তিনি লজ্জিত হয়ে বললেন নিশ্চয়, নিশ্চয়। চল, তাহলে রওনা হয়ে পড়ি।
ওরা যখন প্রমিতের বাংলোয় পৌঁছেছিল তখন সকাল আটটা। মফস্বল শহরের মন্থর জীবনছন্দে তখনও ঘুমের আবেশ জড়িয়ে রয়েছে। প্রমিতের বাংলোটাও যেন হালকা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। বাংলোর রোয়াক পেরিয়ে রূপেন শইকিয়া আর দ্যুতি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। কলিংবেলের দিকে হাত বাড়িয়েও রূপেন হঠাৎ থমকে থেমে গেলেন। বললেন, এ কি! দরজাটা খোলা কেন? মিস্টার ব্যানার্জি তো এসব ব্যাপারে খুব পার্টিকুলার।
মিস্টার ব্যানার্জি।–একটা হাঁক দিয়ে রূপেন একটু ফাঁক হয়ে থাকা পাল্লাদুটোকে ঠেলে খুলে ভেতরে ঢুকলেন, পেছনে পেছনে দ্যুতি। দরজা আলগা পেয়ে একটা ভাম রাতের বেলাতেই ঢুকে পড়েছিল কোয়ার্টারের মধ্যে। কোথা থেকে একছড়া কলা টেনে নিয়ে এসে প্রমিতের সামনের ঘরের মেঝেতেই সেগুলোকে খেয়ে চটকে ভুস্টিনাশ করছিল। এখন চালাক জন্তুটা দুজন মানুষের শব্দ পেয়ে চট করে ওদের পাশ কাটিয়ে বাগানে বেরিয়ে গেল।
মিস্টার ব্যানার্জি। আবার ডাক দিলেন রূপেন শইকিয়া। তারপর খুব অবাক হয়েই স্বগতোক্তি করলেন, কী ব্যাপার! বাড়িতে কেউ নেই না কি! পরমুহূর্তেই ওনারা পৌঁছে গেলেন। ভেতরের সেই ঘরটায় যেখানে খাটের ওপর অদ্ভুতভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল প্রমিত। তার পরণে তখনো অফিসের পোশাক।
দ্যুতি একটা অস্ফুট আওয়াজ করে দৌড়ে গিয়ে খাটের পাশে বসে পড়ল। একটা হাত একবার প্রমিতের কপালে চুঁইয়েই শক লাগার মতন টেনে নিল। বলল, দেখুন, প্রমিতদার গা জুরে পুড়ে যাচ্ছে।
মাই গড! ইনি এই ভাবে সারা রাত পড়ে আছেন! রূপেন শইকিয়া পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে একটা নম্বর ডায়াল করে বললেন দত্তবাবু বলছেন? শুনুন, যেভাবে হোক একজন ডাক্তারকে তুলে নিয়ে আপনাদের ব্যানার্জি সাহেবের কোয়ার্টারে চলে আসুন। এক্ষুনি। উনি খুব অসুস্থ।
পরের কয়েকটা ঘন্টা প্রমিতকে নিয়ে সকলেরই খুব উদ্বেগের মধ্যে কাটল। একবার মনে হয়েছিল হয়তো হাসপাতালেই ভরতি করতে হবে। কিন্তু দুপুরের পর থেকে জ্বরটা নেমে গেল, আচ্ছন্ন ভাবটাও কেটে গেল আস্তে আস্তে। ডক্টর সোম, যিনি প্রমিতকে দেখছিলেন তিনি বিছানার পাশের চেয়ারটা সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একজন কাউকে খুঁজছিলেন, যাকে পরবর্তী শুশ্রূষার নির্দেশগুলো দিয়ে যেতে পারেন। তাঁর দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই এসে স্থির হল ঘরের মধ্যে একমাত্র মহিলা, দ্যুতির মুখের ওপর।
দ্যুতিও এগিয়ে এল ডক্টর সোমের দিকে। বলল, হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যান কি করতে হবে।
ডক্টর সোম বললে, ঘাটায় ইনফেকশন হয়ে গেছে। সেইজন্যই জ্বরটা এত বেড়েছিল। আমি আজ তো একবার ড্রেস করে দিয়ে গেলাম। কাল আবার এসে ড্রেস করে দিয়ে যাব। তার মধ্যে এই ওষুধগুলো চলবে।
দত্তবাবু ডক্টর সোমের হাত থেকে প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ কিনতে চলে গেলেন। দ্যুতি বুঝে নিল কখন কীভাবে সেসব ওষুধ খাওয়াতে হবে। ঠিক হল সেইই আপাতত প্রমিতের কাছে থাকবে। রূপেন শইকিয়া তার অন্যান্য কাজকর্ম সেরে, সন্ধেবেলায় হরিণডুবি ফেরার পথে দ্যুতিকে তুলে নিয়ে যাবেন। আর রাতে প্রমিতের কাছে থাকবে গণেশদা। সে আজ বাড়ি ফিরবে না।
সকলেই চলে গেল। ঘরে রইল শুধু দ্যুতি আর প্রমিত। কিছুক্ষণ খাটের পাশে একটা চেয়ারে বসে দ্যুতি প্রমিতের রোগক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বেশ খানিকটা দ্বিধা কাটিয়ে ডাক দিল, প্রমিতদা!
প্রমিত বিছানার পাশের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। সাড়া দিল না। একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্যুতি উঠে পড়ল। বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির অন্যপ্রান্তে রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াল। গণেশদা সেখানে নেই, সম্ভবত পেছনে কুঁয়োতলায় জামাকাপড় কাঁচতে গেছে। দ্যুতি নিজেই গ্যাস জ্বেলে জল গরম করল। তারপর তাকের ওপরে রাখা হরলিকস-এর শিশিটা নামিয়ে এক গ্লাস হরলিকস বানিয়ে নিয়ে আবার প্রমিতের ঘরে ঢুকল। বিছানায় পাশে দাঁড়িয়ে আবারও ডাকল, প্রমিতদা!
এই বার প্রমিত আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে দ্যুতির দিকে তাকাল।
দ্যুতি হরলিকস-এর গ্লাসটা একটা টুলে নামিয়ে রেখে প্রমিতের পিঠে হাত দিয়ে বলল, একটু উঠুন। প্রমিত বাধ্য ছেলের মতন উঠে বসল। দ্যুতি দুটো বালিশ তার পিঠের পেছনে গুঁজে দিয়ে তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর গ্লাসটা প্রমিতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা খেয়ে নিন!
এবারও প্রমিত বিনা বাক্যব্যায়ে তার নির্দেশ মেনে নিল। দ্যুতি বুঝতে পারল, প্রমিত কোনোভাবেই অন্য কোনোরকম কথাবার্তায় জড়িয়ে পড়তে চাইছে না। চাইছে না তার মাথার ভেতর অবিরাম যে চিন্তার জাল বোনা চলছে তাতে কোনও ছেদ পড়ুক। খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে দ্যুতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাংলোর পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসল। কতক্ষণ বসে বসে শুনল নিস্তব্ধ দুপুরে কুঁয়ো থেকে জল তোলার ধাতব শব্দ। দেখল বাতাবি লেবুর গাছে দুটো দুর্গাটুনটুনি নেচে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। এখনই একটা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কথা প্রমিতদাকে।