ওরা দুজন ঘাসজমিটার কাছ থেকে রওনা হয়ে, ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রমিতের গাড়ি অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। গাড়ির সিটে উঠে দরজাটা টেনে বন্ধ করে প্রমিত বলল, আমি নিজেও খুব কনফিউজড মিস্টার শইকিয়া। হয়তো টেররিস্টদের হাতে অত্যাধুনিক কোনও নাইট ভিশন বায়নোকুলার চলে এসেছে, যার হদিস আমরা রাখি না। তা ছাড়া আর কী হতে পারে বলুন?
গাড়ির জানলায় রাখা প্রমিতের হাতের ওপর নিজের হাতটা আলতোভাবে রেখে রূপেন শইকিয়া বললেন, মিস্টার ব্যানার্জী, ভেঙে পড়বেন না। আমিও আপনার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। এ রহস্য আমি ভেদ করবই।
থ্যাঙ্কস। আপনারাও আর দেরি করবেন না। রওনা হয়ে যান। আর যেভাবে হোক সন্ধের আগে বাংলোয় ফিরে যাবেন। রাতকেই এখন বেশি ভয় পাচ্ছি। যে অন্ধকার আমাদের আড়াল দিত, সেই অন্ধকারই আমাদের ঘাতক হয়ে গেছে।
কথাটা বলে প্রমিত গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আলিপুরদুয়ারের দিকে রওনা হয়ে গেল। তার গাড়িটা যখন রূপেনের পার্ক করে রাখা বোলেরোকে পেরিয়ে যাচ্ছে তখন প্রমিত একবার গাড়িটাকে স্লো করে পেছনের সিটে পাঠমগ্না দ্যুতিকে ডাকল–হাই!
দ্যুতি মুখ তুলে তাকাল।
টেক কেয়ার। ডক্টর শইকিয়ার থেকে আলাদা হবেন না কখনও।
লাজুক হেসে দ্যুতি বলল, ঠিক আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।
ছড়িয়ে থাকা বোল্ডারে বিপজ্জনক ভাবে দুলতে দুলতে প্রমিতের জিপ এগিয়ে যাচ্ছিল। সেইদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হঠাৎ দ্যুতি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ডাকল–শুনুন।
ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল প্রমিতের গাড়ি। সেও জানলা দিয়েই মুখ বাড়িয়ে পেছনে তাকাল। কী হল?
আপনিও সাবধানে যাবেন।
.
০৮.
দ্যুতি আর রূপেনকে বিদায় দিয়ে প্রমিত হরিণডুবি বিট-অফিসে গিয়ে কিছু ফাইলপত্রের কাজ সারল এবং তারপর সে যখন আলিপুরদুয়ারে নিজের অফিসের কম্পাউন্ডে গাড়ি ঢোকাল তখন বেলা অনেকটাই গড়িয়ে গেছে।
কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতেই প্রমিত দেখল অফিসের সামনে বেশ কিছু লোকের একটা জটলা। লোকগুলো সকলেই আদিবাসী; মহিলা পুরুষ মিলিয়ে প্রায় একশোজন হবে। কিন্তু কেন এসেছে ওরা? বুঝতে পারল না প্রমিত। আজ তো কোনও লাইসেন্স বিতরণের দিন নয়।
প্রমিত এটাও খেয়াল করল যে, লোকগুলো অস্বাভাবিক নীরব। ওদের ভাবভঙ্গিতেও কেমন যেন কাঠিন্য। লোকগুলোর চোখের দৃষ্টি সারাক্ষণ তার গাড়ির গতিপথ অনুসরণ করে যাচ্ছে।
গাড়িটাকে ধীর গতিতে অফিসের আরও একটু কাছে নিয়ে আসতেই সে দেখতে পেল জটলাটার অন্যপাশে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর জটলাটার মাঝখানে মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে, তা নির্ভুলভাবে একটি মৃতদেহ। সাদাকাপড়ে মোড়া একটা লাশ ঠিক তার অফিসের বারান্দার নীচে মাটিতে শোয়ানো রয়েছে।
এই অবধিই দেখতে পেয়েছিল প্রমিত। এরপরেই সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে জমাট নৈঃশব্দকে চুরমার করে একটা, মাত্র একটাই গলা, চিৎকার করে উঠল–মারো!
সেই একটা শব্দই মুহূর্তের মধ্যে একশো গলায় ছড়িয়ে পড়ল। একটা বড় পাথর প্রমিতের জিপের উইন্ডস্ক্রিনটাকে চুরমার করে তার পাশে এসে পড়ল। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে দুটো কাজ একইসঙ্গে করল প্রমিত–চাবি ঘুরিয়ে জিপটার স্টার্ট বন্ধ করে দিল, আর মাথাটা নীচু করে নিজে বসে পড়ল সিটের নীচে। ততক্ষণে অসংখ্য পাথর এসে পড়ছে তার জিপের ছাদে। লোহা আর পাথরের সংঘাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে বসেও প্রমিত বুঝতে পারছিল মার মার শব্দ করে ভিড়টা ক্রমশ এগিয়ে আসছে, ঘিরে ধরছে তার গাড়িটাকে। ঠিক এই সময়েই আরও একটা পাথর ড্রাইভিং-সিটের পাশের জানলা দিয়ে ঢুকে সজোরে প্রমিতের কপালে আঘাত করল। চেতনা আর অচেতনার মাঝখানে দুলতে দুলতে প্রমিত বুঝতে পারল পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করেছে। কোলাহলটা ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছে। সে পকেট থেকে রুমালটা বার করে কপালে চেপে ধরল। সাদা রুমালটা দেখতে দেখতে লাল হয়ে গেল। প্রমিত টলতে টলতে নেমে এসে জিপের বডিটায় ভর দিয়ে দাঁড়াল। ততক্ষণে আদিবাসী মেয়ে পুরুষের জটলাটা পুলিশের তাড়ায় ফরেস্ট অফিসের কম্পাউন্ডের বাইরে পালিয়েছে। ফাঁকা চত্বরটায় তখন শুধু প্রমিত আর সেই কাপড়ে ঢাকা শবদেহ।
ওটা কার মৃতদেহ?
একটা বলিষ্ঠ হাত এসে প্রমিতের কম্পমান শরীরটাকে জড়িয়ে ধরল। প্রমিত পাশ ফিরে দেখতে পেল ডিএসপি দেবেশ কাশ্যপের গম্ভীর মুখ। কাশ্যপ সাহেব বললেন, স্যরি ব্যানার্জি। ওরা যে আপনার সঙ্গে কোনও কথা বলবার আগেই এত ভায়োলেন্ট হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। হতোও না, যদি না একটা স্কাউলে ওদের ইন্সটিগেট করত। প্রথম মারের ডাকটা সেই-ই দিয়েছিল। অ্যান্ড দেন দ্যা মব কট ইট আপ। বুঝতে পারছি না, শয়তানটা কে?
ওটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। মধু বর্মণের লোক এ কথা নিশ্চিত। তবে ওর সমস্ত চ্যালার মুখ তো আপনি চেনেন না। কাজেই অইডেন্টিফাই করতে পারবেন না। কিন্তু এবার আসল কথাটা বলুন। মৃতদেহটা কার?
ভেতরে চলুন, সব বলছি।
কেন, ভেতরে যাব কেন? ওদের ভয়ে? গোঁয়ারের মতন মাটিতে পা গেঁথে দাঁড়াল প্রমিত।
আরে না না। ডাক্তারকে খবর দিয়েছি। আপনার কপালে দুয়েকটা স্টিচ দরকার মনে হচ্ছে। সেটা তো এখানে দাঁড়িয়ে হবে না।