প্রমিত গাড়ি ঘুরিয়ে জয়ন্তী গ্রামের দিকে ফিরে চলল। ওখানে তাদের একটা বড় আউটপোস্ট রয়েছে। সেখান থেকে কিছু লোককে এখানে পাঠাতে হবে গাছের গুঁড়িটা রিকভার করে ডিপোয় নিয়ে যাবার জন্য। তাড়াতাড়ি কাজটা না সারলে আবার ফিরে আসবে কাঠ চোরেরা। কুচবিহার বা আলিপুরদুয়ারের বাজারে ওই গুঁড়িটার দাম হবে কিছু না হলেও দু-লক্ষ টাকা। যারা কাজটা করেছে তারা অবশ্য পাঁচশো, হাজার টাকার বেশি পাবে না। তবু সেই টাকাটাই এই গরিব লোকগুলোর কাছে অনেক। সেই জন্যেই ওরা ফিরে আসবে, কাঁধে কাঁধে ওই বিশাল গুঁড়ি বয়ে নিয়ে চলে যাবে গ্রামের মধ্যে লুকানো ডিজেল মোটরে চলা বেআইনি করাতকলের উঠোনে।
জয়ন্তীতে এসে প্রত্যেকবারই প্রমিত কিছুক্ষণ গ্রামের বাইরে চা-জলখাবারের দোকানটায় দাঁড়ায়। এবারেও দাঁড়াল। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার এই দোকানটায় এলে। দোকানের এই বড়সড় চালায় ঢাকা ঘরটা, এই পাকা মেঝে–এ সবই আসলে এক সময়ের এক রেলওয়ে স্টেশনের অংশ। এইখানেই অনেকবছর আগে ছিল জয়ন্তী রেল স্টেশন। তখন আলিপুরদুয়ার থেকে এই অবধি চলে আসত মিটার গেজের ট্রেন। এই দোকানের বেঞ্চিতে বসে উলটোদিকের গাছপালাগুলোর মধ্যে নজর মেলে চাইলে এখনও মরচে পড়া তার, লোহার খুঁটি এইসব দেখতে পাওয়া যাবে। সবই দূর অতীতের সেই ট্রেন চলাচলের চিহ্ন। বক্সাকে যখন কেন্দ্রীয় সরকার সংরক্ষিত অরণ্য বলে ঘোষণা করল, তখন দেশের আইন অনুযায়ী জঙ্গলের ভেতরের সমস্তরকম কমার্শিয়াল অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আলিপুর জয়ন্তী রেলপথ, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জয়ন্তী নদীর তীরে ডলোমাইটের খাদানগুলো।
কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এক ভাঁড় চা খেয়ে প্রমিত আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল ফরেস্টের আউটপোস্টটার মধ্যে। সেখানে নিজের লোকজনকে কাঠচুরির জায়গাটা বুঝিয়ে দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ল নিজের মনে ঘুরে বেড়াতে।
জঙ্গলে অন্ধকার নামে আচমকা। কিছুদূর যাওয়ার পরেই প্রমিতকে জিপের হেড লাইট জ্বালতে হল। ঘড়ি দেখল সাড়ে ছটা। নিজের অজ্ঞাতেই কখন যে সে হরিণডুবির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছিল জানে না। খেয়াল করল, যখন গাছপালার ফাঁক দিয়ে জয়ন্তী নদী আর নদীর ওপাড়ে পাহাড় দেখতে পেল। প্রমিত সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে জিপটাকে রাস্তার মধ্যেই দাঁড় করিয়ে দিল। অন্ধকারের ঘাতকদের সম্বন্ধে তার মনের মধ্যেও গভীর এক ভয় শেকড় গেড়ে বসেছিল। জিপের হেডলাইট জ্বেলে রেখে তাদের টার্গেট হওয়ার ইচ্ছে প্রমিতের ছিল না।
জিপটাকে দাঁড় করিয়ে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল প্রমিত।
এই পথ দিয়েই সেই রাত্রে বিমল বাবুয়ারা এগিয়ে গিয়েছিল। ওই নদীর তীরের ফাঁকা জমিটায় পৌঁছিয়ে ওরা শুয়ে পড়েছিল। তারপর বুকে হেঁটে বেরিয়ে পড়েছিল জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে বাইরে। আর তখনই..।
হঠাৎই প্রমিতকে ভীষণ চমকে দিয়ে রাস্তার অন্যপ্রান্তে একটা লোকের চেহারা জেগে উঠল। লোকটা মাথা নীচু করে আপন মনে নদীর দিক থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে। জিপটাকে সে লক্ষ করেনি। প্রমিত গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রাখা রিভলবারটার দিকে হাত বাড়িয়েও হঠাৎ হেসে ফেলে হাতটা গুটিয়ে নিল। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। এ সেই বুড়ো সোনারু মাঝি– যে লোকটা সবার আগে তিনজন ফরেস্টগার্ডের মৃতদেহ দেখেছিল। বুড়ো আরও একটু এগিয়ে আসতেই প্রমিত তার সামনে সামনে হেঁটে আসা ছাগল চারটেকেও দেখতে পেল। একই সময়ে বুড়োও মুখ তুলেই দেখতে পেল দাঁড়িয়ে থাকা জিপটাকে, আর দেখা মাত্র উলটোদিকে ঘুরে দৌড়নোর উদ্যোগ করল।
প্রমিত তাড়াতাড়ি জিপ থেকে নেমে হাঁক ছাড়ল–সোনারুকাকা! ও সোনারুকাকা! আরে ভয় পেলে না কি? আমি গো আমি, ডিএফও সাহেব। ভয় পাও কেন?
বুড়ো সোনারু একগাল হেসে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, অ্যাই দ্যাখো। আমি ভাবলাম বুঝি খুনেগুলো। প্রমিতের দিকে এগিয়ে এসে আভূমি নত হয়ে তাকে প্রণাম করল সোনারু।
প্ৰতিনমস্কার জানিয়ে প্রমিত বলল, তোমাকে কিন্তু জেলে পোরা উচিত সোনারুকাকা। তোমাদের না এই দিকে আসতে বারণ করেছি। কেন এসেছ? তুমিই তো সবথেকে ভালো জানেনা, একসপ্তাহ আগে কী হয়েছিল ওইখানে।
না এলে যে চলে না বাপ আমার। ফোকলা দাঁতে বলল সোনারু মাঝি। চাষের সময়। চারদিকে জমিতে ফসল। এখন ছাগলগুলো চরানোর ফাঁকা জমি পাই কোথায় মানিক? তাই আসতে হয়।
আর গুলি যখন তোমার পেট ফুড়ে দেবে, তখন কোথায় যাবে?
না বাপ, দেবে না। ওই পাহাড় থেকে আমাকে দেখা কি সোজা কথা? দেখবে, তবে না গুলি করবে।
তাহলে ওদের দেখেছিল কেমন করে? ওই বিমল, সন্দীপ ওদের?
বৃদ্ধ সোনারু এই বক্সাবনের ঘাসমাটির ওপর জন্মেছে। এই বনের ফলপাকুড়, পাখপাখালি, খরগোশের মাংস খেয়ে যুবক হয়েছে। এই বনের গাছের নীচে তার নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই অরণ্য থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে পেট ভরিয়েছে তার বংশধরদের। বনের ভেতরের জলাশয়গুলোর ধারের নরম মাটি যেভাবে জল খেতে আসা জীবজন্তুদের পায়ের ছাপে ভরে যায়, সেইভাবে সোনারুর মুখের চামড়ায় এই অরণ্য অজস্র দাগ কেটে গেছে। সোনারুর সঙ্গে কথা চালাবার সময় প্রমিতের মনের গভীরে হয়তো এই চিন্তাগুলো কাজ করছিল। নাহলে সে অন্ধকার বনপথে দাঁড়িয়ে তার সাথে এত কথা বলবেই বা কেন? তার মনে একটা ক্ষীণ আশা হয়তো ছিল–বুড়ো সোনারু তিন ফরেস্ট গার্ডের হত্যারহস্যের ওপর কোনও আলোকপাত করতে পারবে।