সেই সকালে প্রমিত অবিশ্বাসের চোখে তার তিন নির্ভরযোগ্য যোদ্ধার মৃতদেহের দিকে চেয়েছিল। ওরা তিনজনেই চিৎ হয়ে পড়েছিল। তিনজনেরই বুকে একটা করে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন। প্রমিত কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সামনাসামনি লড়াইয়ে ওদের কেমন করে কেউ এত পরিষ্কারভাবে মারতে পারে। এ তো মেশিনগানের শট নয় যে, ওরা প্রস্তুত হবার আগেই এলোপাথারি গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দিল। এ তো রীতিমতন টিপ করে, সময় নিয়ে, মারা হয়েছে।
কেমন করে…কেমন করে কেউ ওদের সামনে এসে, সেই সময়টা দিয়েও, বেঁচে ফিরে যেতে পারে! ওরা কী করছিল তা হলে? কেন উলটে মারেনি সেই আগুয়ান ঘাতককে?
এই প্রশ্নের ভার মাথায় নিয়ে হরিণডুবি বিট-অফিসের কাঠের বাড়িতে ফিরে এসেছিল প্রমিত। মৃতদেহগুলোকে পোস্টমর্টেমের জন্যে শিলিগুড়িতে রওনা করিয়ে দিয়ে ও.সি রতন বৈদ্যও এসেছিলেন তার সঙ্গে। প্রমিতের সামনেই তিনি ইন্টারোগেট করেছিলেন দুই ক্লার্ক জীবন সিং আর গোপিনাথ মণ্ডলকে। বিট-অফিসার সজলবাবুর সঙ্গেও অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন তিনি। সেই কথাবার্তায় যা জানা গিয়েছিল, তা রহস্যকে আরও গাঢ় করে তুলেছিল।
বিট-অফিসের পেছনে ছোট্ট লিভিং-কোয়ার্টারে রান্নাঘর আর বাথরুম ছাড়া দুটো মাত্র কামরা। তার একটায় থাকতেন নিহত তিন ফরেস্টগার্ড, আর অন্যটায় থাকতেন বিট-অফিসার সজল দত্ত। তৃতীয় কোনও ঘর না থাকায় জীবন সিংহ আর গোপিনাথ মণ্ডল অফিসঘরের মেঝেতেই রাতে বিছানা পেতে শুতেন। লিভিং কোয়ার্টারের ঘরদুটোর পেছনদিকেও যেমন দরজা আছে তেমনি আরও একটা দরজা আছে অফিসঘরের দিকে। যখন ফরেস্টগার্ডরা গভীর রাতে সারপ্রাইজ চেকিং-এ বেরোতেন, তখন পেছনের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে তারা অফিসঘরের মধ্যে দিয়েই বেরোতেন, কারণ সে ক্ষেত্রে, তারা বেরিয়ে যাবার পরে, জীবনবাবু কিম্বা গোপিনাথ মণ্ডল আবার ভেতর থেকে দরজায় খিল দিয়ে দিতে পারতেন। এই ব্যবস্থায় নিরাপত্তা ছিল। বেশি।
ঘটনার আগের রাতে ওরা যে যার নির্দিষ্ট ঘরেই ঘুমোচ্ছিল। এমন সময় অনেকদূর থেকে ভেসে আসা দুটো রাইফেল ফায়ারিং-এর আওয়াজে ওদের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। একটা ফায়ারিং-এ ওরা জেগে ওঠে। তার প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে দ্বিতীয় গুলির শব্দটা ভেসে আসে।
এমনিতে এই হেমন্তমাসে, যখন জঙ্গলের প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জমিগুলোতে পাকা ফসল বিছিয়ে আছে, তখন সারারাতই সেই ফসল নষ্ট করতে আসা হাতির পালকে তাড়াবার জন্যে এদিক ওদিকে ক্র্যাকার ফাটানো হয়। অনভ্যস্ত কানে ক্র্যাকারের আওয়াজ থেকে রাইফেলের গুলির আওয়াজ আলাদা করে চেনা কঠিন। কিন্তু হরিণডুবি বিট-অফিসে যারা ছিল তারা জঙ্গলের সমস্ত আওয়াজকে খুব ভালো করে চিনবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তারা শুধু যে গুলির আওয়াজকেই আলাদা করে চিনতে পেরেছিল তাইই নয়, সেই আওয়াজ জঙ্গলের ঠিক কোনখান থেকে এসেছে সেটা বুঝে নিতেও তাদের অসুবিধা হয়নি, বিশেষত, ওই দ্বিতীয় গুলির আওয়াজটা থেকে, যখন তাদের মাথা থেকে ঘুমের ঘোর সরে গেছে।
ওদের সন্দেহ ছিল না যে, ওই গুলির আওয়াজ এসেছে জঙ্গলের প্রান্তে জয়ন্তী নদীর বেড-এর ওপর থেকে। তার মানে পোচাররা জঙ্গলে ঢুকবার ধান্দা করছে।
জয়ন্তীর যে পাড়ে হরিণডুবি, তার ঠিক অন্য পাড়েই ভুটান। ও পাড়ে, নদীর কিনারার সামান্য জায়গা বাদ দিয়ে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। ভুটান-গভর্নমেন্টের কোনও নিয়ন্ত্রণই নেই ওই জায়গাটার ওপর। ওটা সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তাঞ্চল।
আর এ কথা সকলেই জানে যে, সন্ত্রাসবাদী আর চোরাশিকারি এখন সমার্থক। ভারতের বিভিন্ন বনাঞ্চলে টেররিস্টরাই চোরাশিকারের কাজটা করে, বিশেষ করে এই উত্তরপূর্ব ভারতের বনগুলোয়। এইভাবেই ওরা সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালাবার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগাড় করে। হাতির দাঁত, গন্ডারের খড়গ কিম্বা বাঘের চামড়ার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা জহরতের চেয়েও বেশি। ওইসব প্রাণীর দেহাংশ বিদেশে, বিশেষ করে চীনের চোরাবাজারে বিক্রি করে টেররিস্টরা তাদের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ কেনে। এইভাবেই বোরো জঙ্গিদের হাতে এককালের অপরূপ মানস স্যাংচুয়ারি ছারখার হয়ে গেছে। লোয়ার অসমের এই টাইগার-স্যাংচুয়ারিতে আজ একটিও ডোরাকাটা বাঘ বেঁচে আছে কি না সন্দেহ। পোচারদের এর পরের লক্ষ বক্সা টাইগার রিজার্ভ। এই বনাঞ্চলও নানান দুর্লভ প্রজাতির প্রাণী আর দুমুল্য কাঠের গাছের জন্যে বিখ্যাত। আর সেই ধনাগারে ঢুকবার সবচেয়ে সহজ রাস্তা জয়ন্তীর বেড পেরিয়ে হরিণডুবির মধ্যে দিয়ে। এর আগেও বহুবার এইভাবে জঙ্গলে ঢুকে লুঠপাট চালিয়ে গেছে চোরা শিকারিরা। বিগত এক বছরে, বিমল, বাবুয়া, সন্দীপেরা আসবার পর থেকে ওরা তিনজনে সিংহবিক্রমে চোরাশিকারিদের আটকাচ্ছিল। কাল রাতে গুলির আওয়াজ শুনে ওদের কারুর সন্দেহ থাকে না যে, কিছুদিন চুপচাপ কাটানোর পরে আবার পোচাররা জঙ্গলে ঢুকে জংলি জানোয়ার মারছে। তিন ফরেস্টগার্ড দ্রুত সাজপোশাক পরে নিয়ে ওদের মোকাবিলায় রওনা হয়ে যায়। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে দরজায় খিল তুলে দেন দুই ক্লার্কের মধ্যে একজনজীবন সিংহ। ও.সি. রতন বৈদ্যের প্রশ্নের। উত্তরে তিনি জানান, তখন রাত ঠিক দেড়টা।