বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলে, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না? তারপর কি যেন? এত যে সুধা কেন সৃজিলে বিধি, যদি আমারি তৃষাটুকু পুরাবে না?–ধুর বাবা, কতবছর আগে যে শেষবার গীতবিতান নিয়ে বসেছি, মনে থাকে না কি অত? বনে থেকে থেকে একটা জংলিই হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে, থেমে যাওয়া কথাবার্তা আবার শুরু করার জন্যে প্রমিত দ্যুতিকে জিগ্যেস করল, ডক্টর রূপেন শইকিয়ার জীবনকথা শুনলেন? ইন্টারেস্টিং না?
কেমন করে শুনব? ঠোঁট উলটে বলল দ্যুতি। উনি নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেন না কি? খালি গাছপালা, জীবজন্তু আর আদিবাসীদের কথাই বলে যান। সে সব শুনতেও ভালো লাগছিল, কিন্তু…
দ্যুতির কথা শুনে প্রমিত হেসে বলল, কোয়াইট লাইকলি। ডক্টর শকিয়ার মতন ভদ্রলোক নিজের সম্বন্ধে কিছু বলবেন এটা ভাবা যায় না। আচ্ছা, ওনার কিছুটা বায়োগ্রাফি আমিই বলে দিচ্ছি। একসঙ্গে যখন কয়েকদিন কাটাবেন তখন এটুকু জেনে রাখা ভালো।
উনি পাঁচবছর আগে গুয়াহাটি কলেজে বটানির লেকচারার ছিলেন। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামলেন। ব্যবসাটা খুব ইন্টারেস্টিং ফরেস্ট প্রোডাক্টস-এর ব্যবসা। আমাদের এই ডুয়ার্সের জঙ্গলে নানান লতাপাতা গাছগাছড়া পাওয়া যায় যাদের দারুণ মেডিসিনাল ভ্যালু আছে। তা ছাড়াও কোনও গাছের ফল থেকে সুগন্ধী পাওয়া যায়, কোনও ফুলের পাপড়ি থেকে দারুন রং তৈরি হয়। আমিও সব জানি না। কিন্তু মিস্টার শইকিয়া জানেন। উনি নিত্য নতুন বই জার্নাল ঘাঁটাঘাঁটি করে এইসব খুঁজে বার করেন। এসব জিনিসের বেশিরভাগটাই বাইরে রপ্তানি হয়ে যায়। ভারতের থেকেও বিদেশের মাটিতে এইসব জিনিসের চাহিদা বেশি। ইওরোপ আমেরিকা যে ক্রমশ ন্যাচারাল প্রোডাক্টের ভক্ত হয়ে উঠছে জানেন নিশ্চয়ই?
আমরা মিস্টার শইকিয়াকে এইসব ফরেস্ট প্রোডাক্ট সংগ্রহ করার লাইসেন্স দিই। এতে আমাদেরও একটা উপকার হয়। আরণ্যক গ্রামগুলোর অনেক মানুষকে উনি এই গাছগাছড়া সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। ভালো পেমেন্ট দেন তার জন্যে। মানুষগুলো এরকম একটা ভালো জীবিকা খুঁজে পেয়েছে বলে গত কয়েকবছরে জঙ্গল কেটে চাষ করা কিম্বা জঙ্গলের মধ্যে গরু চরানোর মতন ক্ষতিকর ব্যাপারগুলো কমে গেছে। চোরাশিকারেও আগে লোকাল লোকেদেরই কাজে লাগানো হত। এখন ডক্টর শইকিয়ার থেকে ভাত কাপড়টা পেয়ে যাচ্ছে। বলে ওরা চোরাশিকারিদের মুখের ওপর না বলে দিতে পারছে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমিত বলল, ডক্টর শইকিয়ার গুয়াহাটির বাড়িতেও আমি এক দুবার গিয়েছি। বিশাল বাড়ি, বিরাট বাগান। বোঝাই যায়, ব্যবসা করে উনি ভালোই পয়সা করছেন। কিন্তু উনি নিজে যে ঘরটায় থাকেন সেই ঘরটা দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। একটা চৌকি ছাড়া আর আসবাব বলতে কিছু নেই। আর বই রয়েছে, মাটি থেকে ছাদ অবধি ঠাসা বই আর বইনানা বিষয়ের, নানান ভাষার। সেইজন্যেই মনে হয়, এই ব্যবসাটা উনি বোধহয় ওই গ্রামের লোকগুলোর জন্যেই করেন। ওদের মুখে দু-মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্যে।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে দ্যুতি বলল, অদ্ভুত লোক, তাই না?
.
আধঘণ্টা পরে সত্যিই প্রমিতকে দুঃখিত করে রোদ উঠল। কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল নদীর চর। রূপেন শইকিয়াও পিঠে একটা রুকস্যাক নিয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওদের ডাক দিলেন–চলুন মিস্টার ব্যানার্জি, চল দ্যুতি। আর দেরি করলে আমার সবকটা জায়গায় যাওয়া হবে না।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়িয়ে প্রমিত ভাবল, কি বিচ্ছিরি কাজ। এই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে তাকে এখন একটা রক্তমাখা বধ্যভূমি দেখতে যেতে হবে। এনিওয়ে, ওয়ান শু্যড ওবে দ্যা কল অফ ডিউটি।
প্রমিত জিপসির ড্রাইভিং-হুঁইলে বসল। রূপেন শইকিয়া দ্যুতিকে নিজের গাড়িতে ডেকে নিলেন।
রূপেনের গাড়িতে উঠে দ্যুতি জিগ্যেস করল, এখন কোথায় যাব আমরা?
একটা গ্রামে যাব। গ্রামটার নাম দিবাং, রাভাদের গ্রাম। ওখানে তুমি তোমার কাজ করবে, আমি আমার কাজ…
আপনার কাজ মানে? একটু কৌতূহলি গলায় প্রশ্ন করল দ্যুতি।
দিবাং গ্রামের কাছে একটা বড় জলা আছে। সেখানে গ্রামের লোকেদের দিয়ে সিট্রানেলা চাষ করাবার কথা ভাবছি। সিট্রানেলা জান তো? একরকমের বুনো ঘাস। পেষাই করলে ওর পাতা থেকে সুগন্ধী তেল পাওয়া যায়। কীটনাশক হিসেবে দারুণ কাজ করে। মার্কেট-ভ্যালু অনেক।
তারপর কি খেয়াল হতেই রূপেন শইকিয়া জিভ কেটে বললেন, ইস ছি ছি! তোমার পাস পেপারে বটানি ছিল বললে তো। দ্যাখো তোমাকে আমি ট্রিানেলা চেনাচ্ছি। আমারও হয়েছে মতিভ্রম।
.
আর কথা না বাড়িয়ে দ্যুতিকে নিয়ে বোলেরোয় স্টার্ট দিলেন রূপেন শইকিয়া। পেছন পেছন নিজের জিপসি চালিয়ে আসছিল প্রমিত। সে নিজের গাড়িটাতেই যাচ্ছিল, কারণ, খুনের জায়গাটা দেখেই সে আলিপুরদুয়ারে ফিরে যাবে, কিন্তু ডক্টর শইকিয়াদের তারপরেও আরও ঘোরাঘুরি রয়েছে।
ছোট-বড় নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে টাল খেতে খেতে গাড়িদুটো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল সেই নদীর তীরের ঘাসজমিটায়। প্রমিত আর রূপেন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। দ্যুতি বসে রইল গাড়িতেই। তার কোলে অ্যানথ্রোপলজির বিদেশি জার্নাল। সেটার পাতাতেই ওর সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ। ওরা দুজন কোথায় যাচ্ছেন, কেন যাচ্ছেন, সে সব কিছুই প্রশ্ন করল না সে।