সজলবাবু, জীবন কিম্বা গোপিনাথ, প্রত্যেকেই ওই তিন ফরেস্টগার্ডের বলবীৰ্য্য সম্বন্ধে এতটাই সংশয়হীন ছিলেন যে, তারা তারপরেই আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন। তারা জানতেন, পোচারদের সঙ্গে এনকাউন্টার যদি হয়ই, তাতে বিমল বাবুয়ারা একশোবারের মধ্যে একশোবারই জয়ী হবে। গত একবছরের নানান ঘটনা তাদের সেরকমটাই বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল।
কাজেই ঘণ্টাখানেক বাদে আবার যখন পরপর তিনটে ফায়ারিং-এর শব্দ ভেসে আসে তখন ঘুম ভেঙে গেলেও ওরা কোনও দুশ্চিন্তা করেনি। বিশেষত এবারের আওয়াজগুলো এসেছিল অনেকদুর থেকে, সম্ভবত নদীর অপর পাড়ে, ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে। তার মানে, ওরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছিলেন, বিমল বাবুয়ারা ওদের তাড়িয়ে ছেড়েছে। পালাতে পালাতে টেররিস্টরা গুলি ছুড়ছে।
এর পরে সারারাত আর কোনও গুলির শব্দ পাওয়া যায়নি।
সকালেও যখন বিমল বাবুয়ারা ফিরল না তখনও ওরা কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা করেনি। কারণ একবার বেরোলে ওই তিনজন ফরেস্টগার্ড সাধারনত পুরো বিট টহল দিয়ে আসত; পোচারদের মধ্যে দুয়েকজন তো এদিকে ওদিকে ছিটকে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে, তাই। এমন টহলদারীতে প্রচুর সময় লাগে। সজলবাবুরা নিশ্চিন্তমনেই অফিস খোলার উদ্যোগ করছিলেন। এমন সময় গ্রামবাসীদের মুখে সেই দুঃসংবাদ এসে পৌঁছয়–ওরা তিনজনেই মারা পড়েছে।
যেখানে মৃতদেহ পড়েছিল সেই জায়গাটার আশেপাশে অনেকখানি জায়গা জুড়ে তল্লাশি চালান রতন বৈদ্য এবং তার সহকর্মীরা। তাদের এই উদ্যেগ সম্পূর্ণ বিফলে যায়নি। যেখানে বিমল সন্দীপ আর বাবুয়ার মৃতদেহ পড়েছিল, তার থেকে কিছুটা দূরেই রিভারবেডের ওপর পাওয়া যায় দুটো কার্তুজের খোল। তার মানে ওইখানে দাঁড়িয়েই প্রথম দুটো গুলি চালানো হয়েছিল যে দুটো গুলির আওয়াজ শুনে বিমলরা বেরিয়ে এসেছিল। গুলি চালানোর জায়গাটা সম্বন্ধে বিমলদের আন্দাজ কত নির্ভুল ছিল, এটা তার প্রমাণ।
কিন্তু এটা বুঝতেও প্রমিত কিম্বা রতন বৈদ্যের বেশি সময় লাগেনি যে, ওই দুটো গুলি কাউকে মারার জন্যে চালানো হয়নি। ধু ধু শূন্য রিভারবেডের মধ্যে রাত দেড়টার সময়ে মারার মতন কোনও মানুষ বা প্রাণীকে পাওয়া মুস্কিল। ওই গুলিদুটো চালানো হয়েছিল ঠিক ওই জায়গায় তিন ফরেস্টগার্ডকে টেনে আনার জন্যে। শব্দের উৎসটাকে যাতে ফরেস্টগার্ড তিনজন নির্ভুলভাবে চিনে নিতে পারে, সেইজন্যই সম্ভবত, দুবার গুলি চালানোর মধ্যে পাঁচ মিনিট গ্যাপ রাখা হয়েছিল।
এবং এই প্ল্যান একশোভাগ সাকসেসফুল হয়েছিল। বিমল, বাবুয়ারা কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর সময়েই জানত তাদের ঠিক কোনখানটায় যেতে হবে, ঠিক কোনখান থেকে ভেসে এসেছে গুলির শব্দ।
ওরা রিভারবেডের কাছাকাছি এসে বুকের ওপর শুয়ে পড়েছিল। কারণ জঙ্গলের বাইরে, খোলা জায়গায় উঠে দাঁড়ানোর মানে রিভারবেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনও ঘাতকের সামনে সহজ টার্গেট হয়ে যাওয়া। ওরা নদীর তীর অবধি বুকে হেঁটে, ক্রল করে এগিয়েছিল। ওদের শরীরের ভারে দুমড়ে নুয়ে পড়া ঘাস থেকে ওই সরীসৃপ-গতির ব্যাপারে রতন বৈদ্যের লোকজন নিশ্চিত হয়েছিল। তারপর নিশ্চয় ওরা ভালো করে চেয়ে দেখেছিল, চারপাশে কাউকে দেখতে পাওয়া যায় কি না। দেখে নিয়েছিল দুদিকের রিভারবেড, যেখানে একটা পাখিরও লুকিয়ে থাকার মতন কোনও আড়াল নেই। দেখে নিয়েছিল নিশ্চয় নদীর অপর তীরটাকেও। সেই অহল্যা জমিতেও একটাও গাছের আড়াল ছিল না যেখানে কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। অপর তীরের পাহাড়গুলোকে ওরা নিশ্চয় দেখতে পায়নি। কারণ গতকাল ছিল দ্বিতীয়া, আকাশে চাঁদ ছিল নামমাত্র, বাতাসে ছিল হালকা কুয়াশার চাদর, এবং রাত ছিল গভীর। অর্থাৎ নদীর তীরভূমির ওপাড়ে আর কিছু ওদের চোখে পড়ারই কথা নয়।
যুক্তি বলে, একই কারণে ওই পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মানুষের পক্ষেও ওদের দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়।
অথচ পেয়েছিল।
এক বা একাধিক রাইফেলধারী শার্প-শুটার নদীর অন্যপাড়ের পাহাড়ের ওপরে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই তিন ফরেস্টগার্ডকে এতটাই নিখুঁতভাবে দেখতে পেয়েছিল যে, তারা অনায়াসে ওদের হৃদপিণ্ড ছুঁড়ে দিতে পেরেছিল।
হ্যাঁ, যে বুলেটগুলোতে ওদের মৃত্যু হয়েছে সেগুলো যে উলটোদিকের ওই পাহাড়ের মাথা থেকে ছুটে এসেছে সে ব্যাপারে ও.সি. রতন বৈদ্য এবং প্রমিত ব্যানার্জি দুজনেই নিশ্চিত। প্রথম কারণ জীবনবাবু, গোপিনাথবাবুদের সাক্ষ্য–যেখানে ওরা বলেছেন পরের তিনটে ফায়ারিং এর শব্দ ভেসে এসেছিল অনেক দূর থেকে।
দ্বিতীয়ত, নদীর বেড কিম্বা অপর পাড়ের তীরভূমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আগে যে দুটো বুলেটের কার্তুজের কথা বলা হয়েছে তা ছাড়া অন্য কোনও কার্তুজের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার মানে পাহাড়ের ওপরে কোথাও সেগুলো পড়ে আছে।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে নিশ্চিত প্রমাণ মৃতদের শরীরের বুলেটের ক্ষতের চেহারা। তিনজনের বুকে যেখানে বুলেটগুলো ঢুকেছে সেখানে ক্ষতের আকৃতি গোল নয়–লম্বাটে। এরকমটা একমাত্র তখনই হয় যখন বুলেট শরীরে ঢোকে কোণাকুণি ভাবে, ওপর কিম্বা নীচ থেকে। এক্ষেত্রে নীচ থেকে আসার কোনও জায়গা নেই। অতএব ধরে নেওয়া যায় পাহাড়ের মাথা থেকেই নীচের দিকে কোণাকুণিভাবে ছুটে এসেছিল বুলেটগুলো। তাছাড়া বুলেট যতদূর থেকে আসে, তত ক্ষতের চারিপাশে জমে থাকা বারুদের পরিমাণ কমে যায়। এক্ষেত্রে বিমল বাবুয়াদের বুকের ক্ষতের চারিপাশে বারুদের দাগ একেবারেই ছিল না। এই বুলেটগুলো সন্দেহাতীতভাবে বহুদূরের পথ পেরিয়ে এসেছিল।