তখন সেই শান্তির জন্যে কী মূল্য চাইবে মধু? সেইটাই ঠিক আন্দাজ করতে পারছিল না প্রমিত। সেটা জানবার জন্যেই তাকে আরও কিছুক্ষণ এই নীচ লোকটার সঙ্গে ভদ্রতার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে। সেইরকম মনস্থ করেই একটু ভীতু সুরে প্রমিত বলল, তোমার মতন লিডার থাকতে হরিণডুবিতে অশান্তি কেন হবে, মধু? তুমি কী চাইছ তাই বল না।
মধু বোধহয় মনে মনে ভাবল, হাতি কাদায় পড়া একেই বলে। এই ব্যানার্জি সাহেব তার কত দুনম্বরী প্রোপোজাল পুরোটা না শুনেই তাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে। আর এখন, যেহেতু তিনটে গার্ড মারা গেছে, কাগজে, টিভিতে হইচই হচ্ছে, তাই ওই লোকেরই সুর কত নরম হয়ে গেছে। কথাটা পাড়ার এটাই ভালো সময়।
মধু গলা নামিয়ে বলল, বিনতা ম্যডামকে শিরোমণির গড়টা দিয়ে দিন ব্যানার্জিসাহেব।
প্রমিতের নিখুঁত অভিনয়েও প্রায় চিড় ধরতে যাচ্ছিল। অতি কষ্টে রাগটা গিলে নিয়ে সে বলল, এতদিন তোমার জাতের লোকেদের হাতে শিরোমণির গড়কে দিয়ে দিতে বলছিলে, তার না হয় একটা কারণ বুঝতে পারছিলাম। সেখানে তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের জাতের ইতিহাস, জাতের অতীত গৌরবের ব্যাপার ছিল। কিন্তু হঠাৎ বিনতা ম্যাডামকে দিয়ে দিতে বলছ কেন? তিনিও তো আমার মতনই বাইরের লোক।
গোঁয়ারের মতন মাথা নীচু করে মধু বলল, তা হোক। উনি কথা দিয়েছেন, ওখানে রিসর্ট খুললে আমাদের অনেকগুলো লোককে চাকরি দেবেন–গার্ডের চাকরি, গাইডের চাকরি…
তোমার নিজের লোকেরা আপত্তি করবে না? তারা বলবে না, ওই গড়ে রাজা শিরোমণি যখন ফিরে আসবেন, তখন তিনি যদি দ্যাখেন গড় সারিয়ে হোটেল হয়ে গেছে, তখন তিনি কোথায় যাবেন?
ওদের বোঝাবার দায়িত্ব আমার। চাকরি পেলে অতীতকে ভুলতে সময় লাগবে না।
হঠাৎ চৈতন্যঝোরার নৈঃশব্দকে ভেঙে খান খান করে দিয়ে চিৎকার করে উঠল প্রমিত বোঝাবার দায়িত্ব তোমার, তাই না? তুমি বোঝাবে যে, ওই রিসর্টে সাত আট হাজার লোককে চাকরি দেবেন ম্যডাম, আর তার বদলে যে জঙ্গলটা যুগ যুগ ধরে তোমাদের ভাত কাপড় যুগিয়ে যাচ্ছে, সেই জঙ্গলটাকে বিক্রি করে দিতে হবে। তুমি খুব ভালো করেই জানো মধু, একবার ওখানে রিসর্ট চালু হয়ে গেলে, বিনতা মেহরা তোমার লেংটি পরা জাতভাইদের ওই শিরোমণির। গড়ের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবেন না। দেখলেই কুকুর লেলিয়ে দেবেন ওদের পেছনে। তোমার অবশ্য তাতে কিছু যাবে আসবে না। তুমি তখন হয়তো শিলিগুড়ির কোনও বারে বসে ওই মেহরাদের সঙ্গেই কাবাব হুইস্কি খাবে। আমাকে চাপ দিয়ে কাজটা করানোর জন্যে বিনতা মেহরার কাছ থেকে কত টাকা পেয়েছ মধু?
প্রমিতের হঠাৎ রূপ বদলে, এবং তার চেয়েও বেশি তার কথাগুলোর ধাক্কায়, স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল মধু বর্মন। তার সঙ্গীও একটু পেছনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছিল। ওদের দুজনেরই একটু আগের সেই ঘাড় তুলে দাঁড়াবার ভঙ্গিটা একেবারেই পালটে গেছে।
ঘৃণাভরে ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্রমিত বলল, টাকাটা বিনতা মেহরাকে ফিরিয়ে দিও। বোলো, কাজটা সম্ভব নয়।
মধু আর তার সঙ্গী হঠাৎ উলটোদিকে ফিরে রাস্তার বাঁকে মোড় নিল। সেইখানেই নিশ্চয় ওদের বাহনটা রাখা ছিল। একটু বাদে মোটরবাইকের শব্দ দ্রুত মিলিয়ে গেল শহরের দিকে।
সেদিন আর চৈতন্যঝোরায় সময় কাটানো হল না প্রমিতের। মধু আর তার সঙ্গী চলে যাওয়ার পর জিপের পেছনের সিটে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে সে অশোক রাইকে বলল, চল অশোক।
অশোক জিগ্যেস করল, কোথায় যাব স্যার?
সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর দিতে পারল না প্রমিত। সে কি এখন আলিপুরদুয়ারে বি.টি.আর এর অফিসে ফিরবে? হয়তো তাই যাওয়া উচিত। প্রতিদিন অজস্র ফাইল তার মতামতের জন্যে ওখানে আসে। একদিন কাজ না করলেই অনেক কাজ জমে যায়। কিন্তু আজ একদম অফিসে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না প্রমিতের। তার চোখে ভাসছিল অফিসের বারান্দায় পেতে রাখা বেঞ্চিতে দাঁতে শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে বসে থাকা তিন বিধবার মূর্তি। তাদের চোখে শূন্য দৃষ্টি। তাদের আশেপাশে দু-তিনটে শিশু ঘোরাঘুরি করছে, কখনও তারা ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদছে, কখনও আপনমনে খেলা করছে। মায়েদের হুঁশ নেই। অফিসে ঢুকতে বেরোতে গত কয়েকদিন ধরেই বারবার প্রমিত ওই তিন সদ্য স্বমীহারা রমণীর মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে, আর প্রত্যেকবারই সে দ্রুত পায়ে আড়াল খুঁজে পালিয়ে যাচ্ছে ওদের সামনে থেকে। অফিসের ভেতরে সে হেডক্লার্ককে ডেকে হাতজোড় করে বলছে, দেখুন না দত্তবাবু, বিমল, সন্দীপদের ডেথ গ্র্যাচুইটির টাকাগুলো একটু তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া যায় কিনা। ওরা তাহলে যে যার দেশে ফিরতে পারে।
চেষ্টা করছি তো স্যার। বোঝেনই তো, অ্যাবনর্মাল ডেথ। ফাইল কলকাতায় গেছে, সেখান থেকে ফেরত আসবে। তবে না।
দত্তবাবুর কথার সত্যতা বোঝে প্রমিত। কিন্তু সে কি করে অন্য কাউকে বোঝায়, অনুযোগহীন ওই তিন বিধবার শুন্যদৃষ্টির সামনে দিয়ে যাতায়াত করার সময় তার নিজের কি ভীষণ ক্লান্ত লাগে। মনে হয়ে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার শরীর মাটির ওপর ভেঙে পড়তে চায়।
তাহলে কি সে হরিণডুবি বিট অফিসে গিয়ে বসে থাকবে? কিন্তু সেখানেও তো বিমল বাবুয়াদের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াবে। ওই বিট-অফিসের গেট খুলেই রাতের পর রাত সে ওই তিন সহকর্মীর সঙ্গে নৈশ প্রহরায় বেরিয়েছে। ভোরের আলো ফুটতে ওই বিট অফিসেই ফিরে এসেছে। ওই অফিসের টালি ছাওয়া বারান্দাতে স্টোভ জ্বেলে চা করে খেয়ে ক্লান্ত চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়েছে চারজন একসঙ্গে। ওখানে গেলে এই সবই মনে পড়বে।