হ্যাঁ, দেখলাম। কিন্তু কেন করেছেন বুঝলাম না। চোরাই কাঠ নয় বলেই তো মনে হচ্ছে। না কি ফেক হ্যামার মার্ক ইউজ করেছে?
না, মার্কাগুলো জেনুইন। অরুণাচল থেকে আসছে, শিলিগুড়ি যাবে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ইস্যু করা বিল, চালান আছে। আমরা বক্সিরহাট চেকপোস্ট থেকে চেজ করতে শুরু করেছিলাম। তুফানগঞ্জে পৌঁছে ধরেছি।
প্রমিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, জেনুইন কাগজপত্র, জেনুইন কনসাইনমেন্ট–তাহলে। ধরলেন কেন?
মুচকি হেসে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, কাঠ ধরিনি তো। কাঠের মধ্যে লুকিয়ে যা নিয়ে আসছিল সেইগুলো ধরেছি। এই দেখুন, এইগুলো। তিনি আঙুল দিয়ে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা প্যাকেটগুলোর দিকে নির্দেশ করলেন।
প্রমিত টেবিলের কাছে গিয়ে প্যাকেটগুলো দেখল। প্রত্যেকটা প্লাস্টিকের পাউচের মধ্যে সাদা সাদা একরকমের গুঁড়ো ঠেসে প্যাক করা রয়েছে। এরকম প্রায় একশো-দেড়শো প্যাকেট ছড়িয়ে আছে টেবিলের ওপর।
দেবেশ কাশ্যপ পাশ থেকে বললেন, আন্দাজ করতে পারছেন, এগুলো কী? হেরোইন। পুরোনো গাছের গুঁড়ির মাঝখান বরাবর যে ফাঁপা গর্তটা থাকে, তার মধ্যে প্যাক করে নিয়ে আসছিল। আমাদের কাছে ইনফর্মেশন ছিল, তাই ধরতে পারলাম। না হলে কার বাবার ক্ষমতা আছে ধরে?
প্রমিত এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, তার মুখ থেকে কথা সরছিল না। সে বলল, অরুণাচলে হেরোইন তৈরি হয়?
না, না, অরুণাচলে হয় না। মায়ানমার থেকে অরুণাচলে স্মাগল করা হয়। মায়ানমারে আবার পৌঁছয় চায়না থেকে। ওইসব বর্ডারগুলোয় পাহারা দেওয়া খুব কঠিন জানেন তো? ভয়ানক গভীর জঙ্গল। স্থানীয় গরিবস্য গরিব মানুষজনকে ট্রান্সপোর্টের কজে লাগানো হয়। তারা বাঘের মুখের সামনে দিয়ে, সাপের ছোবল এড়িয়ে পায়ে হেঁটে এই বর্ডার থেকে ওই বডারে মাল আনা নেওয়া করে। তারপর একবার কোনওরকমে সেই মাল শিলিগুড়ির মার্কেটে পৌঁছে গেলে ছোট ছোট ভাগে পেডলারদের কাছে ছড়িয়ে যায়। তখন এ বস্তুকে ধরা অসম্ভব।
একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে প্রমিত বলল, এগুলোর দাম কেমন হবে?
এই টেবিলে এককোটি টাকার বেশি দামের হেরোইন আছে। এ বছরে এটাই বিগেস্ট হল। নারকোটিক ডিপার্টমেন্টের লোকদেরও খবর পাঠিয়েছি। এসে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যে।
প্রমিত তার ডান হাতটা দেবেশ কাশ্যপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশনস্। সত্যি আপনার মতন অফিসাররা…
আপনাকে কেন ডেকেছি জিগ্যেস করলেন না? প্রমিতের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে জিগ্যেস করলেন কাশ্যপ সাহেব।
কোনও বিশেষ কারণ আছে না কি? অবাক হয়ে বলল প্রমিত। আমি তো ভাবলাম কাঠ টাঠের ব্যাপার, তাই।
আরে ধুর মশাই। এই সামান্য কারণে আপনাকে আর টি সেটে যোগাযোগ করব? শুনুন, আমাদের আজকে আরও বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট আছে।
ওরে বাবা! এক কোটি টাকার হেরোইন উদ্ধারের থেকেও বড় অ্যাচিভমেন্ট!
ইয়েস স্যার! সেটা বলার আগে আপনাকে ড্রাগচক্রের ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দিই। না হলে অ্যাচিভমেন্ট বলছি কেন বুঝতে পারবেন না।
দেখুন, ড্রাগ ট্রাগ মাঝে মাঝেই এদিকে ওদিকে ধরা পড়ে। খবরের কাগজে সেসব বিবরণ পড়েন নিশ্চয়। কিন্তু যাদের ধরতে পারা যায় না, তারা হল এই ব্যাবসার মালিক। কেন ধরা যায় না জানেন? যে সিস্টেমে বাবসাটা চলে, তার জন্যে। সেটা একটা ইউনিক সিস্টেম। নামটা শুনে থাকবেন–ড্রাগ কার্টেল। ড্রাগ চক্র।
চক্র না বলে বৃত্ত বললেই আরও অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হয় অবশ্য। একটা নয়, সমকেন্দ্রিক অনেকগুলো বৃত্ত–যেরকম বৃত্ত তৈরি হয় পুকুরে একটা ঢিল ফেললে।
এই পুরো কার্টেলের একদম বাইরের পরিধিতে কাজ করে ড্রাগ-পেডলাররা। তারা হল। সোজা বাংলায় ফেরিওয়ালা। অন্ধকার গলির মুখে, বেশ্যাপল্লীর বারান্দায়, স্টেশন প্লাটফর্মের দূরতম প্রান্তে এরা ছেঁড়া নোংরা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকে। পকেটে থাকে চরস কিম্বা হেরোইনের পুরিয়া। নেশাড়ুরা জানে ঠিক কোনখানে কখন কোন পেডলারকে পাওয়া যাবে। তারা নেশার খোঁজে ঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছিয়ে যায়।
এক-একটা এরিয়ার পেডলারদের কন্ট্রোল করে দুজন বা তিন জন এজেন্ট। এরা পেডলারদের হাতে মাল পৌঁছিয়ে দেয়, আবার তাদের কাছ থেকে বিক্রির টাকাও উশুল করে। পেডলারদের এলাকা দখলের লড়াইয়ে অস্ত্র সরবরাহ করে। কাউকে পুলিশে ধরলে তার ফ্যামিলিকে অনাহারের হাত থেকে বাঁচায়। এইসব কাজের জন্যে এজেন্টরা কমিশন পায়।
এর পরে বৃত্তে থাকে ম্যানেজার। বেশ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মতন শোনাচ্ছে না ব্যাপারটা? সত্যিই ড্রাগের জগৎটা কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মতন প্রফেশনালিই চালানো হয়। যাই হোক, ম্যানেজারই বিদেশ থেকে নেশার জিনিস আমদানি করে, তার জন্যে যে বিপুল পরিমাণ টাকা লাগে তার ব্যবস্থা করে এবং অস্ত্র আমদানিও করে। ম্যানেজারের অনেকসময়েই অন্য জীবিকাও থাকে–কোনো সম্মানজনক জীবিকা–যার আড়ালে থেকে সে এই কাজগুলো চালায়।
এই থানার ঘরে বসেই একটা সত্যি কথা আপনাকে বলছি– পুলিশ এবং পলিটিকাল লিডারদের হাতে না রেখে একটা কার্টেলও তৈরি হতে পারে না। এ ব্যাপারেও সিসিলি এবং শিলিগুড়িতে তফাত নেই। সেই নেতা এবং অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বটাও ম্যানেজারের।