উমমমম!
–আগে কাজের কথাটা শেষ করো। ব্যানার্জি সাহেবের ওপর তোমার যা ইনফ্লুয়েন্স তাতে তুমি যদি একবার বলো শিরোমণির গড়টা আমাকে দিয়ে দিতে, উনি মেনে যাবেন। কিন্তু তুমি কি সেটা বলবে?
সত্যিই আমার পক্ষে এরকম কিছু বলা মুশকিল। তা হলেই তো প্রশ্ন উঠবে, আমার কি ইন্টারেস্ট? আমার একটা প্রকৃতিপ্রেমিক ইমেজ রয়েছে, সেটা ভুলো না। এরকম প্রোপোজাল আমার মুখ থেকে বেরোনোটা সে ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক নয়?
–তুমি তাহলে তোমার ইমেজ নিয়েই থাকো। নিজের ব্যবসা বাড়িয়ে যাও। শুধু মনে রেখ, এটা বিশ্বাসঘাতকতা। তুমি সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলে বলেই আমি এই প্রোজেক্টটার কথা ভেবেছিলাম। সরো, আমি উঠি।
প্লিজ, কতদিন পাইনি তোমাকে। আমি কথা দিচ্ছি, ব্যানার্জি সাহেবকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করব। যদি তা নাও পারি, অন্তত জঙ্গলের ল অ্যান্ড অর্ডারের বারোটা বাজানোর কাজটা তো চালিয়ে যেতে পারব। এখন একবার, একবার…
.
নিকষ অন্ধকারের মধ্যেও নারীশরীরের নগ্নতার আভা রজনীগন্ধার পাপড়ির মতন ফুটে উঠল। ঘাসজমির ওপর মিথুনরত সেই যুগলকে দেখে চিতল হরিণেরা অন্য বিচরণক্ষেত্রের দিকে পাড়ি জমালো। রাতের জঙ্গলের ফিসফাসের সঙ্গে মিশে গেল পুরুষটির ঘন শ্বাস আর রমণতৃপ্ত নারীটির শীৎকার।
একটু পরে আলিঙ্গন খুলে নারীটি বলল, সরো, উঠি। গাড়ি রয়েছে সেই রিভারবেডে। নিজেই ড্রাইভ করে এসেছি।
পুরুষটি দ্বিরুক্তি না করে তার শরীরের ওপর থেকে দ্রুত গড়িয়ে সরে গেল। সরে গেল প্রয়োজনের চেয়েও অনেকটা বেশি, জঙ্গলের ভেতরেই যেন আবার।
সেইদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে নারীটি প্রথমে উঠে বসল। তারপর খুলে রাখা শাড়ি সজ্জা একহাতে জড়ো করে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জঙ্গলের দিকে তার মুখ, পিঠের দিকে ভুটান পাহাড়।
তারপরেই সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটির ওপরে। মৃত্যু আক্ষেপে থরথর করে কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল শরীরটা, যা তখনো নগ্ন।
ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে ফায়ারিং-এর শব্দটা এপাড়ে এসে পৌঁছল বুলেটের একটু পরে। মুচকি হেসে পুরুষটি বনের পথ ধরে হাঁটা লাগল হরিণডুবি বাংলোর দিকে।
.
১৩.
আজ আর ছাগলেরা নয়, সোনারু মাঝিই প্রথম দেখতে পেল বিনতা মেহরার মৃতদেহটাকে, কারণ আগের মৃতদেহগুলোর পরণে ছিল ঘাস মাটির সঙ্গে রং মেলানো ইউনিফর্ম, যা তার বুড়ো চোখে ধরা দেয়নি। কিন্তু আজ মেয়েটার শরীরে কিছুই ছিল না। সবুজ ঘাসের ওপর এলিয়ে পড়া অনেকখানি কালো চুল, সাদা চামড়া আর এক দলা লাল রং–টকটকে লাল। না, সোনারুমাঝির একটুও অসুবিধে হয়নি দেখতে।
এবারেও বিট-অফিসার সজল দত্তই মৃতদেহটাকে আইডেন্টিফাই করলেন। কারণ তিনি এর আগে আলিপুরদুয়ারে তিন-চারবার এবং শিরোমণির গড়ে একবার বিনতা মেহরাকে দেখেছেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই একজন গ্রামবাসী বিনতা মেহরার গাড়িটাকে নদীর চরে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখে। দেবেশ কাশ্যপ এবং অন্যান্য দুয়েকজন পুলিশ অফিসার যারা তদন্তে এসেছিলেন তারা গ্রামবাসীদের প্রশ্ন করে জানতে পারেন, ওরা কাল রাত আটটা নাগাদ ওই গাড়িটার শব্দ পেয়েছিল। অন্ধকার আকাশে ছিটকে ওঠা হেডলাইটের আলোও কেউ কেউ ঘরের দাওয়ায় বসে দেখেছিল। তবে ওরা স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছিল ফরেস্টের জিপ নিয়ে কেউ কাজে বেরিয়েছে। তা ছাড়া আর কী-ই বা ভাববে?
বডি পোস্টমর্টেমের জন্যে জলপাইগুড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে দেবেশ কাশ্যপ যখন আলিপুরদুয়ারে ফিরলেন, তখন দুপুর হয়ে গেছে। তবে আগে তাকে অফিসের বাইরে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের সামলাতে হল।
এবারের কাজটা তার পক্ষে কঠিন হল না। তিনি শুধু একটা ইঙ্গিত দিলেন যে ভদ্রমহিলা মৃত্যুর ঠিক আগে শারীরিকভাবে কারুর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।
তার মানে? ফোঁস করে উঠল সাংবাদিকেরা। রেপ নয়, লাভ-মেকিং?
ঠিক তাই। মিসেস মেহরার শরীরে বলপ্রয়োগের কোনও চিহ্ন পাইনি, কিন্তু ওই পরেরটার চিহ্ন ছিল।
এর পরে দেবেশ কাশ্যপ স্তম্ভিত সাংবাদিকদের দিকে চেয়ে একটা নাতিদীর্ঘ আবেগঘন বক্তৃতা দিলেন, যার মূল কথা–বিনতা মেহরা ছিলেন আপনাদের সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত। ইন ফ্যাক্ট তার আত্মীয়েরা এখনও একটা সংবাদপত্র চালাচ্ছেন। কাজেই আমার অনুরোধ, এই মুহূর্তে এমন কিছু লিখবেন না, যাতে সেই পরিবারটির সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায়। তদন্ত শেষ হতে দিন, তারপরে আমিই আপনাদের ডেকে সব কথা জানাব।
সাংবাদিকরা পত্রপাঠ তাদের টেপরেকর্ডার এবং নোটবুক ব্যাগে পুরে ফেলে প্রস্থান করলেন।
পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পরদিনই পাওয়া গেল। অবজার্ভেশনের ওপর নির্ভর করে দেবেশ কাশ্যপ যা বলেছিলেন তার সবই মিলে গেল। বিনতার শরীরের ভেতর স্পার্ম পাওয়া গেছে, অত্যাচারের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সঙ্গমের পরেই তার পিঠে বুলেট এসে বেঁধে।
রিগর মর্টিসের ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে মৃত্যু হয়েছিল দেহটা আবিষ্কারের কয়েকঘণ্টা আগে, তার মানে গভীর রাত্রিতে।
ফরেনসিকের রিপোর্ট আগেরটারই হুবহু কপি বুলেটটা এসেছিল অন্তত আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে, কৌণিকভাবে নীচু হয়ে–সোজা কথায় আগেও যেখান থেকে এসেছিল। নদীর ওপারের পাহাড় থেকে।
ঘাসের ওপর কোনও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি। নগ্ন শরীরে কোনও আঙুলের ছাপ পাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশ কুকুর এসেছিল। কিন্তু জঙ্গলের হাজার হাজার ফুল পাতা জন্তু জানোয়ার পাখির গন্ধের মধ্যে সে বেচারা বিনতার সঙ্গীর ঘ্রান হারিয়ে ফেলে এবং রণে ভঙ্গ দেয়।