.
২.
মদের খোঁজে কাউকেই আর যেতে হয় না হাটে বাজারে। প্রতিটি গ্রামেই গড়ে উঠেছে মদের ভাটিখানা, নয়তো মদের বেওয়ারিশ দোকান। মদের সঙ্গে পাওয়া যায় মদের চাটও। এ যেন গাঁয়ের এখন কুটিরশিল্প। এই ভাটিখানা কুটির শিল্প প্রতিদিন শতশত নিত্যনতুন মাতাল সৃষ্টি করছে। এই গাঁয়ের মধ্যেই সাত আটটি ভাটিখানা। শনিবার হপ্তা, ছুটির দিন শ্রীকারে। ঝগড়াঝাটির জন্যে বেশ কয়েকমাস মদ খায়নি হপ্তার দিনে। আর মাতলামি করতে করতে বাড়িও ফেরে না। স্বামী স্ত্রীতে বনিবনা নেই তাদের। ডিভোর্স হয়নি সুষমা, শ্রীকান্তের মধ্যে। তবে রাতের বিছানা আলাদা হয়ে গেছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কথাবার্তাও তেমন হয় না। বড় মেয়ে লীলার মাধ্যমে এখন হপ্তার টাকা লেনদেন হয়। ঝগড়া এখন চিরস্থায়ী বিবাদে রূপ নিয়েছে। আবার শ্ৰীকার মদ খাওয়ার মাত্রাও বেড়ে গেছে। আগে তবু ঝগড়া রাগারাগি করতে সুষমা। এখন তাও করে না, কে কি করছে, স্বামী স্ত্রীর সে সব কোন খোঁজ খবরও কেউ রাখে না। বড় মেয়ে লীলা একদিন রেগে গিয়ে মাকে বলেও ফেলে ছিল, মা তোমার রাগ কমাও। বাবা না হয় মদ খায়, সপ্তায় দু-একদিন, নাইট ডিউটির সময় তা বলে তুমি তার সঙ্গে রাতদিন খিটখিট করো কেন? তুমিও রেগে গিয়ে বাবাকে যা তা ভাষায় গালাগাল দাও। সেটাও তো অন্যায় মা। আর এভাবে তোমাদের ঝগড়াঝাটি শুনতে ভাল লাগে না। তোমরা এর চেয়ে কাটান ছিঁড়েন করে নাও তোমরা ডিভোর্স করে নিলে, দরকার হলে বাবুর বাড়িতে খেটে খাবো। তোমাদের এই ঝগড়াঝাটি আর আমাদের একদম সহ্য হয় না।
কথাটা শুনে কেউটে সাপের মতো ফোঁস করে উঠেছিল সুষমা বলি ও বাবা সোহাগী মাগী, বারে কোনো দোষ দেখতে পাস না বাপের পক্ষ নেওয়া। কোথায় বাই মিলে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করবে, না আমাকে জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। এবারে বোঝাব মজা। রস্বতী পুজোটা কেটে গেলেই চলে যাবো বাবুর বাড়িতে। যেখানে হাত নাড়বো সেখানেই ভাত পাবো। একটা লোকের পেটের ভাত আমার জুটে যাবে। মরবি তোরা। ভোরাতো আমার পেটের ছেলেমেয়ে না। তখন বুঝবি ওই মোদো মাতাল, লম্পট বাবা তোদের কতো দ্যাখে।
.
৩.
কয়েকমাসের মধ্যে সুষমার সংসার ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল। সুষমা যতোই অপমান আর অবহেলা করছে শ্রীকান্তকে, শ্রীকান্ত ততোই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। মদ দিনরাত্রি খেয়ে খেয়ে শরীরকে অস্থিচর্মসার করে ফেলেছিলেন। ও মদ খাওয়ার ক্ষ্যাপামি তার কমেনি। সংসারের হেপা আর হেঁসেল ঠেলতে গিয়ে মেয়েটার পড়াশুনাও লাটে উঠে গিয়েছিল। স্বামী স্ত্রীর কলহ দাবানলের আগুনে পুরো সংসারটাই জ্বলছিল। মন মেজাজ যেটুকু ছিল তাও বিগড়ে গিয়েছিল শ্রীকান্ত। রাগে কাপছিল আর বলছিল শ্রীকান্ত, শালা সংসারের নিকুচি করছে। সংসারের কথা ভেবে ভেবে হাড়ে আমার ঘুন ধরে গেছে। সুও মাগীর মন পাইনি। ভাটিখানার বসে আপনমনে বকে যাচ্ছিল শ্রীকান্ত। মদওলি কানা বাগদির বউ বলছিল, কিগো ঠাকুরপো, কি হলো তোমার। সন্ধ্যে তো হয়ে এল। বাড়ি যাবে নে। আর মদ তুমি খেয়োনি বাবু। নেশাটা বড্ড চড়ে গেছে। তুমি তো মদ খেলে আমার পয়সা হবে। এবার খেলে দম ছুটে মরে যাবে। এতো আর জল দেওয়া মদ গো নয়। মদ জ্বাল দিচ্ছি গরম গরম তোমাকে দিয়েছি। দুবোতল তো সাবাড় করেচো। আর একথালা নিহেড়ে মাছের ঝোল। যাও এবার বাড়ি চলে যাও। একা একা বাড়ি যেতে পারবে তো গা ঠাকুরপো? হেই দ্যাখো মাটিতে শুয়ে গেলে। ওরে খোকা তোর কাকাকে খেজুরের চেটাই এনে, বিইছে দে। বালিশটা এনে দে। এখন লেশার ঝেকে একটু ঘুইমে নিক, তোর কাকা।
শ্রীকান্তর শরীরটা তেমন আর নড়াচড়া করছিল না। নেশায় চুর। চোখ মুখের ঘোরও অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। বেঘোরে ঘুমোচ্ছিল। কানা বাগদির বউ অনেক টানাটানি করে তার শরীরের খানিকটা অংশ চেটাইয়ে রাখতে পারলো। মাথায় তেলচিটে পাতলা শক্ত বালিশটা থান হঁটের মতো কোনো রকমে ঢুকিয়ে দিল। কিন্তু শ্রীকান্ত ঠাকুরপোর ঘুম, সে আর ভাঙাতে পারল না রাত পর্যন্ত। তখন সত্যিই ভয় পেল। বাড়ির লোক বলতে সুষমা আর লীলা খবর পেয়েই ছুটলো কানা বাগদির ভাটিখানায়।
শ্রীকান্তর বডি কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। কানা বাগদির ঘরের পাশে ঝোঁপের মধ্যে পচা গুড়ের কলসি নিশাদলে তখনও ফুটছিল। কানাকানি হয়ে গেছে পাড়ায়। লীলার বাবার অবস্থা খারাপ। মদে বিষক্রিয়া হয়ে গেছে। হাত পা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এতরাতে গাঁয়ে ডাক্তার পাওয়া যাবে কোথায়। অগত্যা বাঁশের খালি করেই কয়েকজন ছেলে ছোঁকরা তাকে নিয়ে গেল হেলথসেন্টারে।
হেলথসেন্টারের বড় ডাক্তার শ্রীকান্ত্র নাড়ী ধরে বলল, হয়ে গেছে। ওর বডি বাড়িতে নিয়েই চলে যান। লীলা ককিয়ে কেঁদে ওঠে বাপের বুকে আছাড় খেয়ে পড়লো। সুতো কাটা ঘুড়ি গোৎ খেয়ে পড়ে যেভাবে, ঠিক সেইভাবে। উবু হয়ে বসেছিল সুষমা পাথরের মতো ছোটো ছেলেকে বুকে আগলে ধরে। শ্মশানের বন্ধুরা এসে গিয়েছে প্রধানের জ্বালিয়ে দেবার সার্টিফিকেট নিয়ে। তারা খাটুলি তুললো। বল হরি, হরি বল। বল হরি, হরি বল। বল হরি, হরি বল। শ্রীকান্ত নস্করের মরদেহ চোখের আড়ালে চলে গেল। লীলা ককিয়ে কেঁদে উঠল, ‘বাবা তোমার মনে এই ছিল’ সুষমা পাথরের মত নির্বাক, চোখে মুখে শোকে ছল ছল করছিল যন্ত্রণার ভয়াবহ অশ্রু। তখনও শোনা যাচ্ছিল বল, হরি, হরি বল। চারিদিকে তখন ঘোর অন্ধকার। গাঁয়ের মাটির রাস্তার মোড়ে কুকুরগুলো তারস্বরে চিৎকার করছিল, না কাঁদছিল কে জানে।