গাড়ি থেকে নেমে উলটোদিকের ভুটানপাহাড়ের সারির দিকে তাকালেন রূপেন শইকিয়া। তারপর প্রমিতকে জিগ্যেস করলেন, আপনি সিওর মিস্টার ব্যানার্জি যে, গুলিগুলো ওই পাহাড় থেকেই ছোঁড়া হয়েছিল?
প্রমিত বলল, তাছাড়া আর কি হতে পারে বলুন। বিমল বাবুয়ারা তো রিভারবেডে কিম্বা নদীর ওই তীরে কাউকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে ওভাবে বোকার মতন দুপায়ের ওপর উঠে দাঁড়াত না। শুয়ে শুয়েই তাকে গুলিতে খতম করে দিত। তার মানে যারা গুলি করেছে। তারা ওই পাহাড়ের ওপরে লুকিয়ে ছিল। আর তা ছাড়া ফরেনসিক রিপোর্টও বলছে গুলিগুলো ছোঁড়া হয়েছে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূর থেকে। ওই দূরত্বে পাহাড় ছাড়া আর কী আছে বলুন?
কিন্তু ওই রাতে…নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে ওদের দেখল কেমন করে?
সেইটাই তো আমারাও ভেবে পাচ্ছি না, মিস্টার শইকিয়া। আপনি শুধু একজন বিজনেসম্যান কিম্বা স্কলার নন, ভালো শিকারিও। আপনি ভেবে দেখুন না, যদি কিছু কিনারা করতে পারেন।
রূপেন শইকিয়া অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সেই ঘাসজমির ফালিটা অবধি চলে। গেলেন। পেছন পেছন প্রমিত। বাবুয়া সন্দীপদের শরীরের চাপে থেঁতলে যাওয়া ঘাসগুলো এই কদিনে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। রক্তের দাগ ঢাকা পড়ে গেছে নতুন করে উড়ে আসা ধুলোমাটির নীচে। সেইখানে দাঁড়িয়ে প্রমিত উলটোদিকে পাহাড়গুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে হঠাৎ আত্মমগ্ন গলায় ডাকল, মিস্টার শকিয়া।
কিছু বলছেন?
আপনার চোখের দৃষ্টি কেমন?
লোকে তো বলে বাজপাখির মতন।
এবং আমি জানি আপনি একজন ক্র্যাকশট, বন্দুক হাতে আপনার টিপ ফসকায় না। তাহলে বলুন তো, এই মুহূর্তে আমি যদি আপনার হাতে একটা স্নাইপারস রাইফেল দিয়ে দিই, উইথ টেলিস্কোপিক সাইট, এবং আপনাকে বলি ওইই দূরে পাহাড়টার মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষের হৃদপিণ্ডে গুলি করতে, আপনি পারবেন?
প্রমিতের দৃষ্টিকে অনুসরণ করে রূপেন শইকিয়া তাকালেন পাহাড়ের দিকে। সমস্ত জায়গাটাই ডলোমাইট পাথরের একঘেয়ে ছাই রঙে চোবানো। রুক্ষ্ম পাথরের ওপর রোদ পড়ে ঠিকরে আসছে, ধাঁধা লেগে যাচ্ছে চোখে। রূপেন শইকিয়া দেখলেন এতদুর থেকে আলাদা করে কোনও আকৃতিই বোঝা যাচ্ছে না। তিনি নিশ্চিত সুরেই বললেন, না মিস্টার ব্যানার্জি, আপনি আমাকে সবরকম ইকুইপমেনটস দিয়ে দিলেও পারব না। টেলিস্কোপিক সাইট ওই ডিস্ট্যান্সে কোনও কাজে আসবে না। বেস্ট সাইটের পাল্লাও আড়াইশো মিটারের বেশি হয় না। এ তো তার দশগুণ। আর, যেখানে টার্গেটটাকে দেখতেই পাচ্ছি না, সেখানে হিট করব কেমন করে?
আচ্ছা বেশ। এবার ধরুন রাতের ঘন অন্ধকারের মধ্যে, যখন আর কিছু দ্যাখা যাচ্ছে না, সেই সময়ে ওই পাহাড়টার মাথাতেই হঠাৎ একটা ছোট্ট বাল্ব জ্বলে উঠল। তখন পারবেন, ওই বাল্বটায় মারতে?
অবাক চোখে প্রমিতের দিকে তাকিয়ে রূপেন শইকিয়া বললেন, পারব। একটা বড় ব্যারেলের রাইফেল লাগবে, আর পয়েন্ট থ্রি উইনচেস্টার কিম্বা পয়েন্ট সেভেন রেমিংটন ম্যাগনামের মতন হালকা বুলেট…হ্যাঁ, তখন দশবারের মধ্যে দশবারই মারতে পারব। কারণ, তখন চারিদিকের অন্য সব আকৃতি হারিয়ে যাবে। চোখের সামনে থাকবে শুধু টার্গেট। আর কিছু নয়।
আচ্ছা এবার ভাবুন তো, সেই পরিস্থিতিটাই যদি উলটে যায়। ওই পাহাড়ের মাথায় টেররিস্টরা যদি দ্যাখে এদিকে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে শুধু তিনটে আলোকিত মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে?
কথাটা মনে হল রূপেন শইকিয়ার বেশ মনঃপুত হল। তিনি গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, হুঁ, একমাত্র এইভাবেই রহস্যটার ব্যাখ্যা করা যায়। কেউ ওদের গায়ে তীব্র আলো ফেলে ওদের টার্গেট বানিয়ে দিয়েছিল।
প্রমিত বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়ল। বলল, এই ব্যাখ্যাটাই পুলিশও দিচ্ছে মিস্টার শইকিয়া। ইন ফ্যাক্ট, ওরা ওদের তদন্তও এই লাইনেই চালাচ্ছে। কিন্তু এই থিয়োরিটাও কি বিশ্বাসযোগ্য?
কেন? বিশ্বসযোগ্য নয় কেন? রূপেনকে অসন্তুষ্ট দ্যাখাল।
আপনি মনে মনে একবার সিচুয়েশনটা ভেবে দেখুন। প্রথমত, ওদের গায়ে আলো ফেলার কাজটা যে করবে তাকে ওদের ফলো করে আসতে হবে। রাতের জঙ্গলে ওদের মতন মানুষকে ফলো করার কাজটা মানুষখেকো বাঘের পক্ষেও কঠিন, কারণ তখন চোখ নয়, মানুষ কান দিয়ে দেখে। পায়ের তলায় একটা কুটো পড়ে ভেঙে গেলে যে শব্দ হয়, রাতের অরণ্যে সেই শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যায়। আর সেরকম একটা কুটোও না মাড়িয়ে কেউ ওদের ফলো করে এসেছে এটা একরকম অবিশ্বাস্য।
দ্বিতীয়ত, যদি কেউ ততটা সফলভাবে ওদের ফলো করে এসেই থাকে, সে নিজে ওদের না মেরে অত ঝামেলা করে গায়ে আলো টালো ফেলতে যাবে কেন?
তৃতীয়ত, বিমলদের রিফ্লেক্স ছিল চিতাবাঘের মতন। গায়ে আলো পড়া মাত্র ওদের পক্ষে যেটা স্বভাবিক ছিল সেটা হল পেছনদিকে ঘুরে গিয়ে আলোর উৎসে গুলি করা। ওরা তা করেনি। মৃত্যুর সময় ওদের মুখ ছিল ভুটান পাহাড়ের দিকে ফেরানো। তার মানে, ওদের পেছনের দিকে সন্দেহজনক কিছুই ঘটেনি।
রূপেন শইকিয়া হতভম্ব মুখ করে বললেন, তাহলে কি নদীর ওপাড় থেকে তীব্র সার্চলাইট…
কথা শেষ করার আগেই প্রমিত বলল, অসম্ভব। বক্সার আশেপাশে কম মানুষ বাস করে না, আর তাদের অনেকেই এই হেমন্ত মাসে হাতি তাড়ানোর জন্যে সারারাত ফসলের ক্ষেতে বসে থাকে। সেই রাতেও ছিল। আপনি যা ভাবছেন সেরকম হলে, আকাশে আলোর ছটা কারুর না কারুর চোখে পড়তই এবং আমরা জানতে পারতাম।