আর সমস্ত বৃত্তের কেন্দ্রে একটা ধূর্ত মাকড়শার মতন বসে থাকে মালিক কিম্বা কিং পিন। তার অস্তিত্ব জানে শুধু ম্যানেজাররা, আর কেউ নয়। হতে পারে সেই কিং-পিন নিজে একজন বিখ্যাত সমাজসেবী, রাজনৈতিক নেতা কিম্বা পুলিশ অফিসার। মুখোশের আড়ালে তার মুখটা সাধারণ লোক কোনও দিন খুঁজেই পাবে না। খুঁজে পেলেও বিশ্বাস করতে চাইবে না। কেউ।
বুঝলেন ব্যানার্জিসাহেব, আমরা যখন ড্রাগ ধরি, তখন আমাদের হাতে ধরা পড়ে এইসব ছুটকো ছাটকা পেডলাররা, কিম্বা বড়জোর কোনও এজেন্ট। আজকে যেমন ওই লোক দুটো…ওই ড্রাইভার আর খালাশি ফেঁসেছে। ওদের কাছ থেকে কার্টেল সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারব না, কারণ ওরা নিজেরাই একেবারে বাইরের পরিধির লোক। কেন্দ্রের ধারে কাছেও কোনওদিন যায়নি। তাই ওরা আর আমাদের কী ইনফরমেশন দেবে?
তবু আমরা জেনেছি, আর সেটাকেই বলছি বড় অ্যাচিভমেন্ট। কিন্তু…
কিন্তু কী, মিস্টার কাশ্যপ?
আজ আমরা এরকমই একজন কিং-পিনের খোঁজ পেয়েছিলাম। কিন্তু সে বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল। দুপুর থেকে তার সবকটা ডেন-এ ছাপ্পা মেরেছি। পাখি ভাগলবা।
তবে সে আর লুকনো গর্তের বাইরে আসবে না, আপনার সঙ্গে আর কলার তুলে কথা বলবে না, লোক খ্যাপাবে না শিরোমণির গড় হাত করার জন্যে। নামটা কি আর বলবার দরকার আছে?
কঠিন হয়ে উঠল প্রমিতের মুখ। সে রুদ্ধ স্বরে বলল, মধু বর্মন?
ইয়েস। এই নামটা শোনানোর জন্যেই আপনাকে ডেকেছিলাম।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রমিত বলল–মধু বর্মন সম্বন্ধে টিপ-অফটা কে দিল কাশ্যপ সাহেব?
বলতে পারব না। অ্যানোনিমাস কল ছিল, পাবলিক বুথ থেকে। তবে একদম ইনসাইডার–সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ট্রেলারের নম্বর, কখন কোথা দিয়ে ঢুকবে, কোথায় মাল লুকোনো আছে সব বলে দিয়েছিল। মধুর নামটাও সেই ইনফর্মারই বলেছিল। কথাগুলো যে মিথ্যা বলেনি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। মধুর ডেনগুলোর ঠিকানাও ঠিকঠাক দিয়েছে।
শুধু মধু সটকে গেল।
.
১২.
কটা বাজল?–পুরুষ কণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল।
পাশ থেকে নারীটি রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ি দেখে উত্তর দিল নটা। তারপর যোগ করল–আমার খুব ভয় করছে।
–ভয় করছে? কিসের ভয়?
–কিসের আবার? ওয়াইল্ড অ্যানিমাল-এর। হাতি..বাঘ…।
নিশ্চিন্ত থাকো। তুমি যাদের নাম করলে, তারা নির্দিষ্ট রুটে ঘোরাফেরা করে। এই জায়গাটা সেই রুটের অনেক বাইরে।
তা ছাড়া আরও একটা ভয় রয়েছে। সেটাও তুমি ভালো করেই জানো।
– পাহাড়ের ওপাশ থেকে ছুটে আসা বুলেট?–গোপনীয়তার কথা ভেবেই নিশ্চয় চাপা স্বরে হাসল পুরুষটি। না হলে হা হা করেই হেসে উঠত। হাসি থামিয়ে বলল, এই অন্ধকারে?
–এইরকম অন্ধকারেই তো ওই লোকগুলো মরেছিল, ওই যে কী যেন নাম…?
–বিমল, বাবুয়া, সন্দীপ। বাদ দাও ওদের কথা। নিশ্চয় টর্চ জ্বেলে হাঁটছিল, কিম্বা..বিড়ি টিড়ি খাচ্ছিল। তোমার যদি অতই ভয় করছে, তা হলে এসো, বসে পড় এই ঘাসের ওপর।
–সেই ভালো। কিন্তু সাপ টাপ নেই তো?
–এই শীতে সাপ? তুমি কি বিলেত থেকে এলে? বসো বসো।
শাড়ির খসখস আওয়াজ শুনে বোঝা গেল নারীটি আজ্ঞা পালন করল।
–বেশ। এবার চট করে বলে ফেল, কী জন্যে ডেকেচ্ছ। আমার হাতে সময় বেশি নেই।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নারীটি বলল–যেটা জানতে চাইছি, সেটা হল, মধু বর্মনকে বলি চড়ালে কেন?
মধু ক্রমশ আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। বিপজ্জনক পথে পা ফেলছিল। পয়সা আমিও চাই, কিন্তু অতটা রিস্ক নিতে চাই না। আমাকে এখনও অনেকদিন ধরে পয়সা রোজগার করে যেতে হবে। কেন, তা তুমি জানো। তাই আমার ছদ্মবেশ প্রয়োজন। মধু আর দুয়েকদিন বেঁচে থাকলে আমি এক্সপোজড হয়ে যেতাম। সেটা আমি গুলাবি খুন হওয়ার পরেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর তা ছাড়া…
তা ছাড়া কী সেটা আমি জানি। মধু তোমার রাইভ্যাল হয়ে উঠছিল। ড্রাগ বিক্রির পয়সায় ও অল্পদিনেই প্রচুর ক্যাপিটাল জমিয়ে ফেলেছিল। সেই ক্যাপিটাল দিয়ে ও তোমার সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। চাকর থেকে মালিক হয়ে উঠছিল, ঠিক কি না?
আবারও চাপা স্বরে হাসল পুরুষটি। বলল–তুমি আমার সম্বন্ধে যতটা জানো, আমার স্ত্রীও অতটা জানে না।
নারীটিও হাসল। হেসে বললজগতের নিয়মই তাই। প্রেমিকা স্ত্রীয়ের থেকে এক পা এগিয়েই থাকে। তারপর একটু দ্বিধান্বিত সুরে বলল, তোমার চোরাশিকারের ব্যবসা এখন ফুলে ফেঁপে উঠবে, কারণ বনে কোনও পাহারা নেই। বাড়বে কাঠ চুরির ব্যবসাও…
বারবার চুরি, চোরা এই সব শব্দ গুলো ব্যবাহার কোরো না। শুনতে ভালো লাগে না।
–স্যরি। কিন্তু আমার কী হবে?
–মানে?
–মধু বর্মনকে তো সরিয়ে দিলে। এবার প্রমিত ব্যানার্জির ওপর চাপটা রাখবে কে? মধু এই ব্যপারটায় এত ভালো কাজ করছিল..খুব ক্ষতি হয়ে গেল আমার।
–যে তোমাকে তোমার নিজের হোটেলের ঘরে রেপ করতে গিয়েছিল, তার জন্যেও এত দরদ!
–ওটা এমন কিছু গর্হিত অপরাধ নয়। একলা ঘরে আমাকে দেখলে অনেকেই মাথা ঠিক রাখতে পারে না। ওসবের সঙ্গে ব্যবসার সম্পর্ক নেই। তা না হলে ওকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলাম কেন? ইন ফ্যাক্ট তোমাকে একটা কথা বলি–মধু যদি আমার হাতে শিরোমণির গড় তুলে দিতে পারত তাহলে আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম, ও সেদিন যা চেয়েছিল তা ওকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু তুমিই তার উপায় রাখলে না। এখন বলো, আমার কী ব্যবস্থা করবে? এ কি, এ কি? এসব কি অসভ্যতা শুরু করলে?