ওদেরও কি নাইটজারের মতন অন্ধকারে চোখ জ্বলে?
একটু আগেই প্রমিত আর দ্যুতি একে অন্যের কাছে নিজেদের ভালোবাসার কথা জানিয়েছে। চরিতার্থ হয়েছে ওদের প্রেম। তবু এমন সময়ে দুই যুবক যুবতীর মধ্যে যে উচ্ছ্বাস আশা করা যায় ওদের মধ্যে তা দেখা যাচ্ছে না। করণটা সহজেই বোধগম্য। বড় দুঃসময়ে ওরা একে অন্যের কাছে এসেছে।
মন হাতড়ে লঘু কথা খুঁজতে গিয়ে হঠাই প্রমিতের মনে পড়ল আজ কিছুক্ষণ আগে জঙ্গলের রাস্তায় সোনারু মাঝির সেই প্রলাপ। সে নিজের মনেই হেসে উঠল।
কী হল, হাসছ যে? তার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিগ্যেস করল দ্যুতি।
প্রমিত হাসতে হাসতেই বলল, সোনারু মাঝি কী বলছিল জানো? বলছিল বিমল বাবুয়ারা জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল। সেইজন্যে টেররিস্টরা অন্ধকারের মধ্যে ওদের দেখতে পেয়েছিল।
দ্যুতি অল্প হাসল। কোনও জবাব দিল না।
তারপর যা বলল, শুনলে তো তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। বলল, ও না কি শিরোমণির গড়ের পেছনের রাস্তায় মাঝে-মাঝেই অমন আলোমাখা বেজি কিম্বা সাপ দেখতে পায়।
প্রমিতের এই কথাটা শুনে দ্যুতি কিন্তু হাসতে পারল না, বরং ভারি অস্বস্তি নিয়ে বলল, জানো, এই কথাটা শুনে আমার কি যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছে না। এরকমই একটা গল্প যেন কোথায় শুনেছিলাম! আলোর পাখির গল্প।
কোনও রূপকথার গল্পে বোধহয়। তোমার তো ওটাই কাজ রূপকথা খোঁজা। বাদ দাও না। মনে করেই বা কী হবে? আমার দুর্দশা নিয়েই এখন অনেক গল্প লেখা যায়। আমি আর নতুন গল্প কী শুনব?
দ্যুতি চুপ করে গেল। আজই প্রথম, প্রমিত তার গত কয়েকদিনের সমস্ত উদ্বেগের কথা তার কাছে উজাড় করে দিয়েছে। তিন সহকর্মীর রহস্যময় পরিস্থিতিতে মৃত্যুর কথা, শিরোমণির গড়ের দিকে বিনতা মেহরার এগিয়ে আসা থাবার কথা, এবং শেষ অবধি সেই লোকগুলোর কথা, যারা কদিন আগেও ব্যানার্জি সাহেবকে তার বড় দিল-এর জন্যে শ্রদ্ধা করত, অথচ গুলাবি নার্জিনারির মৃত্যুর পরে যারা পাথর মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
পাথরটা প্রমিতের কপালে লাগেনি, লেগেছে বুকের ভেতরে। আর দ্যুতি নিজেও যন্ত্রণাটা নিজের বুকের মধ্যে অনুভব করছিল। তাই সে আর এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গ পালটাবার জন্যে বলল, মিস্টার শইকিয়ার কী হল বল তো? রাত নটা বাজতে চলল, এখনও উনি ফিরলেন না।
প্রমিত চট করে একবার নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই তো ভাবছি.. নাঃ, আর বোধহয় ভাবতে হবে না। ওই যে তিনি এসে গেছেন।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। গাড়িটা জিগজ্যাগ রাস্তার বাঁক নিতে-নিতে এগিয়ে আসছে। একটু বাদেই গাড়িটা বনবাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল। প্রমিত এবং দ্যুতি অবাক হয়ে দেখল সেটা মোটেই রূপেন শইকিয়ার বোলেরো নয়, হরিণডুবি বিট অফিসের উইলি জিপ। জিপ থেকে লাফিয়ে নামলেন বিট-অফিসার সজল দত্ত, তারপর জোরে পা চালিয়ে বাংলোর বারান্দায় এসে উঠলেন। বললেন, স্যার আলিপুরদুয়ার পুলিশ স্টেশন থেকে কাশ্যপ সাহেব আর টি সেটে কল করেছিলেন। কি যেন একটা জরুরি ব্যাপার জানানোর জন্যে আপনাকে একবার ডাকছেন।
কথাটা শুনে প্রমিত চোখের দৃষ্টিতে দ্যুতির কাছ থেকে বিদায় নিল। তারপর লাফ মেরে বারান্দা থেকে নেমে দৌড়ল নিজের জিপসির দিকে। সজল দত্ত বাংলোয় ঢোকার ঠিক তিন মিনিট বাদে প্রমিতের জিপসি দ্রুত কয়েকটা বাঁক নিয়ে বনের পথে মিলিয়ে গেল, এবং পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় সেই জিপসিকে দেখা গেল আলিপুরদুয়ার পুলিশ স্টেশনের দরজায়।
থানার উঠোনটা পেরোনোর সময়েই প্রমিত দেখল একটা বড় দশ চাকার ট্রেলার সেখানে পুলিশ পাহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। গড়িটায় প্রায় খান আষ্টেক বিশাল গাছের গুঁড়ি, যাকে বলে লিগ, লোড করা আছে। অভ্যস্ত চোখে প্রমিত এটাও দেখে নিল যে, প্রত্যেকটা লগের গায়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হ্যাঁমারিং-এর ছাপ রয়েছে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তত্ত্বাবধানে বন থেকে যত লগ বেরোয় সবার গায়ে লোহার ধারালো ছাঁচ দিয়ে মার্কা আর নম্বর খোদাই করে দেওয়া হয়, যাতে পরিবহনের সময় মিলিয়ে দেখে নেওয়া যায় যে, বিল কিম্বা চালানে যে কাঠের কথা লেখা আছে সেই কাঠই গাড়িতে যাচ্ছে কিনা। একেই বলে হ্যামার-মার্কিং।
হ্যামারিং-এর মার্ক দেখে প্রমিত তাই একটু অবাক হল। মার্কাগুলো অরুণাচলের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। কিন্তু যাই হোক, চোরাই কাঠ তো নয়। তাহলে দেবেশ কাশ্যপ গাড়িটাকে আটকালেন কেন?
কাশ্যপ সাহেবের ঘরে ঢুকে প্রমিত দেখল দুটো লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা ওই ট্রেলারের ড্রাইভার আর খালাশি। দেবেশ কাশ্যপ, ওসি রতন বৈদ্য আর অন্য দুজন পুলিশ অফিসার মন দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা অনেকগুলো ছোট ছোট প্লাস্টিকের পাউচ নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন। প্রমিত ঘরে ঢুকতে দেবেশ কাশ্যপ বাকি তিনজন পুলিশ অফিসারকে চোখের ইশারায় বাইরে যেতে বললেন। তারা যাবার সময় ওই ড্রাইভার আর খালাশিকেও তুলে নিয়ে গেল সম্ভবত লক্-আপের দিকেই।
ওরা বেরিয়ে যাবার পরে দেবেশ কাশ্যপ বললেন, ব্যানার্জি সাহেব, একটা গাড়ি সীজ করেছি দেখেছেন বোধহয়।