মধু বর্মন এমনই এক আরণ্যক গ্রামের অধিবাসী। বক্সার ফ্রিঞ্জ এরিয়ায় ঘন শালবনে ঢাকা সেই গ্রামটার নাম বেশ অদ্ভূত–চকচকি। কে জানে, ওই নামের মানে কী।
টাইগার রিজার্ভের প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এরকম দশ বারোটা গ্রামে সাকুল্যে হয়তো সাত আট হাজার নারী পুরুষ বাস করে। প্রমিত তাদের সামান্য কয়েকজনকেই চেনে। কারণ তারা স্বভাবতই লাজুক, সঙ্কুচিত। চিতল হরিণের মতই তারা গাছপালার আড়াল থেকে ভীত চোখে ভদ্রলোকেদের লক্ষ্য করে। ভদ্রলোকেদের হাতে অনেক পুরুষ ধরে সয়ে আসা অত্যাচার তাদের ওইরকম ব্যবহারই শিখিয়েছে।
যে তাদের হয়ে সামনে আসে, সে ওই মধু বর্মন।
মধু বর্মন নিজের গুণেই বনবাসী মানুষদের নেতা হয়ে উঠেছে। গত দুবছরের মধ্যে প্রমিত অনেকবার তাকে তার জাতের লোকেদের হয়ে বনদফতরের অফিসে দরবার করতে দেখেছে। কখনও জঙ্গলে শালপাতা কুড়োবার সময়সীমা বাড়াবার জন্যে দরবার করতে এসেছে, আবার কখনও হাতিতে ফসল খেয়ে গেলে ক্ষতিপূরণ চাইতে এসেছে। ছেলেটা ছোটবেলায় জলপাইগুড়ির একটা মিশনারি স্কুলে মাধ্যমিক অবধি লেখাপড়া করেছিল, তাই ইংরিজি আর হিন্দি দুটো ভাষাতেই ভালো লিখতে পড়তে পারে। সেই বিদ্যা দরখাস্ত লেখার সময়ে বা ফরেস্টের অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার সময়ে কাজে আসে। ফলে আরণ্যক গ্রামের মানুষদের লিডার হতে মধুর সময় লাগেনি।
প্রমিতের যেটা খারাপ লাগে সেটা হল, নিজের এই বিশেষ অবস্থানের ফায়দাটা মধু বর্মন পুরোদস্তুর তুলে নিচ্ছে। সাত-আট হাজার মানুষ, আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে সাত আট হাজার ভোট মেশিনের বোতামে রাখা আঙুল, মধুর কথায় নড়ে-চড়ে। এই সত্যটা জানে বলেই রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ইলেকশনের আগে মধুকে নিয়ে নিলামের ডাক ওঠে। মধুকে যে কিনতে পারবে, ওই সাত-আট হাজার ভোট তার বাঁধা।
ফলে তিরিশ বছর বয়েস হওয়ার আগেই মধু বর্মনের আলিপুরদুয়ারে সুন্দর দোতলা বাড়ি, যদিও সে বাড়ির অস্তিত্ব তার জঙ্গলের প্রতিবেশীরা জানে কি না সন্দেহ। একটা এনফিল্ড বাইক। এটিও সে রাজাভাতখাওয়ায় রেখে দিয়ে পায়ে হেঁটে চকচকি গ্রামে ঢোকে। তা ছাড়া ভারত ভুটান সীমান্তে বেনামে একটা কমলালেবুর বাগানও রয়েছে। আর সম্ভবত এই সব সম্পত্তির সাদা টাকায় উৎস দেখাতে কাজে লাগবে বলেই একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকরিও করে দেওয়া হয়েছে তার জন্যে। প্রমিতের নিজের অফিসে এদিকের কয়েকজন লোক কাজ করেন। তারাই। প্রমিতকে মধুর সম্বন্ধে এই সব খবর সরবরাহ করেন।
হাতিতে ফসল নষ্ট করলে ফসলের মালিককে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়, তার থেকেও যে মধু বর্মন পয়সা সরায়, তা প্রমিত একবার হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। মুস্কিল হচ্ছে মধুর অক্ষরজ্ঞানহীন প্রতিবেশীরা কিছুই ধরতে পারে না। তারা মধুকে তাদের রক্ষাকর্তা মনে করে। অন্ধের মতন বিশ্বাস করে তাকে।
প্রমিতের ঘোর সন্দেহ, বক্সার কাঠ পাচার চক্রের সঙ্গেও যোগ রয়েছে এই লোকটার। ওর মতন লোভী মানুষের পক্ষে সেটাই স্বাভবিক।
এই মধু বর্মনকে তার জন্যে ফাঁকা রাস্তায় অপেক্ষা করতে দেখে স্বভাবতই প্রমিতের মনটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল। তবু সে বিরক্তি গোপন করে বলল, অপেক্ষা করছ কেন মধু? কিছু বলবে?
অবশ্যই বলব। বলব বলেই তো এসেছি। ঝাঁঝিয়ে উঠল মধু বর্মন। শিরোমণির গড়ের থেকে পবিত্র জায়গা আমাদের কাছে আর কিছু নেই। সেই জায়গা আপনার জন্যে মানুষের রক্তে অপবিত্র হল।
এ কথা ঠিক যে, যে জায়গাটায় বিমল, বাবুয়াদের খুন করা হয়েছে সেই জায়গাটার গা ঘেঁষেই উঠে গেছে শিরোমণির গড়ের টিলা। তবু, আক্রমণটা যে এইদিক থেকে আসবে তা ভাবতে পারেনি প্রমিত। সে একটু হকচকিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, আমার জন্যে মানে?
হ্যাঁ, আপনার জন্যেই। অভদ্রের মতন চেঁচিয়ে উঠল মধু। বহুদিন ধরে আপনার কাছে দাবি করে আসছি শিরোমণির গড়কে আমার জাতের লোকেদের হাতে ফিরিয়ে দিতে। যদি সে কথা শুনতেন তাহলে আজ ওই জায়গায় লোক গমগম করত। খুন খারাবি হতে পারত না।
প্রমিত শান্তভাবে বলল, তা হয় না মধু। কেন হয় না তা তোমাকে আগেও অনেকবার বুঝিয়েছি। শিরোমণির গড় টাইগার রিজার্ভের ফ্রিঞ্জ এরিয়ার মধ্যে পড়ে। ওটা সবার জন্যে খুলে দেওয়া যায় না। কিন্তু তোমরা যারা জঙ্গলের গ্রামে থাক, তাদের তো ওখানে যেতে আমরা কোনওদিন বাধা দিই নি। কারণ আমরা খুব ভালো করেই জানি, জঙ্গলের গ্রামগুলোয় তোমরা। যারা থাকো, তারা জঙ্গলের ভালোমন্দ আমাদের মতন বাইরের লোকের থেকে অনেক ভালো বোঝে। জঙ্গলকে তোমরা কিছু কম ভালোবাসো না।
কিন্তু তুমিই বল, শয়ে শয়ে তীর্থযাত্রী যদি ওই ভাঙা গড়ে জমায়েত হয় তাহলে তারা কি তোমাদের মতন জঙ্গলকে বাঁচিয়ে, জঙ্গলের জন্তুদের বাঁচিয়ে চলাফেরা করতে পারবে? এতে বন্যপ্রাণীদের যেমন ক্ষতি হবে, তেমন ক্ষতি হবে তোমাদেরও। তারপর ওদের সঙ্গে মিশেই কোর-এরিয়ায় ঢুকে পড়বে কাঠচোর কিম্বা পোচাররা।
আপনি কিন্তু জেনে বুঝে আমাদের অপমান করছেন ব্যানার্জি সাহেব। গ্রামবাসীদের আপনি চোর বলছেন। পেপাচার বলছেন। এরপর অশান্তি শুরু হলে আমাকে দোষ দেবেন না।
প্রমিত পরিষ্কার বুঝতে পারছিল, মধু তাকে প্ররোচিত করছে। ওর একমাত্র লক্ষ্য, তাকে রাগিয়ে বেফাঁস কিছু বলিয়ে নেওয়া, আর সেটাকে ইস্যু করে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলা। একবার সেরকম অশান্তি শুরু হলে প্রমিতকে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্যে মধু বর্মণের দ্বারস্থ হতেই হবে।