তিনি বলিতেন, হিন্দুধর্ম ঘোষণা করে, একমাত্র এই ধর্মই অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক সত্যরূপ প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকেই বলে, ইহাকেই একমাত্র পথপ্রদর্শকরূপে গ্রহণ কর’। সকল শাস্ত্রের মূলে জ্ঞানের উৎপত্তিবিষয়ক যে-সকল নিয়ম বর্তমান, এবং যাহা হইতে সকল শাস্ত্রের উদ্ভব, হিন্দুধর্মে ‘বেদ’ শব্দে প্রকৃতপক্ষে তাহাই বুঝায়। হিন্দুধর্মের সন্তানগণের মধ্যে কেহ কেহ বেদনামক গ্রন্থসমূহে আস্থা স্থাপন করেন নাই—যেমন, জৈনেরা; তথাপি জৈনেরা হিন্দুপদবাচ্য ব্যতীত আর কিছু নহে। যাহা কিছু সত্য, তাহাই বেদ, এবং জৈনেরাও সত্য বলিয়া যাহা বুঝিয়াছেন, তাহাই পূর্ণরূপে মানিয়া চলিলেই হইল। যতদূর সম্ভব হিন্দুধর্মের পরিধি বিস্তৃত করিয়া দেওয়া ছিল স্বামীজীর উদ্দেশ্য। পক্ষিণী যেমন দুটি ডানা দিয়া তাহার শাবকগুলিকে আচ্ছাদন করিয়া রাখে, হিন্দুধর্মও তাহার সকল শাখাপ্রশাখা তেমন আচ্ছাদন করিয়া রাখুন—ইহাই ছিল স্বামীজীর মননগত ভাব। প্রথম বার আমেরিকা যাত্রার পূর্বে তিনি নিজের সম্বন্ধে বলেন, “আমি এমন একটি ধর্ম প্রচার করতে যাচ্ছি, বৌদ্ধধর্ম যার বিদ্রোহী সন্তান, এবং খ্রীস্টধর্ম সকল আস্ফালন সত্ত্বেও যার দূরাগত প্রতিধ্বনি মাত্র।” স্বামীজী বলিতেন,’বেদ’ শব্দে যদি গ্রন্থগুলিকেই ধরা যায়, তথাপি ধর্মের ইতিহাসে বেদের মাহাত্ম্য অতুলনীয়। কেবল উহাদের অতি প্রাচীনত্বের জন্য নহে, পরন্তু এই কারণেই উহা বহুগুণে শ্রেষ্ঠ যে, জগতের সমুদয় গ্রন্থের মধ্যে একমাত্র বেদই মানবকে সতর্ক করিয়া বলিতেছেন, তাহাকে সকল গ্রন্থের পারে যাইতে হইবে।(১)
এইরূপে, হিন্দুধর্মের অন্তর্গত সকল সম্প্রদায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হইল সত্য। আবার এই সত্য গ্রন্থনিবদ্ধ নহে, সুতরাং উহাকে শুধু মানিয়া লইতে হইবে তাহা নহে; সকলেই অনুভূতি দ্বারা এই সত্য লাভ করিতে পারেন। ইহা হইতে বুঝা যায়, হিন্দুধর্মে বিজ্ঞানসম্মত-বিশ্বাস এবং ধর্মবিশ্বাস এই উভয়ের মধ্যে কোন প্রকার বাস্তব ও কাল্পনিক বিরোধ নাই। এই বিষয়ে স্বামীজী দেখিয়াছিলেন যে, বিজ্ঞানকে জ্ঞানরাজ্যের সর্বত্র প্রয়োগ করিবার আধুনিককালের যে বৈশিষ্ট্য, ভারতবাসীর সেই ভাবগ্রহণে বিশেষ যোগ্যতা আছে। ভারতের ধর্মচর্চায় রত মনীষিগণ কখনও কোন জ্ঞানের উন্নতির পথে বাধা প্রদান করেন নাই। ইহাও গৌরবের কথা, এখনও পর্যন্ত হিন্দু যাজকগণ কোন ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও মতবাদে বিশ্বাস করিবার অধিকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিয়াছেন বলিয়া শোনা যায় নাই। শেষোক্ত তথ্য হইতেই ইষ্টদেবতার প্রতি নিষ্ঠারূপ মনের উদ্ভব—অর্থাৎ প্রত্যেককে আত্মোন্নতির জন্য স্বয়ং নিজের পথ নির্বাচন করিয়া লইতে হইবে, এবং স্বামীজীর মতে ইহাই হিন্দুধর্মের একমাত্র সার্বভৌম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য হিন্দুধর্মকে জগতের সর্বপ্রকার ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি কেবল যে সহনশীল করিয়াছে তাহা নহে, উহাদিগকে আত্মসাৎ করিয়া লইবার সামর্থ্যও প্রদান করিয়াছে। তিনি দেখাইয়া দেন যে, এমনকি, সাম্প্রদায়িক ভাবও—যাহাতে ঈশ্বর স্বয়ং বিশ্বাসীর বা সাধকেরই মতাবলম্বী বলিয়া বিশ্বাসের দ্বারা সূচিত, এবং নিজের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়টি একমাত্র খাঁটি সম্প্রদায় বলিয়া অভিহিত,এবং যাহাতে সময় সময় চরম গোড়ামি পর্যন্ত স্থান পাইয়া থাকে—হিন্দুধর্মের দৃষ্টিতে তাহা অসত্য বা সঙ্কীর্ণতার চিহ্ন নহে, পরন্তু অপরিণত মনেরই লক্ষণ বলিয়া বিবেচিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলিতেন, উহা বিচারের বেড়া—চারাগাছের পক্ষে অত্যাবশ্যক, কিন্তু বৃক্ষের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা যে কোন কিছুর সীমা নির্দেশ করি, ইহাই প্রমাণ করে যে, আমরা এখনও পর্যন্ত সসীম বস্তু লইয়াই নাড়াচাড়া করিতেছি। যখন অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ হইবে, তখন আমাদের মন কেবল অনন্তের চিন্তায় মগ্ন থাকিবে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিতেন, “সকলেই জামর খানিকটা অংশে বেড়া দিয়ে বলে, ওটা আমার জমি’, কিন্তু আকাশকে কে বেড়া দিয়ে ভাগ করতে পারে?”
যে অসংখ্য সম্প্রদায় ও মতমতান্তর লইয়া হিন্দুধর্ম গঠিত, তাহাদের প্রত্যেকটির ভিত্তি হইল অপরোক্ষানুভূতি, এবং সকলেরই বৈশিষ্ট্য হইল অনন্ত উদারতা—যাহা সকলকে গ্রহণ করিতে সমর্থ। অবশ্য পালনীয় বলিয়া পুরোহিতশ্রেণী যে-সকল নিয়মের প্রবর্তন করেন, তাহা কেবল সামাজিক ক্ষেত্রে। যদিও ইহার ফলে আচার প্রথায় অত্যধিক কড়াকড়ির সৃষ্টি হয়, ইহা দ্বারা স্পষ্টই অনুমিত হয়, তাহাদের মতে মানবমন চিরকালই স্বাধীন। কিন্তু ইহা অস্বীকার করিতে পারা যায় না যে, হিন্দুধর্মের মধ্যে চিন্তাশক্তির যতদূর প্রসারলাভ ঘটে, তাহার মধ্যে কয়েকটি বিশিষ্ট ভাবের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়। ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে শিকাগো ধর্মমহাসভায় এইগুলি ছিল স্বামীজীর বক্তৃতার প্রধান বিষয়।
অস্থিমজ্জাস্বরূপ যে-সকল বিশিষ্ট ধাবণা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ভাবা যায় না, তাহার প্রথমটি হইল সৃষ্টিপ্রবাহের চত্রবৎ আবর্তন। সৃষ্টি থাকিলেই তাহার একজন স্রষ্টা থাকিবে, এবং স্রষ্টা বলিলেই সৃষ্টি বুঝা যায়—উভয়েই তুল্যভাবে পরস্পর সাপেক্ষ। এই দ্বৈতমূলক সম্পর্ক আপেক্ষিক সত্য ব্যতীত আর কিছু নহে। হিন্দুধর্মে এ বিষয়ে গভীর দার্শনিক বিচার আছে এবং স্বামী বিবেকানন্দ তাহার দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করিবার ক্ষমতা দ্বারা স্বল্প কথায় উহা প্রকাশ করিতে সমর্থ হন। সাধারণভাবে ভারতীয় চিন্তার প্রকৃষ্ট উদাহরণস্বরূপ তিনি যে দ্বিতীয় মতটির আলোচনা করেন, তাহা পুনর্জন্ম ও কর্মবাদ, যাহার চরম পরিণতি মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্বের পূর্ণ বিকাশে। পরিশেষে, চিন্তা ও উপাসনার মধ্যে আকারভেদ সত্ত্বেও সকল সময়ে এবং সর্বাবস্থায় সত্যের সর্বজনীনত্ব ঘোষণা দ্বারা তিনি হিন্দুধর্মের এই সকল বৈশিষ্ট্য যে প্রকৃতপক্ষে গৌণ সে বিষয়ে তাহার বক্তব্যের সমাপ্তি করেন। কয়েকটি প্রাঞ্জল বাক্যের মাধ্যমে তিনি সর্বাদিসম্মতরূপে হিন্দুধর্মের একত্ব প্রতিপাদন করেন এবং উহার মুখ্য লক্ষণগুলি চিত্রিত করেন। পাশ্চাত্য-জগতে তাহার অবশিষ্ট কার্য ছিল, প্রধানতঃ সনাতন ধর্মের অন্তর্গত মহান সত্যগুলিকে আধুনিক কালের ও সর্বজনের উপযোগী করিয়া অকাতরে সকলের মধ্যে বিতরণ করা। ধর্মের প্রবক্তা হিসাবে তাহার নিকট সমগ্র জগৎই ছিল ভারতবর্য, সর্বদেশের মানবমাত্রেই তাহার নিজধর্মের অন্তর্ভুক্ত।