এদের মধ্যে দৈনিক দিনকালের মহিলা-সাংবাদিক স্পষ্টই জিগ্যেস করলেন, শিরোমণির গড়ে মারমেড গ্রুপের কটেজ বানানোর প্রস্তাবটায় আপনি রাজি হচ্ছেন না কেন, মিস্টার ব্যানার্জি? তাহলে তো জায়গাটার একটা সিকিউরিটি থাকে। এমপ্লয়মেন্ট জেনারেটেড হয়।
প্রমিত পরিবেশ দূষণের কথা বলতে গেল, কিন্তু তুখোড় সাংবাদিকটি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন– দ্যাট ইজ নট ইওর লুক আউট মিস্টার ব্যানার্জি। তার জন্যে পরিবেশ মন্ত্রক রয়েছে। আপনি। তাদেরই বিচার করতে দিন না।
সাংবাদিক নয়, মহিলার গলায় মারমেডের উকিলের সুর শুনতে পেল প্রমিত৷ সে ক্লান্ত গলায় বলল, হ্যাঁ, হয়তো শেষ অবধি আমাদের সেইরকম ডিসিশনই নিতে হবে।
মহিলার মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল।
প্রমিতও হাসল, তবে মনে মনে। সে জানত, দৈনিক দিনকালের মালিকানা মারমেড বিজনেস গ্রুপের হাতে।
.
সন্ধের সময় প্রমিতের অনুমানের বাকিটাও মিলে গেল। আজ সে অফিস থেকে অনেক আগেই ফিরে এসেছিল। তার বৃদ্ধ হেল্পিং-হ্যান্ড গণেশদা তাকে এক গ্লাস হরলিকস করে দিয়েছিল। তাই খেয়ে সে চুপ করে শুয়েছিল নিজের ঘরে। সেই সময়েই তার মোবাইলে মধু বর্মনের ফোনটা এল। মধু বর্মন সাপের মতন হিস-হিস করে উঠল ব্যানার্জি সাহেব, আমার কথাটা যদি মেনে নিতেন, তাহলে এভাবে আমাদের ওই তীর্থ আমাদেরই জাতের মেয়ের রক্তে লাল হয়ে যেত না।
তার উত্তরে মধুকেও আজ একই কথা বলল প্রমিত, যে কথা সে দুপুরে মিডিয়ার লোকজনকে বলেছিল। আমাকে আর দু-চারটে দিন ভেবে দেখার সময় দাও মধু। মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা পুনর্বিবেচনার দরকার আছে।
হ্যাঁ, দেখুন দেখুন! তাড়াতাড়ি দেখুন। মধুর গলায় পুরোপুরি প্রভুত্বের স্বর। প্রমিতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোন কেটে দিল।
.
এর কিছুক্ষণ পরেই প্রমিতের জ্বরটা এল।
গণেশদা সন্ধে সাতটা নাগাদ রাতের রুটি তরকারি বানিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেল। প্রমিত একটা ঘোরের মধ্যে শুনল, যাবার সময় সে বলে গেল, দাদাবাবু, আমি বেরোলাম। দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।
তবু দরজা খোলাই পড়েছিল সারা রাত। জ্বরের ঘোরে প্রমিতের মনে হচ্ছিল সে তাদের ভবানিপুরের বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছে। জানলা দিয়ে দুপুরের রোদ এসে যেন তার মাথা মুখ পুড়িয়ে দিচ্ছিল। সে কতবার বলল, মা, জানলাটা বন্ধ করে দাও। মা, জানলাটা…। কিন্তু মা কি কাজে ব্যস্ত কে জানে। এক বুক অভিমান নিয়ে আস্তে আস্তে অচৈতন্য হয়ে গেল প্রমিত।
.
০৯.
শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে প্রায় পনেরো একর জায়গার ওপর বছর দুয়েক হল গড়ে উঠেছে। এক নতুন বিলাসবহুল হোটেল। বাগান, সুইমিংপুল, পার্কিং-লট দিয়ে সাজানো হোটেল জেতবন।
ছতলা জেতবনের সর্বোচ্চতল জুড়ে একটিই সুইট তিনটি বড় ঘর, লাউঞ্জ, ডাইনিং রুম, কিচেন নিয়ে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বিলাসবহুল বাসস্থান। পুঞ্জ পুঞ্জ নরম আপহোলস্ট্রি দিয়ে মোড়া সোফাসেট, টিক-উড-এর ডাবলবেড, ফরাসি ক্রিস্টালের ল্যাম্পশেড, রেশমমসৃণ দেওয়ালে আইভরি ফ্রেমে বাঁধানো মুঘল মিনিয়েচারস্-এর প্রতিলিপি এবং বেত আর ধাতুর আরও অজস্র আসবাবে চোখ ধাঁধানো গৃহসজ্জা। এক কথায়, ধনী বিশ্বের যে-কোনও পাঁচতারা হোটেলের সমগোত্রীয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে জেতবনের এই প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট। এখানে। যারা থাকতে আসে তারাও বিশ্বনাগরিক প্রধানত ব্যবসায়ী কিম্বা ডুয়ার্সে শু্যটিং করতে আসা কোনও বলিউড ফিল্মস্টার। ক্বচিৎ কখনও খুব বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা।
আজ এই হেমন্তের সন্ধ্যায় যে দুজন মানুষ প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের লাউঞ্জে বসে আছে তাদের অবশ্য ঠিক এই হোটেলের কাস্টমার বলা চলে না। তাদের মধ্যে একজন তো মালিকপক্ষেরই লোক–বিনতা মেহরা, আর অন্যজন তারই অতিথি, মধু বর্মন।
হ্যাঁ, হোটেল জেতবনের মালিকানা বিনতার মারমেড গ্রুপেরই হাতে। আর সেইই আর্জেন্ট কল দিয়ে ডেকে এনেছে মধু বর্মনকে। মধুর বডিগার্ড ঝুপা হোটেল থেকে একটু দূরে একটা ভাড়া করা টাটা সুমোর মধ্যে বসে অপেক্ষা করছে। বিনতার সঙ্গে কাজ শেষ হলে সে মধুকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার ফিরবে।
সন্ধেটা সুন্দর। জেতবনের লাউঞ্জের উত্তরমুখি কাচের দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের বুকে সন্ধ্যা নামছে। আকাশে তারা ফুটছে, পাহাড়ি গ্রামগুলোতেও আলো জ্বলে উঠছে। অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের শরীর, মুছে যাচ্ছে দু-ধরনের আলোকবিন্দুর মাঝের সীমারেখা। মনে হচ্ছে, একটাই চুমকিগাঁথা কালো ভেলভেটের চাদর যেন মাটি থেকে আকাশ অবধি পাতা আছে।
বাইরের ওই শান্ত সৌন্দর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরের কনসিলড সাউন্ড সিস্টেমে খুব নীচু পারদায় বাজছে কেনি জি-র স্যাক্সোফোন। বিনতা মেহরা আর মধু বর্মনের মাঝখানে পিতলের কাজ করা জয়পুরি সেন্টার টেবলের ওপর নামানো আছে দুটি স্ফটিক স্বচ্ছ সুরাপাত্র। সোনালি সুরার গভীর থেকে বুদবুদ উঠছে অজস্র, অনর্গল।
তবে এ কথা নিশ্চিত যে, এই সব শান্ত সৌন্দর্যের কোনও প্রভাবই ঘরের দুই মানব মানবীর মনের ওপর পড়েনি। ওদের মধ্যে এখন একটা যুদ্ধ চলছে। দুজনেই যাকে ইংরিজিতে বলে ন্যাস্টি মুডে রয়েছে।
সেই মুডেরই প্রকাশস্বরূপ, বিন ওয়াইন গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে সেটাকে এত জোরে সেন্টার টেবলের ওপর নামিয়ে রাখল যে, কিছুটা মদ চলকে টেবিলের ওপর পড়ল। তারপর সে কোলের ওপর খসে পড়া আঁচলটাকে বুকের ওপর জড়ো করে, সামান্য টলোমলো পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। নীচে তাকাল। দেখল, নীল সুইমিংপুলের ধারে প্রমোদলোভীদের ভিড়। ট্রের ওপর খাদ্য পানীয় সাজিয়ে দ্রুত পায়ে যাতায়াত করছে হোটেলের বেয়ারারা। বারবিকিউ কাউন্টার থেকে ভেসে আসা ঝলসানো মাংসের সুঘ্রাণ এত ওপরেও উঠে আসছে।