছে একদিকে জঙ্গল আর অন্যদিকে জয়ন্তীনদীকে রেখে। বেঁচে থাকার জন্যে গ্রামবাসীদের ওই দুটিকেই প্রয়োজন।
বুড়ি একঘেয়ে সুরে বলে যাচ্ছিল রাজা শিরোমণির সঙ্গে অহম রাজার যুদ্ধের কথা, ভূটানের ভোট রাজার যুদ্ধের কথা। সেই কথকতায় সাল তারিখের বালাই নেই, সে সব দ্যুতিকে ফিরে গিয়ে ইতিহাস বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে বার করতে হবে। তবে সব যুদ্ধেই রাজা শিরোমণি নিজের বীরত্বে আর দৈব অনুগ্রহে জিতেছিলেন।
রাজার পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন যেসব দেবতা অপদেবতারা তারাও দ্যুতির প্রায় অচেনা। যেমন বুড়ি বলে মাশানবাবার কথা। তার বর্ণনা থেকে দ্যুতি বোঝে সেই দেবতার সঙ্গে শিবঠাকুরের অনেক মিল–তেমনই জটাজুট, ভুড়ি, বাঘছালের কৌপিন। বাড়তির মধ্যে ওনার ডান হাঁটুর নীচে চেপে ধরা থাকে একটা বড় মাছ। তার মানে? শুনতে শুনতেই দ্যুতির মাথার মধ্যে নৃতাত্বিক প্রশ্ন পাক খায়। মাশানবাবা কি তবে তিস্তা তোর্সার ধীবরদের দেবতা?