তবে প্রমিতের কথার উত্তরে সোনারু মাঝি যা বলল, তাতে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধেই প্রমিতের সন্দেহ জাগল। সোনারু বলল, ওই তিনটে ছেলে গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল গো। নাহলে খুনেগুলো ওদের দেখবে কেমন করে?
মানে!–সোনারুর কথা শুনে বিস্ময়ে প্রমিতের মুখ দিয়ে এ ছাড়া আর কোনও শব্দ বেরোল না। গায়ে আলো মেখে ফেলেছিল মানে?
জঙ্গলের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করলে ওরকম অনেক কিছু হয়। ওই ছেলেগুলো বড় বেশি জঙ্গলের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করত। ওরকম করতে নাই। জঙ্গলকে একটু তফাতে রাখতে হয়। না হলে গায়ে আলকুশি লাগে, গা চুলকে লাল হয়ে যায়। কতরকমের গন্ধ পোকা আছে। গায়ে ঘষে গেলে দুর্গন্ধে তিষ্ঠোতে পারবে না। তেমনি গায়ে আলো লেগে যায়…
আলো লেগে যায়!
যায় বই কি। আমি তো এইখানে সন্ধেবেলা অবধি বসে থাকি। বসে বসে দেখি ওই শিরোমণির গড়ের পেছনের রাস্তাটা ধরে কখনও একটা বেজি দৌড়ে নেমে আসছে, কখনও একটা সাপ…
মুচকি হেসে প্রমিত বলল, বাবা, তোমার চোখের জোর তো এই বয়সেও সাংঘাতিক কাকা! এত দূর থেকে বেজি দেখছ, সাপ দেখছ! চোখ, না দূরবীন?
এমনিতে কি দেখতে পাই মাণিক? ওদের শরীরগুলো যে আগুনের মতন জ্বলে, তাতেই দেখতে পাই।
বুঝলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল প্রমিত। সে সোনারুর মুখ থেকে কড়া দিশি মদের গন্ধ পাচ্ছিল।
তারপর জিপে উঠতে উঠতে বলল, যাই হোক, তুমি সন্ধের পর এখানটায় ঘোরাঘুরি কোরো না।
আবার জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে বনের পথে চলল প্রমিত। মনকে চোখ ঠেরে লাভ নেই। সে জানে কোথায় যাওয়ার জন্যে সে বেরিয়েছে, কোথায় না গিয়ে সে আজ বাড়ি ফিরতে পারবে না।
দ্যুতিকে সে একটা ধন্যবাদ অবধি দেয় নি। সেই মেয়েটাকে, যে না কি এটিকেট জানে না।
সে নিজে জানে তো?
প্রমিতের মনে পড়ছিল, সংসারে অনভিজ্ঞ মেয়েটা কখনও তার মাথা ধুইয়ে দিতে গিয়ে সারা বিছানায় জল ফেলে একাকার করেছে। কখনও হাত চলকে সুপ ফেলেছে তার গায়ের ওপর। তবু চলে যাচ্ছে না তাকে ছেড়ে। হাঁ, তখনই গিয়েছে যখন সে তাকে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছে।
ধন্যবাদ দিতে হবে ওকে। ক্ষমা চাইতে হবে ওই মেয়েটার কাছে।
কিন্তু কেমন করে…কোন ভাষায় সে সব করবে প্রমিত?
.
হরিণডুবি ফরেস্ট বাংলোর সামনে যখন জিপটাকে দাঁড় করালো প্রমিত, তখন নদীর বুকে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। অন্ধকারে নদীর ওপাড়ের পাহাড়গুলোকে অলৌকিক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে ওরা যেন গা মোড়ামুড়ি করছে, সামান্য হলেও সরে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে, আর সেইসব কথাবার্তা শীতল বাতাস হয়ে ধেয়ে এসে কাঁপিয়ে দিচ্ছে ঘরের ভেতর মোমবাতির আলো।
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে প্রমিত কম্পমান মোমবাতির সামনে বসে গভীর মনোযোগে খাতায় লেখাজোখা করছে যে মেয়েটা, তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাই, জীবনে এই প্রথম, প্রমিত ভীষণভাবে অনুভব করল, ওই যে মেয়েটা হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে আছে, মোমবাতির আলোয় যার কপালের ওপর এসে পড়া ঝুরো চুলগুলোকে মনে হচ্ছে সোনার তার দিয়ে তৈরি, যার গলার কাছে একটা নীল শিরা দপদপ করছে আর যার বুকের ওপর থেকে খসে পড়েছে। অন্যমনস্ক ওড়না–ও দেবদ্যুতি সেনগুপ্ত নয়, পিএইচডি অ্যাসপায়ারেন্ট নয়। ও এক নারী। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি, শরীরের প্রতিটি কোষে ও প্রমিতের থেকে আলাদা। ও ফিল্ডওয়ার্ক করতে এই হরিণডুবিতে আসেনি। ও এই হেমন্তের অরণ্যে এসেছে শুধু প্রমিতের জন্যে। যেভাবে মিলনপাগল পুরুষ তিমির ছুঁড়ে দেওয়া শব্দোত্তর তরঙ্গ চেতনায় ধারণ করে হাজার মাইল সমুদ্র পেরিয়ে ছুটে আসে তার সঙ্গিনী, সেই ভাবে শুধু প্রমিতের সঙ্কেতে সাড়া দিয়ে ও এখানে এসেছে। ও ওই পাহাড় নদী বনের সমান বয়সি এক আদিম সত্ত্বা, যেমন আদিম প্রমিত নিজে।
দ্যুতির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হয়তো তাকে কিছু বলে থাকবে। হঠাই সে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। বলল, একি প্রমিতদা। আপনি কখন এলেন! আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? আবার জ্বর এসেছে না কি আপনার?
ভীষণ ব্যস্ত হয়ে খাট থেকে নেমে দ্যুতি এগিয়ে এল প্রমিতের দিকে। দ্যুতি একেবারে প্রমিতের বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল। প্রমিতের দুই করতল তার অজান্তেই দ্যুতির ছোট্ট সুন্দর মুখটাকে ঘিরে ধরল। সেই দুই হাতের উত্তাপে দ্যুতির গালের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছিল।
তার ভালো লাগছিল খুব।
৩. হরিণডুবি বনবাংলো
১১.
আরও ঘণ্টাখানেক পরের কথা।
হরিণডুবি বনবাংলোর বারান্দায় ঘনিষ্ট হয়ে বসে আছে প্রমিত আর দ্যুতি। রাত বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীত। দ্যুতির গায়ে তাই একটা হালকা পশমের চাদর। প্রমিতও জিপের পেছনের সিট থেকে উইন্ডচিটারটা এনে গায়ে চাপিয়েছে।
প্রমিতের এখনও অবধি আলিপুরদুয়ারে ফেরার কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই গড়িমসির অছিলা অবশ্য একটা রয়েছে। রূপেন শইকিয়া এখনও তার জাঙ্গল ট্যুর সেরে ফেরেননি। তার সঙ্গে দেখা না করে যাওয়াটা অভদ্রতা হবে না?
বারান্দায় বসে ওরা তাকিয়েছিল সামনের অন্ধকারের দিকে। দুটো নাইটজার পাখি মাঝে মাঝে বাগানের বেড়ার ওপর এসে বসছিল, আবার পরমুহূর্তেই কোনও পতঙ্গকে ধাওয়া করে উড়ে যাচ্ছিল। তাদের বড় বড় গোল গোল চোখ অন্ধকারে জুলজুল করে উঠছিল। দিনকানা এই পাখিগুলো যতক্ষণ আকাশে আলো থাকে ততক্ষণ জঙ্গলের রাস্তায় ঝরা পাতার রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে মাটিতে বুক চেপে শুয়ে থাকে। তাড়া দিলেও নড়তে চায় না। তখন দেখলে কে বলবে অন্ধকার নামলে এই পাখিগুলোই এমন তড়িৎগতির নিপুন শিকারি হয়ে উঠতে পারে! প্রমিত পাখিদুটোকে দেখতে দেখতে ভাবছিল, ওই দূরের পাহাড়ের ওপর এমনই কিছু রাতশিকারি মানুষ রয়েছে, অন্ধকারেই যারা সক্রিয় হয়ে ওঠে।