ঘরে ঢুকে দ্যুতি দেখল, সে যেভাবে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই বসে আছে প্রমিত। তার চিন্তামগ্ন দৃষ্টি একইভাবে জানলা দিয়ে বাইরে দিকে ফেরানো। দ্যুতি তাকে নীল ক্যাপসুলটা খাইয়ে চুপচাপ বাইরে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎই তাকে চমকে দিয়ে পেছন থেকে প্রমিত ডাকল–দ্যুতি!
অবাক হয়ে দ্যুতি ফিরে তাকাল।
তুমি দুপুরে কী খাবে? কোথায় খাবে?
হঠাৎই চোখে জল চলে এল দ্যুতির। এই লোকটা সবার কথা এত ভাবে কেন? কেন এর বুকে এত মায়া?
সে কোনওরকমে প্রমিতকে বলল, আপনাকে এখন সে সব ভাবতে হবে না। আমি গণেশদার সঙ্গে খেয়ে নেব। আপনি ঘুমোন।
চোখের জল আড়াল করতে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বেরিয়ে গেল দ্যুতি।
.
১০.
তারপর কেটে গেছে আরও দুটো দিন। এই দুদিনেও প্রতিদিন সকালে দ্যুতি চলে এসেছে আলিপুরদুয়ারে প্রমিতের কোয়ার্টারে। ফিরেছে রূপেন শইকিয়ার সঙ্গে সন্ধেবেলায়।
তৃতীয়দিনে প্রমিত ঘোষণা করল–আর নয়। সেইদিন থেকেই দ্যুতিকে দ্যুতির কাজ করতে হবে, তাকে তার কাজ। অর্থাৎ সে অফিস জয়েন করবে, এবং দ্যুতিকে ফিরে যেতে হবে তার ফিল্ডওয়ার্কে।
দ্যুতি তার স্বভাবসিদ্ধ স্বল্পভাষায় যতটা পারা যায় প্রতিবাদের চেষ্টা করল। বোঝাতে চাইল প্রমিতের কপালের ক্ষতটা এখনও শুকোয়নি, শরীরও দুর্বল। অতএব সে যেন আরও দু-একদিন ছুটি নেয়। সে আরও বোঝাতে চাইল যে, তার গবেষণার কাজে যতটা সময় লাগবে ভেবেছিল ততটা সময় লাগবে না। কারণ, রূপকথা, লোককথা সম্বন্ধে যতটা তথ্য পাবে বলে দ্যুতি কলকাতায় বসে ভেবেছিল, এখানে এসে, দুদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বুঝতে পারছে, ততটা পাবে না। অতএব তার হাতেও সময় এখন উদ্বৃত্ত এবং সে সেই সময়টা অনায়াসে প্রমিতের জন্যে দিতে পারে।
প্রমিত রাজি হল না। দ্যুতি কালো ফ্রেমের ভারী চশমাটা দু-আঙুলে কপালের ওপর ঠেলে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল, তারপর কোনও কথা না বলে রূপেন শইকিয়ার গাড়িতে ফিরে গেল হরিণডুবির দিকে।
তিনদিন অনুপস্থিত থাকার পরে অফিসে পৌঁছে প্রমিত প্রথমে ঘণ্টা দুতিন কোনওদিকে চাইবার ফুরসত পেল না, এত কাজ জমে গিয়েছিল টেবলে। তারপর হঠাই তার কাজগুলো শেষ হয়ে গেল। শেষ ফাইলটা তার পিওন কানুবাবুর হাতে তুলে দিতে গিয়ে প্রমিত দেখল আকাশে অসময়ের হালকা মেঘ জমেছে। অদ্ভুত এক হলুদ আলোয় ছেয়ে গেছে চরাচর। তার। হঠাৎই কেমন যেন মনকেমন করে উঠল। অশোক রাইকে ডাকল না, নিজেই জিপসিটা চালিয়ে নিয়ে প্রমিত বেরিয়ে পড়ল অনির্দিষ্ট পথে। হাইওয়ে পার হয়ে ঢুকে পড়ল টাইগার রিজার্ভের মধ্যে।
বনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই গাড়ির গতি কমে যায়। রাস্তা এখানে নষ্ট হয় তাড়াতাড়ি। সামান্য অযত্নেই অরণ্য এগিয়ে এসে গ্রাস করে নেয় মানুষের যাতায়াতের পথ। আদিম সব মহাবৃক্ষ থেকে বড় বড় ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। কখনও তা হাতিতে ভেঙেছে, কখনও ভেঙে পড়েছে পরগাছার ভারে। পড়ে আছে হাতির বিষ্ঠাও। তার ওপরে ঝাঁক বেধে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজস্র প্রজাপতি। এইসবের মাঝখান দিয়ে সাবধানে জিপ চালিয়ে চলেছিল প্রমিত। কোথায় যাচ্ছিল তা সে নিজেও জানত না। কিছুদূর যাওয়ার পরে সে সেই দুই রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছল, যেখান থেকে ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে জয়ন্তী গ্রামের দিকে, আর সোজা পথটা শেষ হয়েছে বক্সা পাহাড়ের নীচে সান্তারাবাড়ি গ্রামে গিয়ে। ওই পথেই ভুটান থেকে পাহাড়ি লোকেদের পিঠের টুকরিতে চেপে সান্তারা, মানে কমলালেবু নামে সমতল বাংলায়। তাই গ্রামের নাম সান্তারাবাড়ি। প্রমিত সামান্য চিন্তা করে সান্তারাবাড়ির পথটাই ধরল।
একটা পাহাড়ি না পেরোনোর পরেই জঙ্গলটা ঘন হয়ে উঠেছে। সেখানেই হঠাৎ শুকনো পাতা মাড়িয়ে মানুষের দৌড়ে পালানোর আওয়াজ শুনতে পেয়ে জিপটাকে ব্রেক কষে দাঁড় করালো প্রমিত। তারপর নিজেও দৌড়ে গেল পলায়নপর পদশব্দের পিছনে। মানুষগুলোকে দেখতে পেল না প্রমিত, তবে তাদের ফেলে যাওয়া শালগাছের গুঁড়িটা দেখতে পেল। প্রমিতের সার্ভিস-রিভলভারটা সবসময়েই গাড়ির গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রাখা থাকে। চট করে সেই অস্ত্রটা বার করে এনে প্রমিত জঙ্গলের মধ্যে এগিয়ে গেল। ভালো করে গাছের গুঁড়িটাকে দেখে সে বুঝতে পারল, হাতকরাত দিয়ে কাটা হয়েছে গাছটাকে–ওইখানেই, সম্ভবত কাল রাত্রেই। বিশাল গুঁড়িটার গা থেকে তখনও কাঁচা রজন গড়াচ্ছে। এই গাছটার এত বড় হতে কম করে সত্তর আশি বছর সময় লেগেছিল, অথচ নষ্ট হল কত সহজে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রমিত গাড়িতে ফিরে এল। তার প্রিয় এই অরণ্য কদিনের মধ্যেই লুঠেরাদের স্বর্গভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক। বিমল বাবুয়াদের মৃত্যুর পর থেকেই এখানে। পাহারা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু যে এইভাবে অবাধে গাছ কাটা হচ্ছে তাই নয় কাল রাতেই খবর এসেছে ঘাঘরঝোরার দিকে একটা বড় সম্বর হরিণকে মেরে পোচাররা তার শিং সমেত মাথাটা কেটে নিয়ে পালিয়েছে। এসব আটকাবার একটাই উপায়, নাইট-পেট্রলিং আবার। চালু করা। কিন্তু অবশিষ্ট ফরেস্টগার্ডরা বিমল বাবুয়াদের মৃত্যুর পর থেকে এতটাই ভয় পেয়ে গেছে যে, তাদের দিয়ে সে কাজ এই মুহূর্তে হবে বলে মনে হয় না। প্রমিত কলকাতায় চীফ কনজার্ভেটর অরিন্দম বসুর সঙ্গে আলোচনা করেছিল ব্যাপারটা নিয়ে। তিনিও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায়ের কথা বলতে পারছেন না। সময়কেই এখন সময় দিতে হবে, যাতে সে ওই তিনজনের মৃত্যুর স্মৃতির ওপর ধুলো ফেলতে পারে। কিন্তু সে সময়টা কতখানি? তার মধ্যে নতুন করে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেবে না তো?