হাঁটতে গিয়ে প্রমিত বুঝতে পারল সে পায়ে জোর পাচ্ছে না। দেবেশ কাশ্যপের শরীরের ওপর ভর দিয়েই সে অফিসঘরে নিজের চেম্বারের ভেতর ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। চার পাঁচজন সহকর্মী এগিয়ে এল। তাদের সকলেরই চোখে উদ্বেগ। ওদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে ওর হাতে পুরু একটুকরো তুলো ধরিয়ে দিল।
থ্যাঙ্ক ইউ তারাপদ। ম্লান হেসে প্রমিত রক্তমাখা রুমালটা পাশের লিটার-বিনে ফেলে দিয়ে তুলোর টুকরোটা দিয়ে কপালের ক্ষতস্থানটা চেপে ধরল। সে বুঝতে পারল, ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতিটা এবার কপাল থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সে চোখ তুলে সহকর্মীদের দিকে তাকাল। বলল, আপনারা কাজে যান। তেমন কিছু হয়নি আমার। চিন্তা করবেন না।
ফরেস্ট অফিসের কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে অসন্তুষ্ট স্বরে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বোঝাই যাচ্ছে তাদের হেড-অফ-দা-অফিসের ওপর এই আক্রমণের ঘটনাকে তারা ভালো চোখে দেখছে না। প্রমিত উদ্বিগ্ন মনে ভাবল, ওনারা প্রতিশোধের কথা ভাবছেন না তো? যারা এইমাত্র তাকে মেরে গেল, প্রমিত জানে, তারা নিজেরাই মার খাওয়া মানুষ। কোনওরকম প্রতিশোধের যোগ্যই তারা নয়।
কিন্তু সে নিজে কী দোষ করল? ওরা তাকে মারল কেন?
ঘর ফাঁকা হওয়ামাত্র প্রমিত দেবেশ কাশ্যপকে আবার জিগ্যেস করল, কী হল বলুন তো, মিস্টার কাশ্যপ? ওরা কার মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল? হাতিতে মেরেছে কাউকে?
না মিস্টার ব্যানার্জি। মানুষে। প্রথমে রেপ করেছে, তার পরে খুন। কাল রাতের ঘটনা। আজ ভোরে ওর আত্মীয়রাই বডি রিকভার করেছে। তারপর এই আনরেস্ট। বলছিল, আপনার সঙ্গে কথা না বলে পোস্টমর্টেমের জন্যে বড়ি ছাড়বে না। আমি থু-আউট সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম, চাইছিলাম পিসফুলি ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে। পারলাম না।
ওঃ ভগবান! আইডেন্টিফাই করা গেছে মেয়েটাকে?
হ্যাঁ। চকচকি গ্রামের মেয়ে, নাম গুলাবি নার্জিনারি। কাল দুপুরে একা একাই শিরোমণির গড়ে পুজো দিতে গিয়েছিল। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল ওখানে পৌঁছতে। ওখানেই গ্যাং-রেপড় হয়েছে।
ওখানে, মানে শিরোমণির গড়ে? আতঙ্কিত প্রমিতের তুলে ধরা হাতটা কপাল থেকে খসে পড়ল। এক ফোঁটা তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ল তার ক্ষতমুখ থেকে। সেদিকে দৃকপাত না করেই সে দেবেশ কাশ্যপের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, বলুন মিস্টার কাশ্যপ। শিরোমণির গড়ে একটা মেয়ে রেপড় হয়েছে? খুন হয়েছে? শিরোমণির গড়ে?
প্রমিতের আতঙ্কের কারণটা বুঝতে দেবেশ কাশ্যপের একটুও অসুবিধে হচ্ছিল না। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
প্রশ্নটা করার সময়ে প্রমিত নিজের চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উত্তরটা পাবার পর আবার সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল তার শরীরের ভেতরে কোনও হাড়ের কাঠামো নেই। ইতিমধ্যে একজন স্থানীয় ডাক্তার ঘরে এসে প্রমিতের কপালের ক্ষতস্থান সেলাই করে দিয়ে গেলেন। অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে, ব্যথা কমানোর একটা ওষুধও তখনই খাইয়ে দিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বলে গেলেন যে ব্যথার তাড়সে একটু পরে জ্বর আসতে পারে। এলে যে ওষুধ খেতে হবে তাও লিখে দিয়ে গেলেন তিনি।
ডাক্তারবাবু যতক্ষণ ঘরে ছিলেন ততক্ষণ প্রমিত আর কোনও কথা বলেনি; চোখ বুজে চেয়ারের পিঠে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে শুয়েছিল। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে সে দেবেশ কাশ্যপকে বলল, এরপর কী হবে বুঝতে পারছেন?
দেবেশ কাশ্যপ কোনও উত্তর দিলেন না।
এরপর মধু বর্মন এবং তার অনুগামীরা আমার ওপর শকুনের মতন ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওরা বলবে, আজ ওখানে হোটেল গড়ে উঠতে দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না।
এবারেও দেবেশ কাশ্যপের দিক থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া এল না। অবশ্য প্রমিত কোনও প্রতিক্রিয়া চাইছিল না বোধহয়। সে স্বগতোক্তির ঢঙে বলে চলল, মিডিয়াও আমাকে ছাড়বে না। একটা জায়গায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর দুটো এরকম ঘটনা। অ্যাডমিনস্ট্রেটর হিসেবে। আমাকে তো তারা কাঠগড়ায় তুলবেই।
প্রমিত চোখ বুজেই বুঝতে পারল দেবেশ কাশ্যপের ভারী হাতটা আলতোভাবে তার কাধ ছুঁল। কাশ্যপ বললেন, নিজেকে অপরাধী করবেন না ব্যানার্জি। দায় কি আপনার একার আছে? আমার নেই? ল অ্যান্ড অর্ডার তো আমারই এক্তিয়ারে। সে কথা যদি বলেন তো আমিও। মিজারেবলি ফেইল করেছি।
প্রমিত বলল, না, মিস্টার কাশ্যপ। আপনি ভালোই জানেন জঙ্গলের মধ্যে নাইট-পেট্রলিং করার ক্ষমতা আপনার পুলিশবাহিনীর নেই, ওটা আমারই দায়িত্ব। অথচ ট্র্যাজেডি দেখুন, বিমল বাবুয়ারা মারা যাবার পর থেকেই সেই নাইট-পেট্রলিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। একেই বলে উভয় সংকট। রাতে জঙ্গলে ঘুরলে ফরেস্টগার্ডরা মরবে। আর রাতপাহারা বন্ধ থাকলে গুলাবির মতন মেয়েরা মরবে। পশুপাখির কথা ছেড়েই দিন।
.
প্রমিতের একটা অনুমান নির্ভুল প্রমাণিত হল। দেবেশ কাশ্যপ বেরিয়ে যাবার একঘণ্টার মধ্যে কলকাতার তিনটে টিভি চ্যানেলের উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিরা তাদের টিম নিয়ে আলিপুরদুয়ারে প্রমিতের অফিসে পৌঁছে গেলেন। কলকাতা এবং শিলিগুড়ির চার পাঁচটা সংবাদপত্রের সাংবাদিকও ছিলেন। প্রমিত মনে মনে হিসেব করে দেখল, ওর মাথায় স্টিচ পড়ার আগে এরা গুলাবির মৃত্যুর খবর পেয়েছে। তা না হলে এত দ্রুত এতটা পথ পেরিয়ে এখানে চলে আসা সম্ভব নয়।