অন্দরমহল
রাজা মোহন সিং ভারি অদ্ভুত ঢঙে রাজ্য চালান। ওর বক্তব্য, কাউকে বিশ্বাস কোরো না। চরের পিছনে চর লাগাও। গোটা রাজ্যের সমস্ত খবর উনি আট রকম বিবৃতিতে পান। একটা দিয়ে উনি অন্যটা বিচার করে দেখেন। উপরন্তু আজকাল উনি একটা নতুন কাজও করেন। গলস্টন সাহেবকে দিয়ে উনি যে একটি বিলেতি বই অনুবাদ করিয়েছেন সেটা দিনে ঘণ্টাখানেক পড়েন। বইটা মাকিয়াভেলির প্রিন্স। থেকে থেকে পড়ার সময় মোহন সিং বলে বসেন, বহুত আচ্ছা!
ইদানীং রাজ্যে তাই টু শব্দটিও কারোর থেকে শোনা যায় না। কিন্তু মোহন সিং একটা নতুন ব্যাপারে বড় ভাবিত হয়ে পড়েছেন। প্রাসাদের চর ভারবু খবর দিয়েছে রানি সুখীন্দরের কাছে রাতে দেখা করতে আসে সেনাপতি ভীমসিংয়ের ছেলে সুন্দর। দালান পাঁচিল টপকে রানির ঘরে ঢুকে খিল মেরে বসে থাকে বহুক্ষণ। তারপর ভোরের আগে-ভাগে পালায়। সুন্দর কীভাবে না কীভাবে জানতে পারে কোন কোন দিন রাজা যাবেন না রানির কোঠায়। এই জানা অবধি মোহন সিংয়ের ঘুম চলে গেছে। যদি কাউকে জীবনে তিনি বিশ্বাস করে থাকেন তবে তা রানি সুখীন্দরকে। বয়সে রাজার চেয়ে অন্তত বিশ বছরের ছোটো হলেও সুখীন্দরের বুদ্ধি খুব পাকা। যেদিন বিয়ে করে এনেছিলেন সেদিন আগের রানির আত্মীয়েরাও স্বীকার করেছিলেন, না, রাজা কাজটা ভালোই করেছেন।
সুখীন্দর কিন্তু মাঝেমধ্যেই রাজাকে বলেন, আপনার এত সন্দেহ বাতিক কেন? রাজ্যে যা হবার হবে। তাতে দিনরাত অতশত গুপ্তচর লাগিয়ে কী হবে?
রাজা তখন হাসেন। বলেন, এক তোমাকে ছাড়া আমার আর কারোকেই তো বিশ্বাস করা ঠিক না। চার-চারটে ঝি রেখেছি বলেই না বড়োরানি তোমাকে বিষ খাইয়ে মারতে পারছে না। এই প্রত্যেকটা ঝি প্রত্যেকটা ঝিয়ের খবর এনে দেয় দেওয়ান সাহেবকে। সেটা জান কী?
এখন সেই সুখীন্দরই চুপিসাড়ে প্রেম করছেন সুন্দর সিং-এর সঙ্গে। রাজা রাগে হাত কামড়াচ্ছেন। উনি ডেকে পাঠিয়েছেন কালু খাঁকে সুন্দরকে ধরার ব্যবস্থা করতে। কাল্প এক
সময় মোহন সিংয়ের বাবা দরবার সিংয়ের বডিগার্ড ছিল। নৃশংস ব্যাপারে ওর জুড়ি নেই সারাহিন্দুস্থানে। ওরই ছেলে এখন হিন্দুস্থানের বাদশাহ বাহাদুর শাহের সেনাদলে ভরতি। এক এক গুলিতে দু-দুটো লোক জখম করতে পারে।
কালু এসে একটা চমৎকার সমাধান দিল। বলল ইঁদুর ধরার মতো ফাঁদ পেতে সুন্দরকে পাকড়াও করা হোক। পরদিন শহরের লোকের সামনে ওর ফাঁদের দড়িটা দু-দুটো ষাঁড়ের গলায় বেঁধে ষাঁড় দুটোকে বিপরীত দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। এভাবে বড়ো জোর পনেরো মিনিটে সুন্দর সিংয়ের দেহটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে! ওই দেখে শহরের আর যারা অন্যের বউদের সঙ্গে ফস্টিনষ্টি করে তারা তাদের ভবিষ্যৎটা বুঝে যাবে। মতলব শুনে মোহন সিং যার পর নাই খুশি হয়েছেন। এই ক-দিনে সুখীন্দরের উপর ভালোবাসাটা তীব্রভাবে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়ে গেছে সুন্দরের ওপর রাগ এবং ঘৃণা। প্রতিহিংসার জেদটা এখন টগবগ করে ফুটছে রাজার অন্তরে।
ঠিক হল রানির কোঠায় যাবার জন্য সুন্দর যেদিকটা দিয়ে পাঁচিল টপকায় সেখানে একটা মোটা দড়ির জাল পাতা হবে। দেওয়াল বেয়ে সুন্দর যখন উঠবে, ওর নিজের হাতের টানেই একসময় দড়ির জাল ওর গায়ে নেমে আসবে। সকাল বেলায় ওই অবস্থাতেই ওকে রানির কোঠার সামনে ষাঁড়ে টানানো হবে। যেহেতু আর কেউ জানে না কেন সুন্দরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে ওকে জালে বাঁধা অবস্থাতে দেখলে লোকে জানবে হারামজাদা নিশ্চয়ই কোনো কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এবং রানি সুখীন্দরকেও রাজা জানতে দিতে চান না যে, তিনি ওদের ব্যাপারটা পুরো জানতেন, তাই ওর জানলার সামনে সুন্দরকে মারা হলে রানি নিজেও ভবিষ্যতে ওরকম প্রেমটেম আর করবেন না। গলস্টন সাহেবই একসময় রাজাকে বুঝিয়েছিলেন যে, খোদ শাস্তির চেয়ে শাস্তির ভয়টাই মেয়েদের বেশি। ব্যাখ্যাটা রাজার খুব মনে ধরেছিল।
সুখীন্দর ওঁর জানালা দিয়ে প্রেমিকের আসার পথটা দেখছিলেন। একফালি চাঁদ তখন আকাশে। সুখীন্দরের কোঠায় কোথাও একটা বাতি জ্বলেনি। গত সাত দিন ধরে সুন্দর ক্রমাগত কবিতা শুনিয়েছে ওকে। সুন্দর কবিতা খুব একটা ভালো বলতে পারে না, কিন্তু অজস্র ভাব আছে গলায়। প্রদীপের আলোয় ও যখন কবিতা পড়ে তখন সুখীন্দর এক মনে ওর মুখটা দেখেন। সুন্দরের ঠোঁটটা সাধারণ পুরুষের তুলনায় সরু, কিন্তু ওর চোখগুলো গভীর। ও কখনও শরাব পান করে না। কবিতা পড়ার সময় ওর চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলে ওঠে জায়গায় জায়গায়। গত তিন দিন ধরে ও সুখীন্দরকে চুমু খেতে চাইছে। সুখীন্দর হয়তো আজ ওকে সেই অনুমতি দেবেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেবেন কী?
সুখীন্দরের বোধ হয় একটা তন্দ্রার মতন এসেছিল। আচমকা ঘোর ভাঙতে দেখলেন সুন্দর একটা মস্ত জালের মধ্যে লটকে গিয়ে আপ্রাণ পালাবার চেষ্টা করছে। আর যতই চেষ্টা করছে। ততই যেন কে বা কারা আরও জোর দিয়ে টেনে টেনে জালটা বসিয়ে দিচ্ছে ওর শরীরে। সুন্দর কয়েকবার সুখীন্দরের নাম ধরে ডাকল, কিন্তু সুখীন্দর সাড়া দিতে গিয়ে চুপ করে গেল। কী সর্বনাশ! কেউ যদি শুনে ফেলে? স্বয়ং রাজাই যদি শোনেন? সুখীন্দর আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে পালঙ্কের ওপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বার বার মনে পড়তে লাগল সুন্দরের সরু ঠোঁট আর জ্বলজ্বলে চোখ দুটো।
সকালে ঘুম ভাঙল যখন সুখীন্দরের তখন দুটো প্রকান্ড ষাঁড় সুন্দরকে টেনে-হেঁচড়ে টুকরো টুকরো করছে। সমস্ত চত্বরটা রক্তে ধুয়ে যাচ্ছে। সুন্দরের প্রাণপাখি অনেক আগেই পালিয়ে গেছে, কিন্তু ষাঁড় দুটো তখনও নিজেদের বল পরখ করে যাচ্ছে। শহরের লোকগুলো যে এত নিষ্ঠুর সুখীন্দর আগে জানতেন না। অন্তত দু-আড়াই হাজার লোক বিস্ফোরিত নেত্রে এই মরণ খেলা উপভোগ করছে। একটিবার ওই দৃশ্য দেখেই সুখীন্দরের মনে হল উনি আর বাঁচবেন না।
খানিক পরে গোটা প্রাসাদ জেনে গেল রানির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাঁর আর কিছুই মনে পড়ে না। স্বয়ং রাজাকেই তিনি আর চিনে উঠতে পারছেন না। রাগে, অনুশোচনায় কঠিন মনের মানুষ মোহন সিংয়ের ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর জন্যই নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। তিনি রাজবৈদ্যকে ডেকে পাঠাবার জন্য হুকুম দিলেন। রানির দাসীদের সবাইকে ওঁর ওপর ভালো নজর রাখতে বললেন। মাথা খারাপ হলে মানুষ কত কীই না করে বসে! সেদিন আর মোহন সিং ম্যাকিয়াভেলি পড়লেন না। সভার গাইয়েদের বললেন খুব করুণ করে সন্ত কবিরের দোঁহা গাইতে। ছোটোবেলায় মোহন সিংয়ের মা খুব কবিরের দোঁহা গাইতেন। আজ ফের নিজেকে ভারি উজবুক, ভারি ছেলেমানুষ মনে হতে লাগল রাজার।
রাজবৈদ্য রানিকে পরীক্ষা করে বুঝলেন ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন যদি ফের কাউকে রানির ভালোবাসা পেতে হয় তাহলে বেশ কল করতে হবে। ঠিক যে দৃশ্য থেকে রানির মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে সেখান থেকেই ফের পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে তুলতে হবে। বৈদ্য রাজাকে ডেকে এক অদ্ভুত পরামর্শ দিলেন। বললেন, শোনা যায় রানিমার একটু দুর্বলতা ছিল সুন্দর সিংয়ের জন্য। আপনাকে এখন থেকে ওর কাছে সুন্দর সিং সেজে
যাতায়াত করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখছি না। এ রোগ তো ওষুধে যাবার নয়।
রাজা প্রথম প্রথম কথাটা শুনে থ মেরে গেলেন। তারপর অনেকক্ষণ ভাবলেন। অবশেষে ভাবতে ভাবতেই বললেন আচ্ছা দেখি।
গোঁফে ঝুলপিতে ছোঁয়া ছোঁয়া কলপ দিতে দিতে মোহন সিং নিজের মনেই হেসে ফেললেন। বিলিতি মেক-আপ ম্যান এসে সুন্দর সিংয়ের ছবি দেখে দেখে রাজাকে সুন্দর বানাচ্ছে দেখলে রানি সুখীন্দরও হাসি চাপতে পারবেন না। শেষে রাজা যখন সুন্দরের মতন পাগড়ি আর নাগরাই পরলেন মেক-আপ ম্যান রবার্টস ওয়ানডারফুল! ওয়ানডারফুল! বলে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। রাজাকে খুশি করার জন্য বলল, নাউ ইউ আর জাসট সুন্দর সিং। ইভন হিজ ড্যাডি উইল কল ইউ সন। রাজা খুশিই হলেন, ইংরেজিতে তারিফ শুনে। চট করে একটা মোহর বার করে রবার্টসকে দিলেন।
রাত্রে যখন মোহন সিং পাঁচিল দালান ডিঙিয়ে রানির কোঠায় যাচ্ছিলেন তখন ওঁর কেন জানি না মনে হল, এই জীবনটাই আসলে সুখের। যত রাজ্যের জাল মানুষ দিয়ে রাজ্য চলানোয় সত্যিই কোনো সুখ নেই। বরং বড়োরানির ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে বাকি জীবনটা সুন্দর সেজে সুখীন্দরের সঙ্গে প্রেম করলে মন্দ হয় না। আবেগের বশে মোহন সিং গুনগুন করে পুরোনো প্রেমের কাওয়ালি গাইতে লাগলেন। আর ঠিক তখনই কী ভেবে উনি ওপরে চাইতে দেখলেন একটা মস্ত দড়ির জাল সড়সড় করে নেমে আসছে ওঁর শরীরের দিকে। তখন উনি এক হাতে একটা কার্নিশ চেপে ধরে আছেন। হাত ফসকালেই চল্লিশ ফুট নীচে বাগানের শিকের ওপর পড়বেন। ভয়ে চিৎকার করবেন, তারও উপায় নেই। লোকজন উঠে এসে ওঁকে এই অবস্থায় দেখলে কী বিশ্রী ব্যাপারই না হবে। রাজা চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। ওপরে জানালায় দাঁড়ানো রানি সুখীন্দর স্মিত হেসে ইশারায় রাজবৈদ্যকে ফাঁস শক্ত করতে নির্দেশ দিলেন।
সম্ভবত মিনিট দশেক ধস্তাধস্তি করে রাজা জালের মধ্যে অচৈতন্য হয়ে পড়লেন। বৈদ্য কাজ হাসিল করে রানির ঘরে গিয়ে বকশিশ নিলেন। সুন্দরের মৃত্যুর শোধ উঠেছে দেখে রানি খুশি হয়ে একটা জড়োয়ার সেট তুলে দিলেন বৈদ্যর হাতে। বৈদ্য বললেন, আপনি পাগলের অভিনয় ভালোই করেছিলেন। না-হলে রাজাকে এই বোকা বানিয়ে মারা কি সম্ভব ছিল?
দেখুন, আমরা বৈদ্যরা পয়সা পেলেই তোক মারতে পারি। তবে এভাবে জাল ফেলে কাউকে মারিনি। রাজ পরিবারের লোকদের বিষ খাইয়ে মারা তো আমাদের উপরি আয়ের একটা বড়ো রাস্তা। সেরকম টাকা পেলে আমরা পুরো গ্রামকে গ্রাম বিষ খাইয়ে মারতে পারি। লোকে ভাববে মহামারি হয়েছে। হেঁ হেঁ হেঁ!
বৈদ্যকে বিদায় করে রানি ওঁর প্রিয় পরিচারিকা বিহারী মেয়ে মতিয়াকে ডাকলেন। মতিয়া ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন, তোর রানি হতে ইচ্ছে করে? মতিয়া বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল। রানি হওয়া? সে আবার কী কথা? রানি হতে কার না ইচ্ছে করে? কিন্তু করছে কে? মতিয়া লাজুক মেয়েটির মতোই ঘোমটা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রানি কাছে এসে ওর পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, আমি সত্যিই তোকে রানি করে দেব। তুই রানি থাকবি, পাগলি রানি। কোনোদিন এই অন্দরমহল থেকে বেরোবি না। সবাই তোকে কুর্নিশ করবে। তোর গুপ্ত প্রেমিক দলবীরকে মাঝ রাতে তোর ঘরে ঢুকিয়ে আনবি। কিন্তু খবরদার! কেউ যেন টের না পায়। তাহলেই বড়োরানির ছেলে, যে ক-দিনের মধ্যেই রাজা হবে সে তোকে কোতল করবে। তুই কেবল হীরে জহরত পরে দিনের বেলা পাগলি সেজে ঘরের মধ্যে ঘুরবি। চারটে দাসী থাকবে, কারোকে তোর মুখ দেখতে দিবি না। বাকি জীবন তোর সুখে কাটবে। বল, রাজি তো?
মতিয়া ফের ফ্যাল ফ্যাল করে চাইল। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে না বলল। রানি দপ করে জ্বলে উঠে বললেন, তাহলে কালই আমি দলবীরকে রাজার খুনি বলে ধরিয়ে দেব। তখন বুঝবি তোর প্রেমের কী দশা হয়।
রাজার খুনি! মতিয়া কিছুই বুঝল না তখন। রানি ওকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে পেছনের দালানের জানালায় নিয়ে জালে ফাঁস-বাধা মোহন সিংয়ের দেহটা দেখালেন। লম্বা দড়ির জালে ঝুলছেন মোহন সিংহ তিন তলা সমান উঁচুতে। মুখে ছোপ ছোপ রক্ত। ভয়ে মুখ চাপা দিল মতিয়া। তারপর কাঁপতে কাঁপতে বলল, না না রানি মা। দলবীরকে খুনি সাজিয়ো না। আমি রানি হব। আমি রানি হব। আমি পাগলি সাজব!
রানি ফের নিজের শোবার ঘরে গিয়ে সমস্ত সিন্দুকের চাবি তুলে দিলেন মতিয়ার হাতে। কানে ফিস ফিস করে বললেন; ভগবান তোর মঙ্গল করুন মতিয়া। তারপর নিজের কাপড় ছেড়ে মতিয়ার কাপড় পরে রানি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন। প্রাসাদের দ্বাররক্ষী রানিকে মতিয়া ভেবে অন্ধকারে জাপটে ধরল। গালে গাল ঘষতে লাগল, মুখে চুমু দিতে লাগল। ওর দেহের বিশ্রী গন্ধে রানির প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছিল। কিন্তু পালাতে হলে ওটুকু সহ্য করতেই হবে জেনে রানি মুখ বুজে রইলেন। কারণ তখন ভোর হয় হয়। রাজার ব্যাপারটা জানাজানি হলেই কেলেঙ্কারি। সাতদিন সমানে হেঁটে সারিন্দ রাজ্যে গিয়ে প্রথম বিশ্রাম নিলেন রানি সুখীন্দর। একটা হিরের আংটি বিক্রি করে দুটো বাঁদর, একগাছা দড়ি আর একটা ডুগডুগি কিনলেন। তারপর বাকি টাকা দিয়ে গোরখ মহল্লায় একটা ঘর ভাড়া করতে গিয়ে খবর পেলেন রাজা মোহন সিং এবং তাঁর রানিকে খুন করার দায়ে রাজপ্রাসাদের এক পরিচারিকা এবং পুরুষ কর্মচারীকে খোলা রাস্তায় কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। খবরটা শুনতেই একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল সুখীন্দরের শরীরে। ওর আর ঘর ভাড়া করা হল না। বাঁদরগুলোকে নিয়ে সরাসরি নদীর ধারে চলে গেলেন। জন্তুগুলোকে কিছু দানা ছড়িয়ে দিয়ে উদাসভাবে চেয়ে রইলেন নদীর নীল জলের ওপারে আধ-ডোবা সূর্যের দিকে। ওঁর মনে হল ওঁর হৃৎপিন্ডটাই যেন আস্তে আস্তে জলে ডুবে যাচ্ছে। এবং খানিক বাদে সত্যিসত্যিই পাগল হয়ে গেলেন।
অ্যাংলোচাঁদ
লরা ম্যাসি ওর বরকে ছেড়ে পালানোর পর হঠাৎ কথাটা মনে এল আমার। যেটা বলেছিল সিরিল আমায় চাঁদনি রাতে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে।
রোজকার মতো সিরিল সেদিনও নেশা করেই ছিল। না হলে আকাশের ত্রিসীমানায় কোথাও কোনো ঘুড়ি নেই, পাখি নেই, গর্জন করে উড়ে যাওয়া অ্যারোপ্লেন নেই, এমনকী শীতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘও নেই। নীলচে কালো আকাশে শুধু একটা নিস্তব্ধ চাঁদ, আর তারই মধ্যে শিস দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর শখ হয় সাহেবের!
আমি ওর মুখপোড়া ঘুড়ির বদলে আধখাওয়া চাঁদটাই দেখছিলাম, যেটা নজরে আসতে সিরিল বলল, দেখে নাও, দেখে নাও, দিস ইজ আ ডিফারেন্ট মুন। এ একেবারে অন্য চাঁদ। দেখে নাও ডিপু।
আমি চাঁদই দেখছিলাম, ওর কথা শুনতে ওর দিকে তাকাইওনি। কিন্তু কথাটা কীরকম টংটং করে বাজল কানে, ট্রামের ঘণ্টির মতো। জিজ্ঞেস করলাম, এটা আলাদা চাঁদ বুঝি? কীভাবে?
সিরিল সাঁ সাঁ করে টেনে ঘুড়ি নামাতে নামাতে বলল, এটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চাঁদ, তোমাদের বাঙালি বাড়ির চাঁদ নয়।
নেশা করে সিরিল এরকম অনেক কথাই বলে, আমি আমল দিই না। ভাবলাম নেশার বুকনিতে ওকে মারে কে! তার উপর চাঁদে পেয়েছে।
সিরিল ঘুড়ি নামিয়ে, লাটাই গুটিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে ফের বলল, তুমি ভাবছ আমি ঠাট্টা করলাম, ভাবো। বাট ইটস ট্রু। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাদ থেকে দেখা চাঁদ আর বাঙালি ছাদ থেকে দেখা চাঁদ এক না।
বাড়ি ফিরে সিরিলের আরও একশোটা কথার মতো এ কথাটাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ, কেন জানি না, এইটাই সেই ট্রামের ঘণ্টির মতো মাথার মধ্যে বাজতে লাগল যেই খবরটা কানে এল বলাইয়ের মুদির দোকানে—লেনার্ডের বউ ভেগেছে।
লেনার্ড ম্যাসির বউ লরা। ছিপছিপে, হিলহিলে অ্যাংলো সুন্দরী, কেবল মুখটুকু বাদে সারাশরীরে সরু সরু, কাটা কাটা দাগ। দেখা যেত হাত, স্কার্টের নীচে পা, আর পিঠখোলা ব্লাউজ পরে থাকলে পিঠের খোলা অংশে। লরা রস করে বলত, মাই লাভমার্কস। ভালোবাসার চিহ্ন। আসলে লেনার্ডের ছুরিতে বানানো দাগ সব, খেপে গিয়ে, সন্দেহে পাগল হয়ে, কখনো বা ভালোবেসে করা। ছ-ছটা বছর মেয়েটা নাকি এভাবে ছুরির ডগায় বেঁচে আছে। একবার হাতে-পায়ে রক্তারক্তি অবস্থায় আমায় ডাক দিল দোতলার জানালা দিয়ে, ডিপু, হারি প্লিজ! শিগগির এসো!
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে উঠে গিয়ে দাঁড়াতে, বলল, শিগগির আমায় একটা ডেটল আর তুলে এনে দাও দাস ব্রাদার্স থেকে। রাশ, অর আইল ডাই। বলে রক্তে ভেজা একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল বেতের সোফাতে।
আমি ডেটল এনে দাঁড়িয়ে আছি ওদের বসার ঘরে, লরা নেই। ছাঁৎ করে উঠল বুকটা। কী হল রে বাপ! মরে গেল নাকি? আমি বার কয়েক ডাক দিলাম, লরা! লরা! কোনো শব্দ নেই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কানে এল একটা চাপা গোঙানি শোবার ঘর থেকে…আমার হাতে ডেটল আর তুলো কাঁপতে লাগল। আর দাঁড়িয়ে থাকা সয় না, আমি আস্তে করে ঠেলে সরিয়ে দিলাম বেডরুমের দরজা।
নারী-পুরুষের সংগম সেই আমার প্রথম দেখা। লরার গায়ের রক্তের ছিটে লেনার্ডের গায়েও। ওরা ভালোবাসছে, না একে অন্যকে খেয়ে ফেলছে কেউ ঠাওরাতে পারবে না। আমি ডেটল আর তুলো চৌকাঠের উপর নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম ওদের রকমসকম, তারপর চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।
এরপরেও একদিন ডেটল না বেঞ্জিন কিনে আনতে হল। নিয়ে গিয়ে আর লেনার্ডকে দেখলাম না, সে তার কাটাছেড়ার কাজ সেরে জাহাজ-ডকের ডিউটিতে চলে গেছে। পরনের ফ্রক ছেড়ে মেয়েটা বিছানার চাদর জড়িয়ে সোফায় বসে ভিজে কাকের মতো কাঁপছে। বললাম, ভালোবাসার আর তোক খুঁজে পেলে না, লরা? আর কতদিন সহ্য করবে একে?
ওষুধটা নিতে নিতে ও বলেছিল, জানি জানি। শুধু বুঝতে পারি না ও কেন আমায় মেরেই ফেলে না।
বলাইয়ের দোকান থেকে ফেরার সময় সিরিলের কথাটা ঘুরছিল মাথায়। অ্যাংলো চাঁদ আর বাঙালি চাঁদ আলাদা।
হয়তো ভুলও বলেনি। দু-দিন যেতেই কেউ আর দেখি বিশেষ উচ্চারণও করে না ব্যাপারটা। ভাবখানা এমন অ্যাংলোদের মধ্যেও তো ঘটেই চলেছে। ছ-বছর বিয়ে টিকেছে, আবার কী চাই! পাড়ার গেজেট বলাই মুদিও একসময় হাল ছেড়ে বসল। বাঙালি পাড়ায় অ্যাংলো চাঁদ উঠল কি ডুবল কারও খেয়ালই রইল না।
আমি যতই ভাবি, এই ভাগাভাগিটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। শোভাকে নিয়ে চাঁদু পালালে গোটা পাড়া মাসখানেকের মতো ঝিম মেরে যায়। যেখানেই যাবে, একটা চাপা, ফিসফিসে কথাবার্তা। …হ্যাঁরে, ওরা কি রেজিস্ট্রি-টেজিস্ট্রি করেছে? না, এমনিই পালালে? …দূর! দূর! রেজিস্ট্রির কী দরকার? পেট তো বাঁধিয়েই বসেছে! সে খবর রাখো?… দ্যাখো, এবার কদ্দিন পর বউকে ঘরে তোলে কেষ্টচরণ!… তারপর হঠাৎ সংবিৎ ফিরলে আমাকে দেখে তোড়ফোড় বলাইয়ের, অ্যাঁ, এ সব কী? বড়োদের কথার মধ্যে টিপটিপ করে এসে দাঁড়ানো! কী চাই, মুড়ি-চানাচুর? তা, সেটা বলবি তো?
তখন আমার রাগি প্রতিবাদ, তোমরা তো সেই থেকে বিজ বিজ, বিজ বিজ করেই যাচ্ছ। আমার কথা শোনার মধ্যে আছ? বলাই বেগতিক দেখে একগাল হেসে বললে, তা যা বলিছিস। চাকরি-বাকরির যা মন্দার বাজার…এইসব নিয়েই বুড়োরা আমরা একটু ভাবনাচিন্তা করি।
কোনো মতে হাসি চেপে, সেই রাগভাব বজায় রেখে মুড়ির পয়সা গুনতে গুনতে বললাম, হু…!
লরার পালানো নিয়ে যে দু-দিন চর্চা চলল তারই মধ্যে ছোট্ট একটা বিপদ ঘটল আমার। পচা মাঞ্জা ফেরত দিতে গেছিলাম মৌলালির মোড়ে আক্রমের ঘুড়ির দোকানে। মাঞ্জা ফেরত নেবার ব্যাপারে ব্যাটা একদম পিশাচ। সমানে বাহানা করে যাচ্ছে একটা-না একটা। …ই দেখো, কৈসা মজবুত হ্যায়। ক্যা বোলতা মাঞ্জা তিখা নেহি?
আমি বলছি, এই ধরছি আমার এমনি সুতো। কাটো তত তোমার মাঞ্জা দিয়ে।
আক্রম ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ঘুড়ি উড়াইতেই জানো না, ডিঙ্গু বাবা। তুমি আমার সময় নষ্ট করাচ্ছ।
আমি যারপরনাই রেগে গেছি, কী, আমি তোমার সময় নষ্ট করছি? তুমি যা-খুশি মাঞ্জা গচাবে আর…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা হাত পড়ল আমার পিঠে, আস্তে করে। ঘুরে দেখি সিরিল। সারাশরীর মদে ভসভস করছে, চোখ দুটো জবার মতো লাল। বলল, লেট দ্যাট রাবিশ মাঞ্জা গো। তুমি আমার সঙ্গে এসো আমি তোমায় মাঞ্জা দেব।
ওর ওই অবস্থা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছি আমি। কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
ও শক্ত করে আমার লাটাইধরা হাতটা ধরে টানল, কাম! সিরিলদের ছাদে এসে বসেছি যখন দু-জনে, তখন সন্ধ্যে নেমেছে চারপাশে। ঝপ করে খানিকটা ঠাণ্ডাও পড়েছে, কিন্তু আকাশে কোনো চাঁদ নেই।? দু-জনে দূরে দূরে দুটো ইটে বসেছি, কিন্তু এইখান থেকেই ওর মদের বিদঘুটে গন্ধ পাচ্ছি। সিরিল বলল, আজ আমার সব লাটাই, সব মাঞ্জা তোমায় দিয়ে দেব। বাট…
মস্ত মস্ত শ্বাস ফেলে সিরিল কথা ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার তর সইছে না, বলে বসলাম, বাট কেন?
সিরিল পকেট থেকে তামাক বার করে সিগারেট পাকিয়ে বলল, বাট…
ফের বড়ো বড়ো শ্বাস পড়া শুরু হল, কী বলতে চায় তাও যেন ভুলে গেল। আমি আর থাকতে না পেরে বলে দিলাম, ইউ আর ড্রাঙ্ক টুডে।
অন্ধকারে লম্বা একটা রিং ছাড়ল সিরিল। বলল, হ্যাঁ, আমি মাতাল। আমি সব সময়ই মাতাল। কিন্তু আমি কোনো অন্যায় করি না।
সিরিলের রিংগুলো যত উপরে উঠছে ততই রাস্তার আলো এসে পড়ছে ওগুলোর উপর। ছোট্ট ছোট্ট গর্তঅলা মেঘ যেন আমি ওই রিং গুনতে গুনতে বললাম, অন্যায়ের কথা বলছে কেন?
ও হাত দিয়ে একটা উড়ন্ত রিং ধরার চেষ্টা করল। দেখল রিংটা নেই। বলল, ইটস লাইক দিস। গত দু-দিনে আমি বারোশো টাকা রেসে হেরেছি, ঠিক এইভাবেই টাকাগুলো হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। কুইনেলা, ট্রেবল টোট, জ্যাকপট…সব ধোঁয়া!
বা-রো-শো টাকা! আমি মনে মনে হিসেব কষছি বারোশো টাকা মানে কত টাকা। কাকা মাইনে পায় হাজার। আমাদের জি ই সি রেডিয়োর দাম ছশো। জগরুর মাইনে তিরিশ। আমার স্কুলের মাইনে…
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, এত টাকা…
সিরিল বলল, ঠিক বলেছ, এত টাকা। বাট আই ক্যান অলওয়েজ আর্ন দ্যাট ব্যাক। আই অ্যাম আ বি ও এ সি স্টাফ। ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারলাইন্স কর্পোরেশন। ইউ নো দ্যাট?
বললাম, জানি। তাই বলে এইভাবে টাকা ওড়াবে?
হঠাৎ সিরিল উঠে এল আমার দিকে, আমি ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি ইট থেকে। সিরিল সিগারেটটা ছুড়ে দিয়ে আমাকে বিশ্রীভাবে জড়িয়ে ধরল আর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর ঘামে, গন্ধে, আদিখ্যেতায় আমার গা ঘুলিয়ে উঠছে। আমি ওর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, প্লিজ লেট মি গো।
ও যেন সাপের ছোবল খেয়েছে হঠাৎ। ওর ওই মদে ভাসা লাল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে মেলে ধরে আমায় বলল, ইউ টক লাইক লরা। তুমি তো লরার মতো কথা বলছ।
লরা! এবার চমকে উঠেছি আমি। আমার পায়ের আর নড়ার জো নেই। তোতলানো শুরু হয়েছে আমার, কেন, লরার কথা বললে কেন?
সিরিল টলতে টলতে ওর ইটের উপর কোনো মতে গিয়ে বসে পড়ে বলল, বিকজ আই লাভড হার। ওকে আমি মার্লিনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম। মার্লিন আমার বউ ঠিকই, কিন্তু লরা…লরা…শি ওয়জ…
রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে আমিই ওর হয়ে কথাটা শেষ করে দিলাম, আ বিচ!
সিরিল কিছু বুঝল, কি বুঝল না বুঝতে পারলাম না। অন্ধকারে হাবার মতো চেয়ে রইল আমার দিকে। আমি আমার পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ইস্পাতের ঠাণ্ডা ছুরিটা চেপে ধরলাম। সেই কবে তুলে এনেছিলাম পাড়ার ড্রেন থেকে। কেলে বিশেষ ছুরি। এই নিয়ে অ্যাটাক করেছিল মস্তান জগুদাকে। জগুদা এক প্যাঁচ ওকে মাটিতে ফেলে এই ছুরি দিয়ে ওর গেঞ্জি ফালা ফালা করে দেয়। তারপর পোড়া সিগারেটের মতো ছুরিটাকে টপকে দেয় নর্দমার দিকে। সে-দৃশ্য আমি ছাদ থেকে দেখেছিলাম। ওই চাঞ্চল্যের মধ্যে কারও নজরই যায়নি বিশের ছুরিটা শেষ অব্দি কোথায় গেল। পরে রাত নামতে, পাড়া শুনশান হতে আমি অন্ধকারে গুলি খোঁজার ভান করে জিনিসটাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম ওখান থেকে। সেই থেকে তিন-তিন বছর এ জিনিস লুকোনো আমার ছাদে পায়রার খোপে। কেউ জানেনি কেলে বিশের অটোম্যাটিক ছুরি ঘুমিয়ে আছে আমার জিম্মায়। কেবল সেদিন চাঁদের আলোয়—
আমি চোখের জল মুছতে মুছতে ওটাকে ঘুম থেকে তুলে এই পকেটে ভরলাম…
আমি উঠে পড়েছি চলে আসব বলে, শুনি সিরিল ফের সেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, ডিপু, ইউ টেক অল মাই লাটাইজ, অল মাই কাইটস অ্যাণ্ড মাঞ্জাজ, বাট…
আমি ভেংচানোর সুরে বললাম, বাট?
সিরিল ফের একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ফরগিভ লেনার্ড!
আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। লেনার্ডকে ক্ষমা! আর সে-কথা সিরিল বলছে কেন? ও কী জানে? কে ওকে কী বলল? হায় ভগবান, এভাবে তাজ্জব হওয়ার জন্য কি এই অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাদ? যে-ছাদে এই মুহূর্তে কোনো চাঁদও নেই।
আমার তোতলামি যেন আর কাটে না। কী…কী…কী…বলছ তুমি, সিরিল? লেনার্ডকে ক্ষমা করার কথা উঠছে কেন? ও কী করেছে?
সিরিল মুঠো করে সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, ও যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ইভন জিসাস ক্রাইস্ট কান্ট ফরগিভ হিম।
—কিন্তু ও করেছটা কী?
—হি হ্যাজ রেপড ইউ, হ্যাজনট হি?
আমি ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি পকেটের মধ্যে ফেলে বিশের ছুরিটা জোর করে চেপে ধরলাম। চোখ ফেটে ক-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। সিরিল ওর নতুন ধরানো সিগারেটটা আলসের বাইরে ছুড়ে ফেলে এসে দাঁড়াল আমার পাশে। আমার চোখের জল মোছাতে লাগল সিরিল, আর বলল, তোমার জন্যই লেনার্ডকে ছেড়ে চলে গেছে লরা। লেনার্ড নিজে আমায় বলেছে। অল হি সিকস নাও ইজ ইয়োর ফরগিভনেস। তুমি ক্ষমা করবে না, ডিপু?
ক-দিন হল সিরিল লেনার্ডকে ক্ষমা করার কথাটা বলেছিল আমি ভুলে গেছি। লরাও যে কতদিন বর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে মনে রাখতে পারছি না। চাঁদ থাকুক, না থাকুক আমি কী এক ঘোরের মধ্যে রোজ ছাদে উঠে আসি সন্ধ্যে নামলেই। এখন সব চাঁদকে আমার আধখাওয়া ঠেকে, চাঁদ আর কমেও না, বাড়েও না, অমাবস্যার রাতগুলোও কী করে, কী করেই জানি উধাও হয়ে গেছে। এই এক অদ্ভুত চাঁদ আর ওই একটা শব্দ, ফরগিভনেস’, সিরিল আমার জীবনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যের অন্ধকারে এখন আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিরিলদের জানলাটা দেখি; যেখানে পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছুটা লালচে আলো ঠিকরে বেরোয়। লাল শেডের হলল্যাম্পের চাপা আলো। আর দেখি লেনার্ড-লরাদের জানালা, যেটা সেই থেকে খোলাও হয় না। একটা নিরেট অন্ধকার টানিয়ে লেনার্ডটা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আমি বুঝতেও পারি না।
আমি আস্তে আস্তে পকেট থেকে বার করে আনলাম কেলে বিশের ছুরি। বোতাম টিপে বার করে ফেললাম ওর লিকলিকে ধারালো ফলা। আর-হায়, আজও এক আধখাওয়া চাঁদের রাত। জ্যোৎস্নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম নিষিদ্ধ অস্ত্রের আকার-প্রকার। তিন তিনটে বছর ঘুমিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মরে যায়নি। ওকে দেখতে দেখতে মনে পড়ল লেনার্ডের বিশ্রী ছুরিটাও। যা শিল্পীর তুলির মতো আলতো করে ও বুলোচ্ছিল লরার হাতে, বুকে, তলপেটে আর সমানে আমার দিকে ঘুরে বলছিল, দিস ইজ হাও ইউ মেক লাভ, বচ্চা। ডেটল, বেঞ্জিন ঘষে মেয়েদের ভালোবাসা যায় না। ভয়ে, উৎকণ্ঠায় আমার গলা বুজে আসছিল। কোনো মতে তাও বললাম, আমি তোমার বউয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করছিলাম না, লেনার্ড। আমি ওর ক্ষতে ওষুধ বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।
ওষুধ?—বিশ্রীভাবে নাক সিটকালো লেনার্ড। মেয়েদের ওষুধের তুমি কী জানো? জানো, মেয়েরা কী ওষুধ চায়?
বলতে বলতে লরাকে ছেড়ে আমার উপর ঝাঁপাল লেনার্ড, ওর সারা গা থেকে বিশ্রী মদের গন্ধ। আমি দু-হাতে ওকে ঠেলে সরাতে গিয়ে হড়কে পড়লাম কাঠের আলমারিটার গায়ে। লেনার্ড চট করে আমার হাত দুটো ধরে টান টান করে বিঁধে দিল আলমারিতে। লজ্জায়, অপমানে আমি অবশ হয়ে গেছি, কিন্তু কাঁদতে পারছি না। যিশুর মতো আমার মাথাটা ঝুলে পড়েছে একদিকে, আর চোখ বন্ধ করে সহ্য করছি আমার গালে, আমার ঠোঁটে, আমার কপালে লেনার্ডের মাতাল চুম্বন।
আমি এও শুনছি দূর থেকে লরা চেঁচাচ্ছে, লেনি, ইউ কান্ট ডু কিস টু হিম। লেনি, ও একটা বালক মাত্র। লেট হিম গো!
এ যে কতক্ষণ চলেছিল আর কোনো দিন আমার মনে পড়বে না। যখন সংবিৎ ফিরল দেখি খাটে শুয়ে লেনার্ড ওর ছুরিটা শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছে আর সেটা বুকে পড়ার আগে লুফছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আর আমার সারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছে মরা বৃষ্টির মতো। বাড়ি ফিরে এসে স্নানঘরে ঢুকে গায়ে প্রথম জলটা ঢালার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ফেটে ভুলে যাওয়া কান্নাটা বেরোতে শুরু করল।
সেই রাতে বাড়ির সবাই দল করে উত্তম-সুচিত্রার ‘সপ্তপদী’ দেখতে বেরুচ্ছিল; আমি বললাম, তোমরা যাও, আমার পড়া আছে।
পড়া ঘোড়াই ছিল, ছিল বোঝাপড়া। আমি সন্ধ্যে হতেই টুকটুক করে উদ্ধার করলাম বিশের ছুরিটা পায়রার খোপ থেকে। একট ন্যাকড়া জোগাড় করে ঝাড়লাম সেটা, তারপর ওর ভোলা ফলায় চুমু খেয়ে শপথ নিলাম, লেনার্ড, দিস ইজ ফর ইউ। এই রইল তোমার জন্য, লেনার্ড।
কিন্তু না, লরাকে আমি বাঁচাতে পারিনি। ও নিজেই পালিয়ে বেঁচেছে। আমার আর চুপি চুপি ওর হাতে ছুরি গুঁজে দিয়ে বলা হল না, সারাগায়ে তোমার ছুরির দাগ এঁকেছে লেনার্ড। একবার শুধু এইটা দিয়ে ওর বুকের কোথাও একটা দাগ কমো, আমি দেখতে চাই।
না, না, ওই দৃশ্যটা আমি ভাবতে চাই না আর। শেষ অবধি লেনার্ড আমার শরীর নিয়ে কী করেছে আমি জানতেও পারিনি, কিন্তু লরার বুকের মাঝ মধ্যিখানে ওই সরু রক্তের নালি!
ফের সেই ডাক শুনেছিলাম জানালা থেকে, ডিপু, রাশ! আই’ম ডাইং।
আমি দৌড়ে উঠে গিয়ে দেখি নীল স্কার্টের উপর পাতলা সাদা ব্লাউজে ঠক ঠক করে কাঁপছে লরা। বলল, ওই ডেটলটা শিগগির নিয়ে এসো। বলেই বেডরুমে ঢুকে গেল। আমি ডেটল, বেঞ্জিন, তুলো নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি মেয়েটা ব্লাউজ ছেড়ে খালি গায়ে খাটের উপর বসে। আমায় বুকের মাঝখানটা দেখিয়ে বলল, আজ ও এখানেও ছুরি বোলাল।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখি ডেটল তুলো নিয়ে। আমি একটা নগ্ন মেয়ের গায়ে হাত দেব কেন? এ তো অসভ্যতা। এই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখাটাও পাপ।
আমি লরার সামনে ডেটল রেখে পিছন ঘুরে বললাম, নো, লরা, আই কান্ট টাচ ইউ। ইটস নট ডান।
আমার তখন মনে পড়ছে কাকার কথা কিছুদিন আগে। মাকে বলছিল আমায় ফিরতে দেরি দেখে—জানো বউদি, শেষমেষ ঠিকই করলাম দিপুকে বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেব। তোমার কষ্ট হবে জানি। কিন্তু দাদা থাকলে সেও এটাই চাইত। এই সব অ্যাংলো-ফ্যাংলোদের সঙ্গে ওর এত মেশামিশি ঠিক না। ওদের তো চরিত্র বলে কোনো বস্তু নেই।
আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপ মেরে শুনছিলাম।
লরার থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে কাকার কথাটাই ভাবছিলাম। টের পেলাম লরা শিশি খুলে ডেটলে তুলো ভিজিয়ে বুকে ঘষছে। ওর ঠোঁট গলে মাঝে মাঝেই ‘উঃ!’ ‘আঃ!’ শব্দ হচ্ছে। একবার বলল, হতচ্ছাড়া সিরিলটা বলে তোমার গায়ে ওষুধ দিতে আমায় ডাকো না কেন?’ স্কাউন্ডেল।
ও কেন বলেছিল এই কথাটা? আমাকে চটাতে? নাকি, আমি যাতে সিরিলকে ডেকে আনি? আমি বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝলাম ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা অমানুষের কাজ। তা হলে ডাক শুনে রাস্তা ডিঙিয়ে ছুটে এসেছিলাম কেন?
আমি ঘুরে গিয়েছিলাম লরার দিকে। বললাম, দাও, আমি ওষুধ বুলিয়ে দিচ্ছি। নারীর বুক কত গভীর আমি জানিনি কোনোদিন। মার বুকে মুখ লুকিয়ে তো কত কাঁদি কতদিন। কিন্তু এ কেমন শিহরণ ঠাকুর! আমি কি খারাপ হচ্ছে যাচ্ছি?
কত কথা বলছে লরা, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ব্যথার মধ্যে ও গানও গাইছে। ন্যাট কিং কোলের ফ্যাসিনেশন’। আর লক্ষ লক্ষ অচেনা অনুভূতির মধ্যে, অজ্ঞাত শিহরণের মধ্যে আবছা আবছা ভাবে আমি বুঝতে শিখছি সিরিল কেন কথায় কথায় আমায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ইউ থিঙ্ক লরা লাভজ লেনার্ড?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস!
ও ঘাবড়ে গিয়ে বলে, এত গলাবাজি করে বলার কী আছে? তখন ওর ওই বদ প্রশ্ন থামানোর জন্য আমি বলি, কারণ আমি জানি।
ও মুখ বিকৃত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, শিট! আর এখন লরার খালি গায়ে ওষুধ বোলাতে বোলাতে আমি কেনই জানি না জিজ্ঞেস করে বসালাম, লরা, ডু ইউ লাইক সিরিল?
লরা গান থামিয়ে গিয়ে ওর সুন্দর ভুরু দুটো ধনুকের মতো বাঁকিয়ে তুলে বলল, হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?
আমার সত্যিই তো কোনো কারণ ছিল না এটা জিজ্ঞেস করার। তাই চট করে একটা মনগড়া কারণ ফাঁদলাম, কারণ ও তোমার খুব পছন্দ করে।
–করুক গে! ওকে বোলো ওই পছন্দটাক যেন মার্লিনের উপরে খরচ করে।
—আর লেনার্ডকে? ডু ইউ লাভ হিম?
লম্বা একটা শ্বাস ফেলল লরা। হ্যাঁ, না কী বলবে বলে চোখ বন্ধ করল, আর ঠিক তক্ষুনি দড়াম করে বেডরুমের দরজায় লাথি মেরে ঘরে ঢুকল লেনার্ড ম্যাসি। ভগবান জানেন কেন, ঠিক সেই লহমায়, আমার তুলোধরা আঙুলগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে লরার বুকে।
সো হোয়াটস দ্য গ্রেট হিয়র দিস আফটারনুন?—লেনার্ড হাতভর্তি মদ আর খাবার রাখল মেঝেতে। লরা ওর ব্লাউজটা গায়ে চড়াতে যাচ্ছিল, লেনার্ড সেটা খামচে নিয়ে ছুড়ে দিল মাটিতে।
তারপর…
তারপর তো আমার আর কিছুই মনে পড়ে না। যখনই ভাবি ওই দৃশ্য—লেনার্ডের ওই মদো, ঘেমো মুখ চষে বেড়াচ্ছে আমার সারামুখে…হয়তো দেহেও, কারণ বাড়ি ফিরে দেখেছি হাওয়াই শার্টের সব বোম খোলা…আমার সব স্মৃতি অন্ধকার হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে বারকয়েক দেখা হয়েছে সিরিলের সঙ্গে। ওর শুধু এককথা লেনিকে ক্ষমা করে দাও। ও পাগল, কিন্তু মানুষ খারাপ নয়।
যেদিন ট্রামস্টপে দাঁড়িয়ে ফের এটা বলল ও, পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল মার্লিন, খারাপ না মানে? মানুষ এর থেকে কত খারাপ হবে? সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেল সিরিল।
আর কাল যেই বড়ো রাস্তার মুখে একই গাওনা শুরু করল ও, আমি পরিষ্কার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত সব বলো কেন রোজ? আই অ্যাম ওল্ড এনাফ টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড অল দিস। আর তুমি যদি জানতে চাও তো শোনো—লরা কোনো দিনও তোমায় পছন্দ করেনি।
দপ করে নিভে গিয়েছিল সিরিলের মুখটা। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মরা গলায় বলল, জানি আমি জানি।
–তা হলে?
—আসলে কী জানো, লেনি ছাড়া জগতে আমার কোনো বন্ধু নেই। আর প্রেমে পড়লাম তো ওরই বউয়ের প্রেমে পড়লাম। কত ছুরির আঁচড় যে মেয়েটা খেয়ে গেল আমার জন্য। গা দিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কোনো দিনই ডাকেনি আমাকে বা মার্লিনকে। দেখতাম ডেটল নিয়ে তুমিই ছুটছ।
বললাম, তার যথেষ্ট মূল্যও পেয়ে গেছি সে-দিন।
সিরিল আমার কাঁধে হাত রাখল, অথচ জানো, তোমাকে ও ওভাবে ডাকছে দেখলে হিংসে হত আমার। ভাবতাম একদিন চারপাশে কোথাও তুমি থাকবে না, ও আমায় ডেকে ফেলবে নিরুপায় হয়ে। ডাকেনি। আর…
সিরিল একটু চুপ করে ছিল, আমি খোঁচালাম আর?
—আর মেয়েটা চলেও গেল তোমার জন্য। লেনিকে সেদিন রাতেই বলেছিল, ইউ হ্যাভ অ্যাবিউজড আ নাইস, ইনোসেন্ট বয়। আমি তোমার সঙ্গে আর থাকতে পারি না।
আমার বুকটা কীরকম কাঁপল হঠাৎ। বললাম, কিন্তু ও গেছে কোথায়?
সিরিল বলল, শুনেছি খড়গপুরে বোনের বাড়িতে।
—ফিরবে না?
—ফিরবে? আনবেটা কে?
–কেন, লেনার্ড!
সিরিল হাসল, ওর অবস্থা কী হয়েছে জানো? সেই থেকে ও মদ আর সিগারেটের উপর আছে। ও খায় না, ঘুমোয় না, কাজে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। ওর চাকরিটা হয়তো চলেই যাবে।
তাই! —জীবনে এই প্রথম লেনার্ডের জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল আমার।
সিরিল বলল, তাও প্রথম প্রথম বলত তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে যাবে। এখন তো ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে, ওর সাড়াশব্দও বন্ধ হয়ে গেছে। পাশের ফ্ল্যাটে থাকে, তবু খবর নেওয়ার উপায় নেই।
-কেন?
—কারণ মার্লিন বলে হি ডিজার্ভজ টু বি লেফট অ্যালোন।
–তুমি তাই করছ তা হলে?
সিরিল প্রতিবাদ করল, না। আমি গতকাল ওর ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ওকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বেশ ক-টা চড় কষিয়েছি গালে-–সোয়াইন! তুমি লরাকে সন্দেহ করো। তুমি জানো কী ধাতুতে তৈরি মেয়েটা? শি ইজ অ্যান অ্যাঞ্জেল, ইউ ব্লাডি ফুল! যাও গিয়ে ফিরিয়ে আনো ওকে। আর ক্ষমা চাও গিয়ে ডিপুর কাছে।
আমি সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেছি।… কেন, ক্ষমা চাইবে কেন আমার কাছে?
আমার তো কোনো অধিকার নেই ওর বউয়ের শরীরে ওষুধ লাগানোর! তুমি সহ্য করতে মার্লিন আর আমাকে ওভাবে দেখলে?
সিরিল স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলল, ইউ মিন ইট? ইউ রিয়েলি মিন ইট? ও তোমার মনের কথা?
আমি পকেট থেকে ছুরিটা বার করে ওর সামনে ধরলাম—যেদিন ব্যাপারটা ঘটল আমি এই ছুরি পকেটে ভরেছিলাম। ভেবেছিলাম লরাকে দিয়ে বলব, একবার অন্তত ওকে মারো, রক্ত বার করো। কিন্তু…
—কিন্তু?
—কিন্তু এখন মনে হয় লরা এটা চাইত না। ও অবাক হত আমার কথা শুনে।
-কেন?
আমার গলা জড়িয়ে আসছিল, বুকে একটা চাপা ব্যথা হচ্ছিল। কোনো মতে বলতে পারলাম, ও যে লেনার্ডের ছুরির কাঁটা-ছেড়াকে ভালোবাসার চিহ্ন ভাবত। লাভ মার্কস।
আমি ফের ছুরিটাকে দেখতে লাগলাম চাঁদের আলোয়। আধখাওয়া চাঁদের আলোতেও ছুরি বেশ হিংস্র। আমি আস্তে আস্তে বাঁ-হাতের কবজির কাছে ব্লেডটা বুলোলাম আর শিউরে উঠলাম ‘উঃ! আর চমকে দেখি আমার পাশে নিঃশব্দে প্রেতাত্মার মতো এসে দাঁড়িয়েছে লেনার্ড।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, লেনার্ড! তুমি!
লেনার্ড আমার হাত থেকে ছুরিটা আস্তে করে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, এটা খেলার জিনিস নয়, ডিপু। এ সব আমার মতো খারাপ লোকদের কাছে থাকাই ভালো।
ও আস্তে করে ছুরিটা বন্ধ করে নিজের পকেটে রাখল। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম। রোগা ফরসা শরীরটা তামাটে মেরে গেছে। চোখের তলায় গর্ত, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর সারাহাতে সরু সরু আঁচড়।
আমি শিউরে উঠেছি—এ তোমার কী দশা, লেনার্ড? আর ইউ ও-কে?
ক্লান্ত হাসি হাসল লেনার্ড। পটপট করে জামাটা খুলে ফেলল। সারাগায়ে ছুরির দাগ। ঠিক যেমন ভরা লরার দেহ। বলল, আর ইউ হ্যাপি নাও, ডিপু?
বললাম, এতে খুশি হওয়ার কী আছে? আমি তো ড্রাকুলা নই।
লেনার্ড বলল, তুমি রিভেঞ্জ, বদলা চাও না? বললাম, না।
—আমি কিন্তু পেনান্সে, প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাসী।
–তোমার প্রায়শ্চিত্তের ধরনটা ভালো না।
–আমার ভালোবাসার ধরনটাও কি ভালো?
আমি চুপ করে গেলাম। ও কাছে এসে পকেট থেকে ছুরিটা বার করে বলল, জাস্ট টু শো হাও মাচ আই লাইক ইউ, ডিপু। তারপর কড়াৎ করে ছুরিটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল নীচে। ছুরি এসে ওর ঘাড় ঘেঁষে মাটিতে গোত্তা খেল। আমি বললাম, এটা কী হচ্ছে লেনার্ড?
লেনার্ড এবার আরও উঁচুতে ছুড়ে দিয়েছে ছুরিটা। আমি ছুরিটা দেখতে গিয়ে আধখাওয়া অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চাঁদটাও দেখে ফেললাম। এবার ছুরি এসে পড়ল ওর কোমরের পাশে। আমি চিৎকার করলাম, লেনি, স্টপ ইট!
লেনার্ড আরও উপরে ছুড়ে দিল ছুরিটা। বনবন করে পাক খেতে খেতে ছুরি উঠল উপরে। লেনার্ড চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল মাটিতে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি আমিও। খানিক পরে ফটাস আওয়াজ করে ছুরি পড়ল চোখ বুজে পড়ে থাকা লেনার্ডের গলার একসুতো দূরে।
লেনার্ড তখনও চোখ খোলার সময় পায়নি, আমি ছুট্টে গিয়ে ছুরিটা কুড়িয়ে ছুড়ে দিলাম ছাদ থেকে অনেকদূরে পারসিবাড়ির বাগানে। লেনার্ড বলে উঠল, এ কী করলে? এ কী করলে, ডিপু? খেলাটা নষ্ট করে দিলে।
আমি ফিরে এসে নীচু হয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, দ্যাটস ও-কে লেনি। লেনি, আই লাভ ইউ! আমার কিছু মনে নেই, সে-দিন কী ঘটেছিল। নো কোয়েশ্চেন অব ফরগিভিং, আই সিম্পলি লাভ ইউ। তুমি যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে যাব লরাকে ফিরিয়ে আনতে। তুমি প্লিজ আর কখনো ছুরি খেলো না।
আমার চোখের জল পড়েছে লেনার্ডের কপালে। ও আমার মুখটা ধরে কপালে চুমু দিল। চাঁদের আলোয় পাগলটাকে এখন আমার লরার মতো নিস্পাপ মনে হচ্ছে।
একবুক ক্লান্তির সঙ্গে লেনার্ড বলল, আহ, স্লিপ! কতদিন ঘুমোইনি…
ও ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ওর পকেটে হাত গলিয়ে ওর নিজের ওই রক্তচোষা ভয়ংকর ছুরিটা বার করে চাঁদ লক্ষ করে আকাশে ছুড়ে দিলাম…
বুঝতে পারলাম না সেটা আর মাটিতে ফিরে এল কি না আদৌ।
আঁতোয়ান সুকের ডায়েরি
এতখানি বুড়িয়ে গেছে বাড়িটা অ্যাদ্দিনে? কীরকম, কীরকম শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেছে কি? ‘১৯’ লেখা নীল-সাদা এনামেলের সাইনটাই বা কোথায় গেল? ফ্ল্যাটের দরজার সামনের স্পেসটাতেও কেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দরজার গায়ে কলিং বেল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অরুণ অগত্যা ঠক ঠক করে আওয়াজ করল দরজায়। তারপর দরজা থেকে একটু পিছিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে।
কিন্তু কোথায় কে? দরজা খোলা দূরে থাক ভেতরে কোনো গলা বা নড়াচড়ার আওয়াজও নেই। ডরোথি কিন্তু ফোনে বলেছিল, আই উইল ওয়েট ফর ইউ ফ্রম সিক্স। আর এখন তো প্রায় সাড়ে ছটা।
অরুণ ফের এগিয়ে নক করল দু-বার। একটু থেমে আরও দু-বার, শেষের বারটা একটু ধাক্কার চালে। অমনি কোঁ কোঁ ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দরজাটা হাট করে খুলে গেল। অরুণ দেখল কমলা রঙের সিল্কের শেডের হল ল্যাম্পের আলোয় মনোরম এক আলস্যের মধ্যে শুয়ে আছে ডরোথির বসার ঘর।
দু-পা ভেতরে ঢুকে অরুণ দেখল ঘরে কেউ নেই। এক মলিন, ধ্বস্ত চেহারা ঘরের। পোড়া সিগারেটের গন্ধে ম ম করছে। রেডিয়োগ্রামে একটা রেকর্ড চাপানো আছে সেই কবে থেকে কে জানে। সে রেকর্ডেও ধুলো পড়েছে। ডালাটা হাঁ করে খোলা।
অরুণের চোখ গেল কোণের ভেঙে পড়া রেকর্ডের তাকটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে গুনগুনোতে লাগল ছেলেবেলার এই ঘরে বসেই শোনা সেই সব গান, সেই সব কণ্ঠ। ন্যাট কিং কোল, বিং ক্রসবি, ফ্রাঙ্ক সিনাট্রা, এলভিস প্রিসলে, পল অ্যাঙ্কা, জিম রিভস, প্যাট বুন…
সব রেকর্ডেই ধুলোর জামা, মেঝের লাল কার্পেটে ঝাঁট পড়েনি বহুকাল। অরুণ দেওয়ালে সুইচ খুঁজে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে একটা সোফায় বসল। কিন্তু বসার জায়গা করতে সোফা থেকে একটা এলপি ডিস্ক সরিয়ে পাশে রাখতে হল। ডিস্কটা তুলতে তার কভারে দেখল হাসি-হাসি মুখের ইভ মত; পাশে ঝাপসা হয়ে আসা কলমের আঁচড়—’টু ডিয়ারেস্ট ডর, উইথ আ কিস–টোনি।
কোনো তারিখ নেই বলে ভাবতে বসল ঠিক কবেকার উপহার হতে পারে রেকর্ডটা। মনের মধ্যে বছরগুলো কীরকম তালগোল পাকিয়ে গেল। এটা..এটা কি তাহলে ডরোথিকে দেওয়া আঁতোয়ান সুকের শেষ উপহার?
ডিস্কটা বাজাবার একটা চাড় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু অরুণের এই ধারণাও ছিল যে, ধূলিধূসর ওই রেডিয়োগ্রাম থেকে আর কোনোদিনও কোনো ধ্বনি ফুটবে না। রেকর্ডটা পাশের সাইডটেবিলে শোয়াতে গিয়ে ওর চোখ পড়ল পাঁচ-পাঁচটা লাল রেক্সিন বাঁধাই সুকের সেই ডায়েরি। যার জন্য অরুণের এই আসা, ডরোথির এই আমন্ত্রণ। ঈশ্বর জানেন কী হিরেমানিক আছে ওর মধ্যে, কিন্তু ছেলেবেলায় সুকের কলমে রোজ একটু একটু করে জিনিসটাকে ফলে উঠতে দেখেছে ও। সেদিন ফোনে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলেছিল ডরোথি—এটা শুধু টোনির একার কথা নয়। এতে আমরা সব্বাই—আমি, তুমি, লোরেন, মার্নি, রিটা, ডুলু, মাম্পু সবাই আছি। ইটস লাইক আ হিউজ লাভলেটার। সত্যি একটা প্রেমের চিঠি। তোমায় পড়তেই হবে এটা, অরু। আর তারপর, তুমি তো লেখক, একটা লাভ স্টোরি লিখো আমাদের নিয়ে।
অরুণ বলেছিল, কিন্তু সেই প্রেমের গল্পটা তো খুব করুণই হবে, ডরোথি।
হোক না।–ওপার থেকে গলা ভেসে এসেছিল মহিলার। সব সত্যিকারের প্রেমের গল্প চোখের জলে শেষ হয়। তুমি লেখক, তুমি জান না চোখের জল কত মিষ্টি হয় যদি সেভাবে কাঁদতে পার?
ঠিক আছে, আমি আসব বলে ফোন নামিয়ে রেখেছিল অরুণ। আর এখন সেই ডায়েরিগুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ও ভাবতে বসল, সত্যিই তো! এইসব ডায়েরি ও কোন কাজে লাগাতে পারবে। কয়েকটা প্রবন্ধ? হারিয়ে যাওয়া অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের সমাজচিত্র? লেট-ফিফটিজ আর আর্লি-সিক্সটিজের একটু কলকাতা? হারিয়ে যাওয়া মিন্টো রো, মিন্টো লেন? নাকি অদ্ভুতচরিত্র অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পুরুষের মনের আগড়াম-বাগড়াম?
অরুণ আনমনে একদম ওপরের ডায়েরিটা তুলে নিয়ে, সে জায়গায় ইভ মত-র রেকর্ডটা রেখে ডায়েরির পাতা ওলটাতে লাগল। লম্বা-চওড়া ডায়েরির পাতায় সুকের হাতের লেখার স্মৃতি ওর একেবারে মুছে যায়নি, ওর মনে আছে সুকের বেশ মুশকিল হত পল্লির বাঙালিদের নামের বাংলা বানান লিখতে। একবার অরুণকেই জিজ্ঞেস করেছিল, অরু, হাউ ডু ইউ স্পেল ইয়োর নেম?
O-r-o-o-n অর O-r-u-n? অরুণ তখন বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলেছিল, কোনোটাই না। ওটা A-r-u-n। আর যখন অরু লিখবে লিখো A-r-u, ক্লিয়ার?
কথাটা মনে পড়তে অরুণের একটু হাসি পেল। হঠাৎ পাশ থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল— হাসছ? এনিথিং ফানি?
অরুণ চমকে উঠে ওপরে চাইতে দেখল আলো-আঁধারির মধ্যে একটা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ডরোথি। বলিরেখায় বলিরেখায় সুন্দর মুখটা কাহিল হয়ে আছে। কাঁচার সঙ্গে পাকা মিশে কেমন ধূসর একটা বর্ণ হয়েছে কোঁকড়া চুলে। গায়ের হালকা নীল গাউনটারও বয়স হয়েছে। পায়ের কার্পেট স্লিপারটার তো এখনই অবসর নেওয়া উচিত। শুধু এই বয়সেও এই চেহারাতেও ডরোথির সেই রুপোলি হাসি-সুকের ভাষায় ডর’স সিলভার স্মাইল এখনও যে-কে-সেই।
অরুণ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ডরোথি, তুমি আজও এত সুন্দর হাসতে পার? তারপর এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো ধরে বলল, কত বছর হল বলো তো?
ডরোথি অরুণকে আপাদমস্তক নজর করে কীরকম স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করল, তুমিও কত বড়ো হয়ে গেলে অরু?
অরুণ একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে লাগল সেইসব দিনগুলোর কথা যখন এক তীক্ষ্ণ বিদ্যুতের মতো এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েটি মিন্টো রো দিয়ে হেঁটে যেত সারাপাড়াকে স্তব্ধ করে। ও রাস্তার মোড় বাঁকলে হয়তো ফের গুঞ্জন শুরু হত ওকে নিয়ে, কিন্তু যতক্ষণ ও দৃষ্টির মধ্যে ততক্ষণ মানুষ কীরকম নির্বাক।
সিঁড়ি, বারান্দা বা ছাদ থেকে ডরোথিকে দেখলে ওই বালকবয়সেও একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যেত অরুণও। সেই দৃশ্য আজও ভোলার নয়। ভোলার নয় আঁতোয়ান সুকের শেষ চলে যাওয়ার দৃশ্যটাও। গ্রীষ্মের মাঝদুপুরে, কাঠফাটা রোদুরে একটা ট্যাক্সির ডিকিতে সুক এক এক করে দুটো সুটকেস তুলল; কী মনে করে রাস্তার এপ্রান্তে ওপ্রান্তে দু-বার চোখ চালাল, পকেট থেকে বার করে একটা চারমিনার ধরাল, তারপর নিজেদের ফ্ল্যাটটার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল, শেষে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কী একটা বলে পিছনের সিটে গা এলিয়ে বসল।
আসলে ডরোথিকে দেখবে বলেই এই বিশ্রী গরমেও ছাদে এসে আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল অরু। ভাগ্যিস ওদের বাড়ির গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা লম্বা বেনেবাড়িটা, যার লম্বা ছায়াতে ওদের ছাদ এখন রোদ থেকে গা বাঁচাচ্ছে! একটা নিরাপদ দূরত্ব আর ছায়া থেকে সারাপাড়ার চেহারা দেখে দেখে লম্বা দুপুর কেটে যায় অরুর। মিসেস স্মিথ, মিসেস হোয়াইট ও মিসেস সালদানা-র কেক-প্যাটিজের পেল্লায় বাক্স নিয়ে ফেরিওয়ালা হাঁক দিলে ডরোথি গোটা একটা থালা হাতে বেরিয়ে আসে, কখনো-সখনো সঙ্গে সুকও। তখন ছাদ থেকে অরু হাঁক তোলে—আমিও আছি, ডর।
কেক-প্যাটিজ তো বটেই, ছাদে দাঁড়ানোর বড়ো টান ডরোথির নিজেরও। ওকে দেখেও চোখের আশ মেটে না। চন্দন বলছিল সেদিন, এ তেষ্টাটা তোর চোখের নয়, মনের। সেটা বুঝিস তুই?
সুকের ট্যাক্সি মৌলালির বাঁকে উধাও হতেই খালি পায়ে দুদ্দাড় করে রাস্তা অবধি ছুটে এল ডরোথি। একবার এধার, একবার ওধার চোখ চালিয়ে দেখল সব শুনশান। একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেলল বুঝি নীচের দিকে তাকিয়ে। তারপর সিমেন্টের থামটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল স্কুলের বাচ্চা মেয়েদের মতো।
বাচ্চা মেয়েদের মতোই একটা সূর্যমুখী হলুদ হাতকাটা গেঞ্জি ওর পরনে। স্কার্টের জায়গায় ছোট্ট নীল হাফপ্যান্ট। যে পোশাকে ওকে দেখলে পাড়ার বয়স্করা একটাই শব্দ উচ্চারণ করেন,
–অসভ্য!
তার ওপর খালি পা।
চাপা রঙের সুন্দরীটির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে দাঁড়িয়েছিল অরু। ওর মনে হল চন্দন কথাটা মিথ্যে বলেনি—ডরোথিকে দেখার তেষ্টাটা ওর চোখের নয়।
ঠিক তক্ষুনি চোখের জল মুছল ডরোথি।
ধড়াস করে উঠেছিল অরুর বুক, ডরোথি কাঁদছে?
কী এক নিশির টানে ছাদ থেকে নেমে গুটি গুটি বাড়ির গেট পেরিয়ে ওপারের বাড়ির থামে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ডরোথির পাশে গিয়ে দাঁড়াল অরু। কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ডর?
হাত দিয়ে চোখ চাপা ছিল ডরোথির। সে হাত না সরিয়েই বলল, টোনি আমায় ছেড়ে চলে গেল।
ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য খুব বিজ্ঞের মতো বলেছিল অরু, সে তো কতবারই তোমায় ছেড়ে গেল আর ফিরে এল। এ নিয়ে ভাবছ কেন? আজ তো শনিবার, দেখো, সামনের শনিবারে ফিরে এল বলে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ থেকে হাত নামিয়ে ডরোথি বলল, মনে হয় না। এবার একটা ভয়ে দুরু দুরু কাঁপতে লাগল অরুর বুক আর ঠোঁট, কে.কে…কেন?
তখন হঠাৎ একটা বিকট কান্নায় ভেঙে পড়ে ডরোথি বাড়ির ভেতরে ছুটল মুখে শুধু একটাই কথা—আমি জানি না! আমি কিছু জানি না!
কীরকম বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে অরু, একবার ভাবল ভেতরে গিয়ে দুটো-একটা সান্ত্বনার কথা বলে ডরোথিকে, পরক্ষণেই মনে পড়ল কাকে নিয়ে যেন বেদম ঝামেলা সুক-ডরোথির মধ্যে হপ্তা দুয়েক আগে। অরু আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এল।
আজও ডরোথির পাড়া বেয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো সুকের সেই চলে যাওয়াটা ভর করে আছে অরুণের মনে। ওর মনে পড়ল বার বার চেষ্টা করেও ওদের শেষ ঝগড়া নিয়ে মুখ খোলাতে পারেনি ডরোথির।
যখনই অরুণ জিজ্ঞেস করেছে, হোয়াট রিয়েলি হ্যাপেনড, ডর? ডরোথি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছে, না, না, তুমি বড্ড বাচ্চা। তুমি কিসসু বুঝবে না।
শেষে ক্লাস নাইনে উঠে হোস্টেলে ভরতি হয়ে পড়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে যেদিন, ডরোথি এল এক বাক্স চকোলেট নিয়ে। মা-র সামনে অরুণের হাতে চকোলেট তুলে দিয়ে বলল, তাহলে, অরু, তুমি সত্যিই বড়ো হয়ে গেলে?
অরুণ মিষ্টি করে বলেছিল, বলছ?
বড়ো বড়ো চোখ করে ডরোথি বলল, ইয়েস! অফ কোর্স!
তারপর ডরোথিকে বাড়ির গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, তাহলে টোনির চলে যাওয়া নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারি?
একটু থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ডরোথি, কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ানো অরুণকে দেখেনি। সামনে, ওপারে নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে চোখ রেখে বলেছিল, আরও কিছুদিন অপেক্ষা করলে ভালো করতে, অরু। আই রিয়েলি মিন ইট।
অরুণ আর কথা বাড়ায়নি। কিছুটা অভিমানে, কিছুটা হতাশায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বাড়ির গেটে। ডরোথি টরটর করে হিলতোলা জুতোর আওয়াজ তুলে ওপারের বাড়িতে চলে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা ঠেলে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে দেখল অরুকে, কিন্তু বাই! বাই!’ বলার মতো করে অরুর ডান হাতটা উঠল না।
ওর মনের চোখে ততক্ষণে ভাসছে আঁতোয়ান সুকের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভরদুপুরের দৃশ্যটা।
অরুণ বলল, আমি তো আজ সত্যিই বড়ো হয়ে গেছি, ডরোথি। আজ আমি সত্যিই তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি, টোনি চলে গেল কেন?
ডরোথি রেডিয়োগ্রামের পাশে রাখা একটা পুরোনো রুপোর কেস থেকে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে ধরল, আর কেসটা এগিয়ে দিল অরুণের দিকে। অরুণ একটা স্টিক বার করে ঠোঁটে তোলার আগে সিগারেটের ব্র্যাণ্ডটা দেখল। ও নামটা পড়ছে দেখে ডরোথির বেশ হাসি পেল, বলল—নিশ্চয়ই ভাবছ এই ভিখিরির দশায় আমি ‘সিনিয়র সার্ভিস অ্যাফোর্ড করছি কী করে? সত্যিই পারি না, তা ছাড়া ওই ব্র্যাণ্ডটা এখানে আসে না।
সিগারেটটা ধরিয়ে বসতে বসতে অরু বলল, কিন্তু এসেছে তো দেখছি। আর বলার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল একটা বিশ্রী রকম কঠিন কথা বলা হয়ে গিয়েছে। কথাটা ঘোরাবার কথা ভাবছে যখন অন্য কিছু বলে ডরোথি এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হল ল্যাম্পের পাশের মোড়াটায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, আমার শরীরের আর তেমন কিছু পড়ে নেই ঠিকই, কিন্তু কিছু অ্যাডমায়ারার্স তবু পড়ে আছে দেখি। ওদেরই একজন ডিকি। তুমি তো চিনতে ডিকিকে, তাই না?
অরুণ মাথা নাড়ল।-মিন্টো লেনের ডিকি? জাহাজের পার্সার?
ডরোথি বলল, এগজ্যাক্টলি! টোনি চলে যাওয়ার পর এতদিন ওরাই তো আমাকে সামলেছে। ও ট্রিপ করে ফিরলে আমার কিছুদিনের জন্য চারমিনারের হাত থেকে নিস্তার। তারপর কয়েক হপ্তা গেলে ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।
হঠাৎ কীরকম চিনচিন করে উঠল বুকটা অরুণের। বলল, তোমায় সামলেছে মানে? ওদের কী স্বার্থ?
যেটা সব পুরুষের! একটু খিলখিল করে হেসে নির্লজ্জের মতো বলল ডরোথি।
তার মানে…? প্রশ্নটা আটকে রইল গলার মধ্যে অরুণের।
ঠিক। ঠিকই। গত চব্বিশটা বছর তো আমি শুধু টোনির জন্য বৃথা অপেক্ষাই করিনি। কিছু বৃথা বেশ্যাবৃত্তিও করেছি। করিনি কি?
‘বৃথা বেশ্যাবৃত্তি’! টং করে কথাটা বাজল মগজে অরুণের। সামান্য নাক সিটকে বলল, বেশ্যাবৃত্তি…তাও বৃথা…?
ডরোথি ফের একটা লম্বা ধোঁয়া ছাড়ল।–বৃথা তো বটেই। আশপাশের অবস্থা দেখছ না? পয়সার জন্য পুরুষ ধরলে এই হাল হয়? টাইপিস্টের চাকরিটাও ছাড়লাম মাত্র দু-বছর আগে।
তাহলে পুরুষ নিতে কেন?কেমন এক অভিমানের সুরে জানতে চাইল অরুণ।
এবার একটা রিং হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে ডরোথি বলল, কে জানে, হয়তো টোনিরই একটা কথাকে সত্যি করতে।
কী কথা? —অরুণ জিজ্ঞেস না করে পারল না। হা হা হি হি করে হেসে কুটোপুটি যাচ্ছে তখন ডরোথি। স্কুলের বালিকার মতো প্রায় ওর এই অদ্ভুত হাসি থামানোর জন্যই অরুণকে ফের জিজ্ঞেস করতে হল—এত হাসির কী হল? বলোই না কথাটা।
এত হাসির পর ধোঁয়া টানা ঠিক হবে না ভেবে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে টিপে নিভিয়ে দিল ডরোথি। কিছুটা মেজাজ তৈরির জন্যই দামি বিলিতি সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল অরুণ। আমেজে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল ওর, শুনল ডরোথি বলছে—তুমি খুব ছোটো ছিলে ঠিকই, তবু তোমায় একবার বলেছিলাম না? অরুণ জানতে চাইল কী কথা?
—যে, টোনি বেহদ্দ পাগল আমার এই শরীরটার জন্যে।
–হু। মনে আছে।
—ভালোবাসা দেখানোর সময় মাঝে মাঝেই বলত টোনি, তোমার এই অপূর্ব শরীর শুধু একটা লোকের ভোগে থাকা ঠিক নয়। তোমার বেশ্যা হওয়া উচিত!
ডরোথি কথাটা শেষ করতেই ও আর অরুণ হো হো হি হি করে দমফাটা হাসিতে ভেঙে পড়ল। হাসির তোড় সামলাতে সামলাতে অরুণ কোনোমতে জিজ্ঞাসা করল, তা তুমি কী বলতে? ডরোথি ফের একটা সিগারেট ধরাবার উদ্যোগ করল; বলল—বলতাম ওহ, দ্যাটস ওয়াণ্ডারফুল! কাল থেকেই শুরু করি? তাতে টোনি বলত, কাল কেন? আজ থেকেই হতে পারে। যখন বলতাম আজ বললে একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। হঠাৎ করে কাকে ধরব এখন? তখন টোনির জবাব আসত, কেন, এই আমাকে দিয়ে! তোমার ফাস্ট কাস্টমার।
এতগুলো কথা বলে চুপ করে গিয়েছিল ডরোথি। হল ল্যাম্পের নিবু নিবু আলোয় এত রোমান্টিক একটা সংলাপ এমনভাবে থমকে যেতে অরুণের কৌতূহল যেন আরও তীব্র হল। ও জানতে চাইল, তাতে তুমি কী উত্তর দিতে ডর?
ডরোথি ওর সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলেছিল। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ওর ওই ফাস্ট কাস্টমার কথাটা আমার ভালো লাগত। তাই প্রতিবার আমি শেষ করতাম আর আমার শেষ খদ্দের! বলে।
কথাটা বলার সময় শূন্যে এক অদৃশ্য আঁতোয়ান সুককে জড়িয়ে ধরার ভান করল ডরোথি। অরুণের মনে হল কোনো বাস্তব দৃশ্য নয়, সিনেমারই যেন এক নাটকীয় দৃশ্য দেখছে ও।
ঠিক তখন একটা ট্রে-তে করে এক পাঁইট রাম, দুটো গেলাস আর এক বোতল সোডা এনে রাখল সেন্টার টেবিলে এক তরুণী কাজের মেয়ে। কত বয়স হবে মেয়েটার? — ছাব্বিশ-আটাশ? তা যখন দরজায় এত এত নক করল অরুণ সাড়া দিতে পারল না?
ভেতরে ভেতরে একটু বিরক্তিই হচ্ছিল অরুণের, যখন ডরোথি বলল, ও বিন্দিয়া, ও-ই আমার সব দেখাশোনা করে…
অরুণ রাগটা আর চাপতে পারল না—দেখাটা করে হয়তো, কিন্তু শোনাটা? আজ অতবার নক করে…
ওর কথার মধ্যে ডরোথি বলল, ও বোবা-কালা। ওর বর ওকে বিহার থেকে এনে ফেলে যাচ্ছিল রিপন স্ট্রিটের ব্রথেলে।
হঠাৎ ভয়ানক লজ্জিত বোধ করে আমরা আমতা করে অরুণ বলল, ত-ত-তো?
—ওর প্রথম খদ্দের জুটেছিল ডিকি। যে ওর কান্নাকাটি শুনে প্রথম রাতে ওকে তুলে এনে আমার এখানে ফেলে।
ওকে নিয়েই যে আলাপ চলছে তা বিন্দিয়ার বোঝার কথা নয়, ও দিব্যি একমনে মেমসাহেব আর সাহেবের ড্রিঙ্ক বানিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অরুণের অস্বস্তি কাটেনি, ও বিন্দিয়া প্রসঙ্গ থেকে কথা ঘোরাতে বলল, কিন্তু ডর, তুমি আজও এখনও বলোনি কেন টোনি চলে গেল।
এরপর এক অদ্ভুত নীরবতা ভর করল ঘরটাকে। সেই নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে একটু-আধটু ভাঙল গেলাস, বোতলের ঠোকাঠুকিতে যখন নতুন করে ড্রিঙ্ক সাজাল ডরোথি। এর মধ্যে বিন্দিয়া দু-প্লেট কাবাবও রেখে গেছে টেবিলে। সম্ভবত তৃতীয় পেগের শেষে কি চতুর্থ পেগের গোড়ায় ডরোথি জিজ্ঞেস করল, সেই যে তোমরা চলে গেলে তারপর আর শমির সঙ্গে দেখা হয়নি। কোথায় আছে ও? কেমন আছে?
শমি মানে শর্মিলা। অরুণের দিদি। খুব বন্ধু ছিল ডরোথির।
অরুণ বলল, ভালো আছে। জামশেদপুরে আছে। কর্তার চাকরি টাটায়।
—ও। ছেলেপুলে ক-টি?
—দুটি ছেলে। বড়োজন সবে ডাক্তারি পড়া শুরু করেছে, ছোটোজন সিনিয়র কেমব্রিজ দেবে বলে তৈরি হচ্ছে। ওরা পিঠোপিঠি।
—শমি সুখী তাহলে?
অরুণ এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে সোফাতে শরীরটা ভালোরকম এগিয়ে দিল। বলল, সুখ মাপার কি থার্মোমিটার আছে, ডর? যে জিভের তলায় কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রেখে বলে দেব কে কতটা সুখী কি অসুখী। তবে বাইরে থেকে দেখে যেটুকু যা বুঝি…ওয়েল শি সিমজ টু বি হ্যাপি।
ডরোথি ওর ড্রিঙ্কে একটা চুমুক দিয়ে বলল, গড ব্লেস! এটা শুনে বড্ড ভালো লাগল। ওর মতো মেয়ের জীবনে সুখী হওয়া উচিত। টোনির মতো পাগলের পাল্লায় পড়ে উচ্ছন্নে যাওয়া উচিত না।
একটা ফোর-ফর্টি ভোল্টের শক লাগল যেন অরুণের পায়ের পাতায়। ও তড়াক করে সোফায় সোজা হয়ে বসে আর্তনাদের সুরে বলল, হোয়-ট! হোেয়ট ডু ইউ মিন, ডর! দে ওয়্যার ইনভলভড? ওরা…ওরা জড়িয়ে পড়েছিল?
ডরোথি ফের সিগারেটে একটা টান দিতে দিতে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। আরেকটু পর মুখে বলল, হ্যাঁ! ওই অবধি আমি সব সহ্য করেছি টোনির পাগলামি। কিন্তু শমির প্রেমপত্রগুলো যেদিন আবিষ্কার করলাম ওর অফিস ব্যাগে আর দুপুরবেলার ওই দৃশ্য চোখে পড়ল…না, না, ওই দৃশ্য আমি বর্ণনাও করব না… আমি মাছ কাটার বঁটি দেখিয়ে টোনিকে বলেছিলাম ঢের হয়েছে। এই মেয়েটার যদি কোনো ক্ষতি হতে দেখি তাহলে এই বঁটির কোপ পড়বে তোমার গলায়। তুমি দেখে নিয়ো। অরুণ আকাশ থেকে পড়েছে যেন। বলল, এসব ঘটল কখন? আমি তো বোজই আসতাম, আমারও চোখের আড়ালে?
ডরোথি বলল, আমি সব সময়েই একটা কথায় বিশ্বাস করেছি—সম্পর্ক, অ্যাফেয়ার, মাখামাখি, বদমায়েসি…এসব চোখে পড়ে। সত্যিকারের প্রেম, সত্যিকারের ভালোবাসা অদৃশ্য! ইনভিজিবল!
অরুণ জিজ্ঞেস করল, তার মানে…?
ডরোথি ঘাড় নাড়ল, টোনি সত্যিই শমির প্রেমে পড়েছিল, হয়তো জীবনে ওই প্রথম বার। আমি বুঝতে পারছিলাম। অতগুলো বছর ধরে ওকে দেখেছিলাম তো। যা খুশি করে বসতে পারত ও। হয়তো শমিকে নিয়ে পালিয়েই যেত। আমি চাইনি তোমার দিদিটার অত বড়ো ক্ষতি হয়ে যাক। যেকোনো মূল্যেই সেটা রদ করতে চেয়েছিলাম। বলতে পারো নিজের জীবন ও সুখের মূল্যেই।
অরুণের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি, জিজ্ঞেস করল, কেন, তোমাকে ভালবাসেনি টোনি?
–কে জানে! ভালো হয়তো বেসেছে। নিজের একান্ত নারীদের যেমন ভালোবেসে থাকে পুরুষরা। সেক্স, প্যাশন কিছুরই অভাব ছিল না। তবে কীরকম যেন শরীর-শরীর, সারাক্ষণ…
—আর শমির ক্ষেত্রে?
—ওহ! ও তো শমিকে পুজো করত। শমির চিঠিগুলো পড়ে বুঝেছিলাম ওর সেটা খুব ভালো লেগেছিল। মেয়েটাও একটু একটু পাগল হচ্ছিল।
হঠাৎ অরুণের মনে পড়ল ওর হোস্টেলে চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে শমি সন্ধ্যে নামলে ছাদে একা একা ঘুরত। একদিন কী করছিস এখানে? জিজ্ঞেস করায় অরুণকে মুখ ঝামটা দিয়েছিল, তোর কী দরকার! যা, নীচে যা! সেই সন্ধ্যের সঙ্গে কোথায় যেন একটা সম্পর্ক আঁতোয়ান সুকের শিস দিতে দিতে রাতে বাড়ি ফেরা, প্রভূত রাম গিলে চিৎকার করে গান, তারপর একসময় ডরোথির সঙ্গে গালিগালাজ, মারপিট…
অরুণ কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ডরোথি, থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং। আজ আমি টোনির ডায়েরিগুলো নিয়ে যাব। আমায় সত্যিই পড়তে হবে সব কিছু। তারপর ভাবব কী করা যায়।
ঠোঁটের সিগারেট হাতে নিয়ে অ্যাশট্রেতে টিপে নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল ডরোথিও। দু-হাতে অরুণের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, পড়া শেষ হলে ফের এসো। বোলো কেমন লাগল। পারলে একটা গল্প লিখো টোনিকে নিয়ে। ইট মাস্ট হ্যাভ আ বিউটিফুল এণ্ডিং। খুব সুন্দর শেষ হতে হবে সে-গল্পের। তা সে যতই কষ্টের হোক।
কী মনে করে অরুণ বলল, গল্পই তো নিজে ঠিক করে শেষে কী হবে, তা কি আগে থেকে বলা যায়?
ডরোথি খুব বিষণ্ণ একটা হাসি মাখিয়ে রাখল মুখে, দরজা অবধি এগিয়ে দিল অরুণকে। দরজার ওপারে গিয়ে অরুণ কিছুটা যখন ঘুরে দাঁড়াল ‘বাই! বাই!’ বলবে বলে তখন কিছুটা আপনমনে ডরোথি বলল, গল্পের নায়িকাও জানবে না শেষ কোথায়?
উত্তরে অরুণ শুধু বলল ‘না’, তারপর বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
২.
সাত সাতটা দিন পড়ার টেবিলের সামনের বুক-র্যাকে দিব্যি শোভা পাচ্ছে আঁতোয়ান সুকের ডায়েরিগুলো। অরুণ বোজ একবার মনে করে প্রথম খন্ডটা নামিয়ে পড়া শুরু করে। আর তা মনে হলেই কতকগুলো অদ্ভুত স্মৃতি ধেয়ে এসে অচিরে মনটাকে এলোমেলো করে দেয়। ওর মনে পড়ে টকটকে লাল রঙের ডায়েরিগুলো কীরকম উন্মনা হয়ে বাড়ির গেটের ধাপিতে বসে বিড়বিড় করে পড়ত সুক। এক-আধবার অরুণকে দুটো-একটা শব্দের বানানও জিজ্ঞেস করেছে। শুনে কান থেকে কলম নামিয়ে বানানটা শুধরেও নিয়েছে। তারপর ফের ডুবে গেছে। নিজের লেখা ডায়েরি পড়ায়।
একবার চটে তিরিক্ষি অরুণের ওপর, কারণ ও বলেছে মেয়েদের শাড়িতে লাগানো হয় যে ব্রোচ তার বানান broach নয়, brooch। বলতে লাগল, কী পাগলের মতো বকবক করছ? তুমি বলতে চাও তোমাদের পারসি টিউটোরেস ডিনা মিস শাড়িতে যেটা লাগায় তার বানান brooch? নট broach? অরুণ হাতের মার্বেল গুনছিল, চোখ না তুলেই বলেছিল, এগজ্যাক্টলি! তখন ‘ধুত্তোর!’ বলে খাতাপত্তর গুটিয়ে বাড়ির ভেতরে হাঁটা লাগিয়েছিল সুক।
আরেক বার কীসব লিখছিল সুক একটা বেতের চেয়ারে বসে। চেয়ারটা গেটের ওই ধাপিটার পাশে রাখা। বিশেষ কোনো কৌতূহল থেকে নয়, এমনি এমনিই অরুণের চোখ চলে গিয়েছিল ওর ডায়েরির পাতায়, যেখানে আপনমনে কীসব লিখে চলেছিল সুক। অরুণের দৃষ্টি যে সেখানে লেপটে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য তার কারণ একটা শব্দ—Prostitute. নিতান্ত বালক, কিন্তু এই শব্দটা ওকে চিন্তায় ফেলার পক্ষে মোক্ষমই। অরুণ চোখে একটু কম দেখে। যদিও চশমা নিতে হয়নি। ও দূর থেকে কিছু পড়ার চেষ্টা করলে ভুরু কুঁচকে যায়। আড়চোখে সেটাই হয়তো দেখেছিল সুক, তাই ধমকে বলেছিল, চোখ ঘোরাও, দিস ইজ অ্যাডাল্ট স্টাফ।
কিন্তু ততক্ষণে যা পড়ার পড়া হয়ে গেছে অরুণের। আর ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা বাতাস বওয়া শুরু হয়েছে। সুক লিখেছে :
একদিন এক বেশ্যাকে সঙ্গে করে বাড়ি আনল বাবা, আর মার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছেন আমার স্ত্রী। সুন্দরী বেশ্যা বেশ অবাকই হয়ে প্রশ্ন করল, ওহ, তাই বুঝি! তোমার বউও আছে! তখন সাত বছরের আমার দিকে দেখিয়ে বাবা বলল, সঙ্গে একটি পুত্র। আমার প্রিয়তম আঁতোয়ান।
সুকের ধমকে একটু চমকেছিল অরুণ। তবে ঘাবড়ে যায়নি, কারণ ডায়েরির ওই শব্দটা ওকে এত ভাবিয়েছিল যে, তার একটা নিষ্পত্তির প্রয়োজন বোধ করছিল। ও হাতের গুলিগুলো পকেটে পুরে ফেলে বেশ স্পষ্ট করে জানতে চাইল, টোনি, তুমি সাত বছর বয়সেই জানতে পারছিলে যে বাবা যে-মেয়েটিকে তুলে এনেছে সে বেশ্যা? Prostitute শব্দটা তো আমি এই ক-দিন আগে জেনেছি। আর কে যে প্রস্টিটিউট তা কী করে জানব? জানা যায় কি?
সুক প্রথমে একটা গম্ভীর শব্দ করেছিল ‘হুম’! কিছুক্ষণ নীরব থেকে পরে বলেছিল, না, জানতাম না। প্রস্টিটিউট শব্দটার মানে জানতাম না। রাতে আমায় ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মা-ই বলেছিল। বিছানায় ভারী কম্বলের তলায় শীতে নয়, রাগে কাঁপছিল মা। কাঁদছিলও। বলেছিল, অনেক সহ্য করেছি আঁতোয়ান, তোর জন্য, শুধু তোর জন্য। আর পারছি না রে। যে-ছুঁড়িটাকে তোর বাপ তুলে এনেছে আজ, তুই জানিস ওটা কী? আ প্রস্টিটিউট! আ ব্লাডি হোর! যার মানে…
মাকে আর কষ্ট করে মানে বোঝাতে হয়নি। ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে তুলে আনা মেয়েটার হইহই, চিৎকার, গান আর কত সব অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে শুরু করেছে। এরকম মেয়ে আসা আর এরকম শব্দটব্দ আমার কাছে নতুন নয়, কিন্তু সেই প্রথম আমি এদের মেলাতে শুরু করলাম মার কান্না আর প্রস্টিটিউট শব্দটার সঙ্গে। আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় মা নিজেই একসময় ঘুমে তলিয়ে গেল, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।
সুকের এই স্মৃতিটা মন থেকে মিলিয়ে যেতেই অরুণের মনে পড়ল ডরোথির মুখে শোনা একটা কথাও। সেই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সে শোনা কথাটা আজও ভুলতে পারেনি অরুণ। পিজবোর্ড কেটে কেটে গঁদের আঠা দিয়ে এঁটে এঁটে বেশ একটা খেলনা এরোপ্লেন বানিয়ে ফেলেছিল সুক। তারপর তাতে রঙিন রঙিন কাগজ সেঁটে দিব্যি বাহারি করা হল সেটাকে। ছোট্ট ছোট্ট টিনের পাত দিয়ে প্লেনের নাকের ডগায় প্রপেলার বসানো হল। মোটা কলমে গা জুড়ে লেখা হল ‘টাইগার মথ। শেষে খেলার মার্বেল দিয়ে বানানো হলো তিন পিস চাকা। তখন খুব চেষ্টা চলল প্লেনটাকে মেঝেতে দৌড় করানোর।
বারে দশেকের চেষ্টাতেও প্লেন ছাড়ল না। ডরোথিদের বাড়ির সামনেকার ওই উঠোনটায় গোটা সকালই কাটছিল এইভাবে, হঠাৎ ডরোথির উদয়। বরের থেকে একটা সিগারেট চাইতে এসে ওই দৃশ্য দেখে বলে উঠল, সেই অচল প্লেন! এবার কার সর্বনাশ করবে?
কথাটা খুব মনে ধরেছিল অরুণের। সেদিন সন্ধেয় সুক রাম কিনতে বেরোতেই সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে জিজ্ঞেস করল ডরোথিকে, ডর, সকালে কী একটা বললে যেন অচল প্লেন নিয়ে? এনিথিং ইনটারেস্টিং?
ওহ ইয়েস! ওহ ইয়েস, অফকোর্স! বলে খুব একপ্রস্থ হেসে নিল ডরোথি। তারপর যোগ করল, ওরকম একটা অ্যাবানডানড প্লেনে আমায় প্রথম কিস করে এই রাস্কেলটা!
সুককে নিয়ে খুব সোহাগ করে কথা বললে ওকে রাস্কেল বলে উল্লেখ করে ডরোথি। তাই জিজ্ঞেস করল অরুণ, প্রথম চুমুটা খুব খারাপ লাগেনি নিশ্চয়ই? ডরোথি তখন ওর ওই পেটেন্ট হাহা হিহি হাসিটা হেসে বলেছিল, টোনির ওই ডায়েরিতে কোথাও লেখা আছে। আমি পড়েছি। পারলে পোড়ো কখনো, তবে বড় হয়ে। টোনির সবকিছুই তো খুব অ্যাডাল্ট ব্যাপার,?
আজ মনে হয় ওই অ্যাডাল্ট ব্যাপার দিয়েই শুরু করা যায়—এই ভেবে অরুণ সামনের তাক থেকে রেক্সিনে বাঁধানো পাঁচটা লাল ডায়েরির প্রথম খন্ডটা তুলে নিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসল। কত কী যে পাগলটা লিখে গেছে এন্তার, রোমাঞ্চের শেষ নেই, কিন্তু কোথায় ডরোথি, তার নামগন্ধই কোথাও নেই! এর মধ্যে মায়ের পাশে শুয়ে সেই প্রস্টিটিউট কথাটা শোনাও এসে পড়ল, কিন্তু সেটা পরে পড়বে বলে পাতা উলটে গেল অরুণ। আর ওলটাতে ওলটাতে খেয়াল হল যে, ওর হাতে ধরা ডায়েরির খন্ডটায় সুক কলকাতাতেই এসে পৌঁছায়নি। গোয়া আর বম্বে করতে করতেই শেষ হয়ে গেছে।
অরুণ উঠে প্রথমটা জায়গামতন রেখে দ্বিতীয় খন্ডটা খুলতেই পুলকিত বিস্ময়ে অবশ হয়ে গেল। ডায়েরিটা শুরু হচ্ছে এভাবে—’ডরোথিকে পাচ্ছি, আমার জীবন শুরু হচ্ছে!’ অরুণ পড়তে শুরু করে দেখল এক অদ্ভুত রস, ছেনালি আর সরলতা মিশিয়ে সুক লিখে গেছে ডর বৃত্তান্তগুলো, যার কোথাও কোথাও কিছুটা স্বীকারোক্তির গন্ধও মিশে আছে। ডরোথিকে পাওয়ার প্রসঙ্গে যেমন লিখছে
আমি বাপু পোড় খাওয়া পার্টি, কোন মেয়ে উঠবে আর কোন মেয়ে বহুত হ্যাপা দেবে দিব্যি বুঝি। কলকাতায় এসেছি এই ছ-মাস, তার মধ্যে তিন তিনটে চিড়িয়া গেঁথেছি। ইভা, ট্রেসি, লাভলি। লাভলি খ্রিশ্চান নয়, কিন্তু এরই মধ্যে পালিয়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য খেপেছে। কিন্তু আমার ভয় করছে ওদের কমিউনিটিকে, কোথাও কিছু ইধর-উধর হলে আমাকে পেঁদিয়ে লাশ করে দেবে। ইভা, ট্রেসিকে নিয়ে ভাবি না, দে আর ওনলি ফর দ্য গুড টাইমজ। আমারও তো গুড টাইমজ চাই, চার-পাঁচ পেগ রাম সেঁটে ট্যাক্সিতে চড়লেই তো আমার হাত দুটো কাজ শুরু করে দেয়। হাজার হোক, এয়ারক্রাফট মেন্টেন্যান্স মেকানিকের হাত তো। নাটবল্ট খুঁজতে বেশি সময় নেয় না; তার ওপর হাতের মধ্যে দুটো রক্তমাংসের বল এলে তার ফিলিং। ওহ ক্রাইস্ট, প্লেনের কোনো কলকবজাই তুলনায় আসতে পারে না। কিন্তু এখানেই একটা মস্ত বড়ো কিন্তু নেভিলদের ক্রিসমাস পার্টিতে আলাপের পর এগারো বার ডেট করা হল, কিন্তু একবারটিও মুখটা দুহাতে ধরে ঠোঁটে চুমু দেওয়া ঘটল না! হোয়াটস হ্যাপেনড টু ইউ, টোনি সুক? তোমার বম্বের সাঙ্গোপাঙ্গরা তো বিশ্বাস করবে না তুমি এগারো দিন ধরে ডেট করেও বিলকুল সুখা যাচ্ছ!
কাজেই সব মহৎ প্রেমের মতো এখানেও আমাকে একটা প্যাঁচ কষতে হয়েছে। আমি ফাঁদ পেতেছি ডরোথির জন্য। ওর খুব কৌতূহল প্লেন নিয়ে আমার কাজ কারবার বিষয়ে। সেদিন বেমালুম বানিয়ে বানিয়ে বললাম, আগামী ফোর্টিন্থ ফেব্রুয়ারি আমার জন্মদিন, সেদিন তোমায় একটা স্পেশ্যাল ট্রিট দিতে চাই।
ও আকাশ থেকে পড়ে চোখ দুটো আলুর মতো গোল করে বলল, তু-তুমি ভ্যা-ভ্যা ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে জন্মেছ! ভ্যালেন্টাইন ডে-টা যে কী, আমি কিছুই জানি না। একটা লিয়েন পাওনা ছিল, সেটা শুক্কুরবার দেখে ওই তারিখটায় নিয়েছিলাম। ডরোথি অমন করছে। দেখে জিজ্ঞেস করলাম, হোয়াটস সো গ্রেট অ্যাবাউট ভ্যালেন্টাইনজ ডে?
ডরোথি ফের অবাক হয়ে গেল—তুমি জানো না ওটা প্রেমিকদের দিন? তখন মোক্ষম চালটা চাললাম—তাতে আর কী লাভটা হল জীবনে? জন্মানোই সার হল, প্রেম কোথায়? ডরোথি তখন সেই অপূর্ব রূপোলি হাসিটা হেসে বলল, লায়ার! ড্যাম লায়ার! মিথুক কোথাকার। তখনই বুঝলাম আমার ফাঁদ পাতা কাজে এসেছে।
বাপরে! বলে একটা কাচের পেপারওয়েটে পাতাটা চাপা দিয়ে একটা সিগারেট ধরাতে উঠল অরুণ। লেখার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার সুকের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে ও। বানানের ছিরি, গ্রামারের গড়বড় আর সিন্ট্যাক্সের রকমসকম ভেদ করে অদ্ভুত একটা স্বাদ উতরে আসছে। কাহিনি শোনানোর কিছুটা চপল, কিছুটা উন্মাদ একটা পদ্ধতিও আছে লোকটার। সুকের জীবনের যতখানি যা চাক্ষুষ করেছিল অরুণ ও তার সঙ্গে মিলিয়ে পড়া শুরু করল ফের। ডায়েরির উত্তম পুরুষেরা কখন যেন কোথায় হারিয়ে গেল, যেভাবে হয়তো সুককে নিয়ে ওর উপন্যাসে লেখা যাবে সেভাবেই ডায়েরির মধ্যে কাহিনির খোঁজে ঢুকে পড়ল অরুণ। আস্তে আস্তে সেই ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে আঁতোয়ান সুক ও ডরোথি রবার্টের প্রথম মিলনের বৃত্তান্তে কুঁদ হয়ে গেল ও।
ডরোথির মনে ধরা ছিল একটা উড়োজাহাজ, আর সুকের মাথায় ভর করেছিল একটা অন্যরকম ওড়া। ট্যাক্সি থেকে শীতের সকালে অ্যারোড্রামে নেমে প্রথম যে কথাটা সুক ডরোথিকে বলেছিল তা হল—আজ তুমি উড়বে।
ডরোথি জিজ্ঞেস করেছিল, কী রকম? বিনা টিকিটে? বিনা প্লেনে?
সুক শুধু দুষ্টু হাসি হেসেছিল, চুপচাপ।
সুক মেন্টেন্যান্স মেকানিক ছিল দারভাঙা এয়ারলাইনের। প্রথমে সেই হ্যাঙ্গারে নিয়ে তুলল ডরোথিকে। দুটো ড্যাকোটা বিমানের মেরামতি, অয়লিং, ঝাড়পোঁছ হচ্ছে সেখানে। একটা ছোট্ট বাও করে সুক বলল, ডার্লিং, এই হল আমার অফিস। আর এরা আমার কলিগ।
বলতে বলতে দুটি যুবা প্লেনের ডানা থেকে নেমে ডরোথিকে বলল, হ্যালো ডরোথি!
ডরোথি, বলা বাহুল্য, বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল। আমার নাম পর্যন্ত জেনে গেছে এরা। গড নোজ আরও কত কী শুনেছে বন্ধুর কাছে।
বেশ চমকেছিল দুই সঙ্গী ড্যানিয়েল এবং আসরানিও। বাপরে, কী চিড়িয়া পাকড়াও করল টোনি! এ তো বিলকুল রুপোলি পর্দা থেকে নেমে আসা এভা গার্ডনার! শুধু গায়ের রংটা চাপা। তাতে চেহারার নখরা আরও বেড়েছে। আর… আর কী চাউনি, মাই গড! ওরা হাঁ করে গিলছিল ডরোথিকে।
শেষে সুক বলল, শালা, কী গিলছিস ওভাবে? একটু আমার দিকেও চা। আফটার অল শি ইজ মাই বার্ড!
এই বার্ড কথাটার প্রতিবাদ করল ডরোথি। বলল, আমি পাখি নই, আই অ্যাম আ…
ওকে কথা শেষ করতে দিল না সুক। ওকে, ওকে, তুমি পাখি নও, তুমি এরোপ্লেন। আমরা এখানে প্লেনকেও বার্ড বলি। নাউ লেটস গো, আমাদের নিজস্ব প্লেনে।
কিন্তু কোথায় সে প্লেন? একটার পর একটা হ্যাঙ্গার পেরিয়ে কোথায় কোন দুনিয়ার প্রান্তে একটা প্লেন দেখিয়ে সুক বলল, ওই আমাদের পাখি।
ডরোথি দেখল চাকায় ঘাস গজিয়ে যাওয়া এক কোন জমানার অ্যাবানডাণ্ড ড্যাকোটা সবুজ খেতের মধ্যে বসে আপনমনে শীতের রোদ পোহাচ্ছে। বলল, এর আর দেখার কী আছে টোনি?
মুচকি হেসে সুক বলল, শুধু খোলটা দেখলেই হবে? কেন, ভেতরটা? ডরোথি বলল, দেখতে চাই, কিন্তু ওর তো সিঁড়িও নেই। উঠব কী করে?
সুক মুখে কিছু বলল না, বেশ কিছুক্ষণ ডরোথির বলা নানা কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিল। শেষে প্লেনটার দরজার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, হ্যাঁ, এই তো সিঁড়ি। আমার দু-কাঁধে পা রাখো।
ডরোথি ওর পায়ের জুতো খুলে এক হাতে নিল, আর অন্য হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ। ও সুকের কাঁধে পা রাখতে সুক উঠে দাঁড়িয়ে ওকে প্রায় ছুঁড়ে দিল প্লেনের মধ্যে। ডরোথি একটা বিড়ালছানার মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্লেনের ফ্লোরে। আর আড়চোখে দেখতে পেল ওর বন্ধুটি প্লেনের ডানার ওপর ভল্ট খেয়ে কীসব করে, এটা-ওটা ধরে ঠিক হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর ওপর।
কোনো নারীর ওপর আছড়ে পড়ার এরকম আনন্দ কখনো পাইনি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম খোলা আগুনের ওপর এক পতঙ্গের মতো পড়েছি আমি। এর আগে একবারও যাকে চুম্বন করিনি তার ব্লাউজ, ব্রা ছত্রভঙ্গ করে তার বুক দুটো নিয়ে এরকম মেতে উঠলাম কেন? ওর বুকের বৃন্ত দুটো দেখামাত্র মনে হল যেন শৃঙ্গ জয় করেছি। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের ঠোঁটে চুমু দেওয়ার আগে তার বুক চুষতে শুরু করলাম। ব্যতিক্রম শুধু মা, যার বুকই চুষেছি, ঠোঁটে ঠোঁট মেলাইনি। তবে…তবে…তবে তাই বা কী করে বলি? আমি কি ভুলে গেলাম…যাক সে কথা, তা তো যথাস্থানে আছে। এখন আমি ডরোথি রবার্টের একটা বুকের বোঁটায় ঠোঁট রেখে অন্য বুকের বোঁটায় আঙুল দিয়ে খেলছি।
যে-ডরোথিকে অ্যাদ্দিন বড় সংরক্ষণশীল মনে হয়েছিল, যাকে বাগে আনতে এত প্যাঁচ পয়জার কষতে হল, তার দিক থেকে প্রথম মুহূর্তের কিছু ‘উঁহুউঁহু!’ শব্দ ছাড়া বিশেষ প্রতিরোধ না পেয়ে যেমন মজা পাচ্ছিলাম তেমনি একটু একটু অবাকও হচ্ছিলাম। অবাক হওয়া আর মজা পাওয়া মিলেমিশে একটা ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে ঠেকল যখন ডরোথি ওর অপরূপ খোলা বুক দুটো নিয়ে ঠেলে উঠে ঠিক এক সদ্য ডেক-অফ করা টাইগার মথের মতো প্রায় উড়ে এল আমার ওপর। দু-হাত প্লেনের দুই ডানার মতো দু-ধারে ছড়ানো, মুখে একটা ইঞ্জিনের আওয়াজের মতো ‘গোঁ-ও-ও-ও’ ধ্বনি। আর আমার ওপর ল্যাণ্ড করার পর দিব্যি ঘোষণা—দিস ইজ আ প্লেন ক্র্যাশ!
ছাইচাপা আগুন বলতে যা বোঝায় ডরোথি দেখলাম ঠিক তাই। এভাবে তো বর্ণনা করা যায় কারও মনকে, স্বভাবকে, হয়তো প্রতিবাকে। এ ছাড়াও এই বাগধারাটা খুব লাগসই ভাবে বর্ণনা করে ডরোথির শরীরটাকে। পোশাক-আশাক যে নারীর সৌন্দর্যের এতখানি ঢেকে রাখতে পারে তা ডরোথিকে ক্রমাগত বিবস্ত্র না করলে জানতে পারতাম না। ওর গায়ের চাপা রংটার মধ্যেও একটা মাদকতা আছে, কিছুটা গাঢ় রেড ওয়াইনের মতো। রংটার নিজেরই একটা লাবণ্য আছে, প্লেনের জানালা দিয়ে রোদ্দুর এসে সেই রংটাকেই এখন সোনালি আভায় মুড়ে দিচ্ছে। ওর দুই বলিষ্ঠ বুকে মুখ ডুবিয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছে হল। কিন্তু আমার ধারালো যন্ত্রটির কোনো ঘুম নেই, সে বাঘের মতো জেগে উঠে ডরোথির গোপন রহস্যভেদে ব্যস্ত হয়ে উঠল। আমার বাঘ কিংবা টাইগার মথ প্লেন কখন যে হ্যাঙ্গার খুঁজে নিয়েছে জানি না, কিন্তু প্লেনের ‘গোঁ-ও-ও-ও’ ধ্বনিটা ছড়াতে শুরু করেছে ডরোথির সামান্য খোলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে। ওর সারাশরীরের মতো সুন্দর মুখটাও ঘামে ভেসে যাচ্ছে। ওর চোখ দুটো আধবোজা, চুলগুলো মাটিতে ছড়ানো। একটু পর পর গোঙানির মতো আওয়াজ করে ও কিছু বলছে, কিন্তু আমি তার কিছুই বুঝতে পারছি না, আমারও ক্ষমতায় কুলোচ্ছে না ওকে জিজ্ঞেস করি, কেমন প্লেন দেখছ ডর?
ওই সকাল থেকেই সুক ডরোথি রবার্টসের ভ্যালেন্টাইন। অরুণ পাতা উলটে উলটে ক্রমশ একটাই জিনিসে এসে ধাক্কা খাচ্ছিল—এয়ারপোর্টের কাজ সেরে এয়ারলাইনের স্টাফ বাসে ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে এসে কখন একটা গাছতলায় এসে দাঁড়াচ্ছে সুক, আর ব্ল্যাকউড অ্যাণ্ড হজ-এর টাইপিস্ট ডরোথি কখন এসে পৌঁছচ্ছে এবং সেখান থেকে কোথায় কোথায় গিয়ে ওরা কী-কী পাগলামি করছে। এই সমস্ত পাগলামির শেষ হয় কখনো সুকের ওয়ান রুম ফ্ল্যাটে, কখনো ডরোথিদের বাড়ির প্রাচীন বিছানায়। এই বিছানায়—ডরোথির বক্তব্য
ওর বাবা ওর মায়ের কুমারীত্ব হরণ করেছিলেন। ডরোথি যখন পেটে এল ওঁরা চার্চে বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সারাপাড়া হামলে পড়েছিল গির্জায়, কিন্তু বর এমিল রবার্টস হাজির হননি। সেদিন সকালেই প্র্যাক্টিসের সময় তাঁর প্রিয় ঘোড়া ক্যাপ্টেন-কুক-এর স্যাডেল থেকে ছিটকে পড়ে কোমায় চলে যান। অবিবাহিত মা মরিন ওয়েলচ সিদ্ধান্ত নেন তাঁর মেয়ে মৃত পিতা এমিল রবার্টসের পদবিই বহন করবে।
অরুণের মনে পড়ল ডরোথি কথায় কথায় একদিন ওকে কী বলেছিল। বলেছিল, তুমি জান অরু, আমি জীবনে কোন জিনিস ভীষণ মিস করি? অরুণ যখন জিজ্ঞেস করেছিল, কী জিনিস, ডর? ও একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, বাবার সঙ্গে একটা ছবি। কিন্তু ঈশ্বর সেটা হয়তো চাননি। বাবার মুখ কখনো দেখলাম না। আর ওঁর স্মৃতি বলতে আমাদের ম্যান্টেলপিসে বাবার জকি-বেশে একটা হাসিখুশি ছবি। বাবা সেদিন ক্যালকাটা ডার্বি জিতেছিল অ্যাফ্রিকান কুইন-এ সওয়ার হয়ে।
সুকের ডায়েরি পড়তে পড়তে একটা জিনিস ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছিল অরুণের কাছে। তা হল নির্মম সত্যকে খুব সহজভাবে মেনে নেওয়ার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে সুকের, আর সেই নির্মম সত্যটাকে সরলভাবে লেখার। যেমন ডায়েরির দ্বিতীয় খন্ডেরই এক জায়গায় ও লিখছে :
আমি জানি ডরোথির মতো এত সংরক্ষণশীল মেয়েকে বিয়ে করার বিপদ আছে আমার। ও আর একশোটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েদের মতো নয়। অথচ আমিও বিয়ে করে আদ্যোপান্ত পালটে যাওয়ার ছেলে নই। মেয়ে ব্যাপারটার আমার রুচি আছে, মেয়েদের জয় করতে, চেখে দেখতে, বিছানায় ফেলে আমোদ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ডরোথি আমার বউ হলে আমি এসব ত্যাগ করব ভাবতেই পারি না। অথচ ডরোথিকে আমি চাই এবং বউ করেই। জানি এতে দু-দুটো জীবন নিয়ে খেলা করছি—ওর এবং আমার; কিন্তু আমি আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসি।
জায়গাটা পড়া হতে অরুণ একটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাত নেমেছে সারাশহর জুড়ে, দূরের অনেক বাড়িরই আলো নিভে গেছে, যেসব আলো নেভেনি তাদের কীরকম জোনাকির মতো ঠেকছে। আকাশ জুড়ে একটা গাঢ় নীল অন্ধকার, আর তার এক কোণে একটা ভাঙা চাঁদ। যেরকম চাঁদকে আঁতোয়ান সুকের ওপরতলার ভাড়াটে সিরিল বলত ‘অ্যাংলো মুন’। ওই ছেলেবেলাতেই কথাটা শুনে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিল অরুণ, এক সন্ধেয় সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সুককে, টোনি, অ্যাংলো চাঁদ বলে কি কিছু হয়?
কথাটা শোনামাত্র হো হো করে হেসে উঠেছিল সুক—নিশ্চয়ই সিরিলের কাছে শুনেছ কথাটা? রাইট? অরুণ মেনে নিয়েছিল—হ্যাঁ। তখন সুক বলল, এটা একটা মহৎ তত্ত্ব মহামান্য সিরিল ওয়াটসনের। অরুণ বলেছিল, তার মানে? আঁতোয়ান সুক একটা ফ্রেশ প্যাকেট ছিঁড়ে একটা ‘লাকি স্ট্রাইক’ ধরিয়ে বলেছিল, সিরিল বিশ্বাস করে এ পাড়ায় বাঙালি, পারসি, এমনকী বাঙালি খ্রিশ্চানদের থেকেও অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানরা সব কিছুতেই পুরোপুরি আলাদা। এতটাই আলাদা যে বাঙালিরা যে চাঁদ দেখে অ্যাংলোরা ঠিক সেই চাঁদ দেখে না। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের চাঁদও আলাদা—অন্তত সিরিল ওয়াটসন তাই বিশ্বাস করে। আর সেই চাঁদ হল অ্যাংলো চাঁদ।
এইসব ভাবতে ভাবতে অরুণ দূরের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে কী ভেবে নিজের মনে হাসল। ওর মনে পড়ল ছেলেবেলায় দেখা চাঁদ নয়, একটা অদ্ভুত সকালের কথা। যে সকালের একটা চরিত্র ডায়েরি লেখক আঁতোয়ান সুক।
৩.
একটা রবিবারের সকাল। বেশ চকচকে রোদের সকালও। রোদে কী একটা সোনালি আভা মিশেছে, যেমনটা মিশে থাকে শরতের আলোয়। তাহলে কি বর্ষা গিয়ে..? অতটা মনে পড়ে না অরুণের। শুধু মনে পড়ে পাড়ার ফটিক, সঞ্জীব, নীলু, ভুলু, ডোম্বল, ডম্বলরা দড়ির বারপোস্ট খাঁটিয়ে বল খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে। একটু আগে বেনেদের রোয়াকে বসে কেশবদা এক প্রস্ত গেয়ে গেছে মানবেন্দ্রর ‘বারে বারে কে যেন ডাকে’ গানটা। অরুণরা বায়না ধরেছিল, কেশবদা, ও আমার চন্দ্রমল্লিকা ধরো। কেশবদা এক টিপ নস্যি নাকে ঠুসে বলল, দূর! দূর! এই ভর সক্কালে কেউ রাতের গান গায়। বলে ধুতির কোঁচা সামলে উঠতে যাচ্ছিল, যখন কী আশ্চর্যের কারণে একটু একটু করে অন্ধকার ছড়াতে লাগল।
আর সবার মতো কেশবদাও আকাশের দিকে হাঁ করে চাইল, আর দেখল একটা জমাট অন্ধকার পাড়ার পশ্চিম কোণ থেকে মেট্রোপলিটান স্কুল পেরিয়ে পুবে মৌলালির দিকে ধেয়ে আসছে। এ আবার কী সূর্যগ্রহণ বাবা, ভাবল সবাই। কিন্তু ভাবনার আগে রাত ছুটছে, সোনালি রোদ গিলছে হাঘরে অন্ধকার। আর থেকে থেকে কীসব আছড়ে পড়ছে পিচের রাস্তায়, সিমেন্টের ফুটপাতে, রাস্তার এধার-ওধারের বাড়ির বারান্দায়। শেষে কোত্থেকে একটা শোর উঠল ‘পঙ্গপাল। পঙ্গপাল!
‘পঙ্গপাল’ শব্দটা অরুণ এক-আধবার স্কুলের ভূগোল-টুগোলের বইতে পেয়েছে, তবে সে বস্তুটি আখেরে কী দাঁড়াতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না। আর পঙ্গপাল মানে যে আসন্ন রাত তা আর কল্পনায় আসবে কোত্থেকে! ও ঘাড় উঁচিয়ে পাড়ার আকাশ জুড়ে বেড়ে চলা অন্ধকার দেখতে থাকল।
ক্রমে পাড়ার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মিশমিশে কালো অন্ধকারে চাপা পড়ল, অরুণ শুনল কেশবদা বলছে, মানে মানে বাড়ি কাট বাপ। এ তো বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার!
সবার মতো অরুণও গুটি গুটি বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। কানে আসছিল পথচারীদের নীচু গলায় কথাবার্তা আর চড়াৎ চড়াৎ আওয়াজ। হয়তো ওই পঙ্গপাল পড়ার আওয়াজ আর তার মধ্যে হঠাৎ ইংরেজিতে একজনের গলা, দিজ আর লোকাস্টস! দে আর গোয়িং টু ভ্যানিশ সুন।
কণ্ঠস্বরটা ভুল হওয়ার নয়, তবু অরুণ জিজ্ঞেস করল, ইজ ইট টোনিং সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর, অফ কোর্স! হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার, অরু কালেক্টস লোকাস্টস?
অরুণ বলল, কালেক্ট করব কী, চোখে তো কিছু দেখতেই পাচ্ছি না। হঠাৎ সেই অন্ধকারে কোত্থেকে এসে আন্দাজে অরুণের একটা হাত ধরল সুক। বলল, ঘাবড়িয়ো না। এটা কয়েক মিনিটের ব্যাপার। লোকাস্ট চলে গেলেই সকাল আবার সকাল হয়ে যাবে।
অরুণ জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে এভাবে লোকাস্ট দেখেছ?
অন্ধকারেই সুকের জবাব এল, হ্যাঁ, ছোটোবেলায়।
অরুণ জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
সুক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আলো ফুটল পাড়ার পশ্চিমে। অরুণ আকাশের দিকে চেয়ে দেখল পঙ্গপাল বাহিনী ক্রমশ সরে যাচ্ছে পুবে, আর পশ্চিমে ক্রমশ আকাশ আর রোদ বেরিয়ে আসছে। রাস্তার দিকে চাইতে অরুণ দেখল শয়ে শয়ে মরা পঙ্গপাল পড়ে আছে। হঠাৎ একটা ওর গায়ে এসেও পড়ল, ও সেটা গা থেকে ঝাড়ার জন্য লাফ দিতে গোটা দুয়েক পড়ল সুকের গায়েও। সাহেব ওর পেটেন্ট করা বুলি ঝাড়ল, শিট! তারপর হাতের ক্যানভাস ব্যাগ দিয়ে এলোপাথাড়ি পিটতে লাগল নিজের হাতে পিঠে পায়ে। আর মুখে ক্রমাগত ওই স্ল্যাং—শিট! বাস্টার্ড! ফাঁক অফ!!
আলো ফুটতে দেখা গেল একটা-দুটো নয়, বেশ ক-টা পঙ্গপাল পড়েছে সুকের জামায়, মাথায়, ব্যাগে। তখন অরুণও জুটল সাহেবের গা ঝাড়তে। সেই ঝেড়ে ফেলা পোকা যেই যেই পড়তে থাকল মাটিতে সুক ওর ভারী ক্যানভাস শুয়ে তাদের পিষতে থাকল। আর মুখে সমানে সেই খিস্তি—শিট! বাস্টার্ড!…
গোটা পাড়ার আলো যখন পরিষ্কার হয়ে গেল সুক যেন একটু স্বাভাবিক হয়েছে। অরুণকে বলল, আজ রোববার, তোমার নিশ্চয়ই ছুটি। চলো, লেটস সেলিব্রেট!
অরুণ বুঝে পেল না কীসের সেলিব্রেশন। বলল, আজ কী? নিশ্চয়ই ডরোথির জন্মদিন নয়। ওর জন্মদিনটা আমি জানি।
ভেরি ক্লেভার! বলে অরুণের পিঠে একটা চাপড় দিল সুক। তারপর বলল, তাহলে আমারটাও জান নিশ্চয়ই।
অরুণ বলল, না। তবে এইটুকু জানি সেটা আজ নয়।
ব্রিলিয়ান্ট! বলল সুক। আসলে ডর চাইছে আমার চাকরিতে প্রমোশনটা সেলিব্রেশন করতে। কোয়ায়েটলি। নো হ্যাঙ্কি প্যাঙ্কি অর পার্টি থ্রোইং। আজ দুপুরে আমার গেস্ট শুধু তুমি।
আমি! শুধু আমি?—অরুণ বেশ তাজ্জব হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, জাস্ট ইউ। কারণ ডরোথি বলল তুমি নাকি কখনো পর্ক ভিন্দালু খাওনি। আজ ও ওটাই রাঁধছে আমাদের দুজনের জন্য। তুমি প্লিজ তোমার মাকে বলো আজ তুমি আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করছ।
অমনি অরুণ বাড়ির দিকে ঘুরছিল মাকে বলবে বলে, সুক ওর হাতটা চেপে ধরে বলল, দাঁড়াও! এখন না।
-কেন?
-তার আগে তুমি আমার সঙ্গে পর্ক, মশলা, জার্মান লোফ আর ওয়াইন শপিং-এ যাবে। রাজি?
অরুণ বিগলিত স্বরে বলেছিল, ওহ, অফ কোর্স!
তালতলা আর এন্টালি মার্কেট থেকে কেনা হল পোর্ক, হ্যাম, সসেজ, রুটি মাখন চিজ, চার রকমের ফল আর কিছু সবজি। তারপর হাঁটা শুরু হল শিয়ালদা-র দিকে। সেখানে লিকার শপ থেকে কেনা হল দু-বোতল রাম আর চার বোতল বিয়ার। কিন্তু ফের পাড়ার
মমাড়ে এসে সুক বলল, ডিয়র অরু, তুমি কি খুব বিরক্ত হবে যদি একটা কথা বলি?
অরুণ বলল, কথাটা না শুনে কী করে বুঝব বিরক্ত হব কি না? পানের দোকানের জগরুকে দিয়ে আমি জিনিসগুলো বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি শুধু ডরোথিকে বলো আমি মিন্টো লেনে ক্লাইভদের বাড়িতে যাচ্ছি। ও রান্না শুরু করে দিক, আমি ঠিক বারোটায় পৌঁছে যাচ্ছি।
অরুণ সুকের হাতে ঘড়িতে দেখল দশটা কুড়ি। জিজ্ঞেস করল, আর আমি? সুক বলল, ইউ বি দেয়ার অ্যাট টুয়েলভ থার্টি শার্প! অরুণ ‘ওকে’ বলে জগরুর সঙ্গে চলে গেল ডরোথির কাছে।
বেশ ভালোই চকচক করছিল ডরোথির চোখ দুটো জগরু যখন একে একে জিনিসগুলো নামাচ্ছে ওর সেন্টার টেবিলের ধারে। শেষ হতে ডরোথি ওকে দু-টাকা বকশিশ করে বিদেয় করে দিল। ডরোথি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সো? ফাইন পার্টি হবে আজ, কিন্তু টোনি কোথায়?
অরুণ তৈরিই ছিল, বলল—ক্লাইভদের বাড়ি গেছে। বলেছে ঠিক বারোটায় চলে আসবে। ডরোথি একটা চাপা আওয়াজ তুলল ‘হুম’। আর ওর সুন্দর মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল। একটু পর স্বগতোক্তির মতো বলল, আবার ওই ছেমড়ি মাগিটার পাল্লায় পড়ল ইডিয়েটটা!
কিছু বুঝতে না পেরে অরুণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, শেষে আমতা আমতা করে বলল, আমাকে ও সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছিল ডর।
চকিতে নিজেকে সামলে নিয়ে ডরোথি বলেছিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো। তুমি নিশ্চয়ই এসো। পর্ক ভিন্দালু আমি তোমার কথা ভেবেই করতে চেয়েছি। প্লিজ কাম।
সুকদের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে বাইরের সোনালি রোদে বেরিয়েও অরুণের কেন জানি না মনে হল পঙ্গপালের অন্ধকারটা যেন পাড়ার আকাশ ছেড়ে কখন ঢুকে পড়েছে এই অ্যাংলো দম্পতির ফ্ল্যাটে। ও এক ছুটে উলটো দিকে নিজেদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে বলা শুরু করল, মা, মা, আজ দুপুরে আমার নেমন্তন্ন ডরোথিদের বাড়িতে।
মা অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী কথা! বাড়িতে মাংস হচ্ছে আর তুমি বাইরে খাবে?
অরুণ বলল, ওদের বাড়িতেও মাংস হচ্ছে, খুব স্টাইলের রান্না।
মা মুখ ভেটকে বললেন, ছাড় তো তোর স্টাইল, যত্তোসব শুয়োরের মাংস দিয়ে রান্না।
অরুণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। খানিক পর নীচু স্বরে বলল, তাহলে কী?
মাও একটু নরম হয়েছে ততক্ষণ। বলল, ঠিক আছে যাও, নেমন্তন্ন করেছে যখন। তোমার মাংসটা ওবেলার জন্য তুলে রাখবখন।
অরুণ মনে মনে মাকে থ্যাংক ইউ বলে স্নান করতে চলে গেল। জীবনে প্রথম পর্ক ভিন্দালু খাওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে।
স্নান সেরে, গায়ে পাউডার ছড়িয়ে, লম্বা কোঁকড়া চুলে সামান্য পমেড ঘষে, পপলিনের শার্ট আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট চড়িয়ে কখন যে দিব্যি পৌঁছে গেছে ডরোথিদের বাসায় অরুণের সে খেয়ালও নেই। কিন্তু ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখল খাবারের মনোহরা গন্ধ চারদিকে মম’ করলেও ডরোথি সেই সকালের বাসি পোশাকেই বসে আছে ডাইনিং টেবিলের এক ধারে, গালে হাত আর চোখ দুটো বন্ধ। ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিল, সেটা ঠেলে বসার ঘরেও একটু থমকেছিল অরুণ। কোনো সাড়া শব্দ নেই দেখে খাবারের জায়গায় ঢুকে ওই দৃশ্য। অরুণ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, হোয়াট হ্যাপেণ্ড, ডর?
ডরোথি চোখ মেলে অরুণকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অরুণ দ্রুত ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখল, বলল—কাঁদছ কেন, বলো কী হয়েছে।
ডরোথি ওর মাথার ওপর রাখা অরুণের হাতটা দু-হাতে নিজের বুকের কাছে টেনে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, অরু, আমার ভয় করছে।
কথার মাথামুন্ডু বুঝতে পারল না অরুণ, জিজ্ঞেস করল, ভয়? কীসের ভয়? একটা থমথমে গলায় ডরোথি বলল, নিজেকে।
অরুণ তো আকাশ থেকে পড়েছে, নিজেকে! কেন?
—মনে হচ্ছে বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যাই।
-কারণ?
–টোনি, ক্লাইভের ওই নির্লজ্জ বউটার সঙ্গে ফেঁসেছে।
–সে কে?
সিলভি।
অরুণের মাথায় কিছুতেই এল না এত ফাঁসাফাঁসির কথা উঠছে কেন। মোটে তো আধ ঘণ্টা, চল্লিশ মিনিটের দেরি। ও ডরোথিকে ঠাণ্ডা করার জন্য বলল, তুমি ওসব চিন্তা ছাড়ো। তুমি চান করে তৈরি হয়ে নাও, আমি টোনিকে ডেকে আনছি। আমার যেতে-আসতে পনেরো মিনিটও লাগবে না।
ক্লাইভদের বাড়ি যেতে যেতে কত অদ্ভুত দৃশ্য চোখে ভাসল অরুণের। ছাদের ঘরে ও পড়তে বসলেই কত নাচগান, হইহল্লার আওয়াজ ভেসে আসে ক্লাইভদের ফ্ল্যাট থেকে। মাঝে মাঝে চিলেকোঠার জানালা খুলে কিছু দৃশ্য দেখে অরুণ। হাতে মদের গেলাস নিয়ে নেচে চলেছে ক্লাইভ, সিলভি, জেমস, এস্থার, এডি, পার্সি, নোয়েল, রিচি, বেলিণ্ডা। এ এক মস্ত দল ওদের, যখনই দেখবে কীরকম পার্টির মেজাজে। বিশেষ করে সিলভির হাঁটাটাই তো নাচ। অরুণ শুনেছে ও নাকি ‘ইজায়াস’ বার-এ রোজ সন্ধেয় গান গাইতে যায়। আর ক্লাইভ যে কী করে সেও এক রহস্য। অত হ্যাণ্ডসাম, টিপটপ, ফুলবাবুটি অ্যাংলোদের মধ্যে আর কে আছে? সারাক্ষণ সিগারেট ফুকছে, শিস দিচ্ছে, মুখে বিলেত আমেরিকা ছাড়া কথা নেই। মেয়েদের নাকি চোখের মণি। সুককে পাওয়ার আগে ডরোথিরও নাকি ‘ক্রাশ ছিল ওর ওপর। তারপর হঠাৎ একদিন স্বর্গ থেকে সিলভিকে পেড়ে নিয়ে এল ক্লাইভ। এ সবই ডরোথির মুখে শোনা কথা। একেক সময় আপনমনে পাড়ার অ্যাংলোদের কীর্তিকলাপ শুনিয়ে যায় ডরোথি। আর অরুণ সেসব আরব্য রজনীর কাহিনির মতো গোগ্রাসে গেলে।
এখন মিন্টো লেনের ওই বাড়িটার দিকে যেতে যেতে আচমকা একটা ভাবনা এল অরুণের। আচ্ছা, সিলভি না হয় খুব সুন্দরী, দারুণ নাচে, গায়। তাবলে ক্লাইভের মতো অত হ্যাণ্ডস্যাম একটা বরকে ছেড়েও সুকের পাল্লায় পড়বে কেন? সুকের গায়ের রং সাহেবি ঠিক আছে। ওর চোখ জোড়া নীল—ঠিক আছে। ও এরোপ্লেনের মেন্টেন্যান্সে আছে—ঠিক আছে। সারাক্ষণ টাকায় টাকায় ওর পকেট ভারী থাকেনা, এইখানে এসে অরুণ একটু থমকে গেল। সিলভি তো টাকাপয়সা ভালোবাসেই, টাকা ওড়াতেও ভালোবাসে…তাই বলে টাকার জন্যে?…আর ডরোথির মতো বউ থাকতে সুক…? অরুণের সমস্ত ভাবনাচিন্তাগুলো কখন কীরকম তালগোল পাকিয়ে গেল। ওর চটকা ভাঙতে ভাঙতে দেখল ও ক্লাইভ, সিলভিদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নতুন করে কোনো ভাবনা আসার আগেই অরুণ বেল টিপে দিয়েছে। তারপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
ফের বেল টিপল অরুণ; কিন্তু সাড়া নেই।
ফের বেল, ফের সেই নিস্তব্ধতা।
অথচ ও জানে সুক এখানে আছে। একটু একটু করে ওর মধ্যে ডরোথির ভয়, দুঃখ, রাগগুলো ছড়াতে লাগল। ও হয়তো সেই রাগেই হঠাৎ বিকট চেঁচিয়ে উঠল—টোনি! তার খানিক পর ফের—টোনি! শেষে মরিয়া হয়ে শেষবারের মতো—সিলভি! কোনো ডাকেই কোনো সাড়া না পেয়ে এবার মনে মনে, নিঃশব্দে অ্যাংলোদের প্রিয় গালটা উচ্চারণ করল–বাস্টার্ড! আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছেই নিজে লজ্জায় পড়ে গেল। ও মাথা নীচু করে বেরিয়ে এল, কিন্তু ডরোথিদের বাড়ি গেল না। চুপি চুপি বাড়ি ফিরে চিলেকোঠায় ওর পড়ার ঘরে ফিরে বন্ধ জানলার একটা মাঝারি ফাটল দিয়ে চেয়ে রইল বাড়ির পিছনে সিলভিদের ফ্ল্যাটের দিকে।
কিছুই সত্যি দেখার নেই, সিলভিদের বসার ঘরটা এমনিই পড়ে আছে। না চলছে। রেডিয়োগ্রাম, না বসে কেউ কোনো সোফায়, না চলছে ফ্যানও। ঘরের ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো যেটা অরুণদের বাড়ির দিকে খোলে তা হাট করে খোলা। তা থেকে লোহার স্পাইরাল সিঁড়িটা দিব্যি নেমে এসেছে একতলায়, কিন্তু সে সিঁড়িও অলসভাবে ঘুমিয়ে আছে, তার কোনো ধাপিতেই কোনো বেড়ালও শুয়ে নেই। অরুণ জানালার গর্ত থেকে চোখ সরিয়ে আনতে যাচ্ছিল যখন ওর নজর টানল একটা সামান্য জিনিস রেডিয়োগ্রামের ওপর রাখা সুকের প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স সিগারেটের পঞ্চাশের কৌটো। গোল টিন, আজ সকালেই সুকের হাতে দেখেছে ও। হাতে মোটা ক্যাশ এলেই এরকম রকমারি বিলিতি সিগারেটের আবির্ভাব হয় সুকের হাতে, বুক পকেটে, সাইডপকেটে। শুধু রনসনের সিগারেট লাইটারটা একই থাকে। সেই লাইটারটাও, অরুণ দেখল, দিব্যি শোভা পাচ্ছে সিগারেটের টিনের পাশে।
অরুণের গলার কাছটা কীরকম ব্যথা-ব্যথা করতে লাগল, ও চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে ছাদের উলটোদিকের আলসেতে গিয়ে দাঁড়াল। দেখতে চাইল ডরোথিদের বাড়ির কী দশা। দেখল সেখানেও সেই একই হাল, রোববারের দুপুরে নিঝুম হয়ে আছে বাড়িটা। অরুণ। ভাবল ডরোথি নিশ্চয়ই চান সেরে সেজেগুঁজে গালে হাত দিয়ে বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। তাহলে ওর কি গিয়ে ওর সঙ্গে আহ্লাদের লাঞ্চটা সেরে ফেলা উচিত না? বিশেষ করে যে মধ্যাহ্নভোজে ওর পোর্ক ভিন্দালু পদে হাতে খড়ি হবে?
পর্ক ভিন্দালুর কথাটা মনে আসাতে বেশ একটা টান বোধ হল অরুণের। আর তার পরেই কীরকম একটা ভয়মিশ্রিত দ্বিধা। কী করে জানাবে মেয়েটাকে যে অত ডাকাডাকিতেও সাড়া দেয়নি সুক। কিংবা ছাদ থেকে ও দেখেছে সুকের সিগারেট আর লাইটার পড়ে আছে সিলভিদের গ্রামের ওপর। এই ভয় ও দ্বিধায় ওর খিদেটাও একটু একটু করে মরে এল, ও মা-র কাছে গিয়ে দুপুরের খাওয়ার কথা বলল না। ওর চিলেকোঠার ঘরটাকেই গোঁসাঘর করল, তার মেঝেতে মাদুরের ওপর শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ল।
ওর ঘুম ভাঙল দূর থেকে ভেসে আসা আবছা এক চিৎকারে—আগুন! আগুন!!
প্রথম প্রথম ওর মনে হয়েছিল স্বপ্নের মধ্যেই কিছু শুনেছে হয়তো। পরে প্যাট প্যাট করে বাইরে গোধূলির আকাশের দিকে চেয়ে স্পষ্ট শুনতে পেল ওই হল্লা। তখন ও ছুট্টে ছাদের ওপারে গিয়ে দেখল পাড়ার ছেলে, ছোকরা, বয়স্ক, সবাই নানা সাইজের বালতিতে জল নিয়ে ছুটছে ডরোথিদের বাড়ির ভেতর। মুহূর্তে বুকটা হিম হয়ে গেল অরুণের। ও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল ডরোথিদের বাড়ি যাবে বলে। তাড়াহুড়োতে বার দুয়েক হোঁচট খেল ছাদের সিঁড়িতে, শেষে পৌঁছোল যখন ওপারের বাড়িতে লীলা শেষ। সুকের দামি জামাকাপড়ের স্কুপে কেরোসিন ঢেলে দেশলাইয়ের আগুন লাগিয়ে গোটা বাড়িটাই পুড়িয়ে ফেলার উপক্রম করেছিল ডরোথি। আগুনের শিখা যখন সিলিং ছোঁয় তখনই অকুস্থলে হাজির নাটের গুরু আঁতোয়ান সুক। প্রথমে এক হ্যাঁচকা টানে বউকে ফ্ল্যাটের বাইরে ফেলে ইলেকট্রিকের লাইনটা অফ করে ও। তারপর বাথরুম থেকে জল এনে ঢালা শুরু করে। এক বিচ্ছিরি অগ্নিকান্ডের বিরুদ্ধে একা লড়ছিল ও, তাও বেশ কিছুক্ষণ। কার্পেট চাপা দিয়ে এক কোণের আগুন চাপতে গিয়ে হাতও পোড়াল। তখনই নাকি ডরোথি চিৎকার জুড়ে দেয় ফায়ার! ফায়ার!!
ডরোথির ‘ফায়ার! ফায়ার!!’ চিৎকার পড়শিদের মুখে ‘আগুন! আগুন!!’ হয়ে ছড়াতে লাগলে বালতি বালতি জল আসা শুরু হল। কেউ জানতেও চাইল না আগুন ধরল কীভাবে অ্যাংলোদের ঘরদোরে, এ আর নতুন কী! কিন্তু সাধের ফ্ল্যাট আগুনে পুড়ছে, জলে ভাসছে দেখে হাউ হাউ কান্না ধরল ডরোথি। ঠিক তক্ষুনি সেখানে ভিড়ের একজন হয়ে এসে দাঁড়াল অরুণ।
আঁতোয়ান সুকের ডায়েরিতে ‘আমি আগুন নিয়ে খেলতে ভালোবাসি’ কথাটায় এতগুলো ছবি ও ঘটনা এসে গিয়েছে অরুণের ভাবনায়। আপনমনে কটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছে কে। জানে। ফের একটা ধরাল ও, আর দেশলাইয়ের কাঠিটা বাইরে ছুঁড়তে গিয়ে খেয়াল করল আশপাশের আরও অনেক বাড়িরই আলো নিভে গেছে। একটা থমথমে অন্ধকার রাত মুড়ে ফেলেছে শহরটাকে, একটা ভারী মেঘ ঢেকে দিয়েছে এক ফালি চাঁদকেও।
অথচ অরুণের চোখে ঘুম নেই। সুকের ডায়েরি ওর ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসেছে। সেখান থেকে ফের ওকে পড়া শুরু করতে হবে। ও ঘরে এসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ফের পাতা ওলটাতে ওলটাতে এসে থেমে পড়ল ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫-এ। পাতার মাথায়
সুকের নিজস্ব হেডলাইন ‘লোকাস্টস ব্রিংগ লাভ অ্যাণ্ড ফায়ার’। পঙ্গপাল নিয়ে এল প্রেম ও আগুন। সুক লিখেছে—
৪.
পঙ্গপালের ঢেউ বয়ে গেল মিন্টো রো-এর ওপর দিয়ে আজ। সাত সকালে ঘোর অন্ধকার, বাইবেলে যেমন দিনের বেলার অন্ধকারের কথা আছে এখানে ওখানে। ঠিক কোথায় বলতে পারব না। আমার তাতে অবিশ্যি অসুবিধে নেই, আমি তো একপ্রকার অন্ধকারেরই জীব। অন্ধকার আমার জন্য ভালো ব্যাপার-স্যাপার ঘটায়। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে। আজও তাই, যদিও শেষটা গোলমেলে হয়ে গেল।
আকাশটা যখন কালো হয়ে গেল আমি অরুর গলার শব্দ পেলাম। আমার ওকে আজ বড়োই দরকার ডরোথিকে সামলানোর জন্য। ডর পর্ক ভিন্দালু করতে চায় শুনে বললাম, অরুকে খেতে বলো আজ। ওকে তো ভিন্দালু খাওয়ানোর কথা আছে। ডর রাজি হতেই সুযোগটা এসে গেল। সিলভি কালই বলেছিল রোববার সকালে ক্লাইভ একদিনের জন্য খড়গপুর যাবে ওর অসুস্থ মাকে দেখতে। সো দিস ইজ আ গ্র্যাণ্ড চান্স, আমি বুঝে গেছিলাম। সিলভিকে কিস্যু বলিনি, তাহলে ও চিল্লামিল্লি করত। জানি ও আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু কোনো সুযোগ দেয়নি এতকাল। একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হয়ে যাচ্ছে আমার। আমার প্রিয়তমা ডরোথি ছাড়া এত ঝামেলায় কেউ ফেলেনি আমায়। অথচ সেক্সি এবং গ্ল্যামারাস সিলভি সম্পর্কে কী উদ্ভট ধারণা সবার। যেন তুড়ি দিলেই উঠে আসবে!
একটা বিশ্বাস আমার ছিলই—ক্লাইভটা বলতে গেলে কিছুই করে না, তাই ওদের ওখানে পয়সা লড়াবার সুযোগ আছে। দুটো রামের পাঁইট আর এক প্যাকেট প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স দিলে ছোকরাকে বাগে পাওয়া যায়। কিন্তু সিলভি? ওকে কিছুতেই বুঝতেই পারি না। কাজেই আজকের দিনটাকেই কাজে লাগাতে হবে। না হলে আর কবে হবে?
মনটা খচখচও করছে। প্রমোশন সেলিব্রেট করার জন্য পার্টি, অথচ ঠিক তক্ষুণি এই সুযোগ, যা হাতছাড়া করা পাপ আমার মতো পুরুষ মানুষের পক্ষে, তাই অরুকেই কাজে লাগাতে হল। বড্ড ভালো ছেলে, ভেরি ইনোসেন্ট। আজ কিস্তিমাত হলে ওকে কাল একটা পাইলট পেন কিনে গিফট করব। ও খুব পেন ভালোবাসে।
আমার বিশ্বাস অরুণ কিছুই আঁচ করতে পারেনি। বেচারা জীবনে প্রথম পর্ক ভিন্দালু খাওয়ার স্বপ্নে মজে আছে। আমার কেনাকাটাগুলো খুব মন দিয়ে দেখছে। তবে ওকে কিছুতেই সিলভিদের বাড়ি অবধি নিয়ে যাওয়া যাবে না। ডরোথি ওকে ক্রস করে কী বার করে ফেলবে গড ওনলি নোজ।
জগরুর সঙ্গে অরুণকে বাড়ির দিকে পাঠিয়ে সিলভিদের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি আমার প্যালপিটেশন বেড়েছে। মেয়েদের সঙ্গে এই ধরনের মোলাকাতে এটা আমার হয়, জানি। ঘড়ি দেখতেও সাহস হচ্ছে না, কে জানে বেল টিপতে হয়তো ব্যাটা ক্লাইভই স্বশরীরে বেরিয়ে এল! এই সব ফষ্টিনষ্টির খেলায় এ তো আকছারই হয়। সেদিক দিয়ে আমি পোড় খাওয়া পাবলিক। যদিও আমার সাকসেস রেটও কিছু খারাপ না, এও বলতে পারি। আসরানি তো আমাকে সোহাগ করে মাদারফাঁকার বলে; বলে এ ছেলে মাকেও ছাড়বে না। আমি মিটিমিটি হাসি, ভাবি এই বিশ্রী, সাংঘাতিক গালিটাও আমার জীবনে সত্যি হয়েছে। তা তো আগেই, জায়গামতো লিখেওছি। যাকগে সেসব পুরোনো কেচ্ছা। এই মুহূর্তে আমি সিলভিদের ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে ক্লাইভকে দেখবার আশঙ্কায় আছি। দরজা খুলল…
না, ক্লাইভ বেরিয়ে আসেনি; সিলভিও না। বেরোল সিলভিদের বুড়ি নোকরানি উসরা। মাগিটাকে আমার একদম পছন্দ নয়। সিঁড়িঙ্গি বুড়ি সারাক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে আছে। দশটা প্রশ্নের জবাব দেয় একটা। চোখে-মুখে সারাক্ষণ সব্বাইকে সন্দেহ। পার্সি বলে ক্লাইভ ওটাকে রেখেছে সিলভির ওপর নজরদারি করার জন্য। দরজা খুলে উসরা তাই কিছুক্ষণ আমাকে মাথা থেকে পা অবধি দেখল। তারপর একটিও কথা না বলে ফ্ল্যাটের দরজার খিল এঁটে বসার ঘরের ওপারের স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে টুকটুক করে নেমে গেল। আমি একটা খোলা খালি ফ্ল্যাটে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুঝলাম না বাড়ির মালগুলো গেল কোথায়। ক্লাইভ না হয় খড়গপুরে গেছে, কিন্তু সিলভি? বেলা এগারোটার পরও নিশ্চয়ই বিছানায় গড়াচ্ছে না!
আমি আমার টিন থেকে একটা প্লেয়ার্স নাম্বার সিক্স বার করে ধরিয়ে সিলভিদের সোফাটায় বসলাম। আরামসে কয়েকটা টান মারতে মগজটা খুলল। তাই তো! বেডরুমে একবার ঢু মারলে তো হয়। জাস্ট ইন কেস।
আমি অ্যাশট্রেতে সিগারেট নিভিয়ে, টিন আর লাইটার গ্রামের ওপর রেখে, আস্তে করে সিলভিদের বেডরুমের দরজাটা ঠেললাম। আর অমনি একটা ঘুরঘুট্টিB অন্ধকার এসে ধাক্কা মারল। কে বলবে এত বেলা বাইরে? শোবার ঘরের সব জানালার পর্দা পুরো পুরো টানা। নো নাইট বালব, নাথিং। আলো থেকে ঢুকে আমি চারগুণ বেশি অন্ধকার দেখতে থাকলাম। তাই খুব মৃদু গলায় ডাকলাম, সিলভি! কোনো উত্তর নেই।
আমি হাতড়ে হাতড়ে বিছানার ধারে গেলাম। ছুঁয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম সিলভি শুয়ে আছে কি না। শ্বাস-প্রশ্বাসের একটা হালকা আওয়াজ কানে এল। সেই শব্দটাকে লক্ষ করে হাত নিয়ে এদিক-ওদিক করতে সিলভির মুখের স্পর্শ পেলাম হাতে। আর সঙ্গে সঙ্গে সারাজগৎ উলটে গেল আমার। আকাশের চাঁদ এখন আমার হাতে, পৃথিবী উলটে গেল কি না তা দিয়ে আমার কী এল-গেল। ওর ঘোর অন্ধকারের মধ্যে গা থেকে সমস্ত কাপড়চোপড় খসিয়ে আমি কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে আদম সেজে বিছানার ভেতর আমার ইভের সন্ধানে সেঁধিয়ে গেলাম। আমার তলপেটটা তখন ভিসুভিয়াসের জাগ্রত আগ্নেয়গিরি!
আমি ওর অপূর্ব বুক দুটোয় হাত বুলিয়ে জাগালাম সিলভিকে। কোনো নতুন বুকজোড়ায় হাত পড়লে মনে হয় যেন নতুন কোনো পাহাড়চুড়োয় উঠলাম। সেই শৃঙ্গজয়ের উল্লাসে আমি সিলভির নগ্ন দেহের ওপর চড়ে আমার ব্যারিটোন ভয়েসে ডাকতে লাগলাম, সিলভি! সিলভি মাই ডিয়ার!
সিলভি কোনো উত্তর দিল না, শুধু দু-হাতে কী এক অদ্ভুত শক্তিতে আমায় জড়িয়ে ধরে সারা মুখে অবিশ্রান্ত চুমু দিতে লাগল। এক-আধবার ঠোঁটে দারুণ কামড়ও দিল, কিন্তু আমি চট করে ছাড়িয়ে নিলাম। মেরুনিসার ঠোঁটের কামড় নিয়ে বাড়ি ফিরে কী কম ঝামেলায় পড়েছি! ডর, আমার প্রিয়তমা, ডর, সেবার জ্বলন্ত সিগারেট চেপে সেই জায়গাটায় বলেছিল, ফের এরকম ঠোঁট নিয়ে ফিরলে ঠোঁটটাই কুপিয়ে দেব।
সে যাকগে এখন সিলভি রীতিমতো বাঘিনি। অন্ধকারে দুটো আদিম জন্তুর মতো একে অন্যকে ছিঁড়ে খাচ্ছি। বালিশ ফেটে তুলো উড়ছে ঘরময়, আমরা কখনো বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে, কখনো ছিটকে পড়ছি নীচের কার্পেটে। আর সবটাই জোড়ায় জোড়ায়। কীভাবে যে দুটো শরীর মিশে এক হয়ে গেছে সঙ্গমে জড়ানো সাপের মতো বুঝতেও পারছি না। আমি আবেগের বশে বেজায় চেঁচাচ্ছি, সিলভি কিন্তু চুপ! কে বলবে সন্ধ্যেবেলায় এই মেয়েই গান গেয়ে মাতিয়ে রাখে ইজায়াস বার।
এক সময় আমারও আওয়াজ থেমে গেল, আমার শরীর শান্ত হয়ে গেল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল সিলভির ঘর সেই অন্ধকার, কিন্তু বিছানায় সিলভি নেই। আমি ওই অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে কাপড়চোপড়, জুতোমোজা পরলাম। তারপর দরজা ঠেলে বসার ঘরে পা রাখতেই সামনের সোফায় দেখলাম ব্রা আর প্যান্টি পরে সিগারেটে ফুক দিচ্ছে সিলভি নয়, ব্ৰেণ্ডা! ক্লাইভের বেস্ট ফ্রেণ্ড এডির বউ, যাকে ক্লাইভরা আড়ালে ডাকে ক্যালকাটাজ হিপেস্ট হোর! শহরের তারকা পতিতা। আবার তলে তলে সব্বাই-ই ওর সঙ্গে বিছানার যাবার তাল কষে। ব্ৰেণ্ডার বান্ধবীদের দিনে তিন ঘণ্টা নিট যায় স্বামীদের পাহারা দিতে, যখন ব্ৰেণ্ডা ধারেপাশে আছে। সেই ব্ৰেণ্ডা! সে কী করে এখানে এল, একেবারে সিলভির বিছানায়?
কিছু জিজ্ঞেস করার আগে ব্ৰেণ্ডাই জিজ্ঞেস করল, কীরকম লাগল ব্যাপারটা টোনি?
কোনো উত্তর দেবার আগে ও-ই বলে দিল, সিলভি বলেছিল তুমি ওকে তাক করেছ আজকের জন্য, কারণ ক্লাইভ থাকছে না। ও তাই ক্লাইভকে সি-অফ করে আমাদের ফ্ল্যাটে চলে গেছে, আর আমি এখানে।
—আর তুমি এখানে মানে?
—সিলভি চায় না, তাই সিলভির হয়ে প্রক্সি দিলাম।
–প্রক্সি দিলে? তার মানে এই লাভমেকিং…
—হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম। পাইলটদের মাটিতে ফেলতে আমার ভালো লাগে।
–তাই? আর পাইলটরা পড়ে গেলে?
—তাদের ফের আমি ওড়াই।
–তাহলে আমিও উড়ব?
—শিওর! এরপর কারও প্রক্সি হিসেবে নয়, পরিষ্কার ব্ৰেণ্ডা হিসেবে। রাজি?
আমি কিছু বলার আগে ফের বলল ব্ৰেণ্ডা, কিছুটা যেন আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে—ডোন্ট ওরি! সিলভির পিছনে ছুটে কাজ নেই, ও তোমাকে চায় না।
জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সেটা নিশ্চিত জেনে গেছ?
ও বলল, হ্যাঁ।
—কীরকম?
–ও বলেছে আমাকে, টোনিকে আমি বিশেষ পাত্তাটাত্তা দিই না। ও ক্লিংগজ, শর্ট অ্যাফেয়ার্স, ছুটকো-ছাটকা প্রেমটেম বোঝে না। ও খুব লম্বা সফর পছন্দ করে ভালোবাসায়।
এই সময় আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, হোয়াট ননসেন্স! আমার অনেক ছুটকো-ছাটকা কেস আছে, ও কী মনে করে আমাকে, ইনোসেন্ট পাদ্রি? আমার একটাই লম্বা সফর ডরোথি। কিন্তু আমি প্রায়ই ওর বিশ্বাসে আঘাত দিই। আমার হ্যাবিট ওইটা।
একটা লম্বা রিং ছাড়তে ছাড়তে ব্ৰেণ্ডা বলল, তাই বলেছিলাম ওকে একবার টোনিকে। আমার হাতে ছেড়ে দ্যাখ, ওকে মানুষ করে দেব। তাই…।
সিগারেটের টিনটা ব্ৰেণ্ডাকে দিয়ে দিলাম, জিজ্ঞেস করলাম একটা ড্রিঙ্ক কিনবে না? ও মাথা নাড়তে একশোটা টাকাও দিলাম, তারপর বললাম, সিলভি এতক্ষণ কী করছে
তোমাদের ওখানে? ও বলল জানি না। নিশ্চয়ই বোরড হচ্ছে খুব। কেউ তো নেই।
-কেন, তোমার বর?
–ও জাহাজে? হয়তো কোনো পোর্টে পরিদের মাঝখানে।
—ও, বেশ চাল খেললে তোমরা তাহলে?
–নাও গেট লস্ট। ঢের হয়েছে। এখন ওকে ডেকে আনি। লাঞ্চও তো খাইনি কেউ। সিলভিদের ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে লজ্জায় শিস দিয়ে ফেললাম। লাঞ্চ খাইনি আমিও তো। সেই সঙ্গে ডর আর অরুও হয়তো…
আমি জোরে পা চালালাম বাড়ির দিকে এবং এসে ঢুকলাম এক আগুন থেকে আরেক আগুনে…
অ্যাদ্দুর এসে অরুণ কিছু অংশ টপকে গেল, অগ্নিকান্ডের যেসব বৃত্তান্ত ওর স্বচক্ষে দেখা। ওই দ্রুত টপকে যাওয়ার মধ্যেও টের পেল সুক যা বলে তাতে বানানো, ফলানো ব্যাপার কিছু নেই। অথচ একটা পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আর যত আশ্চর্য কান্ড দেখা যায় ওর জীবনেই ঘটে। যেমন লিখছে—
আগুন নিভল বটে, কিন্তু আমার হাতের জায়গায় জায়গায় ঝলসে গেল। ক্যাম্বেল হসপিটালে গিয়ে ট্রিটমেন্ট হল। আমার ওপর তলার সিরিল আর মার্লিন আমাদের থাকতে বলল ওদের ফ্ল্যাটে। ওদের ওখানেই খাওয়া-দাওয়া সেরে রাত দেড়টায় যখন ঘুমোবার জন্য লাইট নেভানো হল তখনও সকালের ব্যাপারটা নিয়ে ডরোথি একটাও কথা বলেনি। যেই পাশে এসে শুল অমনি প্রথম প্রশ্ন, সিলভিদের সঙ্গে কী করছিলে?
আমি অবাক স্বরে বললাম, সিলভিদের বাড়ি গেছলাম ঠিকই কিন্তু সিলভি ছিল না।
–তার মানে তাই, সিলভি ছিল না।
আশ্চর্য, সিলভির জায়গায় কে ছিল সেটা আর জিজ্ঞেসও করল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একবার সেই কান্নার মধ্যেই বলল, আমার গলার ক্রস ছুঁয়ে বলো সিলভি ছিল না!
আমি ক্রস ছুঁয়ে বললাম, না ছিল না।
আর ডরোথির কান্না থেমে গেল।
এরপর ও আমার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, আই লাভ ইউ, টোনি।
আমি বললাম, আই লাভ ইউ টু, ডর।
একই দিনে দুটো ভালোবাসা আমার পাওনা হল। একটা ডরোথির, যেটা নতুন করে, হাত পুড়িয়ে, পেলাম। আরেকটা সিলভির। সিলভি আমাকে এক রাতের খদ্দের মনে করেনি। বলেছে লম্বা সফরের প্রেমিক। এই বলাটাই তো ভালোবাসা।
আমার হাতে ব্যাণ্ডেজ, সারাগায়ে ব্যথা, তবু গভীর রাতে আমি আর ডর প্রেম করলাম। আমি হাত বাঁধা কয়েদির মতো চিৎ হয়ে শুয়ে, ও আমার ওপরে ইংল্যাণ্ডের মেয়ে জকিদের মতো সওয়ার। আই হ্যাভ ফাউণ্ড লাভ!
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়েরিটা বন্ধ করে, টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে অরুণ শুয়ে পড়ল। কাল দশটায় ফের অফিস, কখন ফিরবে জানে না, ফেরাটা তো সাংবাদিকদের রুটিনে লেখা থাকে না। তবু মনে হল ফেরার মুখে একবারটি ডরোথিদের বাড়ি ঘুরে এলে মন্দ হয় না। অনেকগুলো প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করছে মাথার মধ্যে। বিশেষ করে একজনকে নিয়ে একটা প্রশ্ন : সিলভি।
হাজারো প্রশ্নের ওঠাপড়ার মধ্যে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল অরুণ।
৫.
এক বোতল অ্যারিস্টোক্র্যাট হুইস্কি আর দু-প্যাকেট বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস সিগারেট নিয়ে গিয়েছিল ডরোথির জন্য। ডরোথি সেই হুইস্কিই সার্ভ করছে দু-জনের জন্য। ইতিমধ্যে ওর বোবাকালা কাজের মেয়ে বিন্দিয়া এসে ক-প্লেট ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে দিয়ে গেছে টেবিলে। একটা প্যাকেট খুলে ডরোথির দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়েছে অরুণ। ডরোথি সিগারেট নিয়ে ওর হুইস্কির গেলাস তুলে বলল ‘চিয়ার্স!’
অরুণও ‘চিয়ার্স!’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন এক স্নিগ্ধ আনন্দে ভরে গেল ওর মনটা। ডরোথি সিগারেট ধরিয়ে হুট করে উঠে গিয়ে গ্রাম চালিয়ে দিয়ে বলল, ফর ওল্ড টাইমজ সেক। আর রেকর্ড থেকে ধ্বনি উছলে উঠে গোটা ঘরটাকে ভরিয়ে তুলল। সারাঘর জুড়ে ভাসতে লাগল ন্যাট কিং কোলের জলদগম্ভীর রোম্যান্টিক গলার ফ্যাসিনেশন’।
গ্রামের পাশে দাঁড়িয়ে গেলাসে প্রথম চুমুকটা দিতে দিতে ডরোথি বলল, টোনির সবচেয়ে প্রিয় গান।
অরুণ গেলাসে সিপ দিয়ে বলল, আমারও।
ডরোথি বলল, তা কি আমি জানি না?
অরুণ হাসতে হাসতে বলল, সবই জান দেখি। শুধু জানলে না বেচারা টোনিটা কোথায় হারিয়ে গেল।
ডরোথি যেন কথাটা শুনেও শুনল না। নিজের সোফায় এসে বসতে বসতে বলল, গ্রামটার যা দশা হয়েছিল। তাই ইলেকট্রিশিয়ান যুগলবাবুকে দিয়ে সারিয়ে সাফ করে ফের চালু করলাম। চল্লিশ টাকা গচ্চা গেল ঠিকই, তবু তোমাকে এখন গান শোনাতে পারছি। মনে হয় এক যুগ পরে এ ঘরে গান বাজছে। কী জানি সত্যি কতদিন!
এরপর দু-জনে চুপ করে ডুবে রইল ন্যাট কিং কোলের ফ্যাসিনেশন-এ। গানটা শেষ হতে হুইস্কিতে দ্বিতীয় সিপ দিতে দিতে উঠে গিয়ে গ্রামটা বন্ধ করে দিল ডরোথি। আর ফিরে এসে সোফায় বসল, সো? কীরকম বুঝলে টোনির লেখাগুলো?
প্রায় আপনা আপনি অরুণের মুখ গলে বেরিয়ে এল, ফ্যাসিনেটিং!
ওর তারিফে চমকে গেছে ডরোথি—বলছ? রিয়্যালি!
অরুণ বলল, অ্যাবসোলিউটলি ফ্যাসিনেটিং!
ডরোথি সহসা বুঝে উঠতে পারল না এরপর কী বলবে। শেষে খুব দ্বিধার স্বরে জিজ্ঞেস করল, ওটা দিয়ে কিছু করা যাবে ভাবছ?
অরুণ, এবার খুব সপ্রতিভ, কেন না? তবে তুমি যা ভাবছিলে তা-ই হবে। আমি ওগুলো নিয়ে কোনো নিউজপেপার ফিচার করছি না। খুব আলাদা গোছের একটা লাভ স্টোরি লিখব।
সঙ্গে সঙ্গে ‘ওয়াও!’ বলে চিৎকার করে উঠল ডরোথি আর কেঁদে ফেলল। হাতের গেলাস নামিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, অরু এখন তো টোনি বলতে আমার কাছে ওই ডায়েরিগুলোই আর রেকর্ড। তুমি জানো টিবি-র লেট স্টেজে আমি এখন?
একটা ঠাণ্ডা হাওয়া সোঁ সোঁ করে বইতে লাগল অরুণের শিরদাঁড়া দিয়ে। মুখে শুধু বলতে পারল, কী বলছ কী, ডর?
ডরোথি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, একটা সিগারেটও আমার খাওয়া বারণ, জান?
-তাহলে খাচ্ছ কেন?
—কারণ আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। এই যে তুমি বললে একটা লাভ স্টোরি লিখবে আমি সেই দিনটার জন্য অপেক্ষা করব। আই মিন ইট।
গলা ধরে এসেছিল অরুণের, তবু না বলে পারল না—কিন্তু আমি তো সেই প্রেমের গল্প লিখব বাংলায়, নট ইন ইংলিশ। তুমি কী করে পড়বে?
ডরোথি ফের হুইস্কিতে চুমুক সেরে বলল, কেন, তুমি এসে আমায় ট্রান্সলেট করে শুনিয়ে যাবে।
ফের এক প্রস্থ নিস্তব্ধতা ভর করল ঘরটায়। দু-জনে একটু একটু করে মদ আর ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেল। শেষে সন্ধের প্রথম সিগারেটটা ধরিয়ে নীরবতা ভাঙল অরুণ। জিজ্ঞেস করল, আমার গল্প হতে গেলে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তরও তোমায় দিতে হবে ডর? এগ্রিড?
—তাহলে বলো, টোনি কি সিলভির প্রেমে পড়েছিল?
প্রশ্নটায় ভালো রকম চমকে গেল ডরোথি। ফলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বেশ জড়তাভরা গলায় বলল, এর কোনো উত্তর হয় না, অরুণ। কখনো মনে হয় হ্যাঁ, কখনো মনে হয় না।
—কখনো হ্যাঁ মনে হয়?
—যখন ভাবি সিলভি যেদিন কলকাতা ছেড়ে পাকাঁপাকি ভাবে চলে গেল দিল্লির ইন্টারকনের ফ্লোর শো আর্টিস্ট হয়ে আর টোনিকে দেখতাম গুম মেরে বসে থাকতে।
-ওরা ফিজিক্যালি ইনভলভড ছিল মনে হয়?
–না, তা মনে হয় না।
–তাহলে ওই ইনফ্যাচুয়েশন, প্ৰেমান্ধতা কেন?
—কারণ ওর একটা বদ্ধ ধারণা জন্মেছিল সিলভি ওকে ভালোবাসে।
চকিতে অরুণের মনে পড়ল সেই পঙ্গপাল আক্রমণের দিনে ব্ৰেণ্ডার মুখে শোনা কথাটা। ও জিজ্ঞেস করল, সিলভি যে ওকে ভালোবাসে সেটা ওর মাথায় ঢুকল কেন?
ডরোথি বলল, আমার জন্য।
-তোমার জন্য! কেন?
—কারণ মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে যেটা ছেলেরা পারে না। নানা জায়গায়, নানা পার্টিতে দেখে আমি টের পেতাম যে, মেয়েটার ভেতর একটা সার্টেন রেসপেক্ট আছে টোনির জন্য। অন্যদের থেকে একটু আলাদা করে দেখত। যেটা আমার ভালো লাগত না, ভয় লাগত।
—আর সেটা টোনি বুঝত?
—হয়তো। নাহলে আমার সামনে সিলভির নাম নিতে গলা ভেঙে যেত কেন।
–বুঝলাম। আর?
—আরেকটা কথা কি জান? টোনি কোনোদিন ইজায়াস বার-এ সিলভির গান শুনতে যায়নি। কোনোদিন। একবার আমি খুব জোরাজুরি করেছিলাম, কিছুতেই রাজি হল না। উলটে ঢের বেশি পয়সা খরচা করে শেহরাজাড-এ স্যাণ্ডি হল্যাণ্ডের গান শোনাতে নিয়ে গেল।
–কারণ?
–কারণ ও যাকে মনে মনে অতখানি চায় সে সবার জন্য প্রেমের গান গাইছে সেটা সহ্য হবার নয়।
—অথচ তোমাকে বলত এত সুন্দর শরীর শুধু একজনের ভোগে লাগা উচিত নয়।
ডরোথি এবার ওর সেই হা হা হি হি রুপোলি হাসিতে ভেঙে পড়ল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, দ্যাট টোনি ওয়াজ সাম ক্যারেক্টার। আমি এখনও ওকে বুঝিনি সত্যি।
অরুণ চুপচাপ খানিকক্ষণ স্মোক করল। সিগারেটটা শেষ করে নিভিয়ে ফের চুমুক দিল ড্রিঙ্কে, তারপর জিজ্ঞেস করল, আর কখন তোমার মনে হয় সিলভির সঙ্গে টোনির সে অর্থে কোনো প্রেম ছিল না?
ডরোথি এবার খুব দ্রুত উত্তর দিল, যখন তোমার দিদি শমিকে লেখা ওর চিঠিগুলোর কথা ভাবি।
ঘরের মধ্যে বাজ পড়ল যেন বিনা মেঘে। শমিকে লেখা টোনির প্রেমপত্র ডরোথি পড়েছে? তাতে কী ছিল? সে-সব ও পেলই বা কী করে?
অরুণ এসবের কিছুই জানে না। বাড়িতে কখন যে কী ঘটে গেছে কোনো আঁচ পায়নি ওই কিশোর বয়সে। শুধু মনে আছে এক রাতে দিদিকে বেদম প্রহার মা আর কাকা মিলে। থেকে থেকে কাকার প্রবল হুঙ্কার—কনভেন্টে পড়ে এই উপকার হল! বিলিতি শিক্ষার এই নমুনা। দুর করে দোব বাড়ির থেকে অপদার্থ মেয়ে কোথাকার!
পাশের ঘরে ভয়ে কান্নায় একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল অরুণ। কেন যে হঠাৎ দিদিকে নিয়ে এত হল্লা বাড়িতে তা বোঝার ফুরসত মেলেনি। তবে তার পর থেকেই দিদির ওবাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছিল। আর তার ক-দিন পর এক ঘটনা ঘটল যার কোনো মানে মাথা বুঝে পায়নি অরুণ সে সময়, আজ যেন তার কিছু খোলস ছাড়ানো যাচ্ছে। পাড়ার মাস্তান জগুদা হঠাৎ এক বিকেলে কাজফেরত সুককে ধরে বেদম ঠ্যাঙাল রাস্তার মাঝখানে। চুলের মুঠি ধরে চড়, দু-চারটে রদ্দা, তারপর গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতর ফেলে দেওয়া। এই মারের সঙ্গে ইংরেজি বাংলা হিন্দি মিশিয়েও কত সব বকাঝকা চালাচ্ছিল জগুদা, যা বাড়ির ছাদ থেকে বিশেষ শুনতে পায়নি অরুণ। শোনার মধ্যে একটাই গাল—সোয়াইন।
তবে সেদিনও একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হয়েছিল অরুণ। যা নিয়ে কখনো জিজ্ঞেস করেনি ডরোথিকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টোনির মার খাওয়া দেখল ও, কিন্তু প্রতিবাদ করল না। যা একেবারেই ওর সঙ্গে মেলে না।
অরুণ জিজ্ঞেস করল শেষে, শমিকে লেখা টোনির চিঠি তুমি পেলে কোত্থেকে?
ডরোথি বলল, টোনি চলে যাবার অনেকদিন পর শমিই এসে দিয়ে গেল চিঠিগুলো। বলল, এগুলো তোমার কাছে থাক, আমি অনেক চেষ্টা করেও পোড়াতে পারিনি। জিজ্ঞেস করেছি তোমরা কি সত্যি সত্যি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে ভেবেছিলে? শমি বলল—হ্যাঁ। ও ভীষণ, ভীষণ চাইছিল একটা সন্তান, যা তুমি ওকে দিতে পারনি। বললাম, কোথায় যেতে? শমি বলল—খুব দূরে কোথাও, যাতে আমার মা, কাকা, ভাইবোনদের কাছে আমার কোনো খবর কখনো না পৌঁছায়। যাতে ওরা ধরে নিতে পারে আমি মৃত। সেদিন আমি আর শমি দু-জনে দু-জনকে ধরে খুব কেঁদেছি। যাবার আগে শমি বলল, ডর, তোমার বন্ধুত্বের সম্মান আমি রাখতে পারিনি, আমায় ক্ষমা করো। আমি বলেছি, শমি, তুমি একটা ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ে। আমি তোমায় অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। টোনির হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর জন্যই ওকে ত্যাগ করেছি আমি।
অরুণের সব প্রশ্নই প্রায় শেষ হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে না এরপর কী আর জিজ্ঞাস্য থাকে। তবু জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের নিয়ে এই রোগের কথা কখনো জানতে চাওনি ওর কাছে? ডরোথি বলল, জানতে চাইনি আবার! শুধুই বলত, ইটস অল ইন দ্য ব্লাড। রক্তের দোষ।
-মানে।
-মানে বাবার থেকে পাওয়া।
—সেই বাবাকে নিয়ে জানতে চাওনি?
–বলত সব লেখা আছে, পরে পড়ে নিয়ো।
–পড়েছিলে?
—তখন দেয়নি। বলত দিস ইজ পার্সোনাল। আমাকে প্রমিস করিয়েছিল আমি কখনো ডায়েরি ছোঁব না। ছুঁইওনি।
—তাহলে যাবার সময় ফেলে গেল কেন?
—সেটাই ইন্টারেস্টিং। রাগারাগি করে অন্তত এক ডজন বার বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। প্রত্যেকবার সুটকেসে বাইবেল আর ডায়েরি সঙ্গে করে। শেষবার কিন্তু ডায়েরিটা ফেলেই গেল। ভেবেছিলাম ডায়েরির জন্যও যদি বা আসে। তবে…
কী মনে করে ডরোথির কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল অরুণ–পরে কবে পড়লে তাহলে?
উত্তর এল—শমির চিঠিগুলো পড়ার পর।
—তখন কী মনে হল?
—মনে হল কারও ডায়েরি নয়, যেন একটা উপন্যাসই পড়ছি। যে উপন্যাসে আমি নিজেও একটা চরিত্র।
—যেটুকু যা পড়েছি তাতে আমার নিজেরও তাই মনে হয়েছে।
–তাই না?
-আমি অবাক হয়ে গেছি ওর গল্প বলার ক্ষমতা দেখে।
—একেক সময় মনে হয় ও নিজের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে পেত।
–ও কবে শুরু করল এই ডায়েরি লেখা? মনে পড়ে?
—আমাদের আলাপের সময়ই দেখেছিলাম একটা খাতা ভরতি হয়ে আছে।
–এখন যখন ডায়েরিগুলো পড়া আছে কোন জায়গাগুলো তোমার সবচেয়ে পছন্দের?
—যে-জায়গাগুলো আমি কালো কালিতে কেটে তছনছ করেছি।
চমকে গিয়ে অরুণ বলল, সে কী! কোন জায়গা ওগুলো? আর কাটলেই বা কেন?
ডরোথি বলল, শমির সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ারের জায়গাগুলো। ডায়েরির আর কোনো জায়গারই তুলনা হয় না তার সঙ্গে। দোজ প্লেসেজ ওয়্যার অলমোস্ট ডিভাইন। তুমি দেখতে পাচ্ছ টোনি যেন পুজো করছে শমিকে…ওরশিপিং হার, লিটেরালি ওরশিপিং শমি। আমার এত ভাল লেগেছিল, তবু মানতে পারিনি। শমিকে লেখা চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেললাম। পরে ডায়েরির ওই শেষ খন্ডটাও পোড়াতে গেছলাম। পারিনি। তাই কালি বুলিয়ে কথাগুলো নষ্ট করে দিলাম।
ডরোথির কান্না শুরু হল। জল আসছিল অরুণের চোখেও। ও চোখের জল মোছার চেষ্টাও করল না। দু-জনে কোনো কথা বলল না বাকি সন্ধ্যে, নীরবে ধূমপান আর মদ্যপানে কেটে গেল সময়টা। ওঠার মুখে অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্রশ্ন গুছিয়ে তুলতে পারল অরুণ। আচ্ছা, ডর, সুকের কাহিনি তাহলে কি ওর চলে যাওয়া দিয়েই শেষ হবে? গল্পটা খুব কষ্টের হবে তাহলে।
ডরোথি একটা ছোট্ট রিং হাওয়ায় ভাসাতে ভাসাতে বলল, কেন, গল্পের নায়িকা আমাকে দিয়েই তো শেষ হতে পারে। নায়কের স্মৃতি নিয়ে পড়ে আছে নায়িকা… কিংবা মারা যাচ্ছে!
এনাফ! বলে ধমকে উঠল অরুণ। ওভাবে কথা বললে আমি আর আসব না। ডরোথি ছেনালির হাসি হেসে বলল, তা কী করে হয়? আমাকে তো গল্পটা অনুবাদ করে শুনিয়ে যেতে হবে।
অরুণ গম্ভীরভাবে বলল, হুম! কিন্তু গল্পের তো শেষ দেখতে পাচ্ছি না।
ডরোথি বলল, পাবে, পাবে। মন দিয়ে শুরু করো। না হয় আবার আসবে।
তাই তো মনে হচ্ছে—বলে এক ঢোঁকে গেলাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল অরুণ। শমির ব্যাপারটা হেঁটে দিয়ে বিপদ করেছ দেখছি।
কার বিপদ?—জিজ্ঞেস করল ডরোথি। তোমার না আমার?
দু-জনেরই-সংক্ষেপে জবাব দিল অরুণ।
কিছু না বলে নীরবে হাসল ডরোথি। অরুণ চলে যাচ্ছে দেখেও উঠে এল না দরজা অবধি। অরুণ খিল নামিয়ে দরজা খুলে ফেলেছে দেখে হঠাৎ বলে উঠল, অরু তুমি তো খুব পন্ডিত ছেলে, আমি তো কিছুই জানি না। তবে স্কুলে পড়া লর্ড টেনিসনের একটা কবিতার লাইন খুব মনে পড়ে। বলব?
অরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, নিশ্চয়ই! বলো, আমি শুনছি।
ডরোথি চোখ বন্ধ করে লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করল।
মনে আসতে একটু গলা ঝাড়ল, তারপর স্কুলের এলোকিউশন কন্টেস্টের প্রতিযোগীদের। মতো প্রবল অনুভূতি দিয়ে বলতে লাগল
Out flew the web and floated wide;
The mirror crack’d from side to side;
‘The curse is come upon me,’ cried
The Lady of Shalott.
ওর আবৃত্তি শেষ হলে অরুণ ‘ব্রাভো!’ বলে আস্তে আস্তে হাততালি দিল। তাতেও ডরোথি চোখ মেলল না।
অরুণ ইশারায় বিন্দিয়াকে দরজা বন্ধ করতে বলে ফ্ল্যাটের বাইরে চলে গেল।
৬.
অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে, পোশাক বদলে, টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে ফের ডায়েরি নিয়ে বসল অরুণ। এবার প্রথম খন্ড। আর খুলেই এক মস্ত চমক…
প্রথম পাতাতেই বেশ বড়োসড়ো করে তারিখ লেখা—১লা এপ্রিল, ১৯৫-। তারপর হেডলাইনের মতো করে লেখা ‘অল ফুলজ ডে’। বোকাদের দিন। আর ডায়েরির প্রথম বাক্যটা আরও তাজ্জব-করা
তিন সপ্তাহ হল বাবা মারা গেছে, ফলে সংসারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় সম্পূর্ণ ছিন্ন হল। তবে বাবা বেঁচে থেকেও যে খুব একটা সম্পর্ক বর্তাচ্ছিল তাও না। যতদিন যাচ্ছিল বাবা ক্রমশ একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়ে যাচ্ছিল। তাও এই লোকটার জন্যই আমি বম্বে ছেড়ে বেরোতে পারছিলাম না। কোথাও যাবার কথা উঠলেই বলত, দ্যাখ টোনি, আমরা আর্মেনিয়ান, তার ওপর ইণ্ডিয়াতে ফরেনার। এই বম্বেই আমাদের যথেষ্ট, অন্য কোথাও গিয়ে ঠাঁই পাব না।
আমি বলতাম, তা কি মরতে বম্বে এলে? সাইপ্রাসই তো ভালো ছিল।
তখন বলত, বাপ রে! কতগুলো মেয়েছেলে জুটে গেছল বল তো! তার মধ্যে তোর মা একটি।
আমি চুপ মেরে যেতাম। নাইটক্লাবের ম্যানেজার আমার পিতৃদেবটি যে-হারে মেয়েদের পেট বাঁধিয়ে যাচ্ছিল তাতে রাস্তাঘাটে ফুটফুটে ছেলেপুলে দেখলেই ভাই বলে ডাকার বাসনা হত। বলতে নেই, বাবার অজস্র আয়ের অনেকটাই খসে যেত মেয়েদের বাঁধানো পেট খালাস করতে। আজ যাবার স্মরণে এই ডায়েরি শুরু করতে এইসব কথা মাথায় ভিড় করে এল।
তবে আমার বাবা, আউগুস্ত সুক, সত্তর বছর বয়সে সদ্যমৃত (ঈশ্বর তার সহায় হন), খুব পাপী লোক ছিল না কিন্তু। ওর দোষ জীবনটাকে বড় ভালোবাসত, আর জীবন বলতে বেচারি বুঝত ওয়াইন অ্যাণ্ড উওমেন। মদ আর মেয়ের পিপাসা বাপটার মিটল না জীবনের শেষ দিন অবধি। বড়ো হওয়ার পর একটাই কথা শুনে এসেছি ওর মুখেইটস বেটার টু ডাই দ্যান নট টু বি এবল টু স্কু। সঙ্গম করতে না পারার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।
গত বছর গ্রান্ট লেন থেকে একটা ছুকরিকে তুলে বাড়ি আনছি দেড়া দাম দিয়ে..ফ্ল্যাটের সামনে এসে ছুকরি বলল, তুমি কি পিম্প?
আমি খচে গেছলাম, কী বলতে চাও, আমি দালাল?
ও তখন আমতা আমতা শুরু করল, না, মানে এখানে একটা খ্যাপা বুড়ো থাকে না?
বললাম, তাই বুঝি?
—তিন চার মাস আগে আমায় নিয়ে এসেছিল এখানে। অনেক টাকাও দিল। কিন্তু আমার বডি নিয়ে যা ছিনিমিনি করল জন্মেও ভুলব না।
কেন জানি না, লজ্জার বদলে খুব গর্বই হল বাবার এই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বললাম, বুড়োটা আজ নেই। জাহাজের পার্টিতে গেছে, কখন ফিরবে জানি না। তবে বুড়োটা আমার বাবা।
প্রচুর রাম খেলাম মেয়েটাকে নিয়ে, তারপর কী ঝোঁক চাপল কে জানে ফুর্তি করার সময় কেবলই জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, বুড়ো আর কী করেছে? বুড়ো কী করল?
বাবা যা যা করেছে ঠিক সেই সেই কান্ড ঘটিয়ে যেতে যেতে এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম। মেয়েটা বলল, বুড়ো এরপর আমার যোনিতে মাথা রেখে শীর্ষাসন করল। গুডনেস গ্রেশাস মি! সত্তর বছর বয়সের লোকটা এই সব করেছে! এই না হলে আমার বাপ!
আমি কাজকর্ম শেষ করে মাঝরাতে ছুকরিকে ভালো টাকা আর এক পাঁইট রাম দিয়ে বিদেয় করলাম। তারপর বাবার যৌবনকালের এক ছবির সামনে মদের গ্লাস তুলে টোস্ট করলাম—টু ইয়োর ইমটাল কক, ড্যাড! তোমার অবিনশ্বর লিঙ্গকে অভিবাদন, বাবা!
প্রচুর চাইনিজ এনেছিলাম সেদিন, কিন্তু খেলামটা কই? যা খাওয়ার মেয়েটাই খেয়েছিল। পরের পর রাম খেয়ে কখন যে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলাম জানি না, সকালে ঘুম ভাঙল লোকজনের ডাকাডাকিতে। দরজা খুলে দেখি বাবাকে সবাই চ্যাংদোলা করে আনছে। বুড়ো বেপ মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল জাহাজে। পরে জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু নড়ার শক্তি নেই। বাবার বন্ধু ভিকিকে বললাম, আঙ্কল, ওকে বাড়ি আনলে কেন? ওকে তো হাসপাতালে ভরতি করা দরকার।
দেড় মাস পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি হতে বাবা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল, আমিই আসতে দিইনি। ফাস্টলি, বুড়োর টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স কেয়ার দরকার। ওর হাতে ট্রেমর ধরেছে। সেকেণ্ডলি, বাড়ি ফিরলেই বুড়ো ফের রেণ্ডি খুঁজতে বেরুবে। বান্দ্রা চার্চের ওল্ড পিপলস হোমে রেখে আসার সময় খারাপ যে লাগেনি তা না। তবে ওর ভালোর জন্যই করতে হচ্ছিল।
আজ কিন্তু মনে হয় আমি বাবা আউগুস্ত সুককে বড়োরকম শাস্তিই দিচ্ছিলাম। আমি ওকে ওর যৌবন জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করলাম। না হলে বুড়ো হয়তো আরও অনেকদিন বাঁচত। কে জানে!
তবে ফি হপ্তায় যখনই গেছি বুড়োর একটাই অনুযোগ—এখানে সব কিছুই ভালো, টোনি। বাট নো ওয়ান কেয়ারস অ্যাবাউট মাই কক। আমার যন্তরটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।
একবার তো হোমের ব্যালকনিতে বসে বাপটা কেঁদেই ফেলে—মাই লাভলি কক ইজ ডাইং, সন। ইটস ডাইং। ও খিদেও ভুলে যাচ্ছে।
তখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি বাড়ি ফিরতে চাও, ড্যাড?
অনেক চিন্তা করে বাবা বলল, নো!
জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
খুব নিশ্চিন্ত স্বরে বাবা বলল, আই ডোন্ট থিঙ্ক আই ক্যান স্ক্র এনিমোর। আর ওই কম্মোটা করতে পারব না।
তখন বললাম অমন ভাবছ কেন ড্যাড? তোমাকে তো জানি, তাহলে তুমি বাঁচবেই না।
বাবা করুণভাবে মাথা নেড়ে বলল, ট্র। কিন্তু এটাই তো জীবন। তারপর একটু থেমে পড়ে বলল, কিংবা মৃত্যু।
আশ্চর্য, যেদিন ভোরবেলায় হোম থেকে বাবার মৃত্যুসংবাদ এল আমার বিশেষ একটা কান্না এল না। বরং মাথায় ভিড় করে এল সেই সব মেয়েদের মুখ যারা ভরিয়ে রেখেছে। আমার শৈশব, বাল্য, কৈশোর আর প্রথম যৌবনের স্মৃতি। যারা সবাই-ই বাবার সংগ্রহ, বাবার সুখের পাত্র, আদরের পাত্রী। যাদের সব্বাইকে বাবা আড়ালে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলত ‘হোল। গর্ত।
এমনকী আমার মাকেও। যে অবিশ্যি আমার সত্যিকারের মা নয়। আমি সেই প্রসঙ্গে আসছি। ডিয়ার ড্যাড কিছু মনে কোরো না। আমি তোমায় তেমন কিছু ঘেন্না করি না, বরং পছন্দই করি। তবে আমার এই স্মৃতিকথা তোমার শোনা দরকার, হেভেন বা হেল যেখানেই থাকো না কেন। এই স্মৃতিগুলো তোমার প্রাপ্য। তোমার জন্যই এই ডায়েরি শুরু করেছি, আর লিখেও যাব। আমি যে কিছুই ভুলিনি।
তোমাকে ভেবেই আজ এপ্রিল ফুলজ ডে-তে খাতা খুললাম। শুধু তুমি আর আমি নই, আমরা সব পুরুষমানুষই খুব বোকা। আমাদের ভালোবাসা বোঝার কোনো ক্ষমতাই নেই। তোমার তো ছিলই না, ভয় হয় আমারও নেই। তোমার হয়তো মনেও নেই আমার জন্মদাত্রী মা রেবেকা স্পিরোজ সুক তোমার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ না পঞ্চম স্ত্রী। যদি চার্চে মন্ত্র পড়ে, আংটি বদল করে শপথ নেওয়াটাকে তুমি বিবাহ বলে মনে করো। মা অবিশ্যি সবসময় বলত, তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে চার্চে, আর তুই হচ্ছিস আমার একমাত্র লেজিটিমেট চাইল্ড। তোর বাবার অন্য বউগুলো হল … না থাকগে।
একটা ব্যাপারে আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে চাই না—সাইপ্রাস ছেড়ে আসার জন্য। তুমি যতই কষ্ট দাও মাকে আমরা কিন্তু সব দুঃখ ভুলে যেতাম সকালে ঘন নীল সমুদ্রটার পাশে গিয়ে বসলে। খুব উত্তেজিত থাকলে আমরা ওই নীল জলে সাঁতার দিতাম অনেকক্ষণ। একেকটা বড়ো ঢেউ এসে শরীরের ওপর ভেঙে পড়লে মা চিৎকার করে উঠত–এসো, এসো! আমাকে ভাসাও! আরও জোরে মারো! এই যে আমি চিৎ হয়ে আছি।
এখন বুঝি সমুদ্রের ওই ঢেউ তখন তোমার কাজটা করত। তুমি যে সংসর্গ থেকে মাকে একটু একটু করে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলে সেই আহ্লাদগুলো মা কুড়িয়ে নিচ্ছিল জল থেকে। আর আমিও একটু একটু করে নিজেকে ভেবে নিতে শুরু করেছিলাম জলের সন্তান বলে।
বাবা, তুমি কি কখনো জানতে পেরেছিলে মা একটা গোটা বছর ধরে তৈরি হচ্ছিল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার জন্যে? আমিও পারিনি, তাই যখন ক্রিসস্তোমো ডে স্কুলে শেষবারের মতো মা বলল, তুমি খুব সাবধানে থেকো লক্ষ্মীটি। খবরদার একলা সমুদ্রে যাবে না। বাবার হাত ধরে যাবে। আমি বুঝতে পারিনি আমি মাকে শেষবারের মতো দেখছি। সেদিন গভীর সন্ধেয় সিরিকালিয়ন বিচে পাথরের ওপর মা-র ক্ষতবিক্ষত দেহটা খুঁজে পেয়ে তুমি যখন হাউ হাউ করে কাঁদছিলে আমার চোখ তখন কিন্তু শুকনো। আমার মনে হল মা এখন ঈশ্বরের কোলে, তুমি আর তাকে কষ্ট দিতে পারবে না।
আমি এসবের ছোট্ট ছোট্ট প্রতিশোধ নিয়েছি সারাজীবন। শেষ প্রতিশোধ তোমাকে হোমে পাঠিয়ে, আমি জানতাম তুমি যৌনক্ষুধায় মারা যাবে। আমি কি মার যৌন ক্ষুধা দেখিনি? তখন বুঝিনি মা ওভাবে সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরতে চাইত কেন, তবু বুঝতাম সমুদ্রের ঢেউকে কোলে নিয়ে মা বালিয়াড়িতে বিছানা পাতছে।
তবে প্রথম প্রতিশোধটা কবে জান? তুমি কল্পনাতেও পারবে না। এথেলরেড রুবিনা সুককে তোমার মনে পড়ে? তোমার কত নম্বর স্ত্রী কে জানে! তোমার মাতৃহারা সন্তানের ভার যার ওপর ন্যস্ত করেছিলে। ওর স্তন ও পাছার প্রশংসা করে শেষ করা যায় না।
ক্যাবারেতে গান গাওয়া গলা—অপূর্ব! যৌনকলায় ও-ই আমার প্রথম শিক্ষিকা। অত বড়ো শরীরে যৌনতার জাদুঘর বানিয়ে রেখেছিল আন্ট এথেল। ও চাইত আমি ওকে মা বলে ডাকি, আমি বলতাম—তা কেন? তাহলে তো সব মজা উবে যাবে।
আট থেকে চোদ্দ বছর অবধি আমার সেক্স টিচার ছিল তোমার তিন, চার কি পাঁচ নম্বর গিন্নি এথেলরেড রুবিনা সুক। তারও দাবি ছিল তুমি তাকে গির্জায় শপথ নিয়ে বিয়ে করেছ।
না, বাবা, আমার প্রতিশোধের ফর্দ এখনও শেষ হয়নি। আমার দ্বিতীয় মাকেও দেখেছি দিনে দিনে কীরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে তোমার থেকে। তোমার নাইটক্লাব যত ফুলে ফেঁপে উঠেছে খদ্দেরে আর টাকায় ততই তুমি সরে গেছ আমাদের জীবন থেকে। রাতই তোমার দিন ছিল, ভোর রাত ছিল তোমার ছুকরিদের নিয়ে ডেরায় ফেরার সময়। তুমি জানতেও পারতে না তোমার হিসাবরক্ষক ছেলেটি—মিখাইল ইগলেসিয়াস—কেমন টুকটুক করে বাড়ি এসে তোমার জায়গাটায় শুয়ে পড়ত। ঘণ্টা দুয়ক এথেলরেডের সঙ্গে খেলাধুলো করে বেশ ফিটফাট চেহারায় বেরিয়ে যেত। এসব কথা না বলার জন্য আমার ঘুষ কী ছিল জান? প্রথম প্রথম বাড়তি হাতখরচ। তারপর নতুন পোশাক-আশাক (ইগলেসিয়াসের মতোই স্টাইলিশ স্কার্ফ, কাফ লিঙ্ক, জুতো আমার পছন্দ ছিল), শেষে যৌনশিক্ষা। আমার সেই সব শিক্ষাদীক্ষার আমি সুনাম রেখেছিলাম—আমার যখন পনেরো বছর বয়স আর তুমি আঠেরো বছরের এক ছুকরিকে এনে ফেললে বাড়িতে আমার দ্বিতীয় মা এথেলরেড পরিষ্কার নির্দেশ দিল : টোনি, গো গেট হার। ধর শালিকে! আমি সময় নষ্ট করিনি, পনেরো বছর এক মাস বয়েসে স্টেফানি লুৰ্দেসকে দিব্যি বুজুকি মিউজিকের রেকর্ড চালিয়ে নাচে নামালাম, স্টেপিং মিলিয়ে কখনো হাত ধরছি, হাত ছাড়ছি, বুকে টেনে নিচ্ছি, জড়িয়ে ধরছি, ক্রমে গালে গাল রাখছি, চোখে চোখ, নাকে নাক, বুকে বুক, ঠোঁটে ঠোঁট…শেষে একসময় ওর সমস্ত কাপড় খুলে নিয়ে, নিজের সব পরিধান বিসর্জন দিয়ে ওর যোনিতে আমার লিঙ্গ। মিউজিক তখনও চলছে। আমরাও মিশে আছি এক অভিনব নাচে। শুনলাম স্টেফানি আমার কানে ফিসফিস করে বলছে, তুমি কি জানো তোমার বাবার সঙ্গে আমার আংটি বদল হয়েছে? এই দ্যাখো—বলে ওর এনগেজমেন্ট রিংটা দেখাল আমাকে। তাতে কী প্রমাণ হয় জান? ও জিজ্ঞেস করল। কী? আমি বললাম, দ্যাট আই অ্যাম আ মাদারফাঁকার।
বাবা, আমি বড়োই হয়েছি আমার চতুর্থ, পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ মা স্টেফানি লুৰ্দেস সুককে যৌনসঙ্গী করে। তুমি হয়তো এর কিছুই জাননি, জানলেও তোমার মনে হয় বড়ো একটা এসে যেত না। আমাকে পেয়েছিল বলে স্টেফানি আর তোমার অন্য বউ এথেলরেড আর ইগলেসিয়াসের কথা তোমার কানে তোলেনি। তবে এথেলরেড ভালোই চেষ্টা করেছে স্টেফানিকে বিষ খাইয়ে মারতে। পারেনি যে তা একান্তই আমার জন্য। আমার দ্বিতীয় মা টের পাচ্ছিল আমি স্টেফানির প্রেমে পড়েছি।
যাক, শেষপর্যন্ত কেউই মরেনি, কেউই তোমায় ছেড়েও যায়নি। বরং তুমিই সব্বাইবে ছেড়ে পালালে, সঙ্গে নিলে শুধু আমাকে। আমি বলেছিলাম এই সমুদ্র ছেড়ে যাব না। তাতে তুমি বললে, তাহলে সমুদ্রেই ডুবে মরতে হবে।
বললাম, কেন?
তুমি বললে, বিকজ আই হ্যাভ বার্নট অল মাই বোটস। আমার সব নৌকোই পুড়িয়ে ফেলেছি।
-কীরকম?
—আমার অ্যাকাউন্টে ইগলেসিয়াস আমার ব্যাবসার সব টাকা তছনছ করে, আমাকে লুঠ করে গ্রিসে পালিয়েছে, আমার চারদিকে এখন পাওনাদার, কারও কোনো পয়সা মেটায়নি লোকটা। আমার দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া গতি নেই।
তখন মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ‘এথেলরেডকে বলছ না কেন?’ চট করে কথাটা সামলে নিলাম। ঠিক করলাম নিজেই গিয়ে জিজ্ঞেস করব। মা তো আকাশ থেকে পড়ল—এই সেদিনও আমার দুটো হিরের নেকলেস বন্ধক রাখবে বলে নিল! হায় রে, আমার মন্দ কপাল! মা হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে বসল। হিসাবরক্ষকের হিসেবি কাজ দেখে ওই বয়সেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে।
তোমাকে বললাম, মা-দের কে দেখবে? তুমি একবার ওপরে আঙুল দেখিয়ে বোঝালে ঈশ্বর, তারপর প্যান্টের সাইডপকেটে থাবড়ে বোঝালে টাকা। আমি বললাম, ঈশ্বর যা করার তো করবেন, কিন্তু টাকাটা জোগাবে কে? তখন তুমি ক্লাবের ক্যাশবাক্স আমার সামনে ফেলে বললে, এর অর্ধেক টাকা তোমার আর আমার, বাকিটা দিয়ে গর্ত বোজাব।
মেয়েদের তাচ্ছিল্য করলে তুমি তাদের গর্ত বলতে। আমার ভালো লাগত না, তবু চুপ করে যেতাম। কিন্তু সেদিন পারিনি; বললাম, এই সব টাকা তোমার গর্তগুলোয় ফ্যালো। আমরা খালি হাতে দেশ ছাড়ব।
গর্তে যা ঢালার পরেও তুমি শেষ হাসি হেসেছিলে। বম্বেতে প্লেন থেকে নামার পরেও তোমার সুটকেস ভরতি মার্কিন ডলার। আমার আর জিজ্ঞেস করার রুচি ছিল না, তবে আন্দাজ করছিলাম ইগলেসিয়াসের সঙ্গে সাঁট করেই কান্ডটা তুমি ঘটিয়েছিলে। তোমাদের টার্গেট ছিল জর্জ এফেন্দি। নাইটক্লাবের মালিক। শরীরে তুর্কি এবং গ্রিক রক্ত। সারাজীবন গড়াগড়ি দিয়েছে হিরে জহরতের ওপর। তুমি আক্ষেপ করতে, শালা আমার শরীরের শেষ রক্তও নিঙড়ে নিচ্ছে, কিন্তু ভুলেও একটা বোনাস কখনো দিল না।
জানি না, এই ধারণাটা আমার ভুলও হতে পারে। খুব সম্ভবত ভুল, কারণ মা এথেলরেডের একটা চিঠি থেকে জেনেছিলাম যে, বছর দেড়েক পর ইগলেসিয়াস ফিরে গিয়েছিল সাইপ্রাসে মা-র কাছে। ওরা তখন সংসার বাঁধার পরিকল্পনা করছিল। আর স্টেফানি চলে গিয়েছিল বেইরুটে নাইটক্লাবে নাচিয়ে হয়ে। এসবই মা-র চিঠি থেকে জানা। তবে ইগলেসিয়াস ফিরে গেছে জেনে আমি তোমার এথেলরেডকে চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দিই। মা তার পরেও বেশ কটা চিঠি আমায় লিখেছিল, কিন্তু আমি সে সবের উত্তর দিইনি। আমার শেষ চিঠিতে লিখেছিলাম, তুমি বার বার কেন আমার ফিরে যেতে বল? বাবার মতো আমিও দেশে ফেরার নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি।
বাবা, আমার প্রতিশোধের কথাটাও বলে নিই? বম্বে এসে তুমি ফের এক রেস্তরাঁর ম্যানেজার হলে। আমায় বললে, টোনি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো। জাহাজে করে দেশবিদেশ ঘোরো। পারলে মাঝে মাঝে সাইপ্রাস হয়ে এসে আমায় গল্প শোনাও। উত্তরে আমি কী বলেছিলাম?—নো ড্যাড, সেটা হয় না, আমার সব নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি। উদবিগ্ন হয়ে তুমি কী বললে?—তাহলে তুমি কী করবে? আমার মতো রাতের পাখি হবে? আমি বললাম না। আমি আকাশের পাখি হব। তুমি ঠিক ধরতে পারোনি আমি কী বলতে চেয়েছিলাম। আমি তাই সহজ করে দিয়ে বললাম, আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যাব। তুমি খানিকটা গুম মেরে থেকে আপনমনে বিড়বিড় করে বললে, বুঝলাম।
আসলে তুমি কিছুই বোঝনি। তুমি বুঝতেই পারনি এ আমার এক ছোট্ট প্রতিশোধ ছিল তোমার সারাজীবনের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। তুমি চাইতে আমি সমুদ্রের জীবন নিই, কারণ সমুদ্রের হাওয়ার মধ্যেই আমরা মানুষ। অথচ ওই সমুদ্রই টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাকে, মা শেষবার বারণও করে গিয়েছিল একলা একলা জলে না যেতে। অথচ কার হাত ধরে আমি সমুদ্রে যাব বল? তুমি কি একবারও আমাকে হাতে ধরে জলে নেমেছিলে? শুধু বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে দূরে জাহাজ দেখিয়ে বলেছ—ওটা ইংলণ্ডেশ্বরীর জাহাজ! ওটা অ্যারিস্টটল ওনাসিসের জাহাজ! ওটা যুদ্ধের! ওটা মাল বহনের! ওটা প্রমোদতরণী!
কিন্তু আমি বেছে নিলাম উড়োজাহাজ। অনেকপরে চাকরিতে প্রথম মাইনে পেয়ে তোমায় কী উপহার এনে দিয়েছিলাম মনে আছে? একটা টাইপিন। তার বিশেষত্ব? সেটা একটা ছোট্ট সোনালি প্লেন! তারপর থেকে টাই পরলেই সে প্লেনটা তোমার বুকে শোভা পেত। আর তোমার কফিনে ছোট্ট কী একটা শুইয়ে রেখেছিলাম তোমার মাথার কাছে খেয়াল করেছ? ওটা একটা ছোট্ট জাহাজ, যার গায়ে আমি লিখে দিয়েছি একটা নাম—রেবেকা। মহিলাকে মনে পড়ে?
না, বাবা, আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই, এখন থেকে তোমাকে আরেকটু ভালোবাসার চেষ্টা করব। নানা শত্রুতা সত্ত্বেও আমরা তো বন্ধুই ছিলাম।
আমি জানি তুমি স্বর্গে নয়, নরকেই যেতে চাও। কারণ ওখানে ফুর্তি বেশি। কিন্তু তোমার পুত্র হিসেবে আমি চাই তুমি স্বর্গে যাও এবং যৌনতাবিহীন এক অনন্ত জীবনযাপন করো। কিন্তু তুমি যা জিনিস বাপ, তুমি ঠিক স্বর্গের দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে নরকে ফুটে যাবে। যেখানে হেলেন অফ ট্রয়, ক্লিওপেট্রা, মাতা হারি-রা তোমার অপেক্ষায়। আর ভয় নেই, কালে কালে আমিও নরকে তোমার সঙ্গী হব। ততদিন তুমি নরকে ফুর্তি করো, আর আমি মর্তে ততদিন সবরকম অবাস্তবতা সহ্য করে যাই।
অতএব বিদায়, প্রিয় আউগুস্তে সুক! মাতালদের মতো আর কান্না জুড়বে না; দ্যাখো আমার চোখ কত শুকনো।
চিঠির আকারে বাবাকে লেখা সুকের ডায়েরির প্রথম এন্ট্রি পড়েই বেশ চুপ মেরে রইল অরুণ। একটা সিগারেট ধরাল, দুটো টান দিয়ে বহুক্ষণ ভাবল—সুকের জীবনের যত জানছে ততই কেমন জটিল হয়ে উঠছে লোকটা। ওর নিজের দেখা ও জানা সুকের চরিত্রকে খুবই খন্ড, আংশিক, একপেশে মনে হচ্ছে। কাহিনি করে লিখতে গেলেও আরও আরও প্রেক্ষিতের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এক অ-অ্যাংলো প্রেক্ষিতের। কিন্তু কার হবে সেই প্রেক্ষিত? দুলালি? যে-মেয়েটিকে নিয়ে ইন্টালি সিনেমা হলে শাম্মী কাপুরের ‘দিল দেকে দেখো’ দেখতে গিয়েছিল বলে ডরোথি বারো দিনের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল? কিন্তু সে দুলালি কোথায় এখন? সে তো কবেই বিয়ে হয়ে আসামে। তাহলে সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়ে মাম্পু, যার পড়ার খাতা বাঁধিয়ে দিত সুক? কিন্তু মাম্পু কোথায়? তাদের গোটা পরিবারই তো কবে থেকে মিন্টো রো-ছাড়া! তাহলে… তাহলে… তাহলে কি দিদি শমি? ও কি রাজি হবে কিছু বলতে? জিজ্ঞেস করাটাও কি শোভন হবে? ওদের সুখী পরিবার…জামাইবাবু দীপেনদা খুব খোলামেলা, উদাস প্রকৃতির হলেও তার কি খারাপ লাগবে না?
নানা এলোমেলো প্রশ্নের মধ্যে ওর সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। অরুণ সেটা নিভিয়ে সুকের ডায়েরির অন্য পাতায় চলে গেল। কিন্তু খোঁচাটা ভেতরে থেকেই গেল। রাতের খাওয়ার সময় যখন টেবিল ছেড়ে উঠল তার মধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে। শনিবার অফ ডে
-সেদিন ভোরে জামশেদপুরে রওনা হবে।
রাতের ঘুমের মধ্যে দিদি শর্মিলাকে স্বপ্ন দেখল অরুণ।
—দিদি তোকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করব, কিছু মনে করবি না তো?
–অদ্ভুত প্রশ্ন! হঠাৎ অ্যাদ্দিন পর কী এমন অদ্ভুত প্রশ্ন গজাল?
–আগে বল মাইণ্ড করবি না।
—মাইণ্ড করলে উত্তরই দেব না।
—দ্যাটস জাস্ট লাইক ইউ!
–আগে বল প্রশ্নটা কী?
—আঁতোয়ান সুক, মানে আমাদের টোনিকে নিয়ে।
–টোনিকে নিয়ে হঠাৎ?
—ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব ভাবছি।
–কী মনে করে?
—ওর সেই ডায়েরিগুলো পেয়েছি।
–অ! আর দে ইন্টারেস্টিং?
—কী বলছিস ইন্টারেস্টিং? দে আর ফ্যাসিনেটিং!
–তাই?
–তাই।
—তা আমি কী করব?
–বলবি, টোনি তোকে ভালোবাসত কি না।
–তাই তো মনে হয়।
—আর তুই?
—সার্টেনলি। তুই তো সত্যটাই জানতে চেয়েছিস।
—নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!
–তাহলে ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি না কেন?
–কোথায় পালাতাম?
—যেখানে নিয়ে যেত ও?
—কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল জানিস?
—কোথায়?
–সাইপ্রাস।
—সব জায়গা ছেড়ে ফের সাইপ্রাস! সাইপ্রাস কেন?
–ও তখন ঠিক করেছিল ওখানে সমুদ্রের ধারে একটা ছোট্ট দোকান দিয়ে আমাকে নিয়ে থাকবে।
-তুই চাইলি না কেন? তুই তো চিরটাকাল প্রবল রোমান্টিক।
–কারণ আমি ওকে খোয়াতে চাইনি।
–খোয়াবার কথা ভাবলি কেন? ওখানে ওর ওই সব নারীসঙ্গের কথা ভেবে?
–না। ওর মার কথা ভেবে। ওর একটা সুপ্ত বাসনা ছিল সমুদ্রে নেমে হারিয়ে যাওয়া।
—কিন্তু তুই থাকতে…?
—আমি থাকতে মানে কী? তুই জানিস ও কখনো আমাকে টাচ করেনি?
—অথচ অত পাগলের মতো ভালবাসত?
—প্রিসাইজালি সেই কারণেই তো আমিও পাগলি হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বলেছিল, তোমাকে বিয়ে না করে ছোঁব না। আর বিয়ের দিন শুধু একটা আনুষ্ঠানিক চুম্বন দেব। আমাদের সত্যিকারের মিলন হবে সাইপ্রাসের সমুদ্র তটে ঢেউয়ের নীচে। আমি শিউরে উঠে বলেছি, সে কী কথা! আমি তো সাঁতারই জানি না। ও হাসতে হাসতে বলত তাতে কী? আমিও তো সাঁতার জানি না, শুধু জলকেই জানি।
—আর তার পরেও তুই ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি না?
—তাতে কী লাভ হত? তোর উপন্যাস মাঝপথে শেষ হয়ে যেত।
–সে তো এমনিই মাঝপথে দাঁড়িয়ে।
—তার কারণ তুই এখনও ডরোথিকে বুঝে উঠতে পারিসনি।
–তার মানে?
–তার মানে তাই! টোনির চেয়ে কোনো অংশে কম রহস্যময় নয় ডরোথি। জগুদাকে দিয়ে টোনিকে মার খাওয়ানোর পিছনেও ডরোথি। আর তোকে প্রথম কে নষ্ট করেছে বল! সত্যি করে বল, আমি সব জানি।
—ড-ডু-ড-ডরোথি।
–কতদূর গিয়েছিলি ওর সঙ্গে বল! কাম আউট ছোটা ভাই।
—পুরোটা!
—তাহলে শোন, টোনিকে বেঁধে রাখার ওটাই ছিল ওর শেষ চাল। টোনিকে বলেওছিল তুমি শমিকে নিয়ে পালিয়ে গেলে আমিও অরুণকে নিয়ে চম্পট দেব। আর শমি আর ওর ফ্যামিলি কোনোদিন সেটা মেনে নিতে পারবে না। ওর ফ্যামিলির কথা ভেবে শমি গলায় দড়ি দেবে। তুই জানতিস এসব?
–না।
–তাহলে আরও শোন। এইসব ভেবেই কাকা গিয়ে তোর হোস্টেলের ব্যবস্থা করে এল। আমাকে রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, লক্ষ্মী মা, একবারটি বাড়ির সম্মানের কথা ভাববা! আমরা কাকে মুখ দেখাব তুই ওকাজ করলে? মা বলল, শমি, আমরা চিরকাল থাকব না, কিন্তু তুই বাড়ির সম্মান… …মার আর কথা জোগায়নি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল, তবু বললাম, তোমরা কেঁদো না। আমি ও কাজ করব না, কথা দিলাম যখন এসব বলছি আমার চোখের সামনে কী দৃশ্য আসছে জানিস? শুধু তোর মুখ! তখন তোর কত বয়স বল?
–চোদ্দোর কিছুটা বেশি।
—আর তোকে নষ্ট করেছে ছাব্বিশ বছরের এক মেয়েছেলে।
–ওভাবে বলিস না প্লিজ! ও তো বলত আমি নাবালক, কিছুই বুঝি না।
–তাহলে নাবালকের সঙ্গে ওই ব্যবহার?
—ও তো এও বলল আমাকে যে তোকে বাঁচানোর জন্য টোনিকে ছেড়েছিল।
—আর তোকে বন্ধক রেখে!
–ওঃফ! তুই ফের সেই গাওনা ধরেছিস।
—ধরবই তো, টোনিকে আগলাবার জন্য ও সব কিছু করতে পারত। এই আমি বলে দিলাম। ও অসাধারণ গুণী মহিলা, কিন্তু টোনির ব্যাপারে শুধু অন্ধ বা পাগল নয়, একেবারে হিংস্র।
-তুই তো উপন্যাস লিখছিস, এগুলো একটু তলব কর। আর সত্যি বলব? নিজের। ভেতরটা ভালো করে খুঁড়ে দ্যাখ। কী তুই এখানে-ওখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছিস? সুকের ব্যাপারে সত্যিকারের কিছু লিখতে গেলে দুটোই তো চরিত্র—ডরোথি আর তুই!
সন্ধ্যেবেলায় শর্মিলাদের বাড়ির বাগানে দীপেনদার সঙ্গে হুইস্কি নিয়ে অনেক সময় কাটাল অরুণ। সুকের জটিল কাহিনির অনেক সূত্রই যেন ক্রমশ আলগা হয়ে আসছিল। দেশের রাজনীতি নিয়ে গল্প করতে করতে অনেক সময় অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল অরুণ। তখন দীপেনদা বলতে থাকলেন, আরে কী নিয়ে এত ভাবছ তখন থেকে? অফিসের সমস্যা? নাকি পৃথার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করলে? পৃথা অরুণের স্ত্রী, সে এই সুক-ডরোথির বৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গও জানে না। ও শুধু জানে বর একটা বড়োসড়ো লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
দীপেনদার প্রশ্ন সামাল দেওয়ার জন্য অরুণ বলল, ও কিছু নয়, একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি, থেকে থেকে ব্যাপারটা মাথায় ঘুরে আসছে।
দীপেনদা বললেন, তা গল্পের প্লট ভেবে বাস্তবকে ভুলে থাকা যায়? এই যে এমারজেন্সি ডেকে বসলেন মিসেস গান্ধী এও তো এক মস্ত প্লট। মানে চক্রান্ত। নয় কি?
দু-জনে এক প্রস্থ হাসির তোড়ে নতুন করে ড্রিঙ্ক ঢালল। অরুণের মনে পড়ল এক একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ—দাবা। শমির কথায় হঠাৎ করে ওর কাহিনির সাজানো দৃশ্যটাই তছনছ হয়ে গেল, খেলাটা এখন দাঁড়িয়ে গেছে পুরোপুরি নিজের সঙ্গে। অরুণের মনে পড়ল সেই দুপুরবেলা যেদিন ডরোথি টোনির সঙ্গে ঝগড়া করে ওর হাত ধরে বেরিয়ে গেল ম্যাটিনি শোয়ে একটা হলিউডি ছবি দেখতে। হল খালি তবু ব্যালকনির একেবারে পিছনের সিট নিল। হলের আলো নিভতে ওর গায়ে হাত দিল। এক সময় গালে চুমু দিল, তারপর ঠোঁটে, তারপর ওর হাতটা নিজের বুকের ওপর রাখল, আর বলল, এটা তোমার, তুমি খেলতে পারো।
শমির ওখান থেকে ফিরে ছ-সপ্তাহ চলে গেল। প্রথম হপ্তা জুড়ে সুকের সবগুলো ডায়েরি পড়া হল অরুণের। বাকি পাঁচ হপ্তা ধরে লিখেই চলেছে, কিন্তু ওর উপন্যাস কোথাওই যাচ্ছিল না। অনেকগুলো প্রেক্ষিতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর দুটো সুন্দর রাস্তার মধ্যে পথ হারাচ্ছিল-মিন্টো রো আর মিন্টো লেন। বার বার মনে পড়েছিল দিদি শমির কথা; চরিত্র তো দুটোই-ডরোথি আর তুই!
ভাবলেই একটা শেলের মতো বিধছিল কথাটা। সত্যিই তো ডরোথিকে সেভাবে ঘাঁটিয়ে দেখেছে ও? কিংবা নিজেকে? নিজের ভেতরেই কুড়িটা বছর ধরে লুকিয়ে থেকে থেকে ডরোথির সঙ্গে সম্পর্কটা ওর কোথায় যে তলিয়ে গেছে। সেই ঘুমিয়ে থাকা সাপটাকেই খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে শমি। সিগমণ্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণে যাকে বলা হচ্ছে ইমার্জেন্স অফ দ্য রিপ্রেসড। দমিত অনুভূতির নবজাগরণ। অরুণ বুঝতেই পারছে না ওর লেখায় নিজের এই অদৃশ্য নাটক কীভাবে চিত্রিত করবে। নিজের প্রেক্ষিত নিয়ে মাথা ঘামালেই তো সেইসব ছবি সিনেমার রিলের মতো নিজেদের মেলে ধরছে। আর ছবি মানেই তো…।
প্লেন নিয়ে একটা ছবির বই দেখছিল অরুণ, হঠাৎ চোখ তুলে দেখল একটু দূরে পোশাক বদলাচ্ছে ডরোথি। ওকে ডাকল, অরুণ আমার ব্রার হুকটা একটু লাগিয়ে দিয়ে যাও প্লিজ! অরুণ কাঁপা কাঁপা হাতে হুকটা লাগাতে গিয়ে দেখল তড়াং করে ইলাস্টিকটা ছিটকে গেছে। ডরোথির বুক থেকে নেমে এসেছে ব্রেসিয়ারের কাপ দুটো। ডরোথি ঘুরে ব্রা-টা ফেলে দিল কার্পেটে আর ঘুরে দাঁড়াল অরুণের দিকে। বলল, ভালো করে দ্যাখো ও বলো কেমন লাগছে।
অরুণের হাত আপনা-আপনিই উঠে গেল ওই অপরূপ বুক দুটোয় আর মুখ দিয়ে শুধু একটাই কথা বেরুল—সুইট!
একটু থেমে ফের বলল, বিউটিফুল!
তারপর আরেকটু থেমে, আই লাভ ইউ, ডর!
তখন ডরোথিই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল।
অফিস থেকে ফেরার পথে ফের এক বোতল রাম, দু-প্যাকেট বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস আর নিজামের রোল নিয়ে ডরোথির ফ্ল্যাটে চলে এল অরুণ। পৃথা দু-দিনের জন্য মামাবাড়ি মিহিজামে গেছে। গল্পের সন্ধানে বেশি রাত অবধি ডরোথির সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে নেই। কাহিনির শেষ যে কোথায় হবে তার কোনো হদিশ এখনও করা গেল না। লাভস্টোরিটা বিয়োগান্তক হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু বিয়োগটা কোথায়, কীভাবে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া দরকার। নাহলে পুরো কাহিনিটাই এক অস্থিরমতি অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানের অবিশ্রাম নারীবিলাস হিসেবে ঠেকবে। আর এই এতগুলো বছর একলা থেকে ডরোথি নিজেই বা কী করেছিল?
ডরোথির ফ্ল্যাটে এসে নক করে অন্ধকারে দাঁড়িয়েই অরুণ শুনতে পেল ডরোথি বসার ঘরে বসে কাশছে। বেশ ভালোই কাশি ধরেছে ওকে। অরুণ আবার নক না করে ঠেলা দিতে দরজাটা এক বিচিত্র আওয়াজ করে খুলে গেল। ও ভেতরে পা রাখতেই দেখল হল ল্যাম্পের মায়াবী আলো-আঁধারিতে ডরোথি সুকের উপহার করা ইভ মর্ত-র গানের রেকর্ডটা গ্রামে বসানোর উদ্যোগ করছে। অরুণকে দেখে একই সঙ্গে অবাক আর খুশি হয়ে বলল, তুমি? হাউ স্ট্রেঞ্জ! আজকেই তোমার কথা ভাবছিলাম।
–আমার কথা ভাবছিলে? কেন? লাভস্টোরি তো এখনও শেষ হয়নি।
—আসলে আমার একটা উকিল চাই, এ ব্যাটা বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাঙবে বলে জ্বালিয়ে মারছে।
অরুণ ওকে আশ্বস্ত করে বলল, ছাড়া তো! ভাঙব বললেই হল। সে আমি তোমাকে ভালো উকিল দিয়ে দেব।
ডরোথি নরম করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, ডিয়ার!
তারপর অরুণের হাতের জিনিসপত্তর দেখে বলল, আবার অত সবের কী দরকার ছিল? আমার এখানে রাম আর সিগারেটের অভাব রাখি না।
অরুণ কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলল, জাহাজি বন্ধু ডিকির দৌলতে তো?
ডরোথি বেশ আহতই হয়েছে। খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমি নিজেই চেয়ে নিয়েছি কাল এই অ্যানিভার্সারির জন্য।
অরুণ অবাক হয়ে গেল, কীসের বার্ষিকী? তোমার জন্মদিন? ডরোথি ঘাড় নাড়ল, না।
–টোনির বার্থ ডে?
ডরোথি ঘাড় নাড়ল, না।
-তাহলে তোমাদের বিবাহবার্ষিকী?
-না, তাও না।
-তাহলে?
ডরোথি কীরকম একটা আবছা গর্বের সঙ্গে বলল, টোনির ফিরে আসার।
গোটা আকাশটাই যেন ভেঙে পড়েছে অরুণের মাথায়—হোয়াট ডু ইউ মিন, ডর? টোনি ফিরে এসেছিল।
ডরোথি খুব শান্ত আর বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল—হ্যাঁ।
থরথর করে কাঁপছিল অরুণের গলা যখন জিজ্ঞেস করল-কবে?
ডরোথির ফের সেই শান্ত, বিষণ্ণ জবাব—চলে যাওয়ার দু-বছর পরে। তখন তোমরা কেউ আর এখানে ছিলে না।
—পৃথিবীর আর কেউ সেটা জানল না?
–আমি জানতে দিইনি।
—কারণ?
–তাহলে ওকে নিয়ে যেত আমার কাছ থেকে ওরা।
—সে আবার কী! নিয়ে যেত কেন?
–ন্যাচারালি কবর দেওয়ার জন্যে।
কবর দেওয়ার জন্যে? কেন, ও কি মরে গেছিল নাকি?
—হ্যাঁ! এই আমার কোলে। ও ফিরে এসেছিল আমার কোলে মরবে বলে।
–কোত্থেকে এসেছিল?
—আমি জানি না।
–সত্যি কথা বলো, ডর। গল্পের জন্য আমার জানা দরকার। ডোন্ট হাইড।
—আমি সত্যিই জানি না, অরু।
–তাহলে কী জান তুমি?
—শুধু এটাই যে শেষবারের মতো শমি ওকে না বলেছিল। শমির তখন বিয়ে ঠিক হয়ে। গেছে। আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শমি বলেছে গো ব্যাক টু ডর!’
—তাতে ও তোমার কাছে ঘুরে এল?
-না, ও আসেনি। সাতদিন ওর মদের সঙ্গী ছিল ডিকি আর আসরানি। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আমাকে ডরোথির কাছে পৌঁছে দে। মাঝরাতে ওরা যখন ওকে রেখে গেল, ও মারাই যাচ্ছে। আমি নিজেই যা পারলাম যত্ন করলাম, কিন্তু ডাক্তার ডাকিনি।
-কেন ডাকলে না?
—কোনো লাভ ছিল না, ও চলেই যেত।
—তো কী করলে শেষ অবধি?
—আমি ওকে একটা খুব প্রাইভেট বেরিয়াল দিলাম। খুব নির্জন কবর।
—নির্জন কবর? কোথায়?
ডরোথি একটা ডিকির গিফট করা সিনিয়ার সার্ভিস সিগারেট ধরাল আর একটা অফার করল অরুণকে। তারপর ওর হাতটা ধরে বলল, এসো, দেখে যাও।
ডরোথির হাত ধরে অরুণ ওদের বসার ঘরের পেছনের ডাইনিং রুম পেরিয়ে স্টোর রুমের ভেতরে ঢুকল। তার এক ধারে একটা বন্ধ দরজা। কী একটা ড্রয়ার খুলে একটা লম্বা চাবির গোছা বার করল। তারপর মিটসেফের ওপর থেকে একটা চার ব্যাটারির টর্চ নিয়ে বলল, এসো অরু। বাল্যে, কৈশোরে কত কত বার এই বিশেষ দরজাটা দেখেছে অরুণ। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি ওটার ওপারে কী। একবার সুক আর মাম্পুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেও ওই দরজাটার পিছনে লুকোবার বাসনা হয়েছিল ওর। কিন্তু তখনও জানা হয়নি দরজাটা কীসের।
ডরোথি ইশারাতে বিন্দিয়াকে বলল বসার ঘরে যেতে আর দরজা খুলে অরুণকে বলল, সাবধানে নামো।
ডরোথির মস্ত টর্চের আলোয় অরুণ দেখল বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে একটা সেলারের মধ্যে। সাহেবরা বলবে সেলার, এদেশীয়রা গোপন কুঠুরি। সিঁড়ি দেখিয়ে নামতে নামতে ডরোথি বলল, মা-র কাছে শুনেছি একসময় এর ব্যবহার হত বন্দুক আর কার্তুজ রাখার জন্য।
অরুণের খুব ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে কার বন্দুক, কার কার্তুজ। কিন্তু তার আগেই ওর চোখ গেছে এক মস্ত লম্বাটে বাক্সের দিকে। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে চেস্ট। ডালা দেওয়া প্রকান্ড বাক্স। অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোয় ডরোথি ওর গোছর একটা চাবি দিয়ে খুলে ফেলল বাক্সের তালাটা। তারপর নীচু স্বরে অরুণকে বলল, একটু হাত লাগাও।
দু-জনে মিলে ঠেলে ডালাটা তুলে ধরতে এক বিকট গন্ধে পা থেকে মাথা অবধি ঝাঁকিয়ে উঠল অরুণের। ও হাতের সিগারেটে লম্বা টান মেরে নাকের বোধটা মারার চেষ্টা করল। ডরোথি দিব্যি ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে বাক্সের কাপড়ের বাণ্ডিলগুলো সরাতে লাগল। বাক্সের মধ্যে কত যে সুগন্ধির বোতল ছড়ানো, যাদের সব গন্ধই জলাঞ্জলি হয়েছে শবের গন্ধ মারতে। একে একে ডরোথি সরাল ম্যাক্স ফ্যাক্টর, কোটি, পাট্টা, ইভনিং ইন প্যারিসের সব মহার্ঘ শিশি। শেষে এক বিবর্ণ গোলাপি চাদর টেনে তুলতে হুস করে ভেসে উঠল পচা, গলা এক দেহ যা বস্তুত কঙ্কালসর্বস্ব। ভয়ে শিউরে উঠেছিল অরুণ, কিন্তু ডরোথি সেই পূর্বের মতো শান্ত। বলল, বছরে বেশ কবার ওর বেশভূষা পালটে দিই। গলে পড়া শরীরের সবকিছু বার করে দিয়েছি। তবু এই গন্ধটা থেকে গেছে। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি। দ্যাখো, কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে টোনি!
অরুণ দেখল শুধু একটা কঙ্কালের চোখের শূন্য কোটরে ক্লান্ত অন্ধকার। না বলে পারল, এভাবে একটা বডিকে বাড়িতে পুষে ঠিক করোনি, ডর। কঙ্কালটা মুক্তি চাইছে।
ওর কথার নিষ্ঠুরতায় চমকে গিয়েছিল ডরোথি। ফের পরিপাটি করে বাক্সটা গুছিয়ে ভারী ডালাটা নামিয়ে রেখে বলল, এভাবে ওকে রেখে দিতে পেরেছিলাম বলেই তো তুমি তোমার গল্পের গ্র্যাণ্ড ফিনালি পেয়ে গেলে, তাই না? এরকম একটা ভয়াবহ সেটিং ছাড়া তুমি টোনির অবিশ্বাস্য জীবনের শেষ দেখাতে কীভাবে? একটা প্রেমের উপন্যাসের এরকম এক ভয়াবহ শেষ কি খুব খারাপ?
অরুণ এসব কথার কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। জুতোয় মাড়িয়ে হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে চুপ করে উঠে এল বসার ঘরে। গ্রামে বসামো ইভ মত-র প্রেমের গানটা চালিয়ে দিয়ে এক পাত্র রাম নিয়ে বসল। একটা ড্রিঙ্ক বানিয়ে রাখল ডরোথির জন্য।
একটু পর ডরোথি দিব্যি সেই পুরোনো দিনের স্টাইলে সেজেগুঁজে, গায়ে অপূর্ব পারফিউম ছড়িয়ে এসে বসল। গান শুনতে শুনতে রাম খেল, স্মোক করল, এক ফাঁকে ন্যাট কিং কোলের ‘রেনড্রপস আর ফলিং অন মাই হেড’ চালিয়ে দিল, তারপর আরেক ফাঁকে এলভিসের ‘লাভ মি টেণ্ডার, লাভ মি ঠু’ চালিয়ে দিল, কিন্তু একটাও কথা উচ্চারণ করল না। কেমন যেন ভুলেই গেল যে ওর সামনে কেউ বসে আছে।
কত রাত অবধি গান, পান, ধূমপান চলল কিন্তু বহু চেষ্টাতেও অরুণ আর ওকে কথা বলায় ফেরাতে পারল না। অরুণ বুঝতে পারল ডরোথির চারপাশ ঘিরে তখন শুধু টোনি, টোনি আর টোনি। মদের প্রভাবে কখন এক সময় ডরোথির উলটো দিকের সোফায় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল অরুণ।
তখন গানও বন্ধ হয়ে গেছে, বিন্দিয়া এসে না খাওয়া রোলের প্লেট, মদের খালি গেলাস সব তুলে নিয়ে গেছে। এক দফা কাশির পর নিজের সোফায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে ডরোথি। বিন্দিয়া ঘরের বাতিটাও নিভিয়ে দিয়েছে।
সকালের এক টুকরো রোদ এসে মুখে পড়তেই ধড়মড় করে জেগে উঠল অরুণ। হাতের ঘড়িতে দেখল আটটা। আরেক টুকেরা রোদ দেখল পড়েছে ডরোথির আজও সুন্দর মুখটায়। একবার ডাকবে মনে করল ওকে, পরমুহূর্তে ভাবল, না থাক। কী সুন্দর হাসি হাসি মুখে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো ভোর রাতের স্বপ্নে এসেছে টোনি। শিশুদের মতো দেয়ালা করছে যেন আশ্চর্য নারীটি।
কিছুদিন আগে টেনিসনের ‘দ্য লেডি অফ শ্যালট’ থেকে কী সুন্দর আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল। যেন নিজেরই বর্ণনায় ওই আবৃত্তি। তা শুনে অরুণ হাততালিও দিয়েছিল, কিন্তু ডরোথির কোনো সাড়া পায়নি। আজও ডরোথির সাড়ার অপেক্ষায় নেই ও, নিদ্রিত নায়িকার রোদে রাঙানো মুখটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে কবিতার এক অন্য অংশ থেকে আবৃত্তি শুরু করল অরুণ
But Lancelot mused a little space;
He said, ‘She has a lovely face;
God in His mercy lend her grace,
The Lady of Shalott.’
ফ্ল্যাট থেকে দিনের আলোয় বেরিয়েই অরুণ ভেতরে ভেতরে টের পেল ওর উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু কে। সেটা সুক নয়, দিদি শমিও নয়, ও নিজেও নয়। কাহিনির কেন্দ্রে একটাই নায়ক কিংবা নায়িকা, আর সেটা ডরোথি রবার্টস সুক। ডরোথির সেই কাহিনি একই সঙ্গে প্রেমের এবং খুনের। শেষবারের মতো ফিরে আসা নায়ককে খুন ও গুম করে নিজের প্রেমকাহিনিকে এক অপূর্ব মাত্রা দিয়ে ফেলেছে মেয়েটা। আর এখন স্বপ্নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়ে শুয়ে শুয়ে হাসছে। মৌলালির মোড়ে এসে একটা ট্যাক্সি ধরল অরুণ; পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখের কোণে জমা জল মুছল। লেখকদের এত সহজে নাকি কাঁদতে নেই, লেখার ক্ষতি হয়।
আমার পাড়ার মেয়েরা
একেকটা জানালা, একেকটা বারান্দা যেন এক-একটা সিনেমার পর্দা আমার। সেখানে মর্নিং শো আছে। ম্যাটিনি-ইভনিং-নাইট শো-ও আছে। আমি বেলায় বেলায় একেকটা ছবি দেখি এক এক পর্দায়, আমার ছাদের একেক আলসের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার নায়িকারা কেউ সোফিয়া লোরেন, কেউ সুচিত্রা সেন, কেউ নূতন কিংবা ওয়াহিদা। একেক বেলায় সকাল, দুপুর কি বিকেলের রোদের একেক লাইটিঙে। একেকে মেজাজে আমি পাই আমার নায়িকাদের।
আমার দুটো বিলিতি নায়িকা, বাকিরা দিশি। আমাকে এখনও সিনেমা হলের অ্যাডাল্ট ফিলমের ঢুকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু আমার এই ছাদের ব্যালকনি সিটের থেকে দিনের পর দিন আমি নানা রঙের প্রাপ্তবয়স্ক ছবিতে মজে আছি। ঠিক এই মুহূর্তে আমার সামনে আমার নায়িকা মার্লিন ওয়াটসন। যার আমি নাম রেখেছি সোফিয়া লোরেন।
মার্লিন এইমাত্র ওর বর সিরিলের সঙ্গে একপ্রস্থ ঝগড়াঝাঁটি, হাতাহাতি করে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফর্সা মুখটা ওর রাগে গোলাপি হয়ে আছে। কান্নাকাটির জন্য চোখ দুটো ফোলা ফোলা। মুখে বিড়বিড় করে কী সব বলতে বলতে হন বন করে ছুটছে মোড়ের দিকে। সিরিল একবার বারান্দায় এসে গর্জন করে বলল, মার্লিন! ডোন্ট গে। লেট মি এক্সপ্লেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
এই মুহূর্ত থেকে বলা যায় মার্লিন কিছুক্ষণের জন্য আমার বান্ধবী হয়ে গেল। সিরিল যেই মুখের জ্বলন্ত সিগারেট রাগের মাথায় ‘শিট!’ বলে ছুঁড়ে ফেলে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল আমি মার্লিনকে আমার হৃদয়ের মধ্যে আঁটোসাঁটো করে পুরে ফেললাম। আমার মনের ভেতরের ফিলম প্রোজেক্টরটা ভোঁ করে চালু হয়ে গেল।
পরিষ্কার করে বলি বরং—মার্লিনকে আমার ভীষণ ভালো লাগে! কী সুন্দর ফর্সা গোলাপি রং। লাল টুকটুকে ঠোঁট! সোনালি চুল ঘাড় অব্দি গড়াচ্ছে; চোখে মেমসায়েবি চাউনি (অ্যাংলোরা মেমসায়েব বই কী!) হিলহিলে শরীর দুলিয়ে খটখট হাঁটা, আর আমাকে দেখলেই একগাল হেসে হাউ আর ইউ, নিটু? সম্বোধন সব কিছু আমাকে ভেতরে ভেতরে পাগল করে দেয়। মনে হয় ছুটে গিয়ে ওকে জাপটে ধরে একটা চুমু দিই ওর বর সিরিলের কায়দায়!
হ্যাঁ, সিরিলের এইসব চুমু আমি দেখি একেক সন্ধ্যেয় ছাদের পড়ার ঘর ছেড়ে সামনের আলসেতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। প্রায় খেয়েই ফেলে যেন বউয়ের মুখটা ওই পেটুক সাহেব। আমার শরীরের ভেতরটা কীরকম কীরকম যেন করে। মনে হয় হৃৎপিন্ডটা লাফাচ্ছে। একটু একটু লজ্জা করে, বেশ মজাও পাই। আবার কীরকম একটা দুঃখও হয়।
অ্যাংলো সায়েব মেমদের বোধ হয় লজ্জা-টজ্জা কম। জানলা হাট করে খুলে কেউ এই সব করে! অবিশ্যি রাতের বেলায় অন্ধকারে ছাদে দাঁড়িয়ে কে কী দেখল, তাতে আর কী এসে যায় ওদের?
কিন্তু আমার এসে যায়। অত সুন্দরী কারও গা থেকে একটা একটা করে জামা খুলে নিলে আমার ভয়ানক বিপদ হয়। আমার শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। হাতের তালু ঘামে, মাথা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে জমা পড়া সারাদিনের পড়াশোনা কপূরের মতো উবে যায়। ভাবনা হয় মা বা কাকা এইসব জানলে কী সব্বোনাশ! অথচ সাপুড়ের বাঁশির মতো দৃশ্যটা দুলে দুলে আমার মনের ভেতরেও জেগে ওঠা সাপটাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। আমি জায়গা ছেড়ে নড়তেও পারি না। একেক দিন এমন মনে হয়েছে হাঁটুর নীচ থেকে আমার পা দুটো কেউ কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছে।
তবে সেই সন্ধ্যায় যেদিন সিরিল মার্লিনের বডিসটাও খুলে নিয়ে ওর দুধের মতো সাদা বুকে মুখ ঘষতে লাগল, আমি ভয়ের চোটে ছাদের অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে পালিয়ে গিয়েছিলাম। যেন ভূত দেখেছি। আর পড়বি তো পড় গিয়ে সটান রাঁধুনি বড়ো ঠাকুরদার সামনে। সে আমার ওই অবস্থা দেখে ভড়কেই গিয়েছিল। আমার দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, কী হইয়েছে তুমার সাহিব? ভূত দেখিয়েসো নাকি? আমি ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্য বললাম, না, না, কিছু না। সিঁড়ি অন্ধকার তো, ভয় খেয়ে গেছি। বড়ো ঠাকুরদা আমার দুই চোখে চোখ ফেলে বললে, আলবৎ কুসু দেখেসো। কত্তো বড়ো চোখ হইয়েছে তুমার। শেষে রাগের মাথায় বলেই ফেললাম, হ্যাঁ, তাই হয়েছে। আমি ভূত দেখেছি।
আর এই এখন যে সিরিলের সঙ্গে ঝগড়া করে বেরিয়ে গেল মার্লিন। আমি চিলেকোঠার পড়ার ঘরে ঢুকে মনের ভেতরের প্রোজেক্টর চালিয়ে ওই দৃশ্যগুলো দেখা শুরু করব। মনের দগদগে ক্ষতের মতো দৃশ্য সব। যার কিছু ভোলা যায় না। কেবল সিরিলের জায়গায় পুরুষটা হয়ে যাব আমি। আমি তখন একটা একটা করে জামা খসাব মার্লিনের শরীর থেকে, শেষে বেরিয়ে আসবে ওর ওই দুধ সাদা বুক, আর…
নীতু! নীতু! নীচ থেকে হাঁক কাকার। আমি উত্তর করলাম যাই কাকা! বলে নামতে লাগলাম ছাদের সিঁড়ি বেয়ে। আর ভেতরে ভেতরে গজরানি আমার নাঃ! এ জীবনে শান্তি বলে কিছু নেই। নিজের মতো একটু থাকব তার জোর নেই।
কিন্তু কাকার সামনে পড়ে এক্কেবারে থমকে গেলাম। কাকার মুখ কী গম্ভীর। কেমন ব্যথা ব্যথা ভাব। আমি ভাবতে বসলাম, কী এমন করেছি যে কাকার এত কষ্ট হল। আমি চুপ করে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কাকা বলল, তোমার বন্ধুরা আজ শহর ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে, ওদের মা তোমাকে আজ ওদের ওখানে যেতে বলে গেলেন। তুমি যেয়ো।
আমি বুঝেই উঠতে পারলাম না কাকা বন্ধু বলতে কাদের কথা বলছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কাদের কথা বলছ, কাকা?
কাকা বলল, কাদের আবার? তোমার ওই ডম্বল আর ডোম্বলের কথা। মৃণালিনী বলছিল ওদের বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসারে অভাব লেগেছে। ওদের তাই মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়েছে। আর দুপুরে মামা এসে নিয়ে যাবেন ওদের।
ভেতরটা অসম্ভব মোচড়াতে শুরু করল। একটা কান্না কাঁদতে ইচ্ছা হল। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, মামাবাড়ি কোথায়?
কাকা বলল, আসামের কৈলাশহরে!
আমার ভেতরটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ডম্বল আর ভোম্বল তাহলে চলে যাবে? আমার ওই নিত্যদিনের সঙ্গীরা না থাকলে কার সঙ্গে পুজোর সকালে শিউলি কুড়োতে যাব? কাদের সঙ্গে গিয়ে ভিড় বাড়াব রথের মেলায়? দেশলাইয়ের টেলিফোন বানিয়ে কাদের সঙ্গে মনের কথা কইব? কাদের সঙ্গে গিয়ে দুপুরবেলায় বসে ‘অনুরোধের আসর’ শুনব? কে আমাকে প্রশ্ন করবে, আচ্ছা নীতু, তুই তো ইংরেজিতে পন্ডিত। বল তো ইংরেজিতে প্রেমিক শব্দের মানে কী?
মনে আছে ওদের ওই প্রশ্নটার উত্তরে বললাম, লাভার। তাতে দিগগজ ডাম্বল বলল, ধ্যাত! সেদিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম উকিল বংশীকাকা বলছে প্রেমিকের ইংরেজি ‘প্রস্টিটিউট। আমি তখন ভয়ঙ্কর তাচ্ছিল্যের কন্ঠে শুনিয়ে দিয়েছিলাম, তোমার মাথা আর বংশীকাকার মুন্ডু। প্রস্টিটিউটের মানে হল খারাপ স্ত্রীলোক।
তখন ভোম্বল মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, তাহলে তো ঠিকই হল। প্রেম তো খারাপ স্ত্রীলোকেরাই করে। তাই না?
আমি আর কথা বাড়াইনি। শুধু মনে মনে বললাম, মূর্খদের জ্ঞান দিয়ে লাভ নেই। যা জেনেছে তাই জানুক।
আর এখন সেই মূর্খদের জন্যে প্রাণ কাঁদছে আমার। কাকাকে বললাম, ঠিক আছে, যাব।
সকাল কেটে দুপুর হতে যে কত সময় লাগল তা ভগাই জানে। বইয়ের পাতা উলটোচ্ছি আর ডম্বল-ভোম্বলের কথা ভাবছি। স্নান করছি আর ওদের মুখ দুটো চোখের সামনে। ভাসছে। আর তারপরই ওদের দুই দিদি লালিমা আর গরিমার মুখ। আমরা শর্ট করে ডাকি লিমা আর রিমা বলে। ভাবছিলাম কে আর এরপর ওদের জন্য সুচিত্রা উত্তমের ছবির ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট কেটে এনে দেবে। কে ওদের জন্য পাড়ার জগুদার হোলনাইট ফাংশনে সিট ধরে রাখবে। কে ওদের কাছে ফুচকার পয়সা চাইবে? কে আর আমাকে ওদের বাথরুমের দরজার ফুটোর সামনে বসিয়ে বলবে দিদিরা চান করছে। দেখবি?
আমি সেই ফুটোতে চোখ রেখে যেন স্বর্গে চলে গেলাম। লিমা আর রিমা চান করছে, একজন আরেকজনের গায়ে সাবান মাখাচ্ছে। একজন আরেকজনের গায়ে বিশেষ বিশেষ জায়গা খুঁটিয়ে দেখছে। রিমা লিমার বুকের বোঁটা দুটো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। তারপর একটা বোঁটায় ঠোঁট ছোঁয়াল। জিভ দিয়ে চাটল।
তখন ডম্বল আমাকে ঠেলা মারল, সর, সর, আমি একটু দেখি। আমি সরতেই ডম্বল সেখানে ফিট হয়ে গেল। আমি সরে এসে দেখি ভোম্বল মুখ গুঁজে সিঁড়িতে বসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল তোর আবার? মুখ তুলে বলল, দিব্যি খেয়ে বল একথা কাউকে বলবি না?
আমি বললাম, কোন কথা?
—এই যে আমরা ফুটো দিয়ে সব দেখি।
–সে কী! তোরা রোজ দেখিস নাকি?
–না তো কী? খুব ভাল্লাগে দেখতে। কী হয়েছে, নিজেরই দিদি ওরা।
দুপুরের ভাত আর মাংস খেয়ে ডোম্বল আর ডম্বলের সঙ্গে শেষবারের মতো বসলাম গিয়ে ওদের কলের গানটার পাশে। ভাইদের জন্য দিদিরা একটা ছোট্ট উপহার এনেছে আজ। একটা নতুন রিলিজ হওয়া রেকর্ড। পাশের ঘরে মাসিমা অঝোরে কাঁদছে দুই ছেলের জন্যে, ফের কবে বাড়ি আসবে কে জানে।
লালিমা রেকর্ডটা চাপিয়ে দিল কলের গানে। পাশে বসে গরিমা যন্ত্রে দম দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঘরের কান্নায় ভরা নীরব হাওয়ার মধ্যে পান্নালাল ভট্টাচার্য গেয়ে উঠলেন, ‘মা আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা। এবার চোখ বেয়ে ধারা নামল আমার।
সন্ধ্যেবেলায় আলতো পায়ে ফের গেলাম। ডোম্বল-ডম্বলদের বাড়ি। দেখি সারাবাড়িতে একটা আলো জ্বলছে, বাকি সব অন্ধকার। যে-ঘরে আলো সেখানে চুপ করে বসে জানলার বাইরে অন্ধকার দেখছে লিমা। আমার পায়ের শব্দে চটকা ভাঙতে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল
কে নীতু? এসেছিস?
বললাম, আর সবাই কোথায়? লালিমা বলল, শিবমন্দিরে পুজো দিতে গেছে।
-তুমি গেলে না?
–না রে, কিছু ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে।
বললাম, আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে লিমাদি।
লালিমা বলল, জানি। সব ব্যাপারেই তো তোরা একসঙ্গে থাকতিস।
বললাম, সে আর বলতে! কত খারাপ কাজই না করেছি একসঙ্গে।
লালিমা চমকে উঠল। খারাপ কাজ। কী খারাপ কাজ করেছিস তোরা?
আমি মাথা হেঁট করে বসে রইলাম। লিমা ফের শুধোল, কী খারাপ কাজ? বল আমাকে আমি কাউকে বলব না।
বললাম, সে তো তুমি বলবে না। কিন্তু ক্ষমা করে দেবে বলো।
লিমা বলল, হ্যাঁ রে বাবা দোব। নে দিলাম।
আমি আমতা আমতা করে বলা শুরু করলাম—আমি ভোম্বল আর ডম্বল তোমাদের দেখেছি…
লিমা এবার রীতিমতো উদবিগ্ন— কী দেখেছিস আমাদের?
–তোমাদের চান করতে দেখেছি।
গমের মতো রং লালিমার, তাতে সূর্যডোবার ছটা লাগল যেন। ওর চোখ দুটো বন্ধ করে বসে রইল চুপচাপ। কিন্তু আমি আর থামতে পারছি না, বলেই চলেছি, আমরা দরজার ফুটো দিয়ে তোমাকে আর রিমাকে সাবান মেখে খেলা করতে দেখেছি।
লিমা সব শুনেও সেই চুপ করে আছে। তারপর হঠাৎ আমার মাথাটা টেনে নিয়ে গালে একটা চুমু দিল। দিয়ে বলল, যাঃ। কাউকে বলিস না, ক্ষমা করে দিলাম।
আমি ফের আমতা আমতা করে শুরু করলাম, আর তো তোমাদের ওভাবে দেখতে পাব
…
-তো?
-তো, আরেকবার দেখতে দেবে তোমার বুকটা।
লালিমা চোখ বড়ো করে আমার দিকে চাইল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, কী দেখতে
চাস?
—তোমার বুক দুটো।
–কেন? এত রসকষ কীসে ভালোমানুষের পো?
—আর তো দেখতে পাব না।
লালিমা হঠাৎ ওর টেপফ্রকের পিছনে বোতামগুলো পটপট করে খুলতে লাগল। তারপর হাতার থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে জামার ওপরের অংশ নামিয়ে বুক দুটো খুলে দিলে আমার সামনে। আর আমি একদম থ।
তাকিয়ে দেখেই যাচ্ছি তো দেখেই যাচ্ছি, সাধও মেটে না, কথাও ফোটে না। আর লালিমা একনজরে দেখে যাচ্ছে আমার চোখ দুটো। জানি না কখন এক সময় আমার ডান হাতটা গিয়ে স্পর্শ করল লালিমার ডান বুক। আদরের ভঙ্গিতে হাত বুলোনো শুরু করলাম। যেন খেলা করছি নিজের সঙ্গে। কিংবা পাড়ার ছোট্ট সরস্বতী প্রতিমার সঙ্গে।
হঠাৎ যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে উঠে এসে লালিমা বলল, আমি এখান থেকে চলে গেলে তোর কষ্ট হবে?
আমি ওর বাঁ-দিকের বুকটায় আদর করতে করতে বললাম, কেন এসব অলক্ষুণে কথা বলছ?
লালিমা বলল, সত্যি রে। আমার সম্বন্ধর খবর দিয়ে গেছে মামা। হয়ে গেলে তো চলে যাব।
আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। লিমার খোলা বুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সিরিলের ঢঙে মুখ ঘষতে ঘষতে বললাম, না, না, তোমরা সবাই এভাবে ছেড়ে চলে গেলে আমি কাদের নিয়ে থাকব?
আমার গলাটা ভেঙে এসেছিল। লিমা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে বলল, নে ছাড়, মা-রা এসে পড়বে কোন সময়। আমি লিমার মুখে, ওর বুকের বোঁটায় দুটো চুমু দিয়ে ঘর ছেড়ে গলির অন্ধকারে পড়লাম।
২.
আমার ম্যাটিনি শোয়ের নায়িকারা দিন দিন সংখ্যায় বাড়ছে। ফ্ল্যাটের চিলেকোঠার ঘরে বসে খেয়াল রাখি মার্লিনদের পাশের ফ্ল্যাটের টুম্পা কখন লোরেটো থেকে ফিরে ওদের বসার ঘরের কাচের শার্সি খুলে নীচে তাকাবে মাথায় বাক্স নিয়ে ঘোরা কেক-প্যাটিসের জন্যে। ও তখন হাত নাড়ে আমায় আমিও হাত নাড়ি।
একদিন এরকম প্যাটিস কিনছি আমরা, হঠাৎ ও বলল, নীতুদা, তুমি ইশকুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ?
বললাম, তা কেন? এখন তো আমার গরমের ছুটি চলছে। আরও এগারো দিন আছে। টুম্পা বলল, তারপর তো তুমি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?
বললাম, তাতে তোর কী অসুবিধে?
-না, মা, বলছিল তুমি ইংলিশে খুব ভালো। আমার কয়েকটা পড়া যদি দেখিয়ে দাও।
–কী পড়া?
—দুটো কবিতা। বেশ টাফ লাগে।
–ওয়াল্টার ডি লা মেয়রের। দ্য লিসনার্স’ আর উইলফ্রেড ওয়েনের ‘স্ট্রেঞ্জ মিটিং’।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তোমাদের এসব কবিতা পড়ানো হয়?
ও বলল, বা রে! আমরা কি বাচ্চা আছি নাকি?
-তাহলেও …
–কেন তোমার কাছেও কঠিন লাগছে?
বললাম, তা না। তবে জানিস কী এই দুটো কবিতাতেই ভূত আছে।
হঠাৎ হাতে প্যাটিস নিয়ে খিল খিল করে হাসতে লাগল টুম্পা। বলল, সেজন্যই অ্যাভয়েড করছ? কেন তুমি তো দিব্যি রাতের বেলায় ছাদের ঘরে একলা পড়। তোমার তো আর ভূতের ভয় নেই।
আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু তুই পারবি আমার ওই ছাদের ঘরে গিয়ে পড়ে আসতে?
কীরকম সিটিয়ে গেল টুম্পা—জানি না, মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কেন, তুমি পার না আমাদের বাড়ি এসে পড়াতে?
বললাম, না। তোমার পাশের ফ্ল্যাটের সিরিলটাকে দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। টুম্পা অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী! ও তো খুব ভালো মানুষ। টিপিক্যাল অ্যাংলোইণ্ডিয়ান নয়। ওর সঙ্গে আবার তোমার কী হল?
বললাম, কিছু না। তবে ও মার্লিনকে মারে। আমার একদম এটা পছন্দ নয়।
টুম্পা বলল, তাহলে বলো আমাকে পড়াতে চাও না। তাই তো?
—তাহলে তাই।
বলে আমার হাতের প্যাটিসটাও ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে এলাম। মার্লিনের কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া আমার চোখের সামনে ভাসছে। ভাসছে ডম্বল-ডোম্বলের মামার হাত ধরে কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার দৃশ্য। ভাসছে লালিমার খোলা বুক। একটা গোটা বছর গড়িয়ে গেছে, কিন্তু দৃশ্যগুলো এতটুকু পুরোনো হয়নি। ইতিমধ্যে লালিমার বিয়ে হয়ে উত্তরপাড়া চলে গেছে। হঠাৎ এক সকালে পায়খানায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে কাকা দেহরক্ষা করেছেন। বাবার মৃত্যুর পর কাকাই মাথার ওপরে ছিলেন। সেই তিনিও চলে গেলেন। মা বলেছে, সামনের বছর থেকে আমি বোর্ডিং-এ থেকে পড়ব। এই এত কিছুর মধ্যে আমি শান্তি পাই নানা ইংরেজি বই পড়ে আর নানা বারান্দায় আর জানালায় আমার সোফিয়া লোরেন, সুচিত্রা সেনদের দেখে। কিন্তু এদের কারও সঙ্গেই প্রায় আমি মিশতে পারি না। শুধু একটা বছরেই আমি কী ভীষণ বদলে গেছি!
আমি জানতাম আমার ছাদের ঘরে এসে পড়তে বললে টুম্পা আসতে পারবে না। আমাদের এই মধ্যবিত্ত পাড়ায় সন্ধ্যের অন্ধকারে একলা কোনো মেয়েকে কোন মা ছাড়বে একটা ছেলের কাছে পড়া বুঝতে? আর যতই হালফ্যাশানি হোন না কেন টুম্পার মা, তিনি বেশ ভালোই জানেন, তাঁর মেয়ে সুন্দরী, উঠতি বয়স আর আমার ইংরেজি বিদ্যার ওপর ওর দুর্বলতা আছে। ইংরেজিতে ভালো হলে আমাদের পাড়ায় সাত খুন মাফ। এ পাড়ায় যার অঙ্কের মাথা সব থেকে বেশি সেই নির্মলেন্দুকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু ইংরেজিতে কেরামতি থাকলেই হল, মাঝে মাঝে আমি যখন মার্লিনের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা কই টুম্পার মা, গজার বাবা, তিলকের কাকা দিব্যি পাশে দাঁড়িয়ে মাথা হেলিয়ে শোনেন। একদিন তো তিলকের কাকা বলেই দিলেন, বাঃ বেশ বলছ তো ইংরেজি। হবে না? তোমার বাবা ইংরেজিকে তো মাতৃভাষাই করে ফেলেছিলেন। কী দারুণ প্লিড করতেন কোর্টে দাঁড়িয়ে। সে সব শোনা আছে। তুমি নিশ্চয় বাবার ওকালতির লাইনে যাবে? আমি হ্যাঁ, না কিছু না বলে সরে এসেছিলাম।
তবু টুম্পা বলেছিল বলেই কি না জানি না। গত তিন-চার দিন আমি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওয়েন আর ওয়াল্টার ডি লা মেয়ারের কবিতা দুটো পড়ি। সন্ধ্যের অন্ধকারে একলা বসে যখন ওয়েনের ‘স্ট্রেঞ্জ মিটিং’ থেকে পড়ি :
I am the enemy you killed; my friend
I knew you in this dark; for so you frowned.
Yesterday through me as you stabbed and killed
I parried, but my hands were loath and cold.
Let us sleep now………
কিংবা ডি লা মেয়ারের ‘লিসনার্স’ থেকে পড়ি—
Is there anybody there? said the Traveller
Knocking on the moonlit door
And his horse in the silence champed the grasses
Of the forest’s ferny floor.
আমার মনে হয় এক নির্জন, ভৌতিক অন্ধকারে জায়গা করে নিয়েছি আমি। আমার এই চিলেকোঠার ঘর তখন আর ঘর থাকে না। তেপান্তরের মাঠ হয়ে যায়। আমার গায়ের নোম দাঁড়িয়ে যায়, আমি মৃত্যুর পরপারে কোনো জগতের স্বাদ পাই। মনে মনে তখন ধন্যবাদ দিই টুম্পাকে এই কবিতা দুটোর কথা বলার জন্য। আমার স্বর্গত বাবা আর কাকার জগতে চলে যাই, আমি ছাদের অন্ধকারে ভর করে।
ওয়েন আর ডি লা মেয়ারই পড়ছিলাম, যখন দরজার শিকল বাজিয়ে কে আওয়াজ দিল যেন। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি টুম্পা, হাতে বই। বললাম, কী ব্যাপার টুম্পা? এরকম সময় এখানে?
-কী করব, তুমি তো পড়াতে গেলে না।
–তোর মা জানেন?
—মা-ই তো বলল, ও আসবে না। তুই পড়াটা দেখে নিয়ে আয়। বললাম, ভেতরে আয়। ও ভেতরে ঢুকে আমার ঘরটা চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। তারপর বলল, বেশ ঘর তোমার। ভূতের কবিতা পড়ার পক্ষে আইডিয়াল।
আমি ভেতরের আড়ষ্ট ভাবটা কাটানোর জন্য বললাম, ওসব ছাড়, বই খোল।
টুম্পা আমার ডি লা মেয়ারের কবিতার খোলা পাতাটার দিকে চোখ ফেলে বলল, আমি কী খুলব? তুমিই তো খুলে বসে আছ।
আমি হেসে বললাম, তা পড়াতে গেলে নিজেকে একটু তৈরি হয়ে নিতে হয় না?
এবার টুম্পার হাসির পালা। বলল, তাহলে তুমি জানতে আমি আসব? আমি বললাম, হ্যাঁ। ও জিজ্ঞেস করল, কী করে?
বললাম, সে তুই বুঝবি না। ও খেপে উঠল, কেন আমি কি কচি মেয়ে নাকি?
এবার আমি ধমক দিলাম, তুই পড়বি, না, এইসব বাজে বকবি?
টুম্পা তাড়াতাড়ি বই খুলে ফেলল। তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না তুমি দেখছি ভালো মাস্টারমশাই হবে।
আমি ফের গর্জালাম, আবার।
আর তক্ষুনি ‘লিসনার্স’ এর শেষ দুটো লাইন মুখস্ত আউড়ে আমাকে স্তম্ভিত করে দিল টুম্পা–
‘Tell them I came, and no one answered.
That I kept my word,’ he said.
কথাগুলো আউড়ে মুখ নীচু করে টুম্পা বসে রইল আমার পড়ানো শুনবে বলে। আর আমার মগজের মধ্যে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। শেষে কোনো মতে বললাম, হঠাৎ এই লাইনদুটো মুখস্থ বলার মানে কী? মুখ না তুলে টুম্পা বলল, সে তুমি বুঝবে না। তুমি পড়াও বরং।
আমি এবার সরাসরি কবিতায় চলে এলাম। বললাম, কবিতার পরিবেশটাই আসল। পরিবেশটাই কবিতা। ধ্বনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা নিস্তব্ধতার কবিতা। চাঁদের আলোয় মায়াবী মূৰ্ছনায় ধরা এক অশরীরী জগৎ। সে জগতেরই দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে কবিতার নায়ক, পর্যটক। মানুষের জগতের এক প্রতিনিধি সে, সংলাপ তৈরি করতে চাইছে জীবনের ওপারের নীরব শ্রোতাদের সঙ্গে…।
হঠাৎ একটা গান বেজে উঠল কাছেই, আর আমাদের নীরব পরিবেশে অশরীরীদের আহ্বানে ছেদ পড়ল। ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে দেখি রেডিওগ্রামে এলভিস প্রেসলির গান চালিয়ে নাচ প্র্যাক্টিস করছে আমার আর এক নায়িকা লোরেন সুইন্টন।
চমকে উঠেছিল টুম্পাও। মুখের সামনে থেকে বই নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওটা কী শুরু হল নীতুদা? আমি সংক্ষেপে উত্তর করলাম, ক্যাবারে নাচের রিহার্সাল।
ও জিজ্ঞেস করল, কে নাচছে?
বললাম, লোরেন সুইন্টন।
ও বিস্ময়ের সুরে বলল, ওই সুন্দরী অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানটা? যার মা ক্যাবারে নাচে?
বললাম, সবই তো জানিস দেখছি। তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন?
ও আমার পাশে সরে এসে জানলার বাইরে চোখ মেলল, আমি একটু দেখি নীতুদা।
আমি ঝাঁজিয়ে বললাম, তুই কি এই করতেই এসেছিস তাহলে? পড়বিটা কখন?
—সে না হয় আবার আসব। দেখি তো আগে।
ও লোরেন সুইন্টনকে দেখতে লাগল। আর আমি ওকে। টুম্পাকে এভাবে কখনো দেখিনি। ফ্ৰকই পরে আছে, কিন্তু এক পূর্ণ যুবতীর রূপরেখা ছড়িয়ে পড়েছে সারাশরীরে। আমার নিজের তাকানোতে নিজেরই কেমন লজ্জা হতে শুরু করল। আমি ওর থেকে চোখ সরিয়ে ওর মাথার ওপর দিয়ে লোরেনকে দেখব বলে চোখ চালালাম। আর যা ভয় করছিলাম ঠিক তাই। ঘরের জানালা হাট করে খুলে একটা ব্রা আর জাঙ্গিয়া পরে নাচছে সুন্দরী যুবতী মেমসায়েব। আর সেটাই পর্দার সিনেমার মতো দেখছে এই চুড়ি।
আমি গর্জন করলাম, টুম্পা জানলা বন্ধ কর।
ও অম্লান সারল্যে প্রশ্ন করল, তুমি পড়ার বাহানা করে এইসব দ্যাখ!
বললাম, পড়ার বাহানা করে দেখি না। পড়তে পড়তে দেখি।
টুম্পা জানলা বন্ধ করতে করতে বলল, অসভ্য মেয়ে কোথাকার।
আমিও ছাড়বার পাত্র নই, বললাম আর তুমি খুব সভ্য। পড়ার নাম করে এসে ওইসব দেখছ! ও মুখ ভেঙচিয়ে বলল, বেশ করেছি দেখেছি, ফের দেখব। বলে জানলা খুলতে গেল ও। আমি তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা চেপে ধরলাম।
কিন্তু এ কী! ওর গায়ে তো আগুন বইছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম। তোর কি জ্বর হয়েছে? তখনও ওর উষ্ণ হাতটা আমার হাতে চাপা। ও থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল হ্যাঁ, ওষুধ দাও।
আমি এক ঝটকায় ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটে চুমু দিলাম। ও দুটো হাত দিয়ে আমার মাথাটা ওর মুখের ওপর চেপে ধরল—আই লাভ ইউ নীতুদা। আই লাভ ইউ।
আমি আস্তে আস্তে ওর বুক স্পর্শ করলাম। কী অপূর্ব অনুভূতি। ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, আলো নিভিয়ে দেব। ওর মুখ ভেসে যাচ্ছিল ঘামে। চোখ বন্ধ। বলল, দাও।
আমি লাইট নিভিয়ে ওর জামাটা খুলতে লাগলাম। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এবার কী করবে তুমি? বললাম, বড়োরা যা করে। ওর ভয় বোধহয় বাড়ল। জিজ্ঞেস করল, কোনো ক্ষতি হবে না তো আমার? কোত্থেকে এক অন্ধবিশ্বাস জন্মাল আমার, বললাম, ধুর! কিচ্ছু হবে না।
ওর সব জামা খুলে ফেলেছি। নিজের পরনের প্যান্ট শার্টও ছুঁড়ে ফেলেছি। ওকে জড়িয়ে ধরে সারাশরীরে আদর ঢেলে দিচ্ছি, এক অদ্ভুত পাগলামির মধ্যে ডুবে গেছি আমরা। আমি অন্ধকারে ওর ওই গোপন জায়গাটা হাতড়ে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ টুম্পা বলল, নীতুদা আজ থাক।
আমি উদবিগ্ন হয়ে অপরাধীর মতো জিজ্ঞেস করলাম, কেন, কী হল?
ও অন্ধকারে ওর জামা খুঁজতে খুঁজতে বলল, মা বলেছিল এই ঘরটার ওপর নজর রাখবে।
বললাম, তো কী হয়েছে? অত দূর থেকে এই ছাদের ঘরের ভেতরে কী হচ্ছে দেখা যায় নাকি?
ও জামা পরা শেষ করেই ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল। আমি তখনও সেই জন্মদিনের পোশাকে বসে আছি। টুম্পা বলল, কিন্তু আলো তো দেখা যায়!
এক মুহূর্তে আমার সব রোমাঞ্চ মাথায় চড়েছে। আমি দুদ্দাড় করে জামাপ্যান্ট গলিয়ে পিছনের জানলা ধাক্কা মেরে খুলে ডি লা মেয়ারের বদলে ওয়েনের কবিতা ‘স্ট্রেঞ্জ মিটিং’ খুলে বসলাম। টুম্পা ওর জায়গায় বসে কবিতার পাতা খুঁজতে লাগল ওর বইয়ে।
আমার ভেতর থেকে কে যেন ঠেলে বার করে আনল কথাগুলো, টুম্পা তোকে ‘স্ট্রেঞ্জ মিটিং’ বা আজব সাক্ষাৎ পড়ানোর কথা ছিল। আর কী এক সাক্ষাৎ হয়ে গেল আমাদের।
টুম্পা লাজুক স্বরে বলল, আমার ঠোঁটে দাগ নেই তো, নীতুদা? বললাম না।
—গালে?
—কোথাও নেই?
–যদি থাকে সেটা মনে। সেখানে কেউ দেখতে পাবে না।
–তুমিও না?
আমি সিঁড়িতে কাদের পায়ের শব্দ শুনলাম। কেউ বা কারা উঠে আসছে। অথচ টুম্পার প্রশ্নেরও উত্তর দেওয়া হয়নি। এই ক-দিনে ‘স্ট্রেঞ্জ মিটিং’-এর আগাগোড়া আমার মুখস্ত। টুম্পার প্রশ্নের জবাব দেব বলে পড়তে শুরু করলাম
Courage was mine and I had mystery
Wisdom was mine and I had mastery
Into vain citadels that are not walled
… … … …
… … … …
Even with truth that lie too deep for taint
I would have poured my spirit without stint
But not through wounds, not the cess of war.
কবিতার পঙক্তির যে কী মানে হয় তা বোঝার বয়স হয়তো হয়নি টুম্পার। কিন্তু কবিতার এইসব কথা হঠাৎ এক অন্য মানে নিয়ে, প্রায় আমার নিজের কথা হয়ে ওর কিশোরী মনে দোলা দিল। কিছু না বলেও মনে হল যেন সব বোঝাতে পেরেছি এক লহমায়।
ঠিক তখন আমাদের কাজের লোক বুড়িমাকে নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ালেন মাসিমা। টুম্পার মা এক গাল হেসে বললেন, আমি উঠতে উঠতেই শুনতে পাচ্ছিলাম তোমার পড়ানো। কী সুন্দর! তুমি মাঝে মধ্যে ওকে একটু ইংরেজিটা পড়িয়ে দিয়ো না। ওর খুব উপকার হয় তাহলে।
আমি প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বললাম, দেখি। ওর মাথা তত খুব ভালো, চট করে বুঝে যায়। তবে… তবে… আমি তো সামনের বছর থেকে বোর্ডিং-এ পড়ব… তখন…
মাসিমা সামলে দিলেন, সে ঠিক আছে। তোমার মতো কারও গাইডেন্স পেলে ও এই ক মাসেও অনেক ধরে নিতে পারবে। আজকাল টিউটরদের কথা জানই তো। পড়ানোর নামে ইয়ার্কি ফাজলামি। টাকার শ্রাদ্ধ।
আমি এতক্ষণে একটু সামলে নিয়েছি। বললাম, তবে মাসিমা ওকে এখানে এসেই পড়তে হবে। আমি তো কোথাও যাই না।
মাসিমা বললেন, বেশ তো, এ তো বেশ ভালোই ঘর পড়ার পক্ষে। কোনো অসুবিধে নেই। বলে ঘরটার ভেতরে একটা পাক দিলেন মাসিমা। তারপর হঠাৎ জানলার পাশে এসে থমকে দাঁড়ালেন। চোখ দুটো ওঁর একটু একটু করে বড়ো হতে লাগল। বিকিনি পরে উদ্দামভাবে নেচে চলেছে লোরেন। গ্রামে গান বাজছে টোনি ব্রেন্ট-এর ‘সামওয়ান এলস ইজ ইন ইয়োর আর্মস টুনাইট।
মাসিমা জানালা বন্ধ করে দিলেন। তারপর মেয়েকে বললেন, এসো টুম্পা। তারপর হাত ধরে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। বুড়িমা সব দেখে বলল, বউটা রেগে গেল মনে হচ্ছে। কী হল আবার?
আমি বিরক্তির সঙ্গে বললাম জানি না। কে বলেছিল আসতে।
৩.
সময় কী করে কেটে যায় ভগবান ছাড়া কে আর জানতে পারে। সেই যে মাসিমা টুম্পার হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন আমার পড়ার ঘর থেকে ঠিক তখনই মনে হয় আমার ওই নিজস্ব সিনেমা হলের সব আলো জ্বলে উঠল। খেল খতম।
টুম্পা আর পড়তে আসেনি তারপর। শুধু শুনেছি এর-ওর মুখে ও বলেছে আমি নাকি খুব ভালো পড়াতে পারি। তাহলে আর পড়তে এল না কেন কোনোদিন? এর কোনো উত্তর পাইনি। লজ্জার মাথা খেয়ে কখনো জিজ্ঞেস করতেও যাইনি। কেবল যেদিন বোর্ডিং-এ থাকতে যাব সেদিন অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলাম। ওদের জানালার দিকে। দেখা গেলে হাত নাড়ব বলে। সারাদিনে একটিবারের জন্যও জানালাটাও খুলল না কেউ।
মাসিমার সেই হেঁটে যাওয়ার পর থেকে নানা জানালায়, নানা বারান্দায় কে কখন দেখা দিচ্ছে তার হদিশ রাখিনি। আর আজ তিন বছর পর হায়ার সেকেণ্ডারির ফাইনালের পর করব বলে ফের উঠে এসেছি আমার চিলেকোঠায়।
ঠিক আজ উঠিনি, ক-দিন ধরেই উঠেছি। শীতের দুপুরের রোদ কীভাবে আকাশ বেয়ে এধার থেকে ওধার হয় সব খেয়াল করি বই পড়তে পড়তে। বইয়ের পাতার ওপরই কীভাবে একটু একটু করে আলো বদলায় তা আমি ধরতে শিখে গেছি।
টুম্পারা বছর খানেক হল পাড়া ছেড়ে আলিপুরে উঠে গেছে। আর বছর দুই হল নতুন বাড়ি করে আমাদের বাড়ির উলটোদিকে কয়েকটা বাড়ির পর এসে উঠেছেন ডক্টর চন্দ্রকান্ত সেন। দিদি বলছিল, ওর মেয়ে রানি নাকি এই বয়েসেই ফাটাফাটি সুন্দরী। আমি সব শুনে চুপ করে থেকেছি। স্কুল ছাড়ার পরীক্ষার তিনমাস আগে মেয়েদের সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। মনে মনে বলেছি, এক সুন্দরীর পাল্লায় পড়ে ঢের শিক্ষা হয়েছে আমার।
আর আজ সেই রানির এক চিঠি হাতে করে নিয়ে এসেছে বুড়িমা। বলেছে, ওই সেন ডাক্তারের মেয়ে রানি লিকেচে গো। তুমি উত্তর দিলে আমি পৌঁছে দেব। চিঠিটা হাতে করে নিয়ে ছাদের ঘরে এসে পড়তে গিয়ে আমার দম আটকে যাওয়ার শামিল। সে লিখছে :
কী বলে সম্বোধন করব জানি না। ক-দিন হল তোমাদের ছাদে তোমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখি। কিন্তু তোমার কথা শুনে আসছি অনেক দিন ধরে এ পাড়ায় যে আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড ছিল সেই টুম্পার কাছে। ও চলে যেতে তাই বড়ো একলা লাগে। ওরও লাগত, তুমি বোর্ভিঙে চলে যেতে। বলেছিল তুমি কী সুন্দর পড়িয়েছিলে দুটো ইংরেজি কবিতা।
টুম্পার কথায় বুঝতে পারতাম ও তোমায় ভালোবাসত। ও বলত তোমার প্রিয় গান মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি। ঠিক বললাম তো? এই গানটা আমারও খুব প্রিয়। তুমি যদি একদিন ওয়েন আর ওয়ালটার ডি লা মেয়ারের কবিতা দুটো আমায় পড়ে শোনাও তাহলে ওই গান আমি তোমায় গেয়ে শোনাব। তবে তোমার ওই চিলেকোঠায় নয়, আমাদের এই বসার ঘরে। আমার অন্ধকার আর ভূতে বড়ো ভয়।
যদি আসো তাহলে বুড়িমার হাতে একটা চিঠি দিয়ো।
রানি
জানি না, কী উত্তর লিখব এর! এর উত্তর দেওয়া তো প্রেমে পড়ে যাওয়ার শামিল। পরীক্ষার মুখে কি আমি এই করব!
চিঠিটা একটা পুরোনো ব্যথা আর একটা নতুন রাগও খুঁচিয়ে তুলেছে। পুরোনো ব্যথা হল টুম্পার স্মৃতি আর নতুন রাগ হল আমার চিলেকোঠার প্রতি রানির খোঁচা। কেন, কী দোষ করেছে আমার চিলেকোঠা? এখান থেকে লোরেনের নাচ দেখতে পাওয়া যায়, এই তো? নিশ্চয়ই টুম্পার কাছে শোনা কথা এসব। তাতে বয়ে গেল আমায়। আমি অভিমানের বশে চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে বাইরে ফেলে জানালা খুলে লোরেনের নাচের অপেক্ষায় রইলাম।
কতক্ষণ বসেছিলাম এভাবে খেয়াল নেই, শেষে লোরেনের নাচ শুরু হল ক্লিফ রিচার্ডের গানের সঙ্গে। আমি মেয়েটিকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। কী অপরূপ সুন্দরী আর লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে মেয়েটি এই তিন বছরে। দিদি বলছিল ও পড়াশুনো ছেড়ে দিয়ে ফুলটাইম ক্যাবারে ডান্সার হয়েছে। নাম নিয়েছে লাশিয়াস লোলা। কলকাতা তো বটেই, সারাভারতেই নাকি ওর জুড়ি নেই। আর কিছুদিন পরই ও দিল্লির ইন্টারকন্টিনেন্টালে পাড়ি দেবে।
আমি স্তম্ভিত হয়ে লোরেনকে দেখছি। ওর নাচের সঙ্গে একের পর এক বেজে যাচ্ছে প্যাট বুন, ফ্র্যাঙ্ক সিনাট্রা, জিম রিভস, কিন্তু আমার মগজে ক্রমাগত বেজেই চলেছে ওই একটাই গান—’আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি।‘ বুঝতে পারছি না সাহেবদের ওই গানে না লোরেনের সৌন্দর্যে না মানবেন্দ্রর গানে মনটা ভিজে জল হয়ে যাচ্ছে। জল আসছে চোখেও, যেন প্রেমে পড়ছি।
শেষে দড়াম করে জানলা বন্ধ করে লজিকের বই খুলে বসলাম। এভাবে চলতে থাকলে আমার পরীক্ষা ডকে উঠবে। নিকুচি করেছে ওই রানির। আমি ওকে চিনি না, আর চিনে কাজও নেই। সেই তো টুম্পার মতো এক ঝড় বইয়ে মিলিয়ে যাবে মহাকালে। তার চেয়ে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।
আমি লজিকের সিলোজিসমে ডুব দিলাম। কিন্তু চোখের পাশটা সমানে খচ খচ করে যাচ্ছে। রানি কি খুব কষ্ট পাবে?
হাত নিশপিশ করছে কলম তুলে একটা চিঠি লেখার জন্য। কিন্তু মনের কোণে সারাক্ষণ ভয়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছি, নীতু, তুমি কি প্রেম করার জন্যই অ্যাদ্দিন পর নিজের ডেরায় ফিরে এলে?
হাত আর মন একই সঙ্গে পাথর হয়ে গেল।
৪.
আমার হাতে ল্যাম্ব রোস্টের প্লেট ধরা, ডান হাতে ফর্কটা দিয়ে একটু ছিড়ছি আর খাচ্ছি। ঘর। ভরতি সাহেব-মেম, দু-তিনটে লণ্ডন প্রবাসী বাঙালি দম্পতি। যাঁর বাড়িতে এসে উঠেছি লণ্ডনে সেই নির্মলদা আর ওর চোদ্দো বছরের মেয়ে সোনালি একে একে সবার সঙ্গেই আলাপ করিয়ে দিয়েছে। মাইনে যেমন তেমনই হোক লণ্ডনে দেখি অধ্যাপকদের সম্মান এখনও আছে। নইলে ইংরেজির তরুণ অধ্যাপক বলে যেই সাহেব মেমদের সামনে আমাকে দাঁড় করাচ্ছেন নির্মলদা অমনি একটা সমীহ ফুটে উঠছে সবার চোখে মুখে, ওহ, রিয়েলি। দ্যাটস গ্রেট। তারপরই লাগোয়া প্রশ্ন, হোয়াট ডু ইউ টিচ? তখন যেই বলছি, ইংলিশ লিটারেচার তখন আর এক-প্রস্থ পুলকিত সমাদর, ওঃ, দ্যাটস মার্ভেলাস! আর এতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাচ্ছে সোনালি। যার চোদ্দোতম জন্মদিন এটা।
যখন আলাপ হচ্ছিল একে একে সবার সঙ্গে তখন হাতে সবার বিয়র কিংবা হুইস্কি ছিল। এখন সবার হাতে সোনালির নিজের হাতে রাঁধা ল্যাম্ব রোস্ট। সে পদের ফরমাশটা কলকাতা থেকে টেলিফোনে ওঁর কাকা আর আমার সহকর্মী রাণার করা। রাণার জোরাজুরিতেই বলা চলে বাউণ্ডস গ্রিনে নির্মলদাদের বাড়িতে এসে উঠেছি। রাণা বলেছিল, যাচ্ছিস তো বাবা ব্রিটিশ কাউন্সিলের কিপটে স্কলারশিপে। টাকাটা বাঁচা, একটু পাবে বসে বিয়র-টিয়র খা। দু চারটে বই-টই কেন, ক্যাবারে-ফ্যাবারে দ্যাখ। দেখতে দেখতে ছ-সপ্তাহ কেটে যাবে। আর আমার ভাইঝিটি একটি রত্ন। আমি খাইনি। তবে শুনেছি দুর্ধর্ষ ল্যাম্ব রোস্ট রাঁধে। ডোন্ট মিস দ্যাট।
সেই ল্যাম্ব রোস্ট চাখতে চাখতে আমার কেবলই মনে পড়ছে উপস্থিত তরুণ দম্পত্তির ওই আগুনের মতো সুন্দর বউটার মুখ। কেবলই মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি যেন। নিশ্চয়ই কোথাও দেখেছি? কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারছি না। শেষে হাল ছেড়ে দিতে বসেছি এই স্তোক দিয়ে, আসলে সুন্দরী বলেই এতরকম চিনি চিনি ভাব করছি। এ মুখ এই প্রথমই দেখলাম।
দেখেছি সবারই খাওয়া হয়ে গেছে, সবাই একে একে নিজের নিজের প্লেট নিয়ে কিচেনের সিঙ্কে গিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। এদেশে কাজের লোকের চল নেই। নিজেরটা নিজে করাই নিয়ম। নেমন্তন্নেও। শেষে আমি উঠলাম প্লেট ধোলাই করতে। বাকিরা সুইট-ডিশ খাওয়া চালু করে দিয়েছে, একজন মহিলা পিয়ানোয় বসে ‘কে সেরা সেরা’ গানের সুর তুলতে শুরু করেছিল। সিঙ্কের এক ধারে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্কভাবে আমি প্লেটে পাউডার ঘষছি।
হঠাৎ পিছন থেকে একটা সুরেলা অথচ অভিমানী মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল, আমরা চিঠির উত্তর কিন্তু পাইনি।
আমি মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি কিচেনের দরজায় ফ্রেম-আটা মা দুর্গার ছবির মতো দাঁড়িয়ে ওই বউটি, যার পরিচয় নিয়ে এতক্ষণ ভেবে মরছি।
আমি সত্যি সত্যি হকচকিয়ে গেছি। কীসের চিঠি? কার চিঠি? কেন হঠাৎ এই চিঠির কথা উঠছেই বা কেন? ভদ্রমহিলাও আমাকে ঠিক শনাক্ত করেছেন তো?
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, আমার কি আপনাকে চিঠি দেওয়ার কথা ছিল?
যুবতী বলল, দেওয়া, না-দেওয়া আপনার মর্জি। কিন্তু আপনি তো চিঠির কথা মনে করতে পারছেন না।
আমি ফের তোতলাচ্ছি, কিন্তু…কিন্তু…
যুবতী বলল, অবশ্য বারো বছর হয়ে গেল তো। ভুলে যাওয়ারই কথা।
আমি ফের অবাক হয়েছি বা-রো ব-ছ-র!
-হ্যাঁ, তা তো হয়েছে। তাতে একটা গান শোনানোর কথা ছিল, …
ওহ, তাই তো। গানের কথা উঠতেই চিলেকোঠার সন্ধ্যের কথা, বুড়ির বয়ে আনা চিঠির কথা, মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমার ভালোবেসেছি’র কথা আর ওই চিঠির প্রেরিকা রানির কথা…বস্তুত স্কুল জীবনের ওই সময়কার সব কথা বন্যার তোড়ের মতো মনে বাঁধ ভেঙে মাথার মধ্যে গোলমাল পাকাতে শুরু করল। আমার হাত-পা দুই-ই অচল হয়ে গেছে, গলা বন্ধ হয়ে আসছে। তার মধ্যেই কোনোমতে উচ্চারণ করলাম, রানি।
রানি হাসল, বাঁকা ছুরির মতো ধার তাতে। আমি, ‘আই শুনুন! বলে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ হাত থেকে প্লেটটা ছিটকে মাটিতে পড়ে চৌচির হয়ে গেল। কী হল! কী হল!’ করে ছুটে এল সোনালি। আমি লজ্জায় সিঁটিয়ে গেছি দেখে আমাকে আশ্বস্ত করল, তুমি কিছু ভেবো না কাকু, একটা দুটো ভাঙাভাঙি ইজ গুড ফর দ্য পার্টি। আমি নিরুপায় হয়ে বললাম, তা বলে কি পৃথিবীর সব ভাঙাভাঙির দায়িত্ব আমার! প্লেটের টুকরোগুলো মাটি থেকে কুড়োতে কুড়োতে সোনালি বলল, যারা মানুষের মন ভাঙে তারা সবকিছুই ভাঙতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
হে ভগবান! এই চোদ্দো বছরেই মেয়েটা এতশত জানল আর শিখল কোত্থেকে? সোনালি বিন-এ প্লেটের খন্ডগুলো ফেলছিল, আমি খুব নজর দিয়ে দেখলাম বারো বছর আগের এক কিশোরীর মুখ, যারও তখন বয়স ছিল হয়তো চোদ্দো। যার নাম ছিল রানি। রানি সেন। যে আমায় একটা চিঠি লিখেছিল। যার উত্তর দেওয়া হয়নি আজও। স্বভাবদোষে সেই কিশোরী মুখটিকে ভালো করে মনে গেঁথে রাখতে পারিনি। হয়তো সে সুযোগও পাইনি, কলেজে উঠতেই তো পাড়া ছেড়ে অন্যত্র উঠে গেলাম আমরা। তারপর আর ক-বারই বা ওই পাড়ামুখো হয়েছি আমি!
আমি আস্তে আস্তে সোনালিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের এই রানিদি কি এখনও গান টান করে?
সোনালি অবাক হয়ে গেল যেন গান? জানি না তো উনি গান-টান করেন কি না? জিজ্ঞেস করব?
আমি আর কিছু বললাম না। সোনালি হাত ধুয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, তুমি চলে এসো কাকু। তোমাকে আইসক্রিম সার্ভ করব।
হাতে সুইট ডিশ নিয়ে এবার আমিই জটলার মধ্যে খুঁজে বের করলাম রানিকে। পাশে ওর ডাক্তার বর অমিত। বললাম, তবুও ভালো-যাওয়ার মুখে আপনাদের সঙ্গে আলাপ হল।
অমিত বলল, নির্মলদার কাছে শুনেছি আপনার কথা। এখন আলাপ হয়ে আরও ভালো লাগল। একদিন আসুন না আমাদের ওখানে, আমি আপনাকে পিক করে নেব। চাইলে নিটোল বাঙালি রান্না খাওয়াতে পারি আপনাকে। রানি ইজ আ গুড কুক।
আমি বললাম, রান্না-টান্না ঠিক আছে, তবে আপনার গিন্নি এক আধটা গান শোনালে যাওয়ার টান আরও বাড়ত।
অমিত এবার সত্যিই অবাক হয়ে গেছে—গান? আপনি কী করে জানলেন রানি গান জানে?
বেকায়দায় পড়ে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করলাম কথা ঘোরাবার। আসলে ওকে দেখেই মনে হয় ভালো গান জানেন।
এবার উত্তর করল রানি, জানতাম। সব ভুলে গেছি। গান শোনানোর মতো লোক চাইলেও তো পাওয়া যায় না।
বললাম, কেন, অমিতবাবু?
অমিতই প্রতিবাদ করল, আর বলবেন না মশাই, যা কাজের শিডিউল এখানে। নিজেও এককালে একটু আধটু রবীন্দ্রসঙ্গীত করতাম। সব চুকে বুকে গেছে।
বুকে বল সঞ্চয় করে বললাম, গিন্নিও কি বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীতের দিকে?
অমিত বলল, না, না, ওর গলায় বাংলা আধুনিক দারুণ খেলত। লতা, গীতা, সন্ধ্যা, হেমন্ত, শ্যামল, মানবেন্দ্র…
মুখ ফুটে অকস্মাৎ বেরিয়ে এল, বাঃ অপূর্ব। তারপর একটু থেমে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা, মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানটা কি …
আমার কথার মধ্যেই কীরকম এক সুরেলা অভিমানী কণ্ঠে বলে উঠল রানি, না না, ওই গানটা কখনো তোলা হয়নি নীতিনবাবু।
আমার হাতের আইসক্রিমের প্লেটটা যেন আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বুঝলাম, গলাটাও বসে যাচ্ছে। রানি আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে পার্টির অন্যদের দেখতে শুরু করল। এক আধবার হাতে ঘড়িও দেখল। যেন এক্ষুনি চলে যেতে হবে।
আমি অমিতকে একটু আসছি বলে সরে এসে কিচেনের দরজা দিয়ে পিছনের বাগানে গিয়ে তারার অন্ধকারে দাঁড়ালাম। কৈশোরের ছাদের সেই অন্ধকারগুলো ভিড় করে আসছে। মনের ওপর। ফিকে একটা সুরের ধ্বনি বেরিয়ে আসছে পাটিরুম থেকে। সেই মহিলা পিয়ানোয় এবার ধরেছেন–‘আই কুড হ্যাভ ড্যান্সড অল নাইট, অ্যাণ্ড ইয়েট বেগ ফর মোর’। আর একটু একটু করে আমার মগজে ছড়াচ্ছে একটা বাংলা আধুনিক প্রেমের গান যেটা কিশোরী রানির কন্ঠে আমার শোনার কথা ছিল, হয়নি।
একটা ক্লাসের পর একটা পিরিয়ড ব্রেক ছিল। আমি বেয়ারা সঞ্জীবকে এক পেয়ালা কফির অর্ডার করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বসলাম লেকচারার্স রুমে। সবে দু-তিনটে টান দিয়েছি সুখ করে হঠাৎ পায়ে মৃদু স্পর্শ কীসের। চোখ তুলে দেখি প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়াল তিস্তা।
তখনও ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়ায়নি, আমি হাত বাড়াতেই ওর মাথাটা পেয়ে গেলাম। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, থাক, থাক, এখানে আর এত প্রণাম-ট্রণামের কী আছে? তারপর একটু থেমে বললাম তা কী ব্যাপার বল?
বড়ো বুদ্ধিমতী এই মেয়ে, ক্লাসে, এমন সব প্রশ্ন করে সময় সময় তা ওর বি এ সেকেণ্ড ইয়ারের তুলনায় ঢের মেচিওর্ড। ওই প্রশ্নগুলো করা ছাড়া ওর গলায় শব্দ বিশেষ শোনা যায়। ওর চেহারার মতো স্বভাবেও কীরকম একটা স্নিগ্ধ নির্জনতা লুকিয়ে আছে। হয়তো একটা অস্পষ্ট বেদনাও।
স্নিগ্ধ চাপা স্বরে বলল, স্যার, মার খুব ইচ্ছে আপনি শেক্সপিয়রের পেপারটায় আমায় একটু প্রাইভেট টিউশন দিন। অনেক বলেছি মাকে যে আপনি প্রাইভেট করেন না। তবু মা ঠিক বুঝতে চাইছে না।
কথাটা ভুল না। প্রাইভেট টিউশন ব্যাপারটাতেই আমার ঘোর আপত্তি। কলেজে পড়াচ্ছি পড়াচ্ছি। কিন্তু তার বাইরে প্রাইভেট নোট সাপ্লাই করে পয়সা কামানোকে আমি পাটোয়ারি ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। কলেজের বাইরে সব সময়টাই আমার নিজের। বই পড়ব, গান শুনব, চাইলে একটা উপন্যাস লিখব, কিন্তু নোট সাপ্লাই নৈব নৈব চ।
কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই তিস্তা বলল, মা বলছিল মা আপনাকে চেনে।
জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম তোমার মা-র?
কোথায় থাক তোমরা? তিস্তা প্রশ্নের উত্তরের বদলে একটা খাম দিল আমার হাতে। তাতে ছোট্ট একটা চিঠি, আমি পড়তে শুরু করলাম–
প্রিয় নীতুভাই,
আশা করি কুশলে আছ। তোমার পড়ানো আর বিদ্যার সুনাম সব সময়ই শুনতে পাই। তিস্তা তো তোমার পড়ানো নিয়ে কী পাগলামোই না করে। বলে স্যার নিশ্চয় আগের জন্মে অক্সফোর্ডের সাহেব অধ্যাপক ছিলেন। আমি শুনি আর খুব গর্ব হয় আমার। তুমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ছ সে খবর পেয়েছিলাম, কিন্তু সেই কলেজেই তুমি ডাকসাইটে প্রোফেসর হয়েছ শুনে যে কী ভালো লেগেছিল তা বলে বোঝাতে পারব না।
আমার এই একটাই মেয়ে তিস্তা। বই ছাড়া ওর আর কোনো বন্ধু নেই। ক-বছর আগে তোমার জামাইবাবুর একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। একটা দিক পড়ে গেছে বেচারির। আর্লি রিটায়ারমেন্টে আছেন ভদ্রলোক। কাজেই সংসারে অভাব না থাকলেও হাজার দেড় হাজার টাকা দিয়ে মেয়েকে প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার সেই সচ্ছলতাই নেই। তিস্তার কিন্তু বড়ো আকাঙ্ক্ষা একটা ফাস্ট ক্লাস পায়। সেজন্যে তোমার কাছে পড়ার বড়ো বাসনা ওর। তাই যদি দিদির মেয়েটাকে স্নেহ করে একটু সময় দাও বড়ো আনন্দ পাই।
তোমার জামাইবাবুর অসুস্থতার পর থেকে উত্তরপাড়ার এই সাহেব বাড়ির উঠোন ছেড়ে কোথাও যাওয়া হয় না আমার। কিন্তু তুমি যদি ভালোবেসে এই দিদিটাকে একদিন দেখতে আসো বড়ো শান্তি পাব। তিস্তাকে যদি একান্ত পড়াতে নাই পার একবারটি অন্তত আমাদের দেখতে এসো। ঈশ্বর তোমার অনেক খ্যাতি, সম্মান আর দীর্ঘজীবন দিন, এই প্রার্থনা করি।
ইতি–
লালিমা
চিঠিটা পড়তে পড়তে বুকের ভেতর একটা অব্যক্ত ব্যথা টনটনিয়ে উঠল। আমি চিঠিপড়া শেষ করেই তিস্তার মুখের দিকে তাকালাম। তাই তো সেই গমের মতো গায়ের রং। সেই টানাটানা, বড়ো বড়ো চোখ। গালে সেই টোল। সেই লাজুক হাসি। এমনকী চুলের বিনুনি আর শাড়ি পরারও সেই একই টং।
আমি চিঠিটা পাট করে খামে ভরে পকেটে রেখে বললাম, তিস্তা, তুমি সামনের সপ্তাহ থেকে মঙ্গল আর শুক্রবার সন্ধ্যে ছটায় আমার বাড়ি চলে এসো। এই নাও ঠিকানা।
তারপর কী একটা ভেবে ফের বললাম, কিন্তু তিস্তা, সন্ধ্যে আটটা সাড়ে আটটার পর তুমি উত্তরপাড়া ফিরবে কী করে?
বোধহয় এই প্রথম তিস্তা এত জোরের সঙ্গে জবাব দিল, স্যার ও আমি পারব। এত কিছু দূর নয় উত্তরপাড়া। কত বাস। কত ট্রেন। মার একটু চিন্তা হবে ঠিকই কিন্তু মা-ই তো চাইছে।
তিস্তা ফের টেবিলের তলা থেকে আমার পা খুঁজে বার করে প্রণাম করল। আমি বললাম, থাক থাক। তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বললাম, মাকে বলবে কোনোরকম মাইনে দেওয়ার চেষ্টাও যেন না করা হয়। তাহলেই পড়ানো বন্ধ। তিস্তা হাসল, ওর ওই মায়ের মতো লাজুক চোরা হাসি।
কী করে, কী করেই যে সময় কেটে যায়। আজ তিস্তার সেকেণ্ড পার্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে। প্রথম পার্টে মাত্র নয় মার্কের জন্য ফার্স্টক্লাস মিস করেছিল বেচারি। দ্বিতীয় পার্টে সব মেক আপ করে সিক্সটি ফোর পার্সেন্ট নিয়ে ওভারল শুধু দীপ্তিময় বসু।
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরেই শুনি বৃন্দা বলল, তিস্তা ফোন করেছিল। ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছে। একটু পরেই দেখা করতে আসছে। তুমি বেরিয়ে যেয়ো না কিন্তু।
আমি গা ধুয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি চাপিয়ে সবে এসে বসার ঘরে বসেছি তিস্তা ঢুকল বিরাট মালপত্তর নিয়ে। আমি অবাক হয়ে বললাম। এসব কী রে তিস্তা? তিস্তা ওর বস্তা-টস্তা আমার পায়ের কাছে রেখে, প্রণাম সেরে বলল, কিছু না।
বললাম, কিছু না তো এসব বগলে করে আনলি কেন? তিস্তাকে এখন তুই’ করেই বলি, ও-ও স্যার-টার ঝেড়ে ফেলে ডাকে মামু। ও বলল
মামু, এসব মা-র কীর্তি, আমি কি জানি না।
দেখতে দেখতে ঝোলা থেকে বেরুল আমার ধুতি, পাঞ্জাবি, সুট লেংথ। বৃন্দার জন্য শাড়ি, এইচ এমটি ঘড়ি আর আমাদের কন্যা নন্দিনীর জন্য এক গুচ্ছের খেলনা। সেইসঙ্গে ভীমনাগের সন্দেশ।
বৃন্দাও ঘরে ঢুকে এতসব দেখে হতবাক। আমি বললাম, তিস্তা তোকে পড়ানোর জন্য তো কোনো টাকার কথা হয়নি। তাহলে এসব করতে গেল কেন তোর মা?
তিস্তা বলল, মামু আপনাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই ঠিকই। কিন্তু মা-রও তো কিছু দিতে ইচ্ছে করে।
আমি চুপ করে গেলাম। বৃন্দা বলল, দাঁড়াও তোমাদের কফিটা করে আনি।
ও চলে যেতে তিস্তাকে বললাম, হ্যাঁরে, বাবা কেমন আছেন?
ও বলল, বাবা ঠিকই আছে। মা ভালো নেই।
তিস্তা বলল, আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা।
-তোকে নিয়ে দুশ্চিন্তা! কেন ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিস বলে?
–না, সৌম্যকে বিয়ে করতে চাই বলে।
—সৌম্য কে?
—ফিলজফির সৌম্য। গতবারে এম এ পাস করেছে।
—তাতে কী হল?
—ছেলেটার চালচুলো নেই। মার ভীষণ আপত্তি।
জিজ্ঞেস করলাম, চাকরি করে?
তিস্তা মাথা নীচু রেখেই বলল, কলেজ টিচার্স প্যানেলে নাম উঠেছে, এখনও পোস্ট পায়নি।
—তা হলে?
–আপনাকেই বোঝাতে হবে মাকে।
–মা কী বলে?
-বলে, তোর জন্য অনেক কষ্ট করেছি জীবনে। ছোটো থেকেই কষ্ট করছি। তোরও কষ্ট দেখলে মরে যাব।
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল আমার। লালিমার কষ্ট তো আমি নিজেও দেখেছি। হে ভগবান, ওই কষ্ট যেন তিস্তার ওপর না গড়ায়।
বললাম, সৌম্য, ছেলে কেমন?
তিস্তা বলল, অপূর্ব! তবে প্র্যাক্টিক্যাল সেন্স কম। না হলে উচ্চমাধ্যমিকের স্ট্যাণ্ড করা ছেলে ফিলোজফি পড়তে যায়? এদেশে এই সাবজেক্ট নিয়ে অধ্যাপনা ছাড়া কিছু জোটে?
-কেন অধ্যাপনা খারাপ পেশা? আমি করি না?
–ও-ও আপনার মতোই বলে, জীবনে টিউশনি করব না, নোট বেচব না।
—তাহলে শুধুই পড়াবে?
—আর বলে শংকরাচার্য নিয়ে গবেষণা করবে।
আমার বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল ব্যথায়। জীবনে কত বাসনা ছিল কান্ট-এর দর্শন নিয়ে গবেষণা করব। পড়াতে পড়াতে কীভাবে সময় চলে গেল। ইংরেজির লোক হয়েও দর্শনের ওপর এই মোহ আমার কাটল না অ্যাদ্দিনে। টিউশনি যে করি না তার একটা কারণও দর্শন পড়ার জন্য সময় বাঁচানো।
আবার আনন্দও হল সৌম্যর কথা ভেবে। আজকের এই র্যাট রেসের দিনেও একটা ছেলে শংকরাচার্য নিয়ে পড়তে চাইছে। আমার চটকা ভাঙল তিস্তার কথায়। মামু, আপনি মাকে বোঝাবেন।
বললাম, বোঝাতে পারব কি না জানি না। তবে চেষ্টা করব।
কফি আর খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে বৃন্দা বলল, তোমরা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ডেও মন ভরছে না?
আমি কফির পেয়ালা হাতে নিতে নিতে পরিবেশ হালকা করার জন্য হিন্দি সিনেমার চালে বললাম, সমস্যা গম্ভীর হ্যায়।
রাতে শুয়ে আছি, চোখে ঘুম নেই। একটু আগে বেডল্যাম্প জ্বেলে নীরস বই পড়েও ঘুম আনানোর চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি।
পাশ ফেরার বহর দেখে মনে হচ্ছে বৃন্দার চোখেও ঘুম নেই। বোধহয় তিস্তার সমস্যা এখন আমাদের দুজনের ওপরই ভর করেছে। হঠাৎ শুনি অন্ধকারে বৃন্দার গলা, সব শুনলে ওর সমস্যা?
বললাম, শুনলাম তো। দেখি ওর মার সঙ্গে কথা কয়ে।
বৃন্দা বলল, লাভ নেই।
-কেন?
—সমস্যা যে মেটার নয়।
—কেন, ছেলে কি খারাপ?
—চমৎকার ছেলে। ফুসফুসটা খারাপ। লিমাদির আসল আপত্তি ওইখানে, তিস্তা চেপে গেছে।
-ফুসফুঁসের কী হল আবার?
—সাসপেক্টেড প্লুরিসি। কিছুদিন হল ধরা পড়েছে।
—এই বয়সে যক্ষ্মা?
—ছেলেটা যে বাল্যকাল থেকে অপুষ্টিতে ভুগছে। বাব নকশাল, মা নকশাল। আণ্ডারগ্রাউণ্ডে থেকে থেকেই তো সংসার করেছে। ভালো চাকরি খুইয়েছে। ছেলেটার বোধহয় ভালো করে দুধও জোটেনি কোনোদিন। পিসিমার কাছে বড়ো হয়েছে।
–তা তুমি এতসব জানলে কোত্থেকে?
—তিস্তার কাছেই শুনেছি। যাকগে তুমি এখন ঘুমোও। কাল দশটায় ক্লাস আছে। মনে আছে?
আমি অন্ধকার ঘরের মধ্যে আরও গভীর এক অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল চা নিয়ে বৃন্দার ডাকে, ওঠো সাড়ে ছটা বেজে গেছে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে কী ভাবছিলাম জানি না, বৃন্দা স্টেটসম্যানটা নিয়ে এসে আমার সামনে রাখল। কাগজটা উলটেপালটে দেখবারও উৎসাহ পাচ্ছি না। শুনি, বৃন্দা বলছে। আচ্ছা প্লুরিসি সারে না? আমি হেসে ফেললাম, কী যা-তা বলছ? চিকিৎসা হলেই সারবে। কথা হচ্ছে, সেজন্য পয়সা লাগবে।
বৃন্দা বলল, সেটাই তো কথা। বেকার ছেলে কোথায় পাবে? বললাম, আর শুধু তো চিকিৎসা নয়, ভালো পথ্যও চাই।
হঠাৎ বৃন্দা বলল, আচ্ছা তুমি পার না ওকে এই সাহায্যটা করতে?
আমি হাসলাম। টাকা তো সব তোমার কাছেই থাকে। তুমিই তো ভালো জান আমার কতটুকু কী সম্বল। মাস গেলে আরও দু-আড়াই হাজার টাকার কমিটমেন্ট তো ইয়ার্কি নয়।
তা ঠিক। বলে আরেক কাপ চা আনতে উঠে গেল বৃন্দা। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার শরীরে হঠাৎ এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। তিস্তার সমস্যার সমাধানের একটা আশা যেন দেখতে পাচ্ছি সহসা। বলতে গেলে তিস্তাই হদিশটা দিয়ে গেল নিজের অজান্তে।
ও চা নিয়ে ফিরতেই আমি সমাধান বাতলে দিলাম, বৃন্দা বাড়তি দু-তিন হাজার কিন্তু সমস্যা হওয়ার কথা নয় আমার কাছে। কথার মাথামুন্ডু ধরতে না পেরেও ও বলল, কীরকম?
-কেন প্রাইভেট টিউশনি?
—টিউশনি! তুমি টিউশনি করবে, যাতে তোমার এত ঘেন্না, আমার স্কুলের টিউশনিও ছাড়িয়ে দিলে যে কারণে।
বললাম, প্রয়োজন। প্রয়োজনে মানুষ সব করে। কথায় আছে না? অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যাণ্ড ওয়ার। প্রেম ও যুদ্ধে সবই বলিদান দেওয়া চলে। আমি না হয় ছ-আট মাস কি এক বছরের জন্য আমার নীতিকেই উৎসর্গ করলাম।
বৃন্দা বলল, তো এই নীতি বর্জন যুদ্ধ না প্রেমের জন্য?
বললাম, প্রেম। তিস্তার প্রেম।
মনের ভিতর খেলে গেল দূর অতীতের দুই বন্ধুর দিদির জন্য ক্ষণকালের এক প্রেমের স্মৃতিও। লালিমার খোলা বুকে শিশুর মতো হাত ছুইয়ে বসে এক স্বর্গের স্বাদ। ঠিক সময় জানালা দিয়ে দিনের প্রথম রোদ্দুর এসে বৃন্দার মুখে পড়ে ওকে উদ্ভাসিত করে তুলল।
আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি
আমি বরাবরের সেই ল্যাবেণ্ডিস মার্কা রাজুই থেকে গেলাম। নীচে পার্টির সব অভ্যাগতই এসে গেল, আমার এখনও টাই বাছা হল না। সাদার ওপর নীল পিনস্ট্রাইপ শার্টের ওপর নীল ব্লেজারটা চাপালেই মেরুনের ওপর স্কাই ব্লু পোলকা ডটের ওই টাইটা উঠে আসবেই গলে। এভাবেই চলে আসছে গত সাত দিন; ভেবেছিলাম আজ নতুন একটা টাই বেছে ফেলবই।
আর এখন আমি আধ ডজন টাই নিয়ে গলায় ঘোরাচ্ছি। আর এইমাত্র
-রাজুকাকু! প্লিজ গেট রেডি। সব্বাই এসে গেছে। উই আর অল ওয়েটিং ফর ইউ। দরজায় টোকা মেরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে আমায় সোমা। ভাবছে অত না চেঁচালে আমার ঘুম ভাঙবে না। মেয়েটার ধারণা আমি দোর দিলেই কম্বলের নীচে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ি। ওর ভাষায়-কাকুর লণ্ডন ঘুম!
আর আমি আধ ডজন টাই হাতে আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি কোনোদিন মানুষ হব না।
এক মাসও হয়নি আমার নির্মলদার বাড়িতে, কিন্তু কারো আর জানতে বাকি নেই আমি কী অসম্ভব স্নান, নিদ্রা আর আত্মবিলাসী। যদি বাথটাবে সাবান জমিয়ে স্নানে নামলাম তো ঘড়ি স্থির হয়ে গেল। যদি ঘুম লাগালাম তো নাওয়া-খাওয়া চুলোয় গেল। আর যদি এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে জানালার পাশে বসলাম তো আমার থেকে ‘আমি’টাই উধাও হল। আমি একটা রক্ত-মাংসের স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। তখন ক-বার সোমা নীচের থেকে হাঁক দিল, নির্মলদা দোতলার টয়লেট ব্যবহার করতে এসে মৃদুকণ্ঠে ক-বার ডাকলেন ‘রাজু! রাজু!’ আমার খেয়াল থাকে না। কিন্তু এই বিশ্বকুঁড়েমির সঙ্গে এক বিশ্বকপালও আমার জুটেছে। সবাই আড়াই দিনের মাথায় আমার ভাবগতিক বুঝে নিয়ে তৃতীয় দিন থেকে আমার সাতখুন মাফ করতে থাকে। সোমা আর ওর বাবাও আমাকে প্রশ্রয়ের সুরে ইদানীং ডাকে ফিলোসফার বলে। ওদের ধারণা আমি সম্ভবত ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও ভাবি।
সত্যিই যদি ওরা দেখতে পেত আমার ভিতরটা। আমি যখন স্নানে কিংবা নিজের মধ্যেই ডুবে থাকি তখন আসলে আমি কিছুই ভাবি না। শুধু একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব ছেয়ে থাকে আমার চোখে, যা আমি আনমনে দেখি। আবার দেখিও না। কিন্তু ভীষণ সুখ অনুভব করি। বাবার কথা মনে পড়ে, যিনি থেকে থেকেই বলতেন, রাজুকে আমি অক্সফোর্ডে পড়াব। কিন্তু হঠাৎ একদিন মামলার ফাইল দেখতে দেখতে সেরেব্রাল স্ট্রোক হল বাবার। ফলে কথা রাখা হয়নি। লণ্ডনে এসে অজস্র সুখের মধ্যে একটা সুখ হল মনশ্চক্ষে বাবার সেই মুখটা দেখতে পাওয়া। একেক দিন গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে আমি আপন মনে হেসে ফেলি। কারণ আয়নায় তখন আমি আমার মুখের জায়গায় দেখতে পাই বাবার মুখ। কোর্টে যাওয়ার আগে তড়িঘড়ি টাইয়ের নট ফাঁসাতে গিয়ে লেংথ মিস করছেন!
সোমার ডাক শুনে আমার চকিতে মনে পড়ল অফিসের বন্ধু রাণাকে। ও-ই চিঠি লিখে আমার থাকার বন্দোবস্ত করেছিল লণ্ডনে। বলেছিল, থাকবি তো চার মাস। অযথা পাউণ্ড নষ্ট করবি কেন? দাদাকে লিখে দিচ্ছি—তোর বোর্ড অ্যাণ্ড লজিং ফ্রি। পকেটে যা থাকে নিজের কাজে খরচ কর। দাদাকে একটা পেনিও দেবার দরকার নেই।
একই সঙ্গে আশ্বস্ত এবং বিব্রত হয়ে বলেছিলাম, সে কী বলছ! অতদিন থাকব, একটা পয়সাও দেব না সংসারে?
রাণা বলল, এগজ্যাক্টলি! দাদার ওখানে ওটাই নিয়ম। আর দাদার সংসার বলতে তো দাদা আর সোমা। বউদি শিলঙে থাকেন, কলেজ অধ্যাপিকা। ছুটিছাটায় লণ্ডন যান। দেখবি সোমাই তোর দেখাশোনা করবে। শি ইজ এ জেম অব এ গার্ল! সোমাই ডেকে উঠল ফের, কাকু! আর আমি এই প্রথম ওর ডাকে উত্তর করলাম, যাচ্ছি! আই’ম রেডি! রীতিমতো বিব্রত হয়ে আমি ওই মেরুন জমিতে নীল পোলকা ডটের টাইটা চড়িয়ে লম্বা লম্বা স্টেপিং-এ নেমে এলাম একতলার বসার ঘরে।
কোনো অর্থেই কোনোদিন আমি পার্টি ম্যান নই। পার্টিতে লাগসই কথোপকথন আমার আসে না, ঘুরে ঘুরে বারোজনের সঙ্গে আলাপ জমাতে পারি না, কাকে, কোন পার্টিতে আগে দেখেছিলাম মনে করতে পারি না। আরও বড়ো সমস্যা, হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে একই সঙ্গে খাওয়া আর বাতচিৎ চালিয়ে যেতে পারি না। প্রায়ই দেখি আমি যখন খাবার তুলেছি হাতে তখন একে একে লোকজন আলাপে প্রবৃত্ত হচ্ছেন আমার সঙ্গে। শেষে আধপেটা খেয়ে নিজেকে দুষতে দুষতে বাড়ি ফিরি। কিন্তু আজ আমি পেট পুরে খাব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি, কারণ দেড় দিন ধরে স্কুলের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে পদগুলো তৈরি করেছে সোমা! আর সুযোগ বুঝে একবারটি শুনিয়েও রেখেছে, কাকু, ল্যাম্ব রোস্টটা কিন্তু তোমার জন্য স্পেশ্যালি মেড। আই মাস্ট হ্যাভ ইয়োর ওপিনিয়ন।
আর আমি এখন সেই পার্টির মাঝখানে।
নির্মলদা লণ্ডনের এক পাবলিক স্কুলের শিক্ষক বলে ওঁর অভ্যাগতদের অধিকাংশই শিক্ষক-শিক্ষিকা। যাঁদের অধিকাংশই আবার সাহেব-মেম। শিক্ষক বললেই আমাদের দেশে কিছু ভারিক্কি চেহারার বয়স্ক লোকের চেহারা মনে পড়ে। নির্মলদার সহকর্মীরা দেখলাম দারুণ হাসিখুশি, টগবগে তরুণ-তরুণী। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়েসি নির্মলদাকে যাঁরা ‘পাপা, ‘ওল্ডম্যান’, ‘গ্র্যাণ্ডপা’ বলে ডাকছেন, ঠাট্টা করেই। কিন্তু নির্মলদার কাছে ডাকগুলো ভীষণ অমায়িক ঠেকছে। নির্মলদার স্বভাবগম্ভীর আচার-ব্যবহারও দেখি বিলকুল বদলে গেছে ওঁদের সঙ্গে পড়ে। উনি ওঁদের কাছে আমাকে পরিচয় করালেন ভাইয়ের বন্ধু বলে নয়, ‘জাস্ট অ্যাবাউট মাই ইয়ঙ্গার ব্রাদার হিসেবে। বলতে বলতে হাতে ধরিয়ে দিলেন বিয়ারের একটা জাগ। তারপর নিয়ে এলেন ওঁর বাঙালি বন্ধুদের কাছে। চার-চারটি বিভিন্ন বয়সি বাঙালি দম্পতি। চতুর্থ দম্পতি বয়সে সবচেয়ে ছোটো, নির্মলদা জানালেন স্বামীটি ম্যাকেলসফিল্ড হসপিটালের সার্জেন। স্ত্রী পার্ট টাইম কাজ করে পোস্ট অফিসে। নাম বৃন্দা। আর…
আর কিছুই আমার মগজে ঢুকছে না। আমি ক্ষণিকের জন্য অসম্ভব অবাক হয়ে তাকালাম মেয়েটির দিকে। রূপে জ্বলে যাচ্ছে সারা দেহ। যেমন রূপ শুধু ছবিতেই দেখি আমরা। আর দেখলেই মনে হয়, আহা, কত চেনা মুখ! কী যেন নাম? আসলে চেনা নয় কোনোখানেই, তবু মনে হয়। আর সব মনে হওয়াটাই বিদ্যুতের এক ঝলকের মতো। কিন্তু তারই মধ্যেই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে মনটা। আগে কোনোদিন না দেখার অনুশোচনায়, পরেও হয়তো দেখা না হওয়ার সম্ভাবনায়।
নির্মলদা আমার পরিচয় দিতে গিয়ে কীসব বলছেন আমি শুনতে পাচ্ছি না। শুধু হাসি হাসি মুখ করে ফ্যালফ্যাল করে দেখছি বৃন্দাকে। আর দেখছি বৃন্দাও আমাকে দেখছে! আর হঠাৎ কীরকম লজ্জা হল আমার। আমি বিয়ারের ঢোক গিলতে গিলতে সরে এলাম পার্টির অন্যত্র।
একটি ইংরেজ যুবতী সবার নজর কেড়ে নিয়েছে। সে তার স্কুলের ভূগোল, ইতিহাস, অঙ্ক ইত্যাদির শিক্ষকদের গলা আর হাবভাব অনুকরণ করে দেখাচ্ছে। সেইসব শিক্ষকদের প্রশ্নের জবাবে বালক-বালিকারা যেভাবে কোঁকায় সেই স্বরও ‘উই উঁই, কুঁই কুঁই করে শোনাচ্ছে। ওর আশপাশের সবাই হেসে কুটোপুটি যাচ্ছে, তাদের দেখাদেখি আমিও খুব হাসছি। আমার খুব ভালো লাগছে এই ভেবে যে, কলকাতার পার্টিগুলোতে যেরকম আজেবাজে কথা হয়, অনুপস্থিত লোকের নিন্দে হয় আর একটা-দুটো লোক বেরোয় যারা জীবনের সমস্ত কান্নাকাটি লোকজনের সামনে সেরে ফেলবে বলে তৈরি হয়ে আছে তেমন কিছুর সম্ভাবনা এখানে নেই। ভালো লাগছে এটা দেখেও যে কেউ কাউকে জোর করে বেশি বিয়ার, হুইস্কি, ওয়াইন গিলিয়ে দিচ্ছে না। আর ভীষণ ভালো লাগছে শুনতে কিছু বিশুদ্ধ অক্সফোর্ড-ইংরেজি অ্যাকসেন্টি। ক্রমে এইসব বিক্ষিপ্ত বিক্ষিপ্ত ভালোলাগাগুলোকেও ভালো লাগতে শুরু করেছে আমার। আমার মতো লোকের ভেতরে যে ধরনের বিলাত-বিলাসিতা লুকিয়ে থাকে সেটাই যেন দামি মদের মতো আস্তে আস্তে অধিকার করছে আমাকে। বৃন্দার মুখটা ভুলতে যতটা কষ্ট হবে ভেবেছিলাম তেমন কষ্ট কিছুই হচ্ছে না। তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বিয়ার হাতে আমি নিজেকেই ভুলতে বসেছি।
আপনাদের দেশে তো খুব ময়ূর হয়। আপনি স্বপ্নে কখনো ময়ুর দেখেছেন?—আমি চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখলাম প্রশ্নটা করেছে বারবারা নামের মেয়েটি। কিছুক্ষণ আগে নির্মলদা যার সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে বলেছিলেন, জানো তো, বারবারা ড্রইং টিচার হলে কী হবে, ওর আসল প্যাশন কিন্তু সাইকোলজি। মনোবিজ্ঞানের ওপর একটা থিসিস নিয়েও ও কাজ করছে।
আমি বারবারার কথায় কীরকম বোকার মতো হয়ে গেলাম। ময়ূর! ময়ূর দেখিনি যে তা নয়। তবে স্বপ্নে? আমি এক ঢোঁকে জাগের বাকি বিয়ারটুকু শেষ করে দিয়ে একটু বা আমতা আমতা করে বললাম, ময়ূর খুব সুন্দর ঠিকই, কিন্তু আমার প্রিয় পাখি কিছু নয়। ছেলেবেলায় দেখেছি কি না মনে নেই, এখন অন্তত স্বপ্নে ময়ূর, বক বা হাঁস-টাস দেখি না।
—তুমি কি স্বপ্নে কোকিলের ডাক শুনেছ?
–কোকিল তো এখানকার খুব ডাকসাইটে পাখি।
বারবারা হা হা হি হি করে হাসতে শুরু করল।
হাসতে লাগলাম আমিও। আর কোত্থেকে উঠে এসে নির্মলদা মেয়েটিকে বললেন, রাজু কিছু বাজে কথা বলে ফেলল বুঝি? বারবারা বলল, হ্যাঁ! ও বলতে চায় ও স্বপ্নে পাখি দেখে না। আমার ধারণা ও সাপ দেখে। কথাটা বলেই খুব গম্ভীর করে ফেলল মুখটা। যেন শেষের কথাটা মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিতেই বলেছে। যা দেখে ভেতরে ভেতরে হোঁচট খেলাম আমি। কারণ আমি তো সত্যিই বিরাট বিরাট সবুজ সবুজ ময়াল সাপ দেখি স্বপ্নে। কী যে তার মানে তা কেবল ফ্রয়েড সাহেবই জানেন। নির্মলদা বারবারার কথার সংশোধন করে বললেন, দুর! রাজু কেবল বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখে। ও সাপখোপ দেখবে কেন? ও কুমির দেখে।
আমরা ফের জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। আর তখনই বসার ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কেতাদুরস্ত উচ্চারণ আর মধুঝরা সুরে সোমা ঘোষণা করল, ডিনার ইজ সার্ভড। শ্যাল উই মুভ টু দ্য ডাইনিং প্লেস? নির্মলদার স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিস্ট্রেস শার্লি পাইন্টার ছুটে গিয়ে সোমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, ও! হোয়াট আ ফাইন পিস অব ইনফর্মেশন। সাউণ্ডস লাইক মিউজিক!
আমি এইমাত্র প্লেটে উঠিয়ে নিলাম আরেক পিস ল্যাম্ব রোস্ট। উঃ কী ভীষণ ভালো বেঁধেছে পদটা সোমা। মেয়েটা সত্যিই একটা জিনিয়াস। তেরো-চোদ্দো বছরের একরত্তি মেয়ের মধ্যে অবলীলায় মিশে আছে একটা মা, একটা মেয়ে, একটা বোন। যেমন বাবাকে তেমনি এই উড়ে এসে জুড়ে বসা কাকুটিকে খাইয়ে-পরিয়ে যত্ন-আত্তিতে জিইয়ে রেখেছে। এ ক-দিনের মধ্যেই ওর বাবার দশা আমারও। সোমা না থাকলে চোখে অন্ধকার দেখি। শুনেছি ক-দিন বাদে স্কুলের এক্সকার্সনে স্কটল্যাণ্ডে যাবে। তখন যে কী হাল হবে আমাদের এক ভগাই জানে। আমি ল্যাম্বের দ্বিতীয় টুকরোটা ছুরি-কাঁটায় ছিড়তে ছিড়তে ইতিউতি তাকালাম সোমাকে ডাকব বলে। সাঙ্ঘাতিক একটা প্রশংসা ওর প্রাপ্য। কিন্তু কোথায় সোমা? লোকের ভিড়ে মিউনাইট ব্লু গাউন পরা মেয়েটিকে তো কোথাও দেখছি না। নিশ্চয়ই ডেসার্ট প্লেটগুলো রেডি করতে গেছে। মেয়েটার মাথার মধ্যে একটা রোলেক্স কি ওমেগা ঘড়ি গাঁথা আছে নিশ্চয়ই। আমি একটা ল্যাম্বের টুকরো পুরলাম মুখে।
লণ্ডনের বাঙালি ও ইংরেজ পরিবারে দুটো-একটা ডিনারে আমন্ত্রণ পেয়েছি এর মধ্যে। দেখেছি খাওয়ার শেষে অতিথিরা নিজের নিজের প্লেটগুলো সিঙ্কে নিয়ে ধুয়ে দেন। দেশের মতো এখানে তো আর কাজের লোক রাখার বিলাসিতা বিশেষ নেই। দিনে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য কাজের লোক রাখলে যে দক্ষিণা গুনতে হবে তাতে মনিবের কামাই ফুরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে সবখানেই দেখি আপনা হাত জগন্নাথ। এ বাড়িতে আমার আবির্ভাবের প্রথম দিনেই নির্মলদা যে দু-চারটে ব্যবহারিক শিক্ষা আমায় দিয়েছিলেন তার একটা হল গরম আর ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে, প্লেটে গ্লাসে ওয়াশিং পাউডার ঢেলে নিজের বাসন ধুয়ে, ন্যাকড়ায় মুছে জায়গা মতো গুছিয়ে রাখা। অনেক দিন বাসন ধুতে ধুতে সিঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করেছি নির্মলদা কি সোমার সঙ্গে। নির্মলদা বলেন, সিঙ্কের পাশের এই জায়গাটা আমাদের উঠোন। এখানে দাঁড়ালে পরনিন্দা-পরচর্চা আপনা-আপনি আসে। আর আস্তে আস্তে এও দেখেছি যে, এ জায়গাটায় একলা দাঁড়িয়ে বাসন মাজার সময় আমার মনে পড়ে দেশের কথা। মায়ের কথা। মা কোনোদিন অন্যকে দিয়ে নিজের বাসন ধোয়ায় না।
ক্রমে ক্রমে সবাই নিজের নিজের বাসন ধুয়ে, জায়গা মতো রেখে আইসক্রিম কেকের প্লেট নিয়ে ড্রইং রুমে চলে গেছে। পার্টিতে শেষ ঢুকেছিলাম আমি, ডিনারও সবার শেষে হাসিল করলাম আমি। তাই কিছুটা লজ্জার সঙ্গেই গুটিগুটি হাতের প্লেট আর কাঁটা-চামচ নিয়ে চলে এসেছি রান্নাঘরের এক প্রান্তে বসানো ডিশ ধোয়ার সিঙ্কে। লজ্জা আরেকটা কারণেও; এখনও কাঁটা-চামচে পরিপাটি করে খাওয়া রপ্ত করতে পারলাম না। চিকেনের পদটা প্রায় অনাস্বাদিতই থেকে গেল আমার হাতুড়ে মার্কা খাওয়ার পদ্ধতিতে। কাঁটা-চামচের খটখটাং আওয়াজ বার করি না ঠিকই, কিন্তু সামান্য কুটকুট আওয়াজেও আহার সারতে পারি। কাঁটা-চামচ ধরলেই স্যুট-বুটের ভেতর থেকে আমার ভেতো বাঙালি সত্তাটা এখনও উঁকিঝুঁকি দেয়। প্লেটে খাবারের অবশিষ্টাংশের স্থূপ দেখে জিভ কাটতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে… আমার চিঠির উত্তর পাইনি কিন্তু।
সুরেলা, মেয়েলি কণ্ঠে কে বলল একথা? চকিতে ঘুরে দেখি কিচেনের দরজায় একটা অভিমানী হাসি মেখে দাঁড়িয়ে আছে বৃন্দা। চিঠি! কীসের চিঠি! কার চিঠি! কেন! আকাশ পাতাল ভেবেও কিনারা করতে পারছি না। আমতা আমতা করে বললাম, আমায় বললেন, বৃন্দা।
বৃন্দা এক রতি অভিমানও ত্যাগ না করেই বলল, আবার কাকে?
—কিন্তু.কিন্তু…আমি তো…
–বারো বছর হয়ে গেছে তো! তাই মনে পড়ছে না। বৃন্দা এবার ঠাট্টার হাসি হাসছে। আর আমি মনে করার চেষ্টা করছি বারো বছর আগে কোনো মেয়ের চিঠি…
বৃন্দা ফের বলল, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের একটা গান শোনার অনুরোধ করেছিলাম। আপনি খুব মানবেন্দ্র-ভক্ত ছিলেন, না? হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো! তাই তো! তাই তো! আমি ভুলিনি। আমার সব মনে আছে… আমার সব মনে থাকে… চিঠির ভাষা থেকে হাতের লেখা থেকে প্রেমিকার মুখ থেকে গানের বাণী থেকে গানের সুর থেকে চোখের জল থেকে… আবার কী করে, কী করে যেন সব ভুলেও যাই। যেমন ভুলেছিলাম বৃন্দাকে।
পাড়ার ডাকসাইটে কার্ডিওলজিস্টের কিশোরী কন্যা বৃন্দা। পটে আঁকা ছবি থেকে নামানো শরীর পূর্ণ প্রস্ফুটিত নয়, কিন্তু কী রূপ! আমি বোর্ডিং স্কুল থেকে ছুটিতে বাড়ি ফিরেছি হায়ার সেকেণ্ডারি টেস্টের পড়া করব বলে। চাইলেও বোর্ডিংয়েই থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু বেশি বেশি পড়া করতে গেলে আমার বাড়ির ছাদের চিলেকোঠাটা খুব দরকার। দারুণ নিরিবিলি। আড় চোখে আকাশ আর ঘুড়ি দেখি। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে ছাদ ঘুরে ঘুরে পায়রাদের দানা খাওয়াই। কাদের পায়রা এরা জানি না। কিন্তু দানা ধরলে হাতে এসে বসে। আমি তখন দার্শনিকের মতো ইণ্ডাক্টিভ লজিকের সিলোজিজম কষি মনে মনে। সব প্রাণীই মরণশীল; সব মানুষই প্রাণী; কাজেই সব মানুষই মরণশীল।
পড়তে পড়তে সন্ধ্যে নামলে আমার আর একটা বিনোদন আছে। চিলেকোঠার পিছনের জানালাটা খুলে দিয়ে স্থির হয়ে বসা মেছো বাড়ির পিছনে অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়ে লোরেনদের বসার ঘর পরিষ্কার দেখি তখন। ঘরে গ্রাম চালিয়ে আপন মনে স্টেপিং প্র্যাক্টিস করছে লোরেন, কখনো কখনো স্ট্রিপ টিজ অভ্যেস করছে। পুরো মাত্রায়! তখন আমি আমার ঘরের লাইট নিবিয়ে ও তুলোর মতো সাদা আর লাস্যে ভরা দেহটাকে চোখ ভরে দেখি। অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয় শরীরে, যা আমার ভালো লাগে। মিশনের ছাত্র আমি, এই বুঝি স্থলন— ভাবি আমি। পরক্ষণেই ভাবি এও তো জীবন। লোরেন যেমন এসব করে আমাকে বিব্রত করতে, আমি দেখি কারণ আমার বিব্রত হওয়ার চেয়ে ভালো লাগাটা বেশি। আমি নারী দেহ দেখছি। বিশেষ কাউকে দেখছি না। ওই দৃশ্য আর আমার ভাবনায় শরীর গরম হয়, ঘামি। কিন্তু আমি নিজেকে বলি—এ আমার পরীক্ষা। আমি পাস করবই। তারপর একসময় আমি ঘরের জানলা বন্ধ করে, লাইট জ্বালিয়ে লজিকের বই নিয়ে বসি।
কিন্তু সেদিন একতলায় পড়ছিলাম স্বৰ্গত পিতার বন্ধ সেরেস্তায়। সামনে খোলা সংস্কৃত বই। যখন ঘরে ঢুকে কাজের লোক বুড়িমা একটা ছোট্ট খাম দিল হাতে। বলল, ডাক্তারবাবুর মেয়ে বিন্দি দিয়েছে। বলেচে দাদাবাবুর কাচ থেকে উত্তর এনো।
আমি বুঝলাম না কে বিন্দি, কেন চিঠি লিখেছে, কী উত্তর চায়। আমি চিঠিটা নিয়ে বুড়িমাকে বললাম, ঠিক আছে। তুমি যাও। তারপর রাইটার্সের কেরানির উন্নাসিক ঔদ্ধত্যে পড়পড় করে খাম ছিঁড়ে বার করে ফেললাম চিঠিটা। আর পড়তে গিয়ে…না, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওই কিশোরী বৃন্দা আমাকে এই চিঠি লিখেছে। এমন এক চিঠি যার কোনো উত্তর হয় না। অন্তত আমি জানি না। কিংবা, জানলেও নিজের মাথা খুইয়ে লিখতে বসতে পারব না। বস্তুত, পড়তে পড়তেই আমি যেন কীরকম হয়ে যাচ্ছি। ও লিখছে—
প্রিয়
শেষে চিঠি লিখিয়েই ছাড়লে। ছাদ থেকে কেন তাকিয়ে থাকো না আমাদের ছাদের দিকে? যাতে আমায় দেখতে পাও বা আমি তোমায় দেখতে পাই। খুব পা-ভারী লোক তুমি কিন্তু। সবাই তোমার খুব সুখ্যাতি করে। বলে তুমি খুব পন্ডিত। খুব ভালো ইংরেজি জানো। আমিও সুখ্যাতি করি। বলি, ও কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না। খুব ভালো লাগত যদি বলতে পারতাম, শুধু আমার দিকে ছাড়া।
শুনেছি তুমি খুব গান শোনো, গান ভালোবাসো। আমিও ভালোবাসি। আমার বান্ধবীরা কেউ গান জানে না, আমি ছাড়া। কিন্তু আমি কখনো বাইরের লোকের সামনে গাই না। তুমি যদি এ চিঠির উত্তর দাও তাহলে আমি কোনো একদিন তোমায় একটা গান শোনাতে পারি। আসলে তোমার সঙ্গে খুব ভাব করতে ইচ্ছে করছে। তোমায় রাস্তা দিয়ে যেতে দেখলে খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় ডাকি, তারপর বুক ধড়ফড় করতে থাকে। জানি না তো তুমি কীরকম মানুষ। নিশ্চয়ই খুব গম্ভীর। কিন্তু রাগী নও। আমি সেধে আলাপ করলে হয়তো পাত্তাই দেবে না। সেদিন যখন চঞ্চলার মুখে শুনলাম তুমি সপ্তাহ খানেক পর বোর্ডিং-এ ফিরে যাবে তখন বাধ্য হয়ে চিঠি লিখে ফেললাম।
কে যেন বলছিল যে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যয়ের ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’ গানটা তোমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা আধুনিক। শোনা অবধি কীরকম যে করছে বুকের ভেতরটা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। এই গানটা জীবনে সবচেয়ে ভালো লেগেছে। শুনলে কীরকম যে হয়! আর ওই গানটাই তোমার এত প্রিয় জেনে আর থাকতে পারলাম না। রোজ দু-বার করে গ্রামোফোনে শুনছি আর ভাবছি, ইশ! থাকত যদি ও এখানটায়! খুব বেহায়া ভাবছ নিশ্চয়ই আমাকে। যা আমি মোটেই নই। ছেলেদের ভালোবেসে ফেলা যে কী তা কোনোদিন জানতাম না। আর নতুন করে জানতেও চাই না। একবারই ঘাট হয়েছে আমার।
যদি চিঠির উত্তর দাও তোমাদের বুড়িমার হাতে পাঠিও। আর যদি না দাও আমি…না, আমি তোমাকে কিছু বলব না।
ইতি
তোমার বৃন্দা
মূর্খ, পাষন্ড আমি। আমি চিঠিটা পড়লাম। একবার দু-বার তিনবার চারবার পাঁচবার বহুবার পড়লাম। বহুবার কলম তুলেও রেখে দিলাম। এ আমি কী করতে যাচ্ছি! সামনে পরীক্ষা আর আমি প্রেমপত্র লিখতে বসব! তাও এমন কাউকে যে না-চিনে, না-জেনে এরকম চিঠি লিখে ফেলে! যে এত খোঁজ নিয়েছে আমার শুধু প্রেম করবে বলে। পাড়ায় টিটি পড়ে যাবে না? লোকে কী বলবে? বলবে, ওপরে সাধু সাধু, পন্ডিত পন্ডিত। তলে তলে… না, এ আমি বরদাস্ত করতে পারব না। আমার সব প্রেম চাপা থাক সত্তার গভীরে, আর ওপরে আমি আমার মতোই। এ চিঠির উত্তর দেওয়া মানেই প্রেমে পড়া। যা আমি কিছুতেই পড়ব না।
আমি চিঠিটা দলা পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দুদ্দাড় করে উঠে গেলাম চিলেকোঠার ঘরে। গিয়ে জানালা খুলে বসলাম। আর দেখি স্ট্রিপ টিজে মত্ত আছে লোরেন। মনে মনে বললাম, বাঁচিয়েছে! দূর থেকে এ অনেক ভালো। আমি কারও কাছে কিছুতেই যাব না। ভাবতে ভাবতে দু-চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল পড়ল। লোরেনের ঘরের গ্রাম থেকে এলভিসের রক-এন-রোল গান ভেসে আসছে। কিন্তু আমি শুনছি মনের ভেতরে মানবেন্দ্র গাইছে ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি।
ক-দিন বাদে চলে গেলাম বোর্ডিং-এ। চিঠি না লিখে। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে এসেও কাউকে চিঠি লিখলাম না। কলেজে যাবার পথেও তাকালাম না একটা বিশেষ বাড়ির দিকে। বুঝলাম আমি ঘোরতরভাবে প্রেমে পড়েছি এমন একটা মেয়ের সঙ্গে যে এমন একটা গান ভালোবাসে, শুনলে আমার খুব অভিমান আর অহংকার হয়। রোজ ভাবি, আর একটা চিঠি যদি আসে… যা আসে না। রাগে আমি আরও একা হয়ে যাই। নিজেকে বোঝাই যে, আমার প্রেমকে নিজে হেঁটে আসতে হবে আমার কাছে। আমি কোথাও যাই না। আমার বুকে এত প্রেম আছে যে, আমার পক্ষে কাউকে প্রেম নিবেদন সাজে না। আমি অপেক্ষা করতে করতে ভুলে যাই কীসের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি নিজের সঙ্গে প্রেমে পড়ে যাই।
যখন ঘোর কাটল দেখি খুব বিব্রত, আরক্ত মুখে বৃন্দা তখনও আমার উত্তরের অপেক্ষায়। বললাম, কেন তুমি আর একটা চিঠি লিখলে না, বৃন্দা? প্রথম চিঠিতে অনেকেই তো ভুল করে। শুধু আর একটা চিঠি যদি…
বৃন্দা মাথা নীচু করে দাঁড়াল একটু। কী ভাবল। তারপর মাথা তুলে ভীষণ দুর্বল, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, তাতে কী লিখতাম?
-শুধু একটা গানের লাইন।
বৃন্দা অপ্রস্তুত হয়ে ছুটে চলে গেল। আর ততক্ষণে ওর বিব্রত অবস্থাটা চালান এল আমার মধ্যে। হাতের ডিনার প্লেটটা মুছতে গিয়ে ছিটকে ফেললাম মাটিতে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে তিনটে ভাঙা টুকরো কুড়োতে যাচ্ছি যখন একটা দমকা হওয়ার মতো ঘরে ঢুকল সোমা—এ কী! কী করছ কাকু! লিভ ইট! লিভ ইট! আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
ব্যাজার মুখে বললাম, দেখো তো, কী একটা নিউসেন্স ঘটিয়ে বসলাম।
সোমা প্রতিবাদ করল, না, না, দিস ইজ গুড ফর আ পার্টি।
পার্টিতে কিছু একটা না ভাঙলে পার্টি কমপ্লিট হয় না।
আমি বললাম, সব ভাঙার দায়িত্ব শুধু কি আমারই, সোমা?
ভাঙা টুকরোগুলো বিন-এ চালতে চালতে পেঁপো মেয়ের মতো সোমা বলল, যারা মন। ভাঙে তাদের এটা অভ্যেস হয়ে যায়।
সর্বনাশ! মেয়েটা কখন কী শুনল? এত অনুমান শক্তি ওর কোত্থেকে এল? ও কি তলে তলে এত পাকা নাকি? আমি ভালো করে চোদ্দো বছরের মেয়েটার দিকে তাকালাম। খুব সুন্দর, মড চেহারা। কোথাও কোনো মিল নেই সেই হারানো কিশোরী বৃন্দার সঙ্গে। আবার কোথায় যেন ওরা একেবারে এক।
সোমা ফের বলল, কাকু, তুমি ড্রইং রুমে যাও। ওখানে বৃন্দা আন্টির হাজব্যাণ্ড তোমার জন্য ওয়েট করছে।
আমি তরুণ সুদর্শন ডাক্তারটির সঙ্গে দ্বিতীয় বারের আলাপেও কেন জানি না করমর্দন শুরু করে দিলাম। আমাদের দুজনের পেটেই বেশ কিছু লাগার বিয়ার পড়েছে। আমার বেশ ভালো লাগল সুমিতকে। সুমিত বলল, তা হলে একটা দিন ঠিক করুন। কবে আসবেন। আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।
বললাম, ঠিক এখনই পারছি না। যদি ক-দিন বাদে একটু ফোন করেন নির্মলদার এখানে।
সুমিত বলল, নো প্রবলেম! আমি ফোন করব।
কিন্তু তারপরেও একটু প্রবলেম থাকছে। আমি যাব, যদি বৃন্দা গান শোনান।
আকাশ থেকে পড়ল যেন সুমিত। একটু থমকেই রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কী করে জানলেন যে ও গান জানে? নিশ্চয়ই নির্মলদা বলেছেন?
একটু চাপা গর্ব নিয়েই বললাম, আমি সেন্ট্রাল ক্যালকাটার ছেলে। আমরা লোকের মুখ দেখেই টের পাই কে, কী জানে বা জানে না। বৃন্দা বলল, না, আপনি একটু ভুলও করলেন মিস্টার মুখার্জি। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার লোকেরা গান শোনানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও অনেক সময় আসেন না।
আমি প্রতিবাদ করে বলতে গেলাম,, না, আমি তা নই। কিন্তু কথাটা আটকে রইল জিভ আর গলার মাঝখানে কোথাও।
সুমিত হঠাৎ আমার সাহায্যে এল। বলল, মিস্টার মুখার্জিকে কিন্তু ডেট ফেল করার লোক বলে মনে হচ্ছে না। তারপর আমার হাতে ফের হাত রেখে বলল, না, না, আপনি প্লিজ আসুন।
আই উইল ফোন ইউ।
আমি বললাম, বহুদিন ভালো বাংলা আধুনিক শুনিনি। বৃন্দা কি কিছু পুরোনো আধুনিক জানেন? ঘাড় নেড়ে বৃন্দা বলল, এক কালে কিছু জানতাম। এখন রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া কিছু গাই না।
বুকে একটা চিনচিনে ভাব হচ্ছে হঠাৎ। একটা ভয়ও। হয়তো এই গানের নিমন্ত্রণও রক্ষা করা হবে না। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার ছেলেদের দুর্নাম থেকেই গেল।
আমি হয়তো জীবনে শেষবারের মতো বৃন্দাকে দু-চোখ ভরে দেখছি। আর সোমা কখন এসে হাতে ধরিয়ে দিল ডেসার্টের প্লেট।
এই রাত তোমার আমার
উত্তর লণ্ডনের বাউণ্ডস গ্রিন পল্লির এক টিপিকাল ডিট্যাচড ইংলিশ কটেজের দোতলার ঘরে একলা বসে তিন দিক মোড়া বেউইণ্ডোর কাচের বাইরের নীল আকাশ, ফর্সা মেঘ আর সবুজের উপর সবুজ চাপানো এর-ওর-তার আর ঈশ্বরের বাগান দেখছিলাম। জানলাটাকে ফ্রেম ভাবলে যেন গোটা একটা কনস্টেবল চোখের সামনে দাঁড় করানো। মন ভরানো এবং নাচানোর জন্য এর চেয়ে মারাত্মক দৃশ্য হয় না, আর তা যে হচ্ছে না, তাও হয়তো নয়। কিন্তু, থেকে থেকেই একটা মধুর বেদনা এসে সব ছেয়ে ফেলছে যখনই মনে পড়ছে আজ মহাষ্টমী।
যদ্দুর মনে পড়ে, ১৯৭৭-এ পন্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে ‘রাগ-অনুরাগ’ বইয়ের কাজ করতে লণ্ডনে গিয়ে প্রথম পুজোর সময় কলকাতা ছাড়া হয়েছিলাম। কুঁদ হয়ে ছিলাম লণ্ডনে ততদিন, যদ্দিন না পুজোর কথাটা এল; আর এল তো এল মা-এর একটা চিঠি ভর করে। সেই চিঠিরই উত্তর লিখছিলাম আমার কাচে-ঘেরা নির্জন ঘরে বসে অক্টোবরের নরম রোদের সকাল দেখতে দেখতে। মা লিখেছিলেন; অমুক অমুক তারিখে পুজো পড়েছে এ বার। শুনেছি, লণ্ডনেও বড়ো পুজো হয়, তুমি তার কোনো একটাতে সময় করে যেও। গঙ্গাতৰ্পণ তো হবে না, তবে মহালয়ার ওই তারিখটায় বাবাকে, কাকাকে মনে করে একটু ধ্যান কোরো। আর পুজোর জন্য একটা নতুন জামা কিনে নিয়ে ওই সময়টায় পোরো। কী করলে আমায় জানিয়ো।
সেটাই লিখছিলাম মাকে। লিখলাম—তোমায় লিখেছি কিছুদিন আগে যে, লণ্ডনের চেয়ে সুন্দর শহর বোধ হয় নেই পৃথিবীতে। আজ অষ্টমীর সকালে অনবরত মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমার জন্য কলকাতার চেয়ে সুন্দর শহর নেই। আর একটু পর কলকাতার প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে যখন আলো জ্বলে উঠবে, আমি মনে মনে ওই সব পাড়ায় পৌঁছে যাব। যদিও এখানকার বেলসাইজ পার্কের বড়ো পুজোয় আমার যাওয়ার কথা আছে একজন বিশিষ্ট বাঙালি ভদ্রলোক নিশীথ গাঙ্গুলির সঙ্গে। আর তোমার কথামতো একটা নতুন নীল সোয়েটার কিনে পরছিও, শীতের কারণে আর জামা কেনা হল না।
আমি সত্যিই মা-কে কোনো স্তোক দিচ্ছিলাম না, মা-ও জানতেন পুজোর সময় আমার কলকাতা ফেলে স্বর্গে যাওয়ারও মন হবে না। হাজার হোক, তিনশো ষাট দিন তো কলকাতায় কষ্ট পেয়ে বাঁচি পাঁচটা রাতের জন্য—পুজোর তিনটে রাত, কালীপুজোর একটা রাত আর ইংরেজি নতুন বছরের রাতটুকু। আরও ছোটো বয়সে আরও তিনটে রাতও জীবনে ছিল। সরস্বতী পুজোর আগের প্যাণ্ডেল বাঁধার রাত, বড়োদিনের রাত আর মধ্য কলকাতায় আমাদের ক্রিক রো পাড়ায় কালীপুজোর পরপর ভানু বোসের সারারাত জলসার রাত। যখন মঞ্চে রক্তমাংসের উত্তমকুমার দেখছি, শুনছি ধনঞ্জয়, শ্যামল, মানব, সতীনাথ, ইলা, আলপনা, প্রতিমা, বাঁশরী, উৎপলা। এই এত সব রাতের শুরুই হত দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর রাতে, আর শেষ হত সরস্বতী পুজোর আগের রাতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অবশ্যই আমাদের ভেবে গান করেননি এই রাত তোমার আমার’, কিন্তু, ওই গানটাই কেবল বোঝাতে পারে পুজোর রাতে আমাদের মনের অবস্থা। নিতান্ত কৈশোরেই, ক্রিক রো-র সংলগ্ন মহেন্দ্র সরকার স্ট্রিটের বিরাট পুজোর সন্ধ্যারতি দেখতে দেখতে, কী করেই যেন হঠাৎ একদিন টের পেয়ে গেলাম এ হচ্ছে প্রেমে পড়ার রাত। অথচ, প্রেম যে কী, সেটাই যথেষ্ট মালুম নেই।
না জেনে, না বুঝে ভালো লাগাই নাকি প্রেম। না জেনে, না বুঝে প্রেমে পড়াই নাকি পুজো। রবীন্দ্রনাথের গানে প্রেম আর পূজার গান কখন কীভাবে আলাদা হয়, সে তো আমি গীতবিতান না দেখলে বুঝতেও পারি না, আর বোঝার পরেও সবসময় মানতেও পারি না। তেমনই, দুর্গাপুজো যে কী করে, কী করে চারধারে আমার প্রেমের মরশুম ছড়িয়ে দিত, তা বুঝতে হঠাৎ দেখলাম কেমন যেন সাবালক হয়ে গেছি আর মেয়েদের দিকে অত খোলা চোখে তাকাতে পারছি না। প্যাণ্ডেলে তো থাকতেন একটাই দেবী আর দুই sub-দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতী। কিন্তু আমাদের সেই কিশোর চোখের উপর দিয়ে ভেসে যেত কত সে লক্ষ্মী, সরস্বতী। আমরা গালে হাত দিয়ে ভাবতাম মেয়েরা সত্যিই কী সুন্দর। তারপর আরও তলিয়ে ভাবতাম, আহা রে, সারাবছর এরা কোথায় থাকে। কারও নাম শুনছি রতু, কারও লাইট, কারও জয়শ্রী, কারও তনুশ্রী, কারও পৃথা। এই সময় আমি একটু গানকাতুরে হয়ে পড়তাম আর মাথায় খেলত পুজোর গান বলে দাগ কেটে বসা সব বাংলা আধুনিক। হেমন্তর ‘তোমার আমার কারও মুখে কথা নেই’, লতার ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে’ মান্নার ‘আমি সাগরের বেলা, তুমি দুরন্ত ঢেউ’, শ্যামলের ‘সারা বেলা, আজি কে ডাকে’, সুবীরের ‘মোনালিসা তুমি কে, বলো না আর অতি অবশ্য মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি/ তবু মনে হয়/ কেন আরও ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়। এইসব গান মনে খেললে ওই পূর্ণ আনন্দের মধ্যে একটা অভাববোধও ঈষৎ জাগত; কেন এই চলমান সরস্বতীদের মধ্যে কেউ আমাদের জন্য গায় না সন্ধ্যার প্লে ব্যাক, এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার কিংবা গীতার মতো করে, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার’। প্যণ্ডেলে বসে বসে এভাবেই এক এক ঘণ্টায় আমাদের এক এক মাস করে বয়েস বেড়ে যেত। পুজো চলে গেলে, শেষে মনের যে দশা দাঁড়াত তা জ্ঞান গোঁসাইয়ের রাগপ্রধানেই কিঞ্চিৎ ধরা যায়—’শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয় ফিরে আয়, ফিরে আয়। এই পাখিটা যে বিগত পুজো, না বুকের ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া শরতের বাতাসটুকুর মতো ওইসব রতু-পৃথারা, তা আর স্পষ্ট করে বলতে পারব না। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো আমাদের জীবনেও প্রেম ও পুজো মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
২.
অরুন্ধতী রায়-এর উপন্যাস থেকে কথাটা তো চালু হল এই সেদিন, কিন্তু চিরকালই আমরা মা দুর্গাকে জেনে এসেছি God of Small Things বলে। অর্থাৎ, ব্যাপারটা ছিল, কথাটা ছিল না। কত অজস্র টুকিটাকি জিনিসের জন্যই যে তখন আমরা ঠায় চেয়ে থাকতাম দুর্গাপুজোর দিকে। জুতোয় পেরেক উঠে গেছে, পা বাঁচিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি, তবু জুতো কেনার কথা তুলব না, তিনটে মাস হজম করে নেব। কারণ, এখন কিনলে পুজোয় আর নতুন জুতো পরা হবে না। নতুন ক্লাসের শুরুতে, জানুয়ারি মাসে, ইশকুলের ইউনিফর্ম কেনার একটা প্রথা ছিল; এ ছাড়া সব শৌখিন জামার জন্যই অপেক্ষা থাকত পুজোর। দিদিদের দেখতাম, বছরের কোনো একসময় একটা ভালো উপহার পেলে সেটা প্রাণে ধরে বাঁচিয়ে রাখত পুজোর জন্য। পাড়ার অনেক বাড়িতেই পুজোর সময় ঘটা করে রেডিয়ো কেনা হত অধিকাংশ বাড়িতেই রেডিয়ো ছিল না—ফলে, রেডিয়ো ঢুকলে সে বাড়ির খুব মর্যাদা বাড়ত। আর যাদের বাড়িতে কলের গান ছিল, তাদেরকে তো রীতিমতো ধনী জ্ঞান করা হত। সেইসব বাড়িতে পুজোর সময় কেনার সামগ্রীর মধ্যে থাকত সে-বছরের শারদ অর্ঘ্যের কিছু রেকর্ড। আমার বাবার মৃত্যুর পর বাড়ির পুজোর কেনাকাটার বহর কমে গেলেও কাকা বা মা এই পুজোর গানের রেকর্ড কেনা বন্ধ করেননি, কারণ পুজোর সময় কলের গানে নতুন গান না বাজলে বাড়িতে পুজো ঢুকত না। পুজো আসত কিছু পুজোসংখ্যা আর বেশ কিছু বইয়ের হাত ধরেও। পুজোর অনেকখানি আগে থেকেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে দিব্যি বৈঠক বসে যেত কেনাকাটা নিয়ে। হ্যাঁ রে তুই কী কিনলি? ম্যাচিং ব্লাউজ কিনতে পারলি? রোলেক্স জরির শাড়ি ক-দিন চলে রে? জানিস তো, বেনেবাড়ির রুমঝুম আস্ত একটা বেনারসি কিনে বসেছে? ওর বিয়েটিয়ে আছে নাকি সামনে?—এহেন এক-শো এগারোটা মেয়েলি কথা শুনতেই হত এ-বাড়ির বারান্দায়, ও-বাড়ির উঠোনে, কী সে-বাড়ির ছাতে। কোন বাড়ির কেনাকাটা কাকে টেক্কা দিল, তাও শুনতে হত। বাবার মৃত্যুর পর আমার জামা-প্যান্টের সংখ্যা কমে যেতে আমি এইসব মা-মাসি-দিদি-বউদিদের আড্ডা থেকে পালিয়ে বাঁচতাম। নইলে তো থুতনি নেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, সাহেবের ক-টা জামা হল এ বার? আমাকে তখন জামার সংখ্যা বাড়িয়ে বাড়িয়ে মিথ্যে কথা বলতে হবে। ভারি রাগ হত, কেউ কেন জিজ্ঞেস করে না, কী রেকর্ড কেনা হল রে? কিংবা কী বই?
আজ, এত দিন পর, ওই সব ন্যাকা-ন্যাকা কথাগুলোই বড় মধুর করে স্মৃতিতে বাজে। মনে পড়ে, একটা মাইসোর স্যাণ্ডাল সোপ হারিয়ে যাওয়াতে একটা মেয়ের সে কী কান্না! সবাই বলছে, মোটে তো দশ আনা দাম। আর একটা কিনলেই হয়। কিন্তু সে-কথা কে বোঝায় তাকে? সে শুধু বলে, পুজোর সাবানটাই হারিয়ে ফেললাম, ছি ছি! এর চেয়ে নিজেই হারিয়ে গেলে পারতাম।
বলতে নেই, পুজোতে সব ছেলেপুলেই আমরা একটু-আধটু হারিয়ে যেতাম। প্যাণ্ডেল বাঁধা দেখতে দল বেঁধে গেলাম গোমেস লেনে, তারপর সেখান থেকে সুরি লেনে, তার পর ডিক্সন লেনে, শেষে বৈঠকখানা বাজারেই। সেখানে দল ভাগাভাগি হয়ে কে যে কোথায় গেল, ভগাই জানে। তখন একে-ওকে খুঁজতে খুঁজতে কখন যে ফের পাড়ার প্যাণ্ডেলে এসে হাঁপাতে লাগলাম, সেও ভগাই জানে। শুধু মনে পড়ে দুপুরের দিকে এ-পাড়া ও-পাড়া করে এক-এক রাস্তায় এক-এক রকমের রোদের খেলা দেখা হত। নীল আকাশ থেকে সোনালি রোদের ঠিকরে এসে এক-এক রাস্তায় এক-এক স্টাইলে, অ্যাঙ্গেলে পড়া হত, এক-এক বাড়ির দেওয়ালে এক-এক চালে খেলা করত রোদ। কালো পিচের রাস্তায় রোদের ওই ওঠা পড়া দিয়েই আমরা টের পেতাম শরৎকাল কতখানি মজেছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে আমার সহপাঠী ও রুমমেট জন্মান্ধ দেওকিষেণ শৰ্মা— যে জীবনে কখনো রোদ দেখেনি, কী গ্রীষ্মের, কী শীতের-শরৎকে বলত হিমবসন্ত, স্রেফ গায়ের উপর রোদের ছোঁয়া বুঝে। আর, আমরা তো সেই স্বর্ণালি রোদ চোখে পান করব বলে পাড়া ডিঙিয়ে বেড়াতাম।
কিন্তু, রোদের সঙ্গে সব মাখামাখিই কিন্তু পুজোর রাতগুলোর টানে। সারাবছরে অমন স্বাধীনতা আর কটা দিনই বা, যখন ট্রামে-বাসে আর পায়ে হেঁটে শহরটাকে প্রায় চষে ফেলা যেত। পর দিন রেল মেরে বন্ধুদের শোনানো যেত ফায়ার ব্রিগেডে রমেশ পালের প্রতিমা কেমন হল, সংঘশ্রীর প্যান্ডেলের কেরামতিটা কী, কিংবা হিন্দ সিনেমার উলটো ফুটে গোপাল পাঁঠার পুজোয় কী সুন্দর দেখানো হয়েছে মায়ের সামনে রামচন্দ্রের আঁখিপদ্ম দানের উপাখ্যান। তবে, সব বৃত্তান্তই শোনানোর দরকার হত প্যাণ্ডেলের চত্বরে, যেখানে লাল-নীল হলুদ-গোলাপি ফ্রকে উদ্ভাসিত বালিকারা আপন মনে করে যাচ্ছে মধুবালা, সুচিত্রা, নূতন, ওয়াহিদার পোশাক, হাসি, নাচ ও হাঁটার গল্প। সবাই সবাইকে আড় চোখে দেখছে আর হাত-মুখ নেড়ে কথা কইছে, কেউ জানতেও পারছে না কার মনের ক্যামেরায় কার মুখের ছবি চিরতরে বন্দি হয়ে গেল। এইসব নিষ্পাপ স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটা দৃশ্য খুব মনে পড়ে, ‘৫৫ সালের পুজোতে মাইকে বাজছে ‘আনারকলি’ ছবিতে লতার গান, ‘ইয়ে জিন্দেগি উসিকি হ্যায় বো কিসিকা হো গয়া’ আর একটা একরত্তি মেয়ে সেটা গলায় তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে আপ্রাণ।
পুজোর সময় মেয়েদের বর্ধিত স্বাধীনতার মধ্যে ছিল নতুন ড্রেসের সঙ্গে খুব গাঢ় করে ঠোঁটে লিপস্টিক, গালে রুজ মেখে বেরোনোর সুযোগ। কনক’ ও ‘কান্তা’-র যুগে এক আধ জন খুব ঈর্ষণীয় হত পাঁচ কি দশ টাকা দামের ‘ইভনিং ইন প্যারিস’ ব্যবহার করে। বাবার কিনে দেওয়া, তাই যখের ধনের মতো আগলানো, ক্যালিফোর্নিয়ান পপি’ বা ‘ইয়ার্ডলে’ মা দিদিদের গায়ে ছিটিয়ে দিতেন। আমার গায়ে একবার আদর করে ইভনিং ইন প্যারিস’ মাখিয়ে দিয়েছিলেন, তাতে একটি মেয়ে আমার গায়ে নাক ঘষে গন্ধ নিতে লাগল। আমি বদ্ধ হাবা, সেই নাকঘষার মানেই ধরতে পারেনি, ভেবেছি, কী বেজায় গন্ধ রে বাবা। বুঝিনি পুজোর রাত ওর মাথা খেয়েছে।
৩.
এখনকার মতো তখনও পুজোয় কলকাতা ছেড়ে পুরী, যশিডি, শিমুলপুর, সিমলা যাওয়ার চল দেখেছি। কেউ কেউ রাঁচিও যেত। স্টাইলের ওপর কেউ কেউ বলত, এবার পশ্চিমে চললাম। তাদের ঘটা করে যাওয়াটা আমরা বারান্দা বা জানলা দিয়ে দেখে মনে মনে হাসতাম। এত তাড়াতাড়ি রাঁচি যাওয়ার কী হল? পরে একটা ব্যাখ্যাও বার করে ফেলতাম—পুজোয় কলকাতা ছাড়লে রাঁচি ছাড়া আর কোথায় যাবে? যে প্রতিবেশী বেনেবাড়ি পুজোয় পশ্চিমে যেত তাদের ছেলে-মেয়েরা ফিরে এসেই জানতে চাইত পাড়ার রকমসকম কেমন ছিল পুজোর সময়। এক লক্ষ প্রশ্ন ওদের, ওদের ট্যুর নিয়ে আমাদের কোনো জিজ্ঞাস্যই নেই। আমরা কেবল ভরে আছি পুজোর স্মৃতিতে। আমাদের এক বন্ধুকে বাড়ির বড়োরা টেনে হিচড়ে শেয়ালদা স্টেশন অব্দি নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে কান্নাকাটি জুড়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে একা ফেরত আসে। কেন যাবে না? তা হলে বড়োবাজার থেকে কিনে আনা দোদমা, বোম আর তুবড়ি কে ফাটাবে? কালীপুজোর পটকা ফাটানো তো হালকা চালে শুরুই হবে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে।
আমরা যারা কলকাতার পুজো ছাড়া বাঁচতে পারতাম না তাদের বাড়িতে একটু স্থানাভাব হত পুজোর সময়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আত্মীয়স্বজনরা ওই সময় থাকতে আসতেন আমাদের বাড়িতে। তাদের মুখে কত গল্প—খুলনার রূপসা নদীর, গোয়ালন্দ বন্দর কি বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের। জায়গায় টান পড়ত বলে ফরাশ পাতা হত, আমরা ছোটোরা গাদাগাদি করে শুয়ে রাতের বেলায় না-দেখা পিতৃভূমি, মাতৃভূমির গল্প শুনতাম। আর অতিথিদের খালি খোঁজ পুজোয় মায়ের নতুন চেহারা কী? সুচিত্রা-উত্তম কি বিয়ে করেছে? বিধান রায় কি সত্যিই নাড়ি টিপে রোগ ধরেন? অর্গাণ্ডি আসলে কী কাপড়? আর তারপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সওয়াল : ভাগ্যশ্রীর সম্বন্ধ চাই, মনা তোমাদের এহেনে ভালো পাত্তর আছে?
স্বজন আসত অনেক বাড়িতেই উত্তর আর পশ্চিম ভারত থেকে। তারাও খুঁজছে পাত্র বা পাত্রী। পুজো শেষ হলে আমাদের বাড়িতে পূর্ববঙ্গস্থিত মামা-মাসিদের মেয়েদের পাত্রী হিসেবে দেখানো হত। পরে শীত-বসন্তে তাদের কয়েক জনের বিয়েও হয়েছে। তারা চলে যেতে নির্জনে চোখের জল মুছেছি। তারপর নতুন করে দৃষ্টি মেলেছি আগামী পুজোর দিকে।
পুজো মানে ছিল সিনেমা এবং থিয়েটার। মা-মাসিদের জন্য ম্যাটিনি শোয়ের অ্যাডভান্স টিকিট কিনে আনায় হাতযশ ছিল দাদার। পাড়ার উঠতি যুবাদের এলেম ধরা পড়ত লাইন দিয়ে সুচিত্রা-উত্তমের বায়োস্কোপের টিকিট জোগাড়ে। সেজন্য সেই যুবারা একটা করে পাঁচ সিকের টিকিট বখশিস পেত। পুজোর সময় পাড়ার অনেক যুবাই প্রতিবেশী যুবতীদের সঙ্গলাভের আশায় মা-মাসিদের দলে ভিড়ে যেত।
বাল্যে মা-এর সঙ্গে পুজোর সময় ম্যাটিনি শোয়ে প্রাচী সিনেমায় রানি রাসমণি’ দেখতে গিয়ে দেখি পাড়ার ডানপিটে ছোকরাদের ভিড়। কী ব্যাপার? তারা কোনো না কোনো মহিলা দলকে এসকর্ট করে এসেছে। বলা বাহুল্য, সেইসব দলে কিছু ক্লাস নাইন, ক্লাস টেনের কুমারী তো আছেই! আমার মা সরল মানুষ, অতশত বুঝতেন না, বললেন দ্যাখো, সবাই ওদের বকাঝকা করে, কিন্তু ওদেরও কীরকম ধর্মের টান।
দুর্গাপুজো নিয়ে একটাই অভিযোগ চিরকাল আমার। পুজোটা কেবল আসে আর যায়, এই এল এই গেল। তিনশো ষাট দিনের অপেক্ষার পর এই ক্ষণিকের উন্মাদনা পোষায়? মহালয়া থেকেই কীরকম হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায়, আর ষষ্ঠী এলে তো প্রতিজ্ঞাই করে বসি, বাকি চার দিন আর একফোঁটা ঘুমোব না! প্যাণ্ডেলে প্রতিমা জেগে থাকবে আর আমি ঘুমোব!
পুজোর রাতগুলোয় তাই এক ভূতেও ভর করত আমাদের। জানলা খুললে কি ছাদে দাঁড়ালে আলোর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত চোখে-মুখে, মনে। গ্লোব লাইট, টুনি বালব, কি পাইপ লাইটের উদার বিকিরণ। সংগতে মাইকে হেমন্ত, সন্ধ্যা, লতা, গীতার গানের ধ্বনি। গোটা জগৎ তখন যেন সহজ হয়ে আসে। রতু, পৃথা তনুশ্রীরা পুজোর জামাতেই প্যাণ্ডেল ছেড়ে এসে ভিড় করেছে জানলায়, বারান্দায়। চোখ ভরে দেখছি পুজো ওদের কত সুন্দর করেছে। দেখছি বেপাড়ারও কত সুন্দরী দলে দলে রাস্তা বেয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে এই রাতটাই শেষরাত, চলে গেলে আর আসবে না। চলে গেলেই ছেলেরা মেয়েরা সবাই কী ভীষণ আলাদা হয়ে যাব। একসঙ্গে ফুচকা খাওয়া, মিষ্টি বরফ বা আইসক্রিম খাওয়া, জলযোগের দোকানে বসে লুচি-ছোলার ডাল খাওয়া শুধুই স্মৃতি হয়ে যাবে। ভিড় ঠেলে পুজো দেখতে দেখতে কেউ বলবে না, আমার হাতটা ধরো। জুতোয় হিলটা বোধ হয় ভেঙে গেল।
লণ্ডনের বেলসাইজ পার্কের সেই পুজোতে দাঁড়িয়ে হাতে এক প্লেট প্রসাদ নিয়ে এই সবই ভাবছিলাম, হঠাৎ পাশ থেকে এক সুরেলা নারীকণ্ঠ-শংকর না? আমি হকচকিয়ে ভাবছি মহিলা যেন কে, কোথায় দেখেছি! সুন্দরী সুন্দর করে হাসলেন, মনে পড়ছে না তো? তুমি তো ক্রিক রো-র। আমিও ক্রিক রো-র। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঠোঁট উপড়ে বেরিয়ে গেল, তুমি পৃথা না? সুন্দরী হাসতে হাসতে মাথা নাড়লেন, মনে পড়েছে তা হলে?
বললাম, মনে না পড়ে উপায় আছে? কত দেখা হত পুজোর রাতে।
কবির নির্বাসন
এক ফাযনী পূর্ণিমার রাতে কবি বনমালীকে স্বীয় রাজ্য থেকে নির্বাসিত করলেন রাজা অক্ষয়চন্দ্র। কবি হিসেবে বনমালী অবশ্যই খুবই বড়ো কিন্তু তাঁর দোষ ছিল অন্যত্র। বনমালীর কাছে কবিতার পাঠ নিতে যেতেন রাজকন্যা মাধবী। মাধবীর যৌবন এবং রূপলাবণ্যে আকৃষ্ট হয়ে প্রৌঢ় বনমালী সহসা ভয়ংকর প্রণয়মূলক কবিতা লিখতে শুরু করেন। লোকলজ্জার ভয়ে প্রথম প্রথম সেসব তিনি প্রকাশ করেননি। ক্রমশ এই স্পর্ধা তাঁর বেড়েই যায়। এবং অবশেষে তিনি মাধবীর উদ্দেশে এমনই মর্মান্তিক, রহস্যময় কবিতা লিখতে শুরু করেন যে মাধবী নিজেও ভারি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। যথাকালে বনমালীর নামে রাজসভায় নালিশ করে ভবতোষ। শোনা যায় ভবতোষের একগুচ্ছ কবিতা একবার বনমালী ‘পক্ষীর বিষ্ঠা’ বলে মাটিতে নিক্ষেপ করেছিলেন। আমার নিজেরও ধারণা ভবতোষ অত্যন্ত নারকীয় কবিতা লেখে। ওরই এক কবিতা পাঠের আসরে হৃদকম্প শুরু হয়েছিল কবি ফণিভূষণের। আমাদের ভরতপুর রাজ্যে অনেকের ধারণা কবিকুলমণি শ্ৰীভতৃহরির পর ফণিভূষণের মতো বড়ো কবি আর জন্মাননি। তবে বনমালীর মতো ফণিভূষণ প্রত্যক্ষ বচনে ভবতোষের নিন্দে কখনো করেননি, কারণ রাজপ্রাসাদে ভবতোষের যাতায়াত বড্ড বেশি। স্বয়ং অক্ষয়চন্দ্র এবং তাঁর সমুদয় অমাত্যেরা ভবতোষকে বিশেষ স্নেহ করেন।
কবিতা লেখা লেখার সঙ্গে সঙ্গে সে কবিকুলের তথা পন্ডিত সমাজের খবরাখবর তাঁদের কানে পৌঁছে দেয়। অনেকের ধারণা কবিতার চেয়ে চরবৃত্তিতে ভবতোষের মেধা অধিক।
যাই হোক, এই ভবতোষ কিন্তু বনমালী সম্পর্কে একটা অদ্ভুত খবর সভায় রটাল। বনমালী নাকি পূর্ণচন্দ্র রাত্রিতে উলঙ্গ হয়ে বৈরাগী নদীতে এক বুক জলে দাঁড়িয়ে মাধবীর উদ্দেশে তাঁর অশ্লীল কবিতা আবৃত্তি করেন। তারপর… তারপর জল থেকে উঠে পাড়ের এক গাছকে মাধবীজ্ঞানে রমন, মর্দন এবং ধর্ষণ করেন। পূর্ণিমার রাত্রির পর যে ভোর হয় তখন বলমালীকে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় বৈরাগীর তীরে পাওয়া যায়। বেশ কিছু কাল ধরেই নাকি বনমালী তাঁর পূর্ণিমাযাপন ওইভাবেই করে থাকেন।
এই খবর প্রথম শুনে রাজা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কন্যাকে এত সম্ভোগের দৃষ্টিতে দেখে এক প্রজা কবি! তিনি বহুক্ষণ পর তাঁর মানসিক স্থৈর্য উদ্ধার করে বনমালীকে ডেকে পাঠাতে নির্দেশ দিলেন। একই সময়ে তিনি ডেকে পাঠালেন মাধবীকেও। মাধবী কবির এই পূর্ণিমার ব্যাপার-স্যাপার জানত না। বনমালীর কবিতায় সে যে অন্তরে অন্তরে পুলকিত হত সে তো বলাই বাহুল্য। শেষ দিকের বাড়াবাড়িতে, বিশেষত কবিতায় তার নগ্ন বর্ণনায় সে যে অপ্রস্তুত হয়নি তা নয়, কিন্তু মাধবী জানত বনমালী অবশ্যই বড়ো কবি। তাই তাঁর শব্দ-বর্ণ চিন্তা দোষও মার্জনীয়। কোনো খারাপ কবি ওইসব লিখলে মাধবী অবশ্যই তাকে জুতোপটা করত। নিজে একটু-আধটু কবিতা চর্চা শুরু করে মাধবী জানতে পেরেছে দেশে সত্যিকারের কবি মাত্র বনমালী! অন্য সব কটিই হাতুড়ে। এমনকী যে ফণিভূষণকে রাজ্যের সবাই শ্রীভতৃহরির পর সবচেয়ে বড়ো পদাকার মনে করে তিনি আসলে অতিনিকৃষ্ট। ভরতপুরে ইদানীং সংস্কৃত ভাষা কিংবা পান্ডিত্যের চল খুব কম। রাজ্যের অধিকাংশ লোকই প্রায় মূখ। তারা এর-তার মুখে ঝাল খায়। তাদের যে যা বোঝায় তাই বোঝে। মাধবী এও জানে যে, রাজ্যের অন্যতম প্রধান মূখ তার পিতা অক্ষয়চন্দ্র নিজে।
বেগতিক দেখে মাধবী বনমালীর প্রাণ বাঁচানোর এক অভিনব পথ অবলম্বন করল। রাজসভার হাওয়া গরম দেখে সে টের পেয়েছিল অনুনয়-বিনয় করে বনমালীর প্রাণ বাঁচানো যাবে না। সে তখন তারস্বরে ঘোষণা করল, রাজন! এই পাপী লোভী কামুক দুর্বিনীত নিকৃষ্ট কবিকে হত্যা করাও হাত গন্ধ করা। আমি এর কাছে কবিতা শিক্ষা করতে গিয়ে টের পেয়েছি এই কবি এক অতিকায় ভন্ড। এর দুরূহ ছন্দজ্ঞান আছে ঠিকই, কিন্তু কাব্যভাব বিন্দুমাত্র নেই। আমি অবলা নারী সহসা এর চাতুরীর মর্মোদ্ধার করতে পারিনি। এতকাল ধরে তাই এত এত সময় নষ্ট করেছি। হায়! হায়! কিন্তু রাজন! আর বেশিদিন এর শিক্ষানবিশি করলে আমি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যেতাম। পরমপিতা ভগবান আমায় বাঁচিয়েছেন। এখন আমার ইচ্ছে তাই যে, এই আশ্চর্য শঠ মানুষটিকে কালবিলম্ব না করে উজ্জয়িনীতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। উজ্জয়িনীর সঙ্গে এই রাজ্যের সাংস্কৃতিক শত্রুতা বহুদিনের। আমরা এখন অবধি একজন কালিদাস সৃষ্টি করতে পারিনি। কিন্তু উজ্জয়িনীও যাতে আর কোনো দিন কোনো কালিদাস সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য এই বনমালীকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। এইরকম কোনো কবি যেকোনো সাহিত্যের মূলে অভাবনীয় কুঠারাঘাত করতে পারে। রাজন! এই প্রার্থনা।
মাধবীর এই বাগ্মিতায় সভায় অনেকের চোখে জল এসে গিয়েছিল। স্বয়ং বনমালীই
কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হল তিনি অতিঅবশ্যই এক সাংঘাতিক ক্ষতিকারক কবি। এবং এই ধারণার বশে তিনি সভার মধ্যে চেঁচিয়ে ঘোষণা করলেন, রাজন! এই কন্যা অতিসত্য কথা বলেছেন। আমার মতন কবিকে নির্বাসন দেওয়া গুরু পাপে লঘু দন্ড। আমাকে বরং আপনি পাগলা কুকুর দিয়ে খাওয়ান।
সঙ্গে সঙ্গে বনমালীর চেয়ে তীব্রতর কণ্ঠে আপত্তি জানালেন মাধবী। না না রাজন! আপনি ওই শঠের শাঠ্যে ভুলবেন না। ও ওই মৃত্যুর মাধ্যমে সামাজিক লাঞ্ছনা এড়াতে চায়। এতকাল আমাদের বোকা বানানোর শাস্তি ওকে দিতে পারেন উজ্জয়িনীর পন্ডিতেরা। যাঁরা ওর কাব্যকে অশ্বহ্রেষা বলে প্রমাণ করে দেবেন। রাজন! আপনি ওর চাতুরীতে বিপথগামী হবেন না।
কন্যার বুদ্ধির দাপটে একেবারে বিগলিত হয়ে গিয়েছিলেন রাজা অক্ষয়চন্দ্র। তিনি বেশ তাচ্ছিল্যের হাসি ছড়িয়ে বনমালীকে বললেন, তুমি চাইলেই আমরা তোমাকে কুকুর দিয়ে খাওয়াব? আমাদের তুমি এতই নিরেট ঠাওরেছ বুঝি! তোমার যা দোষ তাতে তো তোমাকে নির্বাসন ছাড়া কিছুই দেব না। তোমার কবি সম্মানের অপর্যাপ্ত ক্ষতি হবে তাতে। লোকে জানবে তুমি আসলে কোনো কবিই নও। তুমি কালিদাসের মতো কবি হলে তোমাকে কুকুর দিয়ে খাওয়াতাম। তাতে অন্তত আমার সান্ত্বনা থাকত যে, একজন কবিশ্রেষ্ঠকে আমি হত্যা করলাম। কবির খ্যাতির সঙ্গে আমার নামও বিজড়িত হত। কিন্তু তুমি তো ভন্ড। তোমাকে হেনস্থা করা দরকার।
মাধবীর ফন্দিই জিতল সেদিন। বনমালীকে চিরকালের মতন নির্বাসন দিল ভরতপুর। ফাযনী পূর্ণিমার উজ্জ্বল রাত্রিতে বনমালী তাঁর বগলে সামান্য কিছু বইপত্র এবং পরিধেয় বস্ত্র নিয়ে উজ্জয়িনী অভিমুখে রওনা হলেন। যাওয়ার আগে তিনি শেষবারের মতন একবার বৈরাগী নদীর ধারে এসে দাঁড়ালেন। পূর্ণচন্দ্রের প্রতিফলনে যখন বৈরাগীর জল মৃৎপাত্রে গলিত রূপোর মতন দেখাচ্ছে, নিজের একটা কবিতা উচ্চারণ করতে করতে তিনি তাঁর প্রিয় পরিচিত বৃক্ষটিকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হলেন। এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন যে-গাছটি সে জায়গায় আর নেই!
কাহিনির এই অংশেই আমার, অর্থাৎ শৌনক দত্তের আবির্ভাব। আমি বাল্যবয়স থেকেই কবি বনমালীর অন্ধ ভক্ত। আমি কবিতা বিশেষ লিখতে পারি না, কিন্তু পড়ি অনেক। আমার পিতা শিবদত্ত রাজার অমাত্যদের একজন বলে আমি বরাবরই রাজকন্যা মাধবীর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি কবি বনমালীর কাছে পাঠ নিয়ে
মাধবী নিজের কাব্যচর্চার কতখানি উৎকর্ষসাধন করেছে। আমি সেই মাধবীর নির্দেশে কবি ধর্ষিত গাছটিকে যতদূর সম্ভব অবিকৃত অবস্থায় কাটিয়ে নিয়ে মাধবীর কক্ষে রেখে এসেছি। মূর্তিকার চন্দ্রভানু সেই কাঠ দিয়ে মাধবীর একটা মূর্তি তৈরির কাজ শুরু করেছে এবং আমার এখনকার কাজ বনমালীর পাশে বসে মাধবীর কবিতার শেষ শিক্ষাটুকু লিখে আনা।
বনমালী যখন তাঁর প্রিয় গাছটির অন্তর্ধানের রহস্য হাতড়াচ্ছেন মনে মনে, আমি অন্য এক গাছের পিছন থেকে সরে এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালাম। করজোড়ে ভক্তি নিবেদন করে রাজকন্যার বাসনা তাঁকে জানালাম। সমস্ত শুনে স্মিত হেসে কবি বললেন, কবিতা? মাধবীকে জানিয়ে কবিতার শেষ এক গোলকধাঁধায়। যাতে প্রবেশ এবং যার থেকে নিষ্ক্রমণের পথও কবিতা। এই গোলকধাঁধার বিভিন্ন পথ উপপথ হল আকাশ নদী গাছ চন্দ্র সূর্য তারকা এবং মানুষের জীবনের মহাবিচিত্র ঘাত-প্রতিঘাত। এই গোলকধাঁধায় প্রবেশের সঙ্গী নারী এবং নিষ্ক্রমণের সারথি ঈশ্বর। কারও কারও মতে গোটা গোলকধাঁধায় প্রবেশটুকুর রহস্যই জানি। নিষ্ক্রমণের পথ তো আমার জানা নেই।
এই তত্ত্ব আমি যখন মাধবীকে জানালাম তা শুনে মাধবী প্রথমে স্তম্ভিত হল এবং পরে অবিশ্রান্তভাবে কাঁদতে থাকল। তাঁর এতকালের কবিতা চর্চায় সে বৃক্ষের রহস্য কিছুমাত্র জানতে পারেনি। তাহলে কবিতার সিদ্ধি তার আর কতদিনে হবে? কবিতার উপকণ্ঠেও যে গিয়ে উঠতে পারেনি সে আর কবে কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে? পারতপক্ষে সেদিন থেকেই মাধবী অন্নজল ত্যাগ করল। তার একমাত্র দাবি কবি বনমালীকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এবং তা সে যেকোনো পন্থায়।
প্রবীণ কবি ফণিভূষণ বোঝাতে এলেন রাজকন্যাকে। বললেন, কবিতা মানেই ছন্দ, অলংকার, নিপুণ বাক্যবন্ধ, আশ্চর্য কল্পনার এক প্রতীক। গোলকধাঁধার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এবং নারী দেহের বর্ণনা তাতে কম থাকাই বাঞ্ছনীয়। তাতে আবালবৃদ্ধবনিতাই তার রস গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। কবির কথাবার্তা শেষ হতেই রাজকন্যা বলল, দূর হ পোড়ারমুখো! তুমি হাতুড়ে কবিও নও। তুমি সাপুড়ে।
এর মধ্যে একদিন রাজকন্যা সজোরে কোমরে লাথি মারল ভবতোষকে। মেয়ের মন রাখতে তখন রাজা নিজেও তাঁর চটিজুতো দিয়ে কয়েক ঘা মারলেন। বড়ো কথা, মেয়ের ব্যাপার-স্যাপার বুঝতে জীবনে এই প্রথম কবি কালিদাসের পাশাপাশি বনমালীর কিছু কবিতা পাঠ করলেন। এবং অচিরেই আবিষ্কার করলেন তিনি কী নিদারুণ প্রমাদ ঘটিয়ে বসেছেন। তাঁর অচর্চিত সাহিত্যজ্ঞান এবং সাহিত্যবুদ্ধি দিয়েও রাজা বুঝলেন বনমালী বড়ো আশ্চর্য
প্রতিভার মানুষ। চতুর্দিকে লোক ছোটালেন বনমালীকে সসম্মানে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু কোথাও তাঁকে খুঁজে পেলেন না। এমনকী উজ্জয়িনীতেও না। উজ্জয়িনীর রসিকসমাজও বনমালীকে পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে দেখা গেল। কিন্তু তাঁরাও কোনো খোঁজ পান না। আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম গোটা জগৎটাই একটা মস্ত গোলকধাঁধা। কোথায় এর প্রবেশ দ্বার, কোথায় বেরুবার পথ তা কেউ জানে না।
দিনের পর দিন যায় কিন্তু মাধবী অন্নজল বিশেষ স্পর্শ করে না। যদি কখনো ইচ্ছে হয় তো গুটিকয়েক ফলমূল মুখে দেয়। কিন্তু সে-ইচ্ছাও তার বিশেষ একটা হয় না। মাঝে-মধ্যে খড়ি দিয়ে ঘরের মেঝেতে দু-টি চারটি কীসব লেখে। তারপর নিজের চোখের জল দিয়েই সব ধুইয়ে দেয়। সাদা কাপড়ে ঢাকা সাগরের ফেনার মতো গায়ের রং। এক অদ্ভুত বৈধব্যের ভাব আসে মাধবীর চেহারা থেকে। আমি শেষকালে আর অশ্রুসংবরণ করতে পারলাম না। মায়ের অনুমতি নিয়ে বনমালীর খোঁজে বেরুলাম উত্তরের দিকে।
উত্তরের পাঠ শেষ করে একদিন দক্ষিণে গেলাম। তারপর একবার পূর্বে, একবার পশ্চিমে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে একসময় ভরতপুরেই এসে উপস্থিত হলাম। গত চার বছরে রাজ্যের বহু কিছু বদলেছে। ইতিমধ্যে দেহ রেখেছেন আমার স্বজাতির অনেকেই। আমার কথা ভেবে ভেবে মা শয্যাশায়ী। বিবাহিতা বোনই এসে এসে তাঁকে দেখে যায়। আমার পিতা আমার উপর ক্ষুব্ধ। তিনি আমার সঙ্গে বাক্যালাপই করলেন না। আমাকে চিনতে পারল না স্বয়ং মাধবীও।
রাগে-দুঃখে আমি আবার দেশত্যাগ করলাম। এবার আর বনমালীর সন্ধানে নয়, নিজের দৃপ্ত যৌবনের সমুদয় আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তির জন্য। এবং মাসান্তে উপস্থিত হলাম শ্রাবন্তীর এক পানশালায়। দেহের সমস্ত কোষ আমার তখন মদের স্পর্শ, নারীর স্পর্শ চাইছে। আমি সবচেয়ে বড়ো পাত্রের, সর্বাধিক মূল্যের মদ হাতে নিয়ে ক্রমশ অন্ধকারে বারবধূ চিত্রাঙ্গিনীর ঘরের দিকে এগোলাম। শ্রাবন্তীতে চিত্রাঙ্গিনীর বিপুল খ্যাতি। তার রূপের, বাক্যালাপের এবং রঞ্জকতা গুণের কথা মানুষের মুখে মুখে। সবাই তাকে স্নেহ করে চিত্রা বলে ডাকে। আমি কড়া নাড়তেই সে নিজের দ্বার খুলে দিল। আমি সেই রাত্রের মতো তার সঙ্গকামী জেনেও সে কিছুতেই আমায় নিতে চাইল না। অবশেষে অনেক অনুরোধের পর হাতের মদটুকু আমাকে তার ঘরে বসে শেষ করার অনুমতি দিল। আমি ঘরের আবছা আলোয় মদে জল মেশাতে গিয়ে খেয়াল করলাম চিত্রার বিছানার ওপর হাতে পানপাত্র নিয়ে তুরীয় আনন্দে বসে আছেন কবি বনমালী!
প্রথম প্রথম তো আমাকে চিনতেই চান না বনমালী। অনেক বুঝিয়ে-কয়ে যখন তাঁকে সুস্থির করা গেল তিনি বললেন, আমি তো কবিতার কিছুই জানি না! আমি জানতাম কোনো কবি নারীকে সঙ্গে করে কবিতায় প্রবেশ করে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে সেই পরিবেশ থেকে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু দেশত্যাগ করার পর এই শ্রাবন্তীনগরে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় কবি পুরন্দরদাসের। তিনি একুশ বছর মুনি মহাদিত্যের আশ্রমে বৈদিক কবিতাচর্চা করেছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন অতি উৎকৃষ্ট কবি। কিন্তু তিনি কেবল ঈশ্বরকে নিয়ে কবিতা লিখতেন। যার গভীর তত্ত্ব খুব কম লোকই বুঝে উঠতে পারত। এবং আশ্চর্য! এই পুরন্দরদাস কিন্তু ভিখারির মতন মা সরস্বতীর কাছে বাঞ্ছা করতেন নারী সংক্রান্ত কবিতা লেখার কৌশল। শেষে একদিন তিনি আশ্রম ত্যাগ করে শ্রাবন্তীর এই রঙ্গিনীর কাছে এসে কাম মাহাত্মের অভিজ্ঞান প্রার্থনা করলেন! দেশত্যাগের মর্মাতনায় আমিও তখন চিত্রার ঘরে। আমাদের অর্থ সম্বল নিতান্তই সামান্য। আমরা নিজের নিজের কবিতা পাঠ করে চিত্রার অঙ্গসুখের মূল্য দিলাম। এবং প্রত্যুষের আলোর আভায় আমরা একে অন্যকে নিজের কবিতা শোনালাম।
এতক্ষণ কথা বলতে বলতে রীতিমতো শিহরিত, কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন বনমালী। এবার আমার হাত চেপে ধরে বললেন, শৌনক! দু-জনের কবিতার মধ্যে আমরা দু-জনেরই কবিতার পরিণতি দেখলাম। আধ্যাত্মিক কবি পুরন্দরদাস দেখলেন তাঁর ঈপ্সিত কবিতার মূর্তি আমার কাব্যে। রূপলাবণ্য এবং প্রকৃতির কবি আমি আমার শেষ দেখলাম তাঁর কবিতায়। আমরা বুঝলুম আমরা কেউই তৃপ্ত নই, কেউই পূর্ণ নই। আমরা কবিতার গোলকধাঁধার দুই ভিন্ন পথ ধরে তার মধ্যবিন্দুতে এসে যথার্থই দিশেহারা!
সেদিন দু-জন দুজনকে ধরে সারাটা সকাল কাঁদলাম। আমাদের ঘোর ভাঙল যখন তিতিবিরক্ত চিত্রা এক কলস জল আমাদের মাথায় ঢেলে দিল।
সেই থেকে আমি আর কবিতা লিখি না। কিন্তু হায়! মূর্খ পুরন্দরদাস এখনও তাঁর প্রণয়ী কবিতা রচনা করে চলেছেন। আমি আজকাল শেঠ বানারসী দাসের ব্যাবসার খাতা লিখে জীবিকা অর্জন করি। পুরন্দরদাস তাঁর কবিতার পাশাপাশি শ্রাবন্তীর স্বনামধন্যা গণিকাদের জীবনী এবং এই দেশের গণিকাবৃত্তির ইতিহাস লিখে প্রভূত আয় করে যাচ্ছেন। আমার ধারণা তিনি ভাবী কালের কাছে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর এই গবেষণার জন্য। তাঁর কবিতা সবাই ভুলে যাবে।
কিন্তু আমি শৌনক দত্ত অতীব নাছোড়বান্দা। আমি জেদ ধরলাম মাধবীর প্রাণরক্ষার্থে বনমালীকে একবার অন্তত ভরতপুরে ফিরে যেতে হবে। এবং ততোধিক কৃতসংকল্প দেখলাম কবি বনমালীও। যে রাজ্য তাকে নির্বাসিত করেছে সে রাজ্যে তিনি কিছুতেই পা রাখবেন না। আমার কাতর মিনতি শুনে চিত্রাও অশ্রুসিক্তা হল। সেও মিনতি করল কেবল একবারের জন্য বনমালীকে দেশে ফিরতে। কিন্তু কে কার কথা শোনে!
আমি তিনদিন চিত্রার আতিথ্য গ্রহণ করে শেষে দেশে ফিরলাম পুরন্দরদাসকে সঙ্গে নিয়ে। পুরন্দরদাস মাধবীকে মুগ্ধ করার মধ্যে নিজের প্রেমের কবিতার সার্থকতার সম্ভাবনা দেখলেন। আমি তাঁকে বোঝালাম মাধবীর অনুমোদন পাওয়াই কোনো প্রেমের কবিতার উত্তীর্ণ হওয়ার লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া যাবে। এইরকম নানান তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে আরেক ফাযনী পূর্ণিমার রাত্রে আমরা দু-জন বৈরাগীর তীরে এসে উপনীত হলাম। আমি গোটা পরিবেশটাকে বনমালীর কবিতার অনুপ্রেরণা বলে ব্যাখ্যা করলাম। পূর্ণিমার রাতে বৈরাগীর রূপ দেখে ভাবাবিষ্ট পুরন্দরদাস তাঁর প্রেমের কবিতা উচ্চৈঃস্বরে আবৃতি করতে লাগলেন। জলে প্রতিফলিত পূর্ণচন্দ্রের মাধুর্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার লালিত্য একাকার হয়ে যেতে থাকল। আমরা কবিতায় এবং প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় অবগাহন করে একটা রাত কাটিয়ে দিলাম। ভোরের আলোয় আবার হঠাৎ একটা খেয়াল হল যে, যে গাছটির সঙ্গে কবি বনমালীর অজস্র প্রণয় ছিল, এবং যেটিকে মাধবীর নির্দেশে বহুদিন আগে আমি সমূলে উৎপাটিত করেছিলাম ঠিক সেখানেই একটা শুচিস্মিতা মাধবীলতা জেগে উঠেছে। সেই লতার সর্বাঙ্গে ভোরের শিশির ভিড় করে এসে জমেছে।
আমি এবং কবি যখন প্রাসাদে মাধবীর কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে, আমাদের কানে এল মাধবীর অস্ফুট কন্ঠে বেদ গানের মতন কিছু একটা। আমি দ্বারে আঘাত করে ডাকলাম, মাধবী! দ্বার খোলো। আমি তোমার জন্য কবিকে এনেছি।
বহুক্ষণ পার হয়ে গেল কিন্তু মাধবী দ্বার খোলে না। আমি তখন বাগানের দিকে মাধবীর ঘরের যে জানালা আছে সেইদিকে নিয়ে গেলাম কবিকে। বাগানে তখন ফাযনের ফুলের ঐশ্বর্য। সূর্যের কিরণে কবি পুরন্দরদাসকে সাক্ষাৎ কোনো দেবদূতের মতোন ঠাওর হচ্ছে। গায়ে তাঁর গৈরিক বসন, যাতে বৈরাগ্যের চেয়ে ধর্মের আভাই বেশি। তাঁর অত্যুজ্জ্বল চক্ষু, উন্নত শির, তীক্ষ্ণ নাসিকা এবং স্পন্দমান ওষ্ঠ পৌরুষের সমস্ত আবেগকে যেন জীবন্ত করে তুলেছে। ক্ষণিকের জন্য আমার মনে হল পুরন্দরদাস বুঝি কোনো নাটকের চরিত্র, লিখিত পৃষ্ঠার থেকে উৎসারিত হয়ে দেহধারণ করে আজ এইখানে। আমি আবার সজোরে ডাকলাম, মাধবী!
নিজের মাধবী ডাকে নিজেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। দেখিনি কখন মাধবী এসে জানালায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সে চেয়ে আছে অনন্তের দিকে, আমাদের দিকে তার নজর নেই। আমি বললাম, মাধবী! আমি তোমার জন্য কবি এনেছি। কবিতায় এঁর সিদ্ধি কবি বনমালীর চেয়েও বেশি। ইনি তোমার জন্য কবিতা লিখেছেন, তুমি শুনবে?
হারানো সখাকে খুঁজে পেলে মানুষের মনে যে ভীষণ বিস্ময় এবং আনন্দের উদ্ভাস হয় ঠিক সেই রকম কিছু ঘটে গেল মাধবীর মধ্যে। সে শিশুর মতন বেণী আকর্ষণ করতে করতে বলল, এ তুমি কী দারুণ কথা শোনালে শৌনক! তুমি এখনই কবিকে নিয়ে এসো আমার কক্ষে। আমার তো দৃষ্টি শক্তি আর নেই, আমি ওঁর কবিতার মাধ্যমে চিনে নেব আমার পুরোনো জগৎকে। তুমি এক্ষুনি নিয়ে এসো ওঁকে।
আমার বুকের মধ্যে রক্ত সহসা হিম হয়ে গেল। নিরন্তর অনাহার এবং অশ্রুপাতে মাধবীর চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ওর সামনাসামনি এসে বললাম, তুমি নিজের একী সর্বনাশ করেছ মাধবী? তুমি কবিতার জন্য নিজের সব খুইয়ে দিলে?
মাধবী ম্লানভাবে হাসল। বলল, কবিতা তো কখনো কিছু দেয় না। যেটুকু তুমি সাধনা করে কবিতার থেকে নিতে পার তার অনেক বেশি কবিতাই তোমার থেকে নিয়ে নেয়। কিন্তু সে কথা যাক। আমি কবিতা শুনতে চাই। কবি পুরন্দর, আপনি আপনার কবিতা শোনান।
মাধবীর উপস্থিতিতে কীরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন পুরন্দর দাস। তিনি বিনয়ী কণ্ঠে বললেন, আমি জীবনের অধিকাংশ সময় আধ্যাত্মিক কবিতাই লিখেছি। প্রেমের কবিতা ক বছর মাত্র। যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে আপনি ক্ষমা করে দেবেন।
এর পর কবি পুরন্দর তাঁর কবিতা পড়তে শুরু করলেন। আমি তো কবি নই, তা-ও ওই সময়ে যতখানি পেরেছি তাঁর কবিতা টুকে রাখার চেষ্টা করেছি। আমার লেখায় কবির কাব্যগুণ যথাযথ না এলেও তার ভাবটুকু আসবে। আমি তাই শোনাচ্ছি আপনাদের। কবি পড়লেন :
চন্দন চর্চিত তোমার আনন প্রিয়ে
অরণ্যের প্রায় কোনো অনন্য উপমা।
ক্লান্ত পথিক যেন হারিয়ে গিয়েছে কোনো আলোকিত দিনে
সে রহস্য তুমিই জেনেছ প্রিয়তমা।
আমরা পান্থশালে, নিতান্তই আশ্রিত জীব,
আমরা জানি না কেন তোমার প্রভঙ্গে কাঁদে মেঘ,
তোমাকে বাঁধার মতো কোনো রঞ্জু আমাদের নেই,
তোমাকে বন্দনা করে সেরকম কবিও চিনি না।
তোমাকে ব্যাখ্যা করে যারা
সে ফুল আজ ফোটে না এখানে;
তোমার গাছের মতো গাছেরাও বি
গত খরায় মারা গেছে।
আমরাই পড়ে আছি শুধু, তোমার পূজারি,
রাজকোষে নিয়মিত অর্থ দিয়ে যাই,
আমাদের পরিবারে নানা শোক,
সে তোমার না জানাই শ্রেয়।
তোমাকে যে চন্দ্র করে আলোকসম্পাত,
সে কেবল আমাদের উন্মাদই করে,
আমরা দুঃখী লোক দুঃখ দিয়ে তোমাকে গড়েছি।
তারপর বসে আছি রাজকীয় কোনো কালিদাস
এসে কবিতার তীব্র অসি হেনে
চিরে দেবে আমাদের বুক,
অশ্বপৃষ্ঠে তোমাকে বসিয়ে, নিয়ে যাবে অনেক সুদূরে।
আমাদের ভাগ্য প্রিয়ে এই,
চিরকালই ভাগ্য এই ছিল,
আমাদের মধ্যে কেউ কবি হতে চায়নি কখনো,
কালিদাস নামে কেউ বেশিদিন বাঁচে না এখানে।
পুরন্দরদাস এই কবিতা পড়তে পড়তে কাঁদছিলেন। কবিতা শুনতে শুনতে কাঁদছিল মাধবীও। আমি মূর্খ এই শব্দ টুকতে ঢুকতে ভাবের ঘরে ঢুকতেই পারিনি। অথচ নিয়মের খাতেই জিজ্ঞেস করে বসলাম, মাধবী, এই কবিতা তোমার কেমন লাগল? আর অমনি ভূতে পাওয়ার মতন মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের চুল ছিড়তে ছিড়তে মাধবী কান্না ধরল। এই সর্বনাশ তুমি আমার কেন করলে শৌনক? কেন তুমি আমার সঙ্গে শঠতা করলে? এরকম কবিতা আমি বাল্যে শুনেছি কবি বনমালীর কাছে। কেন তুমি আমার সেই হারানো স্মৃতি জাগাতে আজ এই কবিকে আনলে? ইনি তো আমায় নতুন কিছু শোনালেন না। আমি ভেবেছিলাম ইনি নারীর মধ্যে নারীর চেয়েও মহৎ কোনো সত্তার কথা বলবেন। সেরকম কবিতা আমি মাঝেমধ্যে স্বপ্নে শুনে থাকি! যে কবিতার মাধ্যমে আমি আমার সমস্ত অতীতকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব, সেরকম একটা কবিতাও আমি লিখে ফেললে বনমালীর ওই শব্দের গহ্বর থেকে আমি নিষ্ক্রান্ত হতে পারব। শৌনক, তুমি জানো না আমি কী অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে কাল অতিবাহিত করছি। বনমালী আমাকে শুধু একটা নেশায় নিক্ষেপ করে গেছে। সেখান থেকে বার হবার পথ সে আমায় জানিয়ে যায়নি। আর একবারও যদি তার দেখা পেতাম। হায়, অভাগা আমি! আমার কবিতায় বনমালী যে কীরকম ঈশ্বরের মতোন অমোঘ তা যদি তাকে জানিয়ে দিতে পারতাম!
মাধবীর এই বিলাপ চলল বহুক্ষণ। পুরন্দর ঋদ্ধিযুক্ত মানুষ হলেও অন্য পুরুষের প্রশংসা বা কদর তাঁকে বিচলিত করে না। বিশেষত বনমালীর কদর তো নয়ই। শ্রাবন্তী থেকে উজ্জয়িনী আসার পথে তিনি আমায় বলেছিলেন যে, নারীর রহস্য সম্পর্কে মহাকবি অমরুর চেয়েও বনমালীর ভাবনা অনেক ক্ষেত্রে গভীর এবং আধুনিক। অথচ মাধবীর ব্যবহারে সেই পুরন্দরদাসও বেশ ভালোরকম অস্বস্তি বোধ করছিলেন। আমি নিজেও একটি বিশেষ অর্থে মাধবীর প্রণয়ী। আমি তাঁকে স্ত্রী করতে চাই না কিংবা শারীরিকভাবে পেতে চাই না। ওকে দূর থেকে একটা শিল্পের নমুনা হিসেবে দেখায় আমার বিপুল তৃপ্তি। যে আনন্দ আমি পেয়েছি উজ্জয়িনীর কোনো প্রস্তর মূর্তি দর্শন করে। কিংবা বিষণ্ণ সন্ধ্যাকালে শ্রাবন্তীর পার্শ্ববর্তী রেবা নদীর দিকে তাকিয়ে।
আমাদের দুজনের মনোভাব তখন কী করি? কী করি? অতঃপর আমিই বললাম মাধবীকে, তুমি যদি পিতার অনুমতি পাও আমি তোমাকে বনমালীর কাছে একটিবার নিয়ে যেতে পারি।
রাজাকে বোঝানো যে কী দারুণ কষ্টকর ব্যাপার ছিল তা আর না-ই বললাম। তাঁর একমাত্র কন্যা তায় অন্ধ এবং অসুস্থ, তাকে কিছুতেই তিনি আমাদের সঙ্গে ছাড়তে রাজি নন। কিন্তু মাধবীও নাছোড়বান্দা। কবি পুরন্দরও তখন অনুমতির জন্য কাকুতিমিনতি করলেন। শেষে রাজি হওয়া সত্ত্বেও আমার অভিসন্ধির ওপর নজর রাখতে তিনি আমাদের সঙ্গে ভবতোষকেও পাঠালেন। রাজার ভাবনা হল যে, পুরো ব্যাপারটাই যদি বনমালীর একটা চক্রান্ত হয় তাহলে তাঁর পরমশত্রু ভবতোষ অন্তত তাঁর সাধের গুড়ে বালি দেবে। রাজার নিজেরও ভীষণ যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু শ্রাবন্তীর সঙ্গে ভরতপুরের সম্পর্ক ভালো নয় দেখে তিনি আর ওদিকে এগুলেন না।
আমরা যখন শ্রাবন্তীতে এসে হাজির হলাম মাধবী এক আশ্চর্য কথা বলে বসল। ওর ধারণা ও স্বপ্নে এই নগরীতে বিচরণ করেছে। চোখে দেখে না অথচ প্রতিটি অলিগলিই যেন তার চেনা। সহসা পালকিতে বসেই সে জিজ্ঞেস করল, এই নগরীর উত্তর-পশ্চিমে রেবা বলে নদী আছে না? আমি বললাম, হ্যাঁ—সেই নদীর পাড়ে যেখানে পুরবাসীরা স্নান করে সেখানে মাধবী নামে একটা গাছ আছে না?
আমি সে-বিষয়ে কিছুই জানতাম না, তাই পালকির বাহকদেরই জিজ্ঞেস করলাম। তারা তো সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, আছে মহাজন! নিশ্চয়ই আছে। নগরীর মেয়েরা ওই গাছে নানান রকম মানত ঝুলিয়ে রাখে। কেউ কেউ বলে ওটা কোনো এক মহাকবি পুঁতে গিয়েছিলেন।
যখন মাধবীকে বললাম সেই কথা ও কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর যেন কোনো এক স্বপ্নের অতল থেকে আচ্ছন্নভাবে বলল, শৌনক, আমিই ওই গাছ।
৩.
মাধবী এবং বনমালীর সেই সাক্ষাতের দৃশ্য আমি বর্ণনা করার উপযুক্ত লোক নই। আমার কাষ্ঠশুষ্ক বিবরণে সেই মুহূর্তের তাৎপর্য কিছুতেই বোঝা যাবে না। মাধবীর দৃষ্টি নেই দেখে বনমালী চোখের জল সামলাতে পারলেন না। মাধবীর গন্ডদেশ থেকে অশ্রু মোছাতে মোছাতে কবি বললেন, মাধবী, কেন যে মানুষ কোনো কবিকে দ্রষ্টা বলে আমি জানি না। সে তো তার নিজের অধঃপতনও তার কবিতায় আঁচ করতে পারে না। তাহলে তোমার …
কবিকে কথার মধ্যেই থামিয়ে দিল মাধবী। না, না কবি, আপনি কবিতাকে ছোটো করবেন। কবিতা যে কিছু দেয় না তা আমিও বুঝি। কিন্তু কবিতা যা দেয় তা তো কেউই বোঝে। আপনিই না আমায় বলেছিলেন একসময়, ব্রহ্মার সবচেয়ে বড় সৃষ্টি কবি কালিদাস! আপনিই না বলেছিলেন কবি ত্রিকালদ্রষ্টা! আপনিই প্রমাণ করেছিলেন যে হিমালয় পর্বতের অস্তিত্বের অতিরিক্ত সত্য নিহিত আছে কবি কালিদাসের হিমালয়ের বর্ণনায়? হিমালয় স্বয়ং যতখানি সত্য তার চেয়েও মহিয়ান কবির বর্ণনা—সেও তো আপনারই তত্ত্ব নয় কি!
এইভাবে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিল মাধবী। কিন্তু গোঁয়ার মানুষ বনমালীও। তিনি বললেন, আমি এখন বলছি কবিতা ছায়ামাত্র। কবিতা গোলকধাঁধা। কিন্তু আমার পূর্বের ধারণার গোলকধাঁধাও সে নয়। সে গোল নয়, সরল রেখামাত্র। এর কোনো আদি নেই, অন্ত নেই। সরল রেখার মতো ভীষণ গোলকধাঁধা আর কিছুই নেই। কেউ জানবেও না যে এই রেখা কোন বিন্দুতে বিদ্যমান। তাই আমি বলি কবিতা হল শেষমেষ এক অনন্ত নির্যাতন। এক অপরূপ সর্বনাশ।
কবিতার এই নিন্দে শুনতে শুনতে শিবনিন্দায় আর্ত সতীর মতন মাধবী ধীরে ধীরে স্তব্ধ হতে থাকল। তারপর মনের এক মোহাচ্ছন্ন পরিমন্ডল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করল :
পত্রমর্মরও তার বেদনা বোঝেনি,
যার বাস শ্রাবন্তীর সীমানা পেরিয়ে,
দিবসের প্রথম বিহঙ্গ তাকে দেখেছে ক্কচিৎ,
শোনায়নি গান তাকে বিহ্বল বাতাস।
আমি তার যাত্রাপথে থাকি, যদিও পিছিয়ে,
আমি দেখি গমনাগমন কত মানুষের
মৃত্যু ও শোকে।
আমি দেখি পশ্চিমা বায়ু
কীভাবে মত্ত করে বন,
কীভাবে পালিত পশু প্রাণপণ
ধরে রাখে নিজেদের প্রাণ!
মর্ত্যভূমি বড়োই কঠিন ঘর,
যাওয়া-আসা নিয়ত আছেই,
যারাই যত্নে বাঁধে সুখনীড়
তারাই ভাঙে তা কালে দু-হাতে।
সব শোকই যাত্রাপথে আছে
সব সুখই যাত্রা পথে রয়
যতদূর যাত্রা করা যায়।
তিনি আর কতদূর যান?
আমি আর কতখানি যাব?
এ তো শুধু যাওয়া, শুধু যাওয়া,
আমার হৃদয় শুধু পথ।।
তার উচ্চারণ শেষ হওয়ার পরও মাধবীর ঘোর কাটল না! অনুরূপ এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমরাও। কবি বনমালীও বুঝলেন রাজকন্যার কী সর্বনাশ তিনি করে দিয়েছেন। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে তিনি কেবল নিজেকেই ধিক্কার দিতে থাকলেন। বললেন, মাধবী আমি পাষন্ড। আমি নরাধম। আমি কবিতার অনুপ্রেরণার জন্যই তোমাকে প্রতীক করে ব্যবহার করেছি। আমি তো তোমায় ভালোবাসিনি। আমি তো কাব্যের খাতিরে তোমার নাম, তোমার ব্যক্তিত্বের মূৰ্ছনাকে কাজে লাগিয়েছি। আমার কবিতার মাধবী আর তোমার জীবন্ত সত্তার মধ্যে তো দুস্তর ফারাক। তুমি জীবন্ত, তুমি ভগবানের সৃষ্টি। আমার কবিতার মাধবী তো ছায়া, একটা মানুষের কল্পনার পরিণতি। আমার কবিতার মাধ্যমে তুমি নিজের বিন্দুমাত্র সত্য দেখতে পাও না। তুমি ফিরে যাও। তুমি এই ভয়ংকর, মর্মান্তিক কল্পনার পথের যাত্রী হয়ো না মাধবী। তোমার তো সব আছে। যাদের কিছুই নেই সেই ভিখারিরাই এই কবিতার নকল জগতে আসে। যারা কিছুই পায়নি জীবনে তারাই শব্দের, ধ্বনির জগতে নকল রাজা সাজে। তারা যে নকল তারা তা নিজেও জানে না। আমি যে গাছটিকে মাধবী বলে স্নেহ করতাম সে তো কখনো মাধবী হবে না। তেমনি আমার কবিতা।
গাছের প্রসঙ্গ আসতে মাধবী ইশারা করে থামিয়ে দিল কবিকে। কবি, আপনি যে গাছটিকে মাধবী জ্ঞানে প্রণয় করতেন তাকে আমি শিল্পীর দ্বারা মাধবী করেই আমার কক্ষে রেখেছি। সেও আমার মতনই সত্য।
না, সে শুধু প্রতিকৃতিমাত্র। সে কখনো তুমি নও। কল্পনার তো শরীর হয় না।
কিন্তু আপনিই না বলেছিলেন শরীরের সত্য মুছে গেলেও কল্পনার সত্য জেগে থাকে।
তাহলে বলি। আমি রেবার পাড়েও একটি গাছকে মাধবী মনে করে স্নেহ করে থাকি। সেও কি মাধবী তাহলে?
হ্যাঁ, সেও মাধবী। যদি আপনার কল্পনায় প্রাণ থেকে থাকে, যদি আমার বাস্তব এবং আপনার কল্পনার পরমপ্রণয় থেকে থাকে।
মাধবীর এই কথা শোনামাত্র কবি বনমালী ত্রস্ত পায়ে রেবার কূলের দিকে হাঁটতে লাগলেন। তাঁকে অনুসরণ করলাম আমি, মাধবী, পুরন্দরদাস এবং ভবতোষ। তখন বেলা পড়ে এসেছে। কূলে এসে সমস্ত বস্ত্র ছুড়ে ফেলে ঝাঁপ দিলেন জলে। একটু বাদেই ভেসে উঠে এক গলা জলে দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতাগুচ্ছ আবৃত্তি করতে লাগলেন। ক্রমে গোধূলির শেষ রশ্মিও বিলীন হল। নির্জন কূলে দাঁড়িয়ে তিনজন মন্ত্রমুগ্ধের মতন সেই অনির্বচনীয় কবিতা শুনতে থাকলাম। একসময় চন্দ্রোদয় হল! চন্দ্রের আলোকে উদ্ভাসিত হল কবির মুখ, কবির দেহ। তিনি যন্ত্র চালিতের মতন সমস্ত লাজ-লজ্জা ভুলে কূলে উঠে এলেন এবং পাড়ের গাছটির সঙ্গে সংগমে নিমগ্ন হলেন। আমরা স্তম্ভিত হলাম দেখে যে অদূরে রাজকন্যা মাধবীও তার সমস্ত বস্ত্র একে একে ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নিরাবরণ মাটিতে কাতরাতে লাগলেন। তার শরীরের ভাব দেখে মনে হল বুঝি বা কোনো অদৃশ্য প্রাণী তার সঙ্গে অলৌকিক এক রতিক্রীড়ায় মগ্ন হয়েছে। আমরা আরও আশ্চর্য হলাম দেখে যে, যে ভঙ্গিতে বনমালী গাছটিকে আকর্ষণ করছেন, তার শরীরে নিজেকে প্রয়োগ করছেন, তারই সংগতি যেন মাধবীর অঙ্গভঙ্গিতে!
আমি জানি না আমরা কতক্ষণ এই দৃশ্য দেখেছি। আমাদের বক্ষ বিদীর্ণ হয়েছে বেদনায় যখন আমরা দেখলাম একেবারে উন্মাদের মতন কবি বনমালী তাঁর গাছকে নিগ্রহ করছেন। তাঁর দুই হাতের পেষণে তখন বৃক্ষের সমস্ত শরীর যেন বাষ্পরুদ্ধ। যেন ছটফট করছে। আমরা দৌড়ে গেলাম তাঁকে বৃক্ষের থেকে আলাদা করে দিতে। কিন্তু হায় নিয়তি! ততক্ষণে অদূরে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেছে রাজকন্যা মাধবী। আমরা তার শরীরের পাশে গিয়ে দেখলাম তার কণ্ঠদেশে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে দশ আঙুলের দাগ। আমি তার মাথার কাছে ঝুঁকে ডাকলাম, মাধবী! মাধবী! কিন্তু মাধবী তখন গাছ। কিংবা গাছের মতন।
এই তার শ্রেষ্ঠ সুযোগ বুঝে ভবতোষ ‘খুন! খুন!’ বলে চিৎকার করে নগরীর দিকে দৌড়োতে লাগল। তার জীবনের যা কিছু প্রাপ্য দাক্ষিণ্য তখন নির্ভর করছে বনমালীকে খুনি প্রমাণ করার মধ্যে। সেইসঙ্গে আমাকেও চক্রান্তের অংশীদার করায়। কারণ কোন সভা বিশ্বাস করবে মাধবীর অলৌকিক সংগম এবং মৃত্যুতে? আমার শুধু দুঃখ হয় হতভাগ্য ভবতোষ এই পরম অলৌকিক দৃশ্য দেখার পরও চরিত্রগতভাবে এতটুকু বদলাল না!
তাঁর জ্ঞান ফিরতে বনমালী যখন তাঁর সর্বনাশা কীর্তির কথা শুনলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ রেবার জলে ঝাঁপ দিলেন। আমি আর পুরন্দরদাস মাধবীর সৎকারটুকু শেষ করলাম রেবার তীরে। পুরন্দর অতঃপর তাঁর সমস্ত কবিতা জলে নিক্ষেপ করে মুনি মহাদিত্যের আশ্রমে ফিরে গেলেন। আর বেচারা আমি! আমি না ঘরের, না ঘাটের। আমি চিরকালের মতো
প্রবাসী হয়ে গেলাম। কারণ ভরতপুরে যাওয়া মানে শূলে চড়া। আমি এখন কোথায় যে যাব আমি নিজেও জানি না। আমার এই অভিজ্ঞতা আমি কাউকে কোনোদিন প্রাণ খুলে জানাতে পারব না। কারণ রাজার চর সর্বত্র। আমি আমার সাদামাটা ঢং-এ ভাবী কালের জন্য এই বিবরণ লিখে রেবার পাড়ে রোপণ করে যাচ্ছি। যদি কখনো কেউ এটি উদ্ধার করেন তবে তিনি যেন আমার ভাষা এবং ভাবের অক্ষমতাকে ক্ষমা করেন, ইচ্ছে মতন এই বিবরণকে আধুনিক ভাষায় জনগণের সামনে তুলে ধরেন। তবে অনুরোধ, এই ঘটনা এবং নামধাম যেন তিনি অবিকৃত রাখেন। এবং এই রচনার কৃতিত্বও যেন তিনিই নেন। আমি অখ্যাত অবলুপ্ত হয়ে থাকতে চাই।
কামকল্পনা
মহাগুরু দেবানন্দের শেষনিঃশ্বাসের অপেক্ষায় তাঁর শিষ্যকুল আমরা বসেছিলাম তাঁর শয়নকক্ষে।
শ্বাস-প্রশ্বাস ঠাওরানোর উপায় নেই, তাঁর বক্ষদেশ এতই অচঞ্চল। আদুল দেহে চিত হয়ে শুয়ে আছেন যেন গঙ্গার স্থির ভাসমান। শরীরে কোথাও বেদনা থাকলেও মুখে তার ছোঁয়ামাত্র নেই। শুভ্র শ্মশ্রুগুফে আবৃত মুখটায় আভাস বলতে একটাই—ক্লান্তির। গত পূর্ণিমায় গুরু অধ্যাপনা সাঙ্গ করে হঠাৎই বলেছিলেন, ধাতুক্ষয়ের জন্যই যেমন পুরুষ ও নারীর রমণক্রিয়ায় বিরামের ইচ্ছা জাগে তেমনই আত্মবিশ্বাস ক্ষয়েই মানুষের জীবনে বিরামেচ্ছা উৎপন্ন হয়।
বলা বাহুল্য, গুরুর এই মন্তব্যে আমরা প্রমাদ গুনেছিলাম। অকস্মাৎ মহামতি বাব্যের শ্লোক প্রয়োগ করে জীবন ও রমণপ্রক্রিয়াকে এক করে দেখানোর ইচ্ছা হল কেন আচার্যের। চিরকালই তো তিনি কামশাস্ত্রকার শ্বেতকেতু, বাভ্রব্য বা গোনৰ্দীয়ের শ্লোক উদ্ধৃত করে এসেছেন পূর্বাচার্যদের সঙ্গে নিজের মতানৈক্য বোঝাতেই, বলেছেন পূর্বাচার্যেরা সুরতক্রিয়ার যান্ত্রিক তত্ত্বই উদ্ধার করতে পেরেছেন, তার দর্শনের জগৎ তাঁদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাঁর পরমশ্রদ্ধেয় বাৎস্যায়ন মুনিকে গুরু দেবানন্দ বলেছেন, কামশাস্ত্রের মনোবিজ্ঞানী। কিন্তু দার্শনিক? না, ও সম্মানটুকু তিনি কৃপণের মতো গচ্ছিত রেখেছিলেন শুধু একজনের জন্যেই।
নিজের জন্য? না, তাও না। ভানুপ্রিয়ার জন্য।
এই ভানুপ্রিয়াটি কে, তা দীর্ঘ ত্রিশ বছর তাঁর সঙ্গ করে একটা ধারণা হয়েছিল আমার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মানবীর চারিত্র্য ও প্রকার সম্পর্কেও আমার অনুমানে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কখনো মনে হয়েছে ভানুপ্রিয়া মহাবলীপুরমের কোনো রাজদুহিতা, কখনো বারাণসীর বিধবা, কখনো রেবতীর শাস্ত্ৰশীলা অন্তঃপুরিকা, কখনো উদয়নগরের বারবনিতা, কখনো গুরু দেবানন্দের মাতা, কখনো ভগিনী, কখনো বিচ্ছিন্না স্ত্রী কিংবা রক্ষিতা। আমার গুরুভাইয়ের নিজের নিজের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা করে নিয়েছে ভানুপ্রিয়া সম্পর্কে। তবে যেহেতু শিষ্যকুলে গুরুর সঙ্গে আমারই সংসর্গ দীর্ঘতম তাই আমার ধারণাই কিঞ্চিৎ প্রাধান্য পেয়েছে এতাবৎ।
অথচ গুরুকে মুখ ফুটে কেউ প্রশ্নও করিনি কোনওদিন : আচার্য, ভানুপ্রিয়া কে?
গুরুর বয়স অশীতিপ্রায়, অথচ জরা তাঁকে গ্রাস করেনি। উল্লিখিত পূর্ণিমায়ও তিনি পাঁচটি নবনির্মিত শ্লোক আবৃত্তি করলেন কামনার শোক বিষয়ে। বললেন, যে গভীর আনন্দবর্ধন হয় তারও নিষ্পত্তি শোকে।
আমি তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন তুলেছিলাম, এ কী কথা, দেব? সুরতক্রিয়ার তীব্র আনন্দ কি নারী বা পুরুষকে তীব্র মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন রাখে না দীর্ঘসময়?
গুরু স্নানভাবে হেসেছিলেন। তারপর বললেন, সেই মুগ্ধতাও তো স্মৃতিমাত্র। আর স্মৃতির জন্ম বিচ্ছিন্নতায়, সুখসমাপ্তিতে, শোকে। রমণস্মৃতি তাই আন্দোলনমাত্র এক ধরনের চিত্তবিক্ষেপ, পিপাসার জন্ম, যার অপর নাম শোক।
বেশ কিছুকাল যাবৎই শুরুর শিক্ষায় এই এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে : তিনি কামকলাকে অনিবার্য যন্ত্রণা হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। বলেছেন, শাস্ত্রকাররা বিধান দিলেও আমি কামকে ধর্ম ও অর্থের সঙ্গে ত্রিবর্গের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না। কারণ ধর্ম ও অর্থের দর্শন আছে, কামের দর্শন কোথায়? সুখ যে বর্গের অন্তিম লক্ষ্য তা দার্শনিকতাশূন্য। যে সুখ শান্তির স্তরে পৌঁছোয় না তার কোনো দর্শন হয় না।
এইসময় গুরুভাই গৌতম বললে, কিন্তু আচার্য, দেহের এই অপরিহার্য সুখ ব্যতীত কি জীবনে শান্তি আসতে পারে?
গুরু তাঁর সদ্যরচিত শ্লোকগুলির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন, নারী-পুরুষের জীবনে শান্তি আনে প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সমর্থন যা ধর্মের পথে আসে কাম তার সামান্য উপকরণ মাত্র। কামজনিত অনুরাগে প্রেমের উদগম হয়, তার বিশুদ্ধিকরণ হয় ধর্মে। তবেই শান্তি।
এরপর গৌতমের মতো বাকি সবাই নিশ্ৰুপ হয়ে রইলাম। গুরু বলতে থাকলেন, মুনি বাৎস্যায়ন কামের সুস্থ সামাজিকতা দেখিয়ে গেছেন। আচারও। সংযত কামকে বলেছেন ধর্মাচার। কিন্তু সেই ধর্মাচারেও অধ্যাত্ম কোথায়? দার্শনিকের নিমগ্ন তপশ্চর্যা কোথায়? দার্শনিকের নিমগ্ন তপশ্চর্যা কোথায়? চতুর্দিকে দেখি স্থূল, পৃথুল কামকলাপ নিয়ে কবিরা কাব্যনির্মাণ করছে, এক কাল্পনিক কৃষ্ণ সৃষ্টি করে তাঁকে রতিসাগরে নিক্ষেপ করছে, বিস্মৃত হচ্ছে গীতার অবতারকে। কেবল ভানুপ্রিয়াই একটা সত্য উচ্চারণ করেছিল : কাম নিয়ে অজস্র গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় বলেই কবিদের তাই নিয়ে এত আদিখ্যেতা। মানুষ কুকুর বিড়ালের মতো সর্বসময়ে কামে লিপ্ত হলে কে আর তা নিয়ে কাব্য ফলাত? চক্ষুলজ্জা, সমাজবিধান এই সবই কামকে কবিতা করেছে।
বাৎস্যায়নের পর যে গুরু দেবানন্দকে আমরা জগদশ্রেষ্ঠ কামশাস্ত্রী জ্ঞান করে এসেছি এতদিন তাঁর এইসব মন্তব্যে আমরা উত্তরোত্তর বিভ্রান্ত হচ্ছিলাম। কামতত্ত্বের প্রতিই যেন এক তীব্র বিদ্বেষ প্রকট হচ্ছিল তাঁর কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা চালচলনে। একদিন যেমন দেখলাম গুরু তাঁর প্রিয় বাৎস্যায়নিক কামসূত্রের পুঁথিগুলো চেলাকাঠের আগুনে জ্বালিয়ে শেষ করেছেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন, হর-পার্বতী কি কামসূত্র পড়ে রমণে লিপ্ত হতেন? কাম কি কবিতা যে তার একটা নির্দিষ্ট ভাব ও গঠন হবে? জনে জনে যা পৃথক তার আবার ব্যাকরণ কীসে?
আমি ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু মনের ও শরীরের আচরণের কি ব্যাকরণ হয় না? কবিতাও তো মনের আচরণ?
গুরু আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন যেন আমি নিতান্ত বালকের মতো কথা কইছি। তারপর ফের মন দিয়ে কামসূত্র পোড়াতে পোড়াতে বললেন, কামকলার সেরা মাধুর্য কী জানো? তা হল ক্রিয়াটি সাময়িক উন্মাদনার ফলশ্রুতি। ব্যাকরণ শিক্ষা করে কবিতা রচনা যেমন অসম্ভব তেমনই অসম্ভব কামশাস্ত্রজ্ঞ হয়ে যথার্থ বেগবান নায়ক হয়ে ওঠা। কবিতার অনুপ্রেরণা আর সম্ভোগের নিয়ন্তাও এক উন্মাদনা, যার শাস্ত্র হয় না।
বললাম, তা হলে এতকাল ধরে যা শিখলাম…
গুরু বললেন, সবই সত্য, তবে অধস্তন সত্য। অর্থাৎ যা বিবরণমূলক। এবার শিক্ষা কর ঊর্ধ্বতন সত্য, যা…
উৎকণ্ঠার বশে গুরুর কথার মধ্যেই বলে বসলাম, যা?
গুরু বললেন, যা স্বপ্নমূলক, অর্থাৎ অবাস্তব, অতএব দর্শনস্পষ্ট।
গুরুর ত্রিশ বছরের সান্নিধ্যে এমন হতভম্ব আমি হইনি কখনো। কামকলা অসম্ভব?
বললাম, মানুষের নিত্যকার ব্যবহারকে অসম্ভব বলছেন, দেব?
গুরু হাসলেন, বলব না? লিখলেটা কে? বাৎস্যায়নদেবই তো? যিনি জীবনে একবারটি সংগমে লিপ্ত হলেন না। অরণ্যের উপান্তে বসে ধ্যানবলে তিনি অরণ্যের অন্ধকারকে অনুমান করলেন।
বললাম, তাতে কি কামসূত্র বাস্তবতা হারায়?
গুরু বললেন, তা হারায় না, কিন্তু অমন বৃত্তান্ত থেকে কামকলার স্বপ্নিল অবাস্তবতায় পৌঁছোনো যায় না। সংগমের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলেই রমণের অসম্ভবতা আবিষ্কার সম্ভব। বাৎস্যায়ন যা চেষ্টাও করেননি আর…
-আর?
—আর আমি ভানুপ্রিয়ার দীর্ঘ সঙ্গলাভে বুঝলাম যে সব মানুষই এক অর্থে কামারণ্যের উপান্তবাসী, সে অরণ্যের বাইরে থেকেই অনুমানে, অনুমানে তার ধারণা গড়ে নেয়। অরণ্যে প্রবেশ করলেও তা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সে বিশেষ কিছু স্মৃতি বহন করে আনে না। কিছু স্বাদ, বর্ণ, ঘ্রাণের স্মৃতির অতিরিক্ত সে সঞ্চয়ে রাখতে পারে না। কালে কালে তা-ও অন্য স্মৃতির মধ্যে মিশে অস্পষ্ট হয়ে যায়। এবং একসময় হয়ে যায় সম্পূর্ণ কল্পনা। হয়তো এই কারণেই ভানুপ্রিয়া কামকলাকে বলত কামকল্পনা।
আমি বলে উঠলাম, তা হলে কি এইজন্যই আপনার কামসূত্রাবলির আপনি নামকরণ করেছিলেন কামকল্পনা?
গুরু হেসে বললেন, হয়তো। হয়তো না!
সেইদিন থেকেই একটু একটু করে আমরা শিষ্যরা গুরুর কামকল্পনার পুঁথি চুরি করা শুরু করি। সবারই একটাই ভয়—গুরুর যা মতিগতি দাঁড়াচ্ছে তাতে অচিরে এসব পুঁথিও হয়তো চেলাকাঠের আগুনে যাবে! গুরুর সম্পদ আহরণ ধীরাজ মুনির মতে নির্বাসনযোগ্য অপরাধ জেনেও আমরা এর কাজ থেকে নিবৃত্ত হতে পারিনি। আমরা ধীরাজের অভিমতের বিরুদ্ধে মনে মনে প্রয়োগ করেছি কাশীর বিশ্রুত পন্ডিত ত্রিলোকনাথের যুক্তি : শিষ্যরাই গুরুর বৈধ উত্তরাধিকারী। আর আমরা তো স্বীয় স্বার্থে নয়, গুরুর ঐতিহ্য রক্ষার্থেই এ পথ ধরেছি। গুরুর সব রচনা আগুনে গেলে আমরা কোথায় দাঁড়াব? আমাদের মধ্যে একমাত্র যে নারীআশ্রমিক সেই নীলকান্তাই এ ব্যাপারে পথ দেখাল। গুরুর নিদ্রাযাপনের পূর্বে তাঁর শির ও পদযুগল মর্দনের সময়ে সে একটু একটু করে সরিয়ে আনতে শুরু করল কামকল্পনা পুঁথির ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়, অধিকরণ ও টীকা। আমরা কি ভুলতে পারি সেইসব সুখ ও আহ্লাদের দিন যখন জনগণের সুবিধার্থে গুরুদেব স্বীয় সূত্রের টীকা রচনায় ব্যাপৃত হলেন।
কিন্তু গুরুর ওই পুঁথি অপহরণের মধ্যেই যেন যত বিপত্তির উৎপত্তি। একবার মহামূল্যবান পুঁথি হস্তগত হলে কে আর তা পড়ার লোভ সংবরণ করতে পারে! আমরাও পারিনি। আর সেইসব পুঁথি থেকেই আশ্চর্য আশ্চর্য সব তত্ত্ব উদ্ধার হতে থাকল। যেমন রমণ প্রসঙ্গে গুরু এক বিস্তীর্ণ আলোচনায় বলেছেন যে, রমণের এক প্রধান উল্লাস আবিষ্কারে। যে কারণে সমস্ত পুরুষের মধ্যে নব নব নারীদেহ আবিষ্কারের তাড়না থাকে। যা থেকে জন্মে ক্রম-অতৃপ্তি, যা কারণ হয় চরিত্রনাশের। তবে কী নারী, কী পুরুষে রতি ও রমণে প্রকৃত আবিষ্কার হল রতির সমার্থক চিন্তাদি যেমন রস, প্রীতি, ভাব, রাগ, বেগ ও সমাপ্তির পূঢ়ার্থ তথা রমণক্রিয়ার সমার্থক চিন্তাদি যেমন সম্প্রয়োগে, রত, রহঃ শয়ন ও মোহনের মর্মোদ্ধার। এই কথা ঋষি বাৎস্যায়নের কীর্তিতে আছে, কিন্তু বাৎস্যায়ন আবিষ্কার-মাহাত্মকে গুরুত্ব দেননি। ফলে অভ্যাসবশত রতি ও রমণ ঔদাস্যকেও প্রশ্রয় দেননি। গুরু দেবানন্দ এই সুখী, সফল কামসূত্রকে বলেছেন যান্ত্রিক, যার রাসায়নিক, জৈবতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিটোল, কিন্তু তাতে রহস্য নেই, দুর্লঙ্ঘ্য প্রশ্ন নেই, চিন্তার ঝাঁপ নেই।
অন্য এক জায়গায় দেখা গেল গুরু লিখছেন, ভানুপ্রিয়ার স্বরূপ উদ্ধারই আমাকে সাংখ্যদর্শন থেকে সরিয়ে আনল কামজিজ্ঞাসায়। কেমন হতে পারে চতুর্দশবর্ষীয় বালকের মন যখন…এর পরের রচনাংশ হাতে আসেনি বলে জানা গেল না গুরু কোন বিস্ময় বা আবিষ্কারের কথা বলতে উদ্যত হয়েছিলেন। যেমন আরেকটি প্রসঙ্গেরও নিস্পত্তি হল না। পুঁথির পৃষ্ঠা এলোমেলো রয়ে গেল বলে, যেখানে গুরু বলেছেন, আমার ব্যক্তিগত আবিষ্কারের এক গৃঢ় ক্ষেত্র হল রতি, রমণ ও স্বপ্নের সম্পর্ক। স্বপ্নের দ্বারাই আমরা রতিজীবনের জন্য তৈরি হই এবং আমাদের বাস্তব স্বপ্ন ও রতির সম্পর্ক অশ্রু ও মনোবেদনার মতো, হর্য ও হাস্যের মতো, কখনো কখনো যেমন হর্ষেও অশ্রুপাত হয়, বেদনার সঞ্চার হয় হাস্যের মতো, তেমনই সময় সময় স্বপ্ন ও রতিতেও এহেন বিহুলকর ব্যঞ্জনার উদ্ভাস হয়। ভানুপ্রিয়ার যৌনতা আবিষ্কারের দিন…হা হতোস্মি! ঠিক এইখান থেকেই পুঁথি নিশ্চিহ্ন। আমরা নীলকান্তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলাম পুঁথির এইসব অংশ সংগ্রহ করার জন্য। সে বললে, গুরুর শয়নকক্ষের অন্ধকারে আমি কী করে পড়ে পড়ে বার করব ও সব? হাতের কাছে যা পাই তাই উদ্ধার করে আনি।
সম্প্রতি যে-পুঁথিগুলো উদ্ধার করেছে নীলকান্তা তাতে কামকলা, যৌনতার ঊর্ধ্বে আরেক বিষয়ের কথা বার বার ফিরে এসেছে—মৃত্যু! তবে সেই মৃত্যুর আবহ হিসেবেও স্থানে স্থানে দেখা দিয়েছে যৌনতা। যেমন গুরু লিখছেন এক পর্যায়ে—ওঁ ধ্বনি ও মন্ত্রোচ্চারণের মতো পুরুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে যা অপূর্ব ধারায় আন্দোলিত করে তা হল স্ত্রীর শীৎকারধ্বনি। মৃত্যুপথযাত্রী পুরুষের ক্লান্ত চেতনায় মন্ত্রের মতো এই ধ্বনির স্মৃতি প্রত্যাগত হলে তা সুখের হয়। এও হল কামকলার অসম্ভবতার এক বিচিত্র, মধুর রূপ। মুনি বাৎস্যায়নের এই অভিজ্ঞতা হয়নি কারণ তিনি ছিলেন সংগমে অনভিজ্ঞ। কিন্তু আমার?
বিগত পূর্ণিমার পর গুরু দেবানন্দ অন্তিমশয্যা গ্রহণ করেছেন, সেই থেকে তাঁর বিশাল পুঁথিভান্ডার ঘাঁটাঘাঁটি করেও আমরা তাঁর জীবন সম্পর্কে কোনো নিষ্ঠ ধারণায় পৌঁছোতে পারিনি। তিনি কি কখনো বিবাহ করেছিলেন? কখনো কি নারীসঙ্গ ঘটেনি কামশাস্ত্রের এই অলৌকিক প্রতিভার? ভানুপ্রিয়া কে? সে কি জীবিত না মৃতা না নিতান্তই কাল্পনিক? তাঁর মৃত্যুকালে গুরুর শেষ অভিলাষ কী?
নীলকান্তা সেদিন বলল, মূর্ধান্বিত অবস্থায় গুরু নাকি বার বার নাম ধরে ডেকেছেন ভানুপ্রিয়াকে।
গতরাত্রে নীলকান্তা যখন গুরুর কপালে জলসিঞ্চন করতে করতে মুমূর্ষ আচার্যকে জিজ্ঞেস করল, দেব, কিছু বাসনা করেন? গুরু নাকি অতিকষ্টে বিড় বিড় করে বলতে পেরেছিলেন, ধ্বনি ধরো।
ধ্বনি ধরার অর্থ দেবনামকীর্তন। যা সেই থেকে তাঁর শিষ্য আমরা সমানে করে চলেছি। কিন্তু, আশ্চর্যের আশ্চর্য, আশ্রমের একমাত্র নারী যুবতী নীলকান্তই জানাল গুরু নামধ্বনির সঙ্গে হয়তো শীৎকারধ্বনির কথাও বলতে চেয়েছেন। ফলে গুরুকক্ষের সংলগ্ন কুঠুরি যেখানে নীলকান্তার বাস সেখানে আমরা আশ্রমিকরা একের পর এক রমণে লিপ্ত হতে চললাম নীলকান্তার সঙ্গে! জ্যেষ্ঠ শিষ্য হিসেবে সদ্য তরুণীর সতীচ্ছদ ছিন্ন করার দায় বর্তায় আমার উপর। সেই অপূর্ব সম্ভোগের স্বাদ এখনও আমার ওষ্ঠে, জিহ্বায়, চক্ষে বস্তুত সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছেয়ে আছে। আশ্রমিকদের মধ্যে আমি এবং নীলকান্তাই অবিবাহিত, ফলে কামশাস্ত্রাধ্যয়নের এক অলৌকিক প্রয়োগ আমাদের দু-জনার জীবনেই। পরে শুনেছি। নীলকান্তার শীৎকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল কীর্তনধ্বনি এবং সে-সময় এক অপূর্ব প্রসন্নতা ফুটে উঠেছিল গুরুর মুখমন্ডলে। রমণকালেই নীলকান্তা জানায় যে, এই অভিজ্ঞতার পর অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তার সঙ্গ করা অসম্ভব। সে কার্যত আমার স্ত্রী। ফলে সেই থেকে গুরুর ম্লান শ্রবণে শীৎকারধ্বনি প্রক্ষেপণের জন্য আমি ও নীলকান্তা নিরবচ্ছিন্নভাবে রমণে লিপ্ত আছি। এবং এই অনির্বচনীয় সুখের মাধ্যমে উপলব্ধি করছি রতি ও রমণ তত্ত্বোত্তীর্ণ। কী বাভ্রব্য, কী শ্বেতকেতু, কী গোনদ্দয়, কী দত্তক, কী ঘোটকমুখ, কী স্বয়ং বাৎস্যায়নদেব! গুরু দেবানন্দের কামদর্শনও কি…নবম বারের মতো আমার ধাতুক্ষয় হতে চলেছে…আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না।
আমার নিদ্রাভঙ্গ হল নীলকান্তার চুম্বনে। নীলকান্তা আমার বক্ষের উপর দেবী দুর্গার মতো ব্যাপ্ত বিস্তৃতভাবে শায়িত। বলা যায় স্থাপিতও। আমি ক্লান্ত, অবসন্ন, কিন্তু সে চিরবেগা। আমি হেসে বললাম, কিছু বলবে? সে বলল, নাথ, জাগো। গুরুর সেই ভানুপ্রিয়া এসেছেন। দেখবে না?
ভানুপ্রিয়া! মুহূর্তের মধ্যে সব ক্লান্তি মিলিয়ে গেল দেহ ও মন থেকে, আমি দিগবসনা নীলকান্তাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, কান্তা, বস্ত্র দাও।
আমরা শিষ্যরা গুরুর শয্যা ঘিরে বসেছিলাম, যখন এক অপূর্ব সৌরভ বিস্তার করে ঘরে প্রবেশ করলেন ভানুপ্রিয়া। আশ্রমে পা রাখার পর দীর্ঘ এক দন্ড তিনি এক বিশেষ কক্ষে আবদ্ধ ছিলেন। বলেছিলেন, গোধূলিলগ্নে আমি দেবদর্শন করব না। আচার্যের অনিষ্ট হবে।
কিন্তু সারা আশ্রম জেনে গিয়েছিল আগন্তুকের পরিচয়। দীর্ঘকাল ধরে একটু একটু করে যে মহিলার ছবি ও ধারণা আমরা মনের মধ্যে গড়ে তুলেছি, আজ তিনি সাক্ষাৎ ধরা দিয়েছেন, রক্ত-মাংসে ধ্বনিতে সম্পূর্ণ। আশ্রমিক আমরা গুরু প্রিয় পার্বত্য লোকসংগীতে ভরিয়ে রেখেছিলাম গুরুকক্ষ, যখন শ্বেতবস্ত্র ও রক্তাভ ললাটিকায় অনিন্দ্য ব্যক্তিত্বময়ী ভানুপ্রিয়া প্রবেশ করলেন সেখানে আমরা সকলে একে একে উঠে নমস্কার জানালাম তাঁকে; তিনি কিছুটা উদাসীনভাবেই প্রতিনমস্কার করে গুরুর পদপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালেন। গুরুর পদধূলি নিয়ে কয়েকবার পূর্ণ প্রদক্ষিণ করলেন তাঁর শয্যা, তারপর তাঁর মাথার পাশে মাটিতে বসে চাপাস্বরে ডাকলেন, আনন্দ! আনন্দ! আমি এসেছি। আমি…আমি ভানুপ্রিয়া।
আমরা, আশ্রমিকরা, রোমাঞ্চে স্তব্ধ হয়েছিলাম। আমাদের গুরুদেবকে কেউ আনন্দ বলে ডাকছে, এ অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। আরও অবাক হওয়ার ছিল—বর্ষীয়সীর ডাকে এই প্রথম চোখ মেলতে দেখলাম, আমরা মুমূর্ষ আচার্যকে, আর তাঁর চোখে জল! তিনি চোখের এককোণ থেকে মহিলার দিকে চেয়ে বললেন, তুই শেষ অবধি আসতে পারলি, ভানু?
ভানুপ্রিয়া তাঁর সারা পিঠে ছড়ানো সাদা মেঘের মতো চুলের একমুঠি দিয়ে আচার্যের চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, কেন, ভুলে গেলি আমার যে কথা ছিল সতী হওয়ার!
হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন গুরু, অমন কথা বলিসনি, ভানু। ও আমি সইতে পারব না। ভগবান তোর প্রতি কঠোর হয়েছেন বলে আমি তো হতে পারি না।
ভানুপ্রিয়া এবার আঁচলে নিজের অশ্রু মুছতে মুছতে বললেন, আমি তো জীবনে কিছুই পাইনি, আনন্দ। এই শেষ গরিমাটুকু থেকেও আমায় বঞ্চিত করবি? গুরুদেব ফের দীর্ঘ সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভানুপ্রিয়া আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, আমাদের একটু নির্জনতার প্রয়োজন আছে বৎসগণ। একটু সময় দেবে?
আমরা গুরুদেব ও ভানুপ্রিয়াকে প্রণাম জানিয়ে কক্ষের বাইরে চলে এলাম; আসতে আসতে আড়চোখে দেখলাম গুরুর ওষ্ঠে চুম্বন রাখছেন ভানুপ্রিয়া। অকস্মাৎ অনুভব করলাম নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপের আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠার মতো এক নতুন জীবন—হোক
তা ক্ষণিকের—ভর করেছে গুরুদেবকে। নীলকান্তাকে বললাম, এ কাজ গহিত হলেও এ তোমাকে সম্পন্ন করতেই হবে কান্তা। পাশের কুঠুরিতে বসে তোমায় লিপিবদ্ধ করতে হবে গুরুদেব-ভানুপ্রিয়ার শেষ সংলাপ। ঈশ্বর জানেন কী বিশাল রহস্য অনাবৃত হবে সেই সূত্রে।
নীলকান্তা তার ছোট্ট কুঠুরিতে লেখনী ধরে সংলাপের অপেক্ষায় প্রথম যে ধ্বনি শুনতে পেয়েছিল তা ছিল, আমরা পরে জেনেছি, গুরুদেব ও ভানুপ্রিয়ার মিলিত কান্নার স্বর।
২.
আমরা রহস্যের আকাঙ্ক্ষাতেই নীলকান্তাকে গুরুকক্ষের সংলগ্ন কুঠুরিতে স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু অধিক রাত্রে গুরুদেব যখন পুনরায় নীরব, নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়লেন, ভানুপ্রিয়া আশ্রমের অতিথিনিবাসে ফিরে গেলেন এবং আমরা নীলকান্তার লেখা সংলাপ গোগ্রাসে পাঠ শুরু করলাম, অমাবস্যার অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় আমাদের হৃৎপিন্ড ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল গলা বেয়ে। আমরা রহস্যের প্রত্যাশায় ছিলাম; অকল্পনীয় আশ্চর্যবোধের আশঙ্কায় নয়। সংলাপের শেষ বাক্যটি পাঠ করার পর আমাদের কারওরই গন্ডদেশ শুষ্ক রইল না। কী মর্মব্যথায় গুরুদেব কামকলাকে অসম্ভব এবং পরাবাস্তব বলেছেন তার ইঙ্গিত পেলাম। সংলাপের একখানে ভানুপ্রিয়াও বলেছেন যে, সমস্ত শোক, দুঃখ, আনন্দ বিরহ, সাফল্য, গরিমা ও সাধনার মতো কামেরও নিষ্পত্তি মৃত্যুতে। বাৎস্যায়ন ও তাঁর কতিপয় পূর্বাচার্যও সম্ভবত অনুমান করেছিলেন যে, দেহমধ্যে লিঙ্গ ও যোনিই সবচেয়ে দেরিতে বৃদ্ধ হলেও, কাম ও কামনার মৃত্যু মৃত্যুতে। ভানুপ্রিয়া বলেছেন, প্রকৃত সতীদাহ স্বামী-স্ত্রীকে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় আগুনে সঁপে দেওয়া। যাতে একের নাসিকা, ওষ্ঠ, চক্ষু, বক্ষ, হৃদয়, পাকস্থলী, অন্ত্রনালি, জঙ্ঘা, পদ ও যৌনাঙ্গ অপরের অঙ্গের সঙ্গে নিশ্চিহ্নভাবে মিশে যায়। যা তাদের অন্তিম সংগম। কিন্তু হায়!…এইখানে ফের কান্নায় ভেঙে পড়ে কপালে করাঘাত করেছেন ভানুপ্রিয়া, আমার তো সেভাবেও সৎকার হওয়া বিধেয় নয়, আনন্দ! আমি যে শিখন্ডী?
হ্যাঁ, দেবানন্দ-ভানুপ্রিয়া সংলাপের এই সেই মর্মান্তিক আবিষ্কার—ভানুপ্রিয়া শিখন্ডী। নপুংসক। উভলিঙ্গ। না পুরুষ, না নারী।
আমরা আরও আবিষ্কার করলাম গুরুদেব দেবানন্দ ভানুপ্রিয়ার পিতা আচার্য বহ্নিদেবের শিষ্য, যে বহ্নিদেব তাঁর গীতিভাষ্য অগ্নিতে নিক্ষেপ করেন যখন বার্তা পৌঁছোয় তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্য দেবানন্দ সাংখ্যচর্চা পরিত্যাগ করে কামশাস্ত্র রচনায় লিপ্ত হয়েছে।
আচার্য কিন্তু মৃত্যুকাল অবধি জেনে যেতে পারেননি দেবানন্দ কেন দর্শনচর্চা পরিত্যাগ করল। তিনি এও জানেন না সহসা এক প্রাতে দেবানন্দ কেন কন্যা ভানুপ্রিয়ার সঙ্গে আশ্রম থেকে পলায়ন করল। তিনি আক্ষেপে বলেছিলেন, কন্যা ভানুপ্রিয়া যোনিবিযুক্তা। সে কী করে সমাজধর্ম পালন করবে দেবানন্দের সঙ্গে?
দেবানন্দও জানে না তার প্রেয়সীর স্বরূপ, শুধু যৌবনধর্মে ক্রমশ আকৃষ্ট হয়েছে ভানুপ্রিয়ার প্রতি। প্রথমে স্পর্শ, পরে ক্রম আলিঙ্গন—সৃষ্টক, বিদ্ধক, উদঘৃষ্টক, পীড়িতক, অবশেষে চুম্বন ও শেষের সেই ভয়ংকর দিনে—দেবানন্দ উন্মাদের মতো প্রার্থনা করেছে, ভানু এই পূর্ণিমার রাতে উদার হও, ভানু। আমি আর সইতে পারছি না। ভানুপ্রিয়া আপ্রাণ চেষ্টায় তার বসন আগলে রেখে বলেছে, ও তুমি চেয়ো না, আনন্দ। আমার দেবার কিছুই নেই। আমি অপ্রাকৃত, আমি অসম্ভবা।
এর পরদিনই ভানুপ্রিয়া সবার অলক্ষ্যে আশ্রম ত্যাগ করে। কাকপক্ষীও টের পায়নি তরুণী কোথায় গেল; শুধু দূর থেকে নীরব ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করে নিষাদরি অরণ্যের প্রান্ত অবধি পৌঁছে গেল দেবানন্দ। অরণ্যের মুখে যুবতীর আঁচল আঁকড়ে ধরল যুবক, বলল—এ অরণ্যে কাঠ কুড়োতেও মানুষ আসে না। তুমি এখানে কী করবে?
ভানুপ্রিয়া বলল, আমি তো মানুষ নই। আমি লিঙ্গের, তাই না-মানুষ।
দেবানন্দ বলল, পশুকুল শিখন্ডী চেনে না, তারা রক্ত-মাংস চেনে।
ভানুপ্রিয়া বলল, মানুষও রক্ত-মাংসই চেনে, কামনা-বাসনা-রতি-রমণ জানে, মানুষ চেনে কি?
দেবানন্দ বলল, আমি তো সেই মানুষের অনুসরণেই এতদূর এলাম।
—কিন্তু সে-আসা পূর্ণ হওয়ার নয়। আমি রতিতে অপরাগ।
-তা হলে কামকলাও অসম্ভব। নারী-পুরুষের ধাতুক্ষয়ে যে কলার নিষ্পত্তি তা পূর্ণ মানবিক নয়। আর যা অমানবিক তা…
এখানে সাময়িক নিদ্রাভাব আসে অনুলেখিকা নীলকান্তার। সে পুনরায় সজাগ হতে শোনে গুরু দেবানন্দ বলছেন, ভানুপ্রিয়া, তোমাকে অরণ্যের উপান্তে শিখন্ডীদের মধ্যে রেখে আর গুরুগৃহে প্রবেশ করতে পারিনি। ভেবেছি তলিয়ে দেখব মুনি বাৎস্যায়নের সূত্রাদি, তারপর রচনা করব আমার বিরুদ্ধ-কামসূত্র।
তখনই ভানুপ্রিয়া হেসে বলে, তোমার কামকল্পনা?
দেবানন্দ বলে, কামের অসম্ভব।
দেবানন্দ-ভানুপ্রিয়া সংলাপে এও উদ্ধার হয় যে, প্রেয়সী অরণ্যবাসী হওয়ার পরও সাত-সাতটা বছর গুরুদেব তাঁর কাছে নিয়মিত যাতায়াত করেন। প্রবল তর্ক ও বিতর্কে একটু একটু করে সত্যের আভাস পান। দিনমানে কবিরাজের হিসাবরক্ষার কাজ করে রাতে প্রদীপের আলোয় রচনা করেন তাঁর কামকল্পনার ভিত্তিসূত্র। ভানুপ্রিয়া প্রায়শই গুরুকে বলেছেন, আনন্দ, নারীসংগম করো, নচেৎ তোমার ধারণা আংশিক হবে। দেবানন্দ তখন বলেছেন, বাৎস্যায়নদেবেরও তো শুনেছি নারীসম্ভোগ ঘটেনি। আর তিনি লিখেছেন কামের নিয়মনীতি। কামকলার অসম্ভবতা রচনার জন্য নারীর কী প্রয়োজন?
তাঁদের শেষ সাক্ষাতে ভানুপ্রিয়া দেবানন্দকে প্রণাম করে বরমাল্য পরিয়ে দেন। বলেন, হৃদয় দিলাম, নাথ। দেহ দেব সতীদাহে।
তারপর একটু রয়ে সয়ে বলেছেন, ঢের হয়েছে নাথ-নাথ করা, তুমি শুধু আমার আনন্দ হয়েই থেকো। এই অভিশপ্ত জীবনের একমাত্র আনন্দ।
গুরু তখন প্রতিবাদ করেছেন, তোমায় সুখ দিতে পারিনি, তোমার সতীত্ব দাবি করব কেন?
ভানুপ্রিয়ার প্রত্যুত্তর ছিল, কারণ সতীত্বই কাম জয় করে। অগ্নিসম পরাক্রমশালী কামকে এই এক অনুভূতিই পদানত করে। সতীত্ব কামের অসম্ভব। সতীদাহে সেই অলৌকিক সংগম।
দেবানন্দ উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, আমি সতীদাহ মানি না।
ভানুপ্রিয়া উত্তর করেছেন, আমিও মানি না। কিন্তু ভালোবাসা মানি।
কিন্তু ভালোবাসা মানে তো সহমরণে যাওয়া নয়।
—কিন্তু যে সহজীবন পেলে না?
এই সময় তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়েন দেবানন্দ। বলেন, কিন্তু কে তোমাকে জানাবে আমার মৃত্যুসংবাদ?
ভানুপ্রিয়া বলেন, আমার দেহ।
–তোমার দেহ! সে কী কথা?
–জানো না বার্ধক্যে স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোনের মতো। তাদের সংলাপও তখন ব্রীজাত ‘তুমি-তুমি’ থেকে প্রায় ‘তুই-তোকারি’ হয়ে আসে। একের মনোব্যথা, দেহবেদনার সাড়া পায় অন্যে। তাই একজন গত হলে অন্যজনও শীঘ্রই মৃত্যুর মুখ দেখে।
দেবানন্দ বলেছেন, তার মানে তুমি সংবেদ পাবে আমার মৃত্যুর?
ভানুপ্রিয়া বলেছেন, যদি তোমার যাওয়ার পরিস্থিতি হয় পূর্বে। নচেৎ তুমিও সাড়া পাবে আমার মৃত্যুর।
সংলাপের শেষদিকে গুরু দেবানন্দ জানতে চেয়েছেন, তুই কী করে বুঝলি, ভানু, আমি যাচ্ছি?
ভানুপ্রিয়া জানিয়েছেন, সহসা জীবনে বিরামেচ্ছা অনুভব করলাম, আনন্দ।
জীবনে সব কিছুর উপর আস্থা হারিয়ে ফেললাম। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকাতে মনে হল তুই আমাকে ডাকছিস। প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হল, মনে হল বুক ফেটে যাবে। আমি শ্বেতশুভ্র বস্ত্রে, কপালে সিঁদুরের টিপ পরে তোর সন্ধানে বেরুলাম।
উদগ্রীব স্বরে তখন গুরুদেব জানতে চেয়েছেন, কিন্তু আমার ঠিকানা পেলি কীভাবে?
গভীর দুঃখের মধ্যেও আনন্দের হাসি হেসে বলেছেন ভানুপ্রিয়া, যেদিকে চোখ যায় হেঁটেছি। যখনই বুকে ব্যথা উঠেছে বুঝেছি পথ ভুল হল। ফের সঠিক পথে ফিরতেই ব্যথা মিলিয়ে গেছে। মনে হয়েছে তোর হৃৎপিন্ড আমার হৃৎপিন্ডকে আকর্ষণ করছে। শেষ অবধি পৌঁছোতে পেরে সব ব্যথা কোথায় মিলিয়ে গেল। এখন শুধু শেষ শ্বাসটুকুর প্রতীক্ষা।
সংলাপ পাঠ শেষ করে আমরা আশ্রমিকরা নিস্তব্ধে একে অন্যের মুখের পানে চেয়ে চেয়ে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার রাত কাটালাম। উষার প্রথম লগ্নে গুরুদেবের কক্ষে গিয়ে দেখলাম তিনি অপূর্ব শান্তিতে শেষ নিদ্রায় মগ্ন। আমি তাঁর বক্ষে হাত রেখে বুঝলাম তাঁর প্রাণবায়ু বহুক্ষণ নিষ্ক্রান্ত। আমি নীলকান্তাকে বললাম, যাও গুরুমাতাকে বার্তা দাও।
কিয়ৎপর নীলকান্তা ছুট্টে এসে বলল, নাথ, গুরুমাতাও দেহরক্ষা করেছেন।
শ্মশানে মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করে নগ্ন, আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় গুরু দেবানন্দ ও দেবী ভানুপ্রিয়াকে চিতার অগ্নিতে সমর্পণ করলাম আমরা। আর তারপরই সেই অলৌকিক ঘটনার স্ফুরণ দেখলাম। আগুনের লেলিহান শিখায় গুরু ও গুরুমাতার দেহ দুটি অপূর্ব রমণভঙ্গিতে উথালপাথাল হতে থাকল। আর চিতা থেকে ধ্বনি জাগল বিচিত্র, ব্যাখ্যাতীত শীৎকারের। যেন এক অসম্ভব, লোকাতীত সংগমে লিপ্ত দেবানন্দ ও ভানুপ্রিয়া।
আমি জ্যেষ্ঠ শিষ্য হিসেবে মুখাগ্নি করেছিলাম গুরুদেবের গুরুমাতারও। জানি আজ থেকে আমি, জয়মঙ্গল স্বামী, গুরু দেবানন্দের কামশাস্ত্রাধ্যয়ন আশ্রমের অধ্যক্ষ। আমি নীলকান্তাকে আদেশ করলাম গুরুর কামকল্পনার তাবৎ পুঁথি চিতার পাশে এনে জড়ো করতে।
গুরুভাইরা সকলেই উৎকণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্ন করল, এ কী করেন, প্রভু? কামকল্পনা দাহ করবেন? আমি পুঁথিপত্র একে একে আগুনে সঁপতে সঁপতে বললাম, দৈব কৃপায় অসম্ভব চাক্ষুষ হয়, যেমনটি আজ দেখলে। তার কি শাস্ত্র হয়? এই অসম্ভবের কাহিনিটুকুই লিখে রাখা যথেষ্ট।
কোথাকার ছবি
বাড়িটার আট ভাগের ছ-ভাগই ভেঙে নামানো হয়ে গেছে, বাকি আছে শুধু এই হলঘরটা। হলঘরটায় এককালে একটা মস্ত ঝাড়লণ্ঠন ঝুলত। এখন চারপাশ থেকে রোদ ঢুকেই আলোয় স্নান করাচ্ছে ঘরটাকে। দু-বিযে খোলা জমির মধ্যে কীরকম আনমনে দাঁড়িয়ে আছে হলটা। শাবল আর গাঁইতিতে ধ্বস্ত হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর…
পাশ থেকে গলা ভেসে এল প্রোমোটার মাংতুরামের, ‘কিবল আপনার জন্যই এই হলটা এখনও ভাঙলাম না, অরুণবাবু হাঁ, আপনি লিখলেন কি সবুর করার জন্য, তাই সবুর করলাম। আপনি মানী রাইটার আছেন, তাই আপনাকে একবার আপনার বার্থপ্লেসটা দেখিয়ে দিতে চাইলাম, হাঁ। আমাদের কমুনিটির মধ্যে রাইটার লোগদের জন্য খুব রেসপেক্ট আছে, হাঁ। এখন দেখে লিন কি আপনার কোনো জিনিস আপনি লিবেন কি না।
অরুণ হাঁ করে তাকিয়েছিল হলের দেওয়ালে ধূলিধূসর হয়ে ঝুলে থাকা বিশাল পেন্টিংটার দিকে। তিন ফুট উচ্চতা আর ছ-ফুট দৈর্ঘ্যের কালো ফ্রেমে বাঁধানো সাহেবের আঁকা ছবিটা জন্ম থেকে দেখে এসেছে অরুণ। কে, কবে ছবিটা আমদানি করেছিল অরুণের ধারণা নেই, তবে বাবাকে ও কখননো সখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে উপভোগ করতে দেখেছে শৈশবে।
আর উপভোগ করার মতনই ছবিটা, অন্তত এরকম ধূলিধূসর হওয়ার আগে অবধি তাই ছিল। সাহেবের আঁকা ছবিটা একটা পার্টি সিন। ভিক্টোরীয় বা তারও আগের কোনো যুগের এক বিপুল ভোজ ও নৃত্যসভার দৃশ্য। পরমাসুন্দরী সব মেমসাহেব আর নায়কোচিত চেহারার সব সাহেবদের মিলনসভা। কারও হাতে পানীয়ের গেলাস, কারও হাতে আঙুর, কোনো সাহেবের বাহুবন্ধনে কোনো রূপসী চোখ বুজে এলিয়ে আছে, অনেকেই হাত ও কোমর ধরাধরি করে বল নাচে ব্যস্ত। এক-আধজন পুরুষ আপন মনে দীর্ঘ, সরু পাইপে তামাক সেবনে বাঁদ, কোনো রমণী আবার আলতো করে চুমু দিচ্ছেন প্রিয় পুরুষের ঠোঁটে। আলো ঝলমলে সভায় নারী-পুরুষের পোশাকে রঙের উৎসব চলছে। কেবল একটি কোণে একটি যুবতী কীরকম মলিন মুখে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে। অরুণের মনে পড়ল, বাল্যে কীভাবে ও চুপিসাড়ে এসে দাঁড়াত ছবিটার নীচে, আর আস্তে আস্তে কী যেন একটা ঘটে যেতে ওর শরীরে, মনে। ওর মনে হত, ও নিজেও ওই ছবির বাইরে নয়। ছবিরই একটা মানুষ ও, বাইরে এসে আলাদা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অরুণের ঘোর কাটল মাংতুরামের কথায়, কী অরুণবাবু, ছবিটা আপনি লিবেন? তো লিয়েই যান। উ দিয়ে আমার কোনও পারপাস সার্ভ হবে না। আপনি রাইটার লোগ, আপনি উর মিনিং বাহির করতে পারবেন। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল মাংতুরাম, এ লখিয়া, ই পিকচারকো উতারো অউর সাহেবকো গাড়িমে ডাল দো। দেখ উসকো ডামিজ না হোয়। মেহেঙ্গা পিকচার হৈ।
অরুণের মাথায় খেলল না, এই এত বড়ো ছবিটা ও ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে কোথায় রাখবে। ঠিক এই ভেবেই তো আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ওরা ছবিটা ফেলেই চলে গিয়েছিল ফ্ল্যাটবাড়িতে। জন্মভিটের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ সত্ত্বেও মধ্য কলকাতার এই বাড়িটায় আর কখনো পা রাখেনি অরুণ। মাঝেমধ্যে এ পাড়া দিয়ে যেতে যেতে হয়তো আড়চোখে চেয়েছে বাড়িটার দিকে আর লজ্জায় চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। অত সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটার কী দশাই না হয়েছে মাড়োয়ারিদের হাতে। বাড়িটার স্টাইলই ঝেড়ে বদলে ফেলে সেটাকে একটা কুৎসিত কারখানার চেহারা দিয়েছে। আর এতদিন পর চিঠি দিয়ে জানাল যে, বাড়িটা ভেঙে সেখানে আটতলা ফ্ল্যাটবাড়ি তুলবে প্রোমোটার মাংতুরাম। অরুণবাবু চাইলে এসে একবার শেষ দেখা দেখে যেতে পারেন ওঁর জন্মভিটেকে।
স্মৃতির বাড়িটাকে দেখতে আসার সময় অরুণ কল্পনাও করতে পারেনি, হলঘরের ওই পেন্টিংটা আজও টিকে থাকবে মাড়োয়ারিদের নজর এড়িয়ে। একটু অবাকই হয়েছিল অরুণ—অ্যাদ্দিনে কেউ এটাকে পেড়ে নামিয়ে দেখতে চাইল না, ছবিটাকে বেচা যায় কি না! উলটে আজ মাংতুরাম যত্ন করে সেটাকে নামাচ্ছে অরুণের গাড়িতে তুলে দেবে বলে। অতবড়ো ছবি তো গাড়ির রুফে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। আর সে যেমন করে হোক নিয়ে গেলেও ওটাকে অরুণ ঝোলাবে কোন দেওয়ালে? ওর ফ্ল্যাটে তো একটাও দেওয়াল নেই ছবিটিকে ধারণ করার।
তবু ছবিটা ওকে নিতেই হবে। ছবিটার দিকে তাকালেই বাবার স্মৃতি ভেসে আসে। বাবার মৃত্যুর দিনেও ওঁর দেহটাকে শোওয়ানো হয়েছিল এই হলঘরে, এই ছবিটার নীচে। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বালক অরুণের কেবলই মনে হচ্ছিল, হঠাৎ করে বাবা হয়তো দাঁড়িয়ে পড়ে তাকাতে শুরু করবেন ছবিটার দিকে।
কিন্তু ছবিটার আসল রোমাঞ্চ বিস্তার আরম্ভ হল বাবার মৃত্যুর পর থেকে। অরুণ একলা বোধ করলে, মন খারাপ হলে পর নিঃশব্দে দাঁড়াত গিয়ে ছবিটার নীচে। চোখ তুলে চেয়ে রইত লাল-নীল-হলুদের বন্যায় ভেসে যাওয়া নারী-পুরুষের দিকে। নীরব ছবিতে আস্তে আস্তে বেজে উঠত বাজনার ধ্বনি, হাসির হররা, নাচের ছন্দ, আর খানিক পরে অরুণের মনে হত, সেও ওই পার্টির অংশ। শুধু পার্টিতে হাজির থেকেও ওই পার্টি বা পরিবেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থেকে যেত ওই মলিন মুখের একলা মেয়েটি। যেন কেউ ওকে নাচতে ডাকেনি, পানীয় অফার করেনি বা কাছে গিয়ে যেচে কথা বলেনি।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে অরুণ আবিষ্কার করল যে, ছবিটার মধ্যে ওই মেয়েটার দিকেই যেন ওর টান বেশি। গোটা পার্টির লোকজনকে ছেড়ে ও কেবল ওই মেয়েটাকেই দেখে। এবং পার্টির ধ্বনির বদলে মন দিয়ে শোনে মেয়েটির অনুচ্চারিত নিঃশব্দ সংলাপ এবং এভাবে দেখতে দেখতেই একদিন অরুণের মনে হল, মেয়েটি ওর কানের মধ্যে ফিসফিস করে বলছে, আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও প্লিজ!
প্রথম মুহূর্তে গায়ে কাঁটা দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল অরুণ। সর্বনাশ! এ কী শুনল ও ছবির থেকে? একটু পরে সংবিৎ ফিরে পেয়ে ও ছবির দেওয়াল থেকে দূরে সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়াল। ছবিটা যেমন থাকার তেমনই আছে। মেয়েটাও সেই মৌন, বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ, সভার এক কোণে। অরুণ নিজের মনে একটু হেসে হল ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর বহুদিন সেটির কাছে যায়নি।
ছবিটা ওর গাড়ির মাথায় শুইয়ে বেঁধে দিয়েছে লখিয়া। মাংতুরাম বলল, এবার আমি বাড়িটা পুরাই ডিমোলিশ করতে পারব। আর নতুন বিল্ডিং হলে আরেকবার আপনার পায়ের ধুলা দিবেন ইখানে।
অরুণ ‘আচ্ছা। নমস্কার!’ বলে গাড়িতে এসে বসল। মিন্টো রো-এর বাঁকটা ঘুরতেই ছবির ওই স্মৃতিগুলো ফের কেঁপে এল মাথায়। ও সিগারেট ধরিয়ে জানলার বাইরে দৃষ্টি মেলে বসে রইল। ড্রাইভারকে একবারটি শুধু বলল, নন্দ, বাড়ি চলল। আজ অফিস যাব না।
অনেক দিন পর ফের যখন ছবিটার নীচে দাঁড়িয়েছিল অরুণ, ওর খেয়াল হল যে, সেটি আর আগের মতো মিশছে না ওর সঙ্গে। ছবিটা আবার কীরকম ছবি হয়ে গেছে। লোকজনের হাসি, নাচের পদধ্বনি, পিয়ানো কিংবা বেহালার সুর উপচে এসে পড়ছে না ওর কানে। ছবির সাহেব-মেমরা যে-যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, ছবিতে যেমন থাকে। আর মেয়েটিও সেই আগের মতো ভিড়ের এক কোণে হারিয়ে আছে সবার অলক্ষ্যে। অরুণের ভয় হল, ও আর কোনোদিন ওই ছবির উৎসবে ঢুকে পড়তে পারবে না। আর এইটা মনে হতেই গলার কাছটায় কেমন যেন কান্না কান্না ব্যথা তৈরি হল। ও চট করে একটা লম্বা টুল জোগাড় করে তাতে দাঁড়িয়ে ছবিটার মুখোমুখি হল। ছবির কাচের ওপর নাক ঠেকিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে দেখতে লাগল দুঃখী মেয়েটিকে। সত্যিই ওর চোখে কি জল আছে? নাকি কারও বিফল প্রতীক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে ও উৎসবের এক কোণে?
‘বিফল প্রতীক্ষা’ কথাটা হালে ইস্কুলে শিখেছে অরুণ। কেন ভাবল ও এই কথাটাই, ও নিজেও জানে না। একটা দশ বছরের বালক কী জানে বিফল প্রতীক্ষার ব্যাপারে। আর কেনই বা ভাবল মেয়েটা কারও অপেক্ষায় আছে? এই এতশত ভাবতে ভাবতে অরুণ ফের একটু চোখ চালাল ছবির অন্যত্র। আর তখনই চোখে পড়ল, ওর ছবির অন্য প্রান্তে এক হিংস্র চেহারার যুবক, যে দুই ভয়ংকর লোলুপ চোখে পান করছে ছবির মেয়েটির রূপ। মেয়েটি যেমন সভার সব আনন্দ-উত্তেজনা ভুলে ডুবে আছে নিজের দুঃখে, এই লোকটিও যেন সব উৎসবের ফাঁকে গভীর প্রতীক্ষায় এই মেয়েটির জন্য। অরুণ যতই দেখে সেই লোকটিকে, ওর হিংস্রতা যেন একটু একটু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেষে একসময় মনেই হল অরুণের, লোকটা সত্যি সত্যি এবার একটু একটু করে এগোচ্ছে মেয়েটির দিকে।
সর্বনাশ! লোকটা তো তা হলে ধরেই ফেলবে মেয়েটাকে। আর মেয়েটাই বা পালিয়ে যাচ্ছে না কেন? আর থাকতে পারছে না অরুণ, ও দুম দুম করে ছবির কাচে ঘুসি মারতে লাগল যেখানে দাঁড়িয়ে (নাকি চলন্ত) লোকটা। তারপর হঠাৎ অন্ধকার!
চোখ খুলে অরুণ দেখল, ওর মা, কাকা, দাদা, দিদি-রা ওর মুখের উপর ঝুঁকে। পাশে বাড়ির ডাক্তার সামন্তবাবু। কাকা ওকে চোখ মেলতে দেখে হাঁফ ছেড়ে বললেন, যাক, ভয় কেটে গেছে। এখন ওকে ফের ঘুম পাড়িয়ে দাও ডাক্তার।
দফায় দফায় কতবার কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল অরুণ, ওর জানা হয়নি। শেষে কাজের লোক চিন্তা একসময় একটু বকুনির ঝাঁঝে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, খোকাবাবু, তুমি টুলে চড়ে অত্তো বড় ছবিটা পাড়তে গিয়েছিলে কেন? ওটা ঘাড়ে পড়লে তুমি বাঁচতে? ফের যদি তুমি ওই ছবির কাছে গেছ তো তোমার একদিন কি আমার একদিন। অরুণ নিজের মধ্যে ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে অস্ফুট স্বরে বলেছিল, আচ্ছা।
অরুণের চটক ভাঙল ফ্ল্যাটে এসে। তিনজনে মিলে ধরাধরি করে ছবিটা এনে লাজুক লাজুক মুখে ও পৃথাকে বলল, মাংতুরাম বলে এক প্রোমোটার আমাদের বাড়িটা ভেঙে মাল্টিস্টোরিড তুলছে। বাবার এই ছবিটা ওই আমাকে নিয়ে আসতে বলল। ছেলেবেলায় যখন বাড়িটা বিক্রি হয়, ওটা নিয়ে রাখার কোনো জায়গা পাননি মা। তাই…
পৃথা দেওয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড় করানো ছবিটা কিছুক্ষণ মন দিয়ে দেখে বলল, দারুণ ছবি, কিন্তু তবে একে রাখবে কোথায়? এতখানি দেওয়ালই তো এ ফ্ল্যাটে নেই। অরুণ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, সমস্যা তো সেটাই। সাধে আর মা ছবিটা ছেড়ে এসেছিলেন। আবার প্রাণে ধরে বিক্রিও করতে পারেননি। পৃথা বলল, তা হলে? তা হলে আর কী? থাকুক আপাতত এই ডাইনিং প্লেসে, তারপর দেখা যাবে।
অমনি প্রতিবাদ করে উঠল পৃথা, না, না, তাই কি হয় নাকি? এত সুন্দর একটা জিনিস এভাবে পড়ে থাকবে। এটা বরং টিঙ্কর ঘরে ঠেস দিয়ে রাখা যাক এখন, পরে দেওয়াল বার করা যায় কি না দেখব।
অরুণ খুব খুশি হল মনে মনে। কারণ এরকম প্রস্তাব ও চাইছিল পৃথার কাছ থেকে আসুক। তখন ড্রাইভার নন্দ, কাজের লোক আশু আর অরুণ মিলে ছবিটা ফের ধরাধরি করে নিয়ে বসাল টিক্কর ঘরে। চার বছরের কন্যাটি তখন খেলনাপাতি সাজিয়ে বসেছিল, প্রকান্ড ছবিটা দেখে গোল গোল চোখে বলল, বাপরে, এ কী এনেছ বাপি? পিকচার?
অরুণ হাসতে হাসতে বলল, সাহেব-মেমদের পিকচার। দেখছে কীরকম ডান্স করছে? গাইছে। হাসছে।
টিঙ্কু ছবিটার সামনে হাঁটাহাঁটি করে খুঁটিয়ে সব দেখে হঠাৎ বলল, বাপি, ওই মেয়েটা কিন্তু হাসছে না। মেয়ের কথায় রীতিমতো চমকে গিয়েছিল অরুণ, কিন্তু কিছু একটা ওকে বলা দরকার বলে একটু কেশে নিয়ে বলল, তাতে কী? তুমি না হয় ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ওকে হাসাবে!
টিঙ্কু কোনো জবাব না দিয়ে ফের মন দিয়ে ছবিটা দেখতে লাগল, যেন বিশাল একটা ম্যাপ স্টাডি করছে।
রাতে যখন টিঙ্কু ওর ছোট্ট বিছানায় নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে আর পৃথা বসার ঘরের সোফায় টেবিল ল্যাম্পের আলোয় একমনে পড়ে চলেছে একটা শারদীয় সংখ্যা, অরুণ আস্তে আস্তে মেয়ের ঘরে ঢুকে টর্চের আলোয় খুঁটিয়ে দেখতে লাগল ছবিটা। ছেলেবেলায় ছবির যে দুটো জিনিস দেখার কথা মনে আসেনি কখনো, সেই দু-জায়গায় প্রথমে আলো ফেলল অরুণ। প্রথমে শিল্পীর নামে। দেখল অ্যালফ্রেড নিউটন জন। না, এ নামের কোনো শিল্পীর কথা তো শোনেনি কখনো। তারপর ছবির টাইটেল–’দ্য আন এণ্ডিং পার্টি। অর্থাৎ অশেষ ভোজসভা। কিন্তু অশেষ কেন?
অরুণ এবার আলো ফেলে ফেলে দেখতে লাগল গোটা ছবিটা, যদি কোনো সূত্র পায় শিরোনামটার। কিন্তু এ কী! সেই হিংস্র লোকটা তো আর তার জায়গায় নেই! কোথায় সে? আর ওই অসহায়, নিঃসঙ্গ মেয়েটিই বা কোথায়? দেখতে দেখতে ফের গান আর নাচের শব্দ পেতে শুরু করেছে অরুণ, জোরকদমে পার্টি চলছে, সাহেব-মেমরা আপন মেজাজে নেচে চলছে, কারও খেয়ালই নেই, সভার দুটো মানুষ কখন, কোথায় উধাও হয়েছে।
অরুণ সমস্ত ছবির ওপর টর্চ ঘোরাতে শুরু করেছে, কিন্তু কোথাও ওই দুটি প্রাণী নেই। হঠাৎ খেয়াল হল, এ কী, এক ধারের মোটা ভেলভেটের পর্দা ওভাবে ঝাপটাচ্ছে কেন? ওর পিছনে কী ঘটছে? অরুণ হাত দিয়ে পর্দাটা সরাতে গিয়ে বুঝল, ছবির কাচে হাত আটকে যাচ্ছে। পার্টি চলছে, সব নারী-পুরুষ নাচে-গানে বিভোর। কিন্তু পর্দাটাও ঝাপটাচ্ছে, নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটছে ওর আড়ালে। তা হলে কি ওই লোকটা ওই মেয়েটাকে…?
আর ভাবতে পারছিল না অরুণ, ওর ডান হাতে ধরা টর্চ দিয়ে দমাদ্দম মেরে কাচটাকে ভেঙে ও ছবির ভেলভেট পর্দাটা সরাতে গেল…কিন্তু হাত আটকে গেছে, দেখে পৃথা ওর হাতটা ধরে রেখে বলছে, কী হল তোমার? এত সুন্দর ছবিটাকে তুমি নষ্ট করে ফেলছ?
তাই তো! নখ দিয়ে আঁচড়ে ও একটা ছবির পর্দা সরাতে যাচ্ছিল কেন? তা কি যায়? উলটে কাচ ভাঙতে গিয়ে হাতের পাশটাও কেটেমেটে একাকার। গলগল করে রক্ত গড়াচ্ছে কড়ে আঙুলের পাশ বেয়ে।
অরুণের কোনো উত্তর জোগাল না, এই খ্যাপামির কী ব্যাখ্যা দেবে ও?
পরদিন নন্দ আসতে অরুণ বলল, নন্দ, ছবিটা আরেকবার গাড়িতে তুলতে হবে। অত বড়ো ছবি এভাবে এক কোণে ফেলে রাখা ঠিক হবে না।
পাশ থেকে পৃথা বলল, তা হলে ছবিটা কি বেচে দেবেই ঠিক করলে? কথার উত্তর না দিয়ে অরুণ একবার হাঁটু গেড়ে বসল ছবিটার সামনে, দেখল দুঃখী মেয়েটি আর হিংস্র যুবকটি দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে যে-যার জায়গায়, যেন অরুণকে বোকা বানানোর জন্যই। হঠাৎ করে রক্ত চড়ে গেল ওর মাথায়। বলল, বেচব না তো কী করব? এই মাল ঝোলাবার জায়গা আছে বাড়িতে?
শুষ্ক গলায় পৃথা শুধু বলল, তা হলে আর এত ঝুঁকি নিয়ে বয়ে আনার কী দরকার ছিল? রাগ হজম করতে করতে অরুণ বলল, আমার বুদ্ধি!
ছবিটা বার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যখন, অরুণের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল টিঙ্কুর কথায়, পিকচারটা নিয়ে যাচ্ছ কেন বাপি? কী সুন্দর নাচ-গান হচ্ছে ওতে!
অরুণ বলল, দেখি, পার্টির একটা ছোট্ট ছবি এনে দেব তোমাকে। অ্যাতো বড়ো ছবি কোথায় রাখব বলো সোনা?
অফিসের পথে প্রথমেই স্টেনর-এর দোকানে নামল অরুণ ছবিটাকে নিলামে দেবে বলে। পরের দিন শনিবার, নিলামের দিন। ছবির দর রাখা হল দু-হাজার, তারপর যত দূর ওঠে উঠবে। কাগজপত্তর তৈরি হতেই অরুণ ফের রওনা হল অফিসের দিকে। মাথায় ঘুরছে একটা চিন্তা : টিঙ্কুর জন্য ফরাসি শিল্পী দুফি-র আঁকা কার্নিভালের একটা দৃশ্য কিনতে হবে। অক্সফোর্ড বুক শপ-এ দুফি-র প্রিন্ট পাওয়া অসুবিধে হবে না। দুফি-র ছবিগুলোর মধ্যে এমন সব রং, আঁকার এমন টঙ, এমন মেজাজ, তা ছোটো-বড়ো সবারই মন ভরিয়ে দেয়।
বাড়ি ফেরার পথে দুফি-র প্রিন্ট পেয়ে যেতে সত্যি খুব স্বস্তি আর আনন্দ হয়েছিল অরুণের। কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশি চাঞ্চল্য হল সোমবার অফিসের পথে স্টেনরে নামতে। এক গাল হেসে ম্যানেজার যখন বলল, আপনার ছবি তো দারুণ প্রফিট দিয়েছে, মিস্টার সেন?
অরুণ একটু অবাক হয়ে বলল, কীরকম?
-কীরকম মানে? নিট ষোলো হাজার টাকা!
—তাই বুঝি? কে কিনল?
-জেফার্সন ব্রাদার্সের আউটগোয়িং ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস্টার আরবুথনট। বললেন, এরকম একটা ছবির জন্যই অপেক্ষা করছি এতদিন।
কমিশন কেটে টাকাগুলো গুনে অফিস যেতে যেতে ফের কীরকম উদাস হয়ে গেল অরুণ। কোত্থেকে যে কে ছবিটা ওদের বাড়িতে এনেছিল জানা নেই। এতকাল বেঘোরে পড়ে পড়ে ধুলো কুড়িয়েছে ছবিটা অন্যের ঘরে। অবশেষে অন্য আরেকজনের ঘরে চলে গেল অরুণকে এককাঁড়ি টাকা উপহার দিয়ে। ছেলেবেলার এই ছবি দেখতে দেখতে পড়ে যাওয়ার, ক-দিন আগে হাত কাটার সব ব্যথা, বেদনা এক নিমেষে উবে গেল ওর। আর কীরকম একটা মনখারাপ, মনখারাপ ভাব জাগল হঠাৎ। ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেন কিছুটা বাল্যকালও হারিয়ে গেল অরুণের। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা সিগারেট ধরাল।
অফিসের সাতকাজের মধ্যেও অবচেতনে যেন ছবিটা ঘোরাফেরা করছে মনে। অনেকগুলো টুকরো টুকরো প্রশ্ন ছড়িয়ে আছে মনের আনাচে-কানাচে। সেই সব প্রশ্ন আবার মিলেমিশে একটা মস্ত প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। শৈশব থেকে দেখে আসা ছবিটা বাস্তবিকই মোনালিসার রহস্যময় হাসি হাসছে ওর মনের আয়নায়। অরুণ একটা লেখা তৈরি করার জন্য বসেছিল, কিন্তু সাড়া পেল না। ও প্রধান সম্পাদকের ঘরে গিয়ে একটা অজুহাত দিল —শরীরটা ভালো নেই। লেখাটা কাল দিলে খুব দেরি হবে কি? সম্পাদকমশাই জানেন, এমন অজুহাতের লোক অরুণ নয়। উনি মুখে একটু ছদ্মচিন্তিত ভাব দেখিয়ে বললেন, না, না, শরীর খারাপ থাকলে আজ দেওয়ার দরকার নেই। তবে কাল পাওয়া যাবে তো? অরুণ বিগলিত স্বরে বলল, অবশ্যই! অবশ্যই!
অফিস থেকে বেরিয়ে অরুণ কিন্তু বাড়ি গেল না। ও রওনা হল ন্যাশনাল লাইব্রেরির দিকে। ভেতরটা আনচান করছে। তলব করে দেখতে হবে অ্যালফ্রেড নিউটন জন শিল্পীটি কে, কবেকার কোথাকার? ওঁর কোনো ছবির মূল্য কী দাঁড়াতে পারে এবং ‘দ্য আনএণ্ডিং পার্টি’ ওঁর কোনো বিশ্রুত ছবি কি না।
কম বই ঘাঁটতে হয়নি অরুণকে, অধিকাংশ শিল্পের বইতে একটিবারের জন্যও কোনো উল্লেখ নেই অ্যালফ্রেড নিউটন জন-এর। ঘণ্টা দুয়েক এভাবে ধস্তাধস্তির পর যখন হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখে অরুণ, ওর খেয়াল হল দ্য আনএণ্ডিং পার্টি’ ছবির নামে কোথাও কোনো এন্ট্রি পাওয়া যায় কি না, নগণ্য শিল্পীদেরও কোনো উল্লেখযোগ্য কাজের উল্লেখ থাকে ডিকশনারিতে। এইভাবে ইণ্ডেক্স দেখতে দেখতেই ও হঠাৎ পেয়ে গেল নামটা। তারপর ছবির বর্ণনা পড়তে গিয়ে বাক্যে বাক্যে হোঁচট খেতে লাগল। প্রথমেই পড়ল যে অমর ইংরেজ শিল্পী উইলিয়ম টার্নারের বন্ধু ছিলেন ‘দ্য আনএণ্ডিং পার্টি’ ছবির শিল্পী অ্যালফ্রেড নিউটন জন। একটা সময়ে নিউটন জনকে বর্ণনাও করা হত, উইলিয়ম টার্নার অব দ্য ড্রইং রুম’ বলে। অর্থাৎ টার্নার তাঁর নদী, সমুদ্র, পর্বত ইত্যাদি প্রকৃতির ছবিতে যে রঙের জাদু ঘটাতেন, নিউটন জন সেটাই করতেন বসার ঘর, হলঘর, পার্টি ইত্যাদির চিত্রায়ণে। ওঁর সেরা ছবি ‘দ্য আনএণ্ডিং পার্টি’-তে অবশ্য রঙের ও রেখার খেলার পাশাপাশি আরও একটা জাদু কাজ করেছে। কালো জাদু, ব্ল্যাক আর্ট, তুকতাক। তাঁর জীবনের এই শেষ ছবিতে তিনি এঁকেছেন তাঁর প্রেয়সীকে, যাঁকে তিনি জীবনে পাননি। ছবিতে তিনি নিজেকেও এঁকেছেন এক হিংস্র, ক্ষুধার্ত যুবক হিসেবে। ছবির রং তিনি তৈরি করেছিলেন মন্ত্রপূত জল ও রক্ত মিশিয়ে। মাত্র দু-টি প্রদীপের আলোয় রাতের অন্ধকারে তিনি এই ছবি আঁকতেন। দেড় বছর ধরে এই ছবিটা নিয়ে পড়েছিলেন তিনি, যে জন্য ছবিটা টার্নার ঠাট্টা করে বন্ধুর ছবির নামকরণ করেন ‘অশেষ ভোজসভা।
ছবিটা কিন্তু বিক্রি করেননি নিউটন জন। তিনি এটি দান করেছিলেন তাঁর প্রেয়সীকে। শোনা যায় এই ছবি বাড়িতে টাঙানোর কিছুদিন পর থেকে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে মহিলার এবং তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। তখন লণ্ডনের শিল্পমহলে জোর গুজব ছড়ায় আলফ্রেড নিউটন জন বাণমারা ছবি আঁকেন। তুকতাক, মারণবিদ্যা তাঁর ছবির উপকরণ। এই সব কথা ওঠার পিছনে কিছুটা অবদান ছিল স্বয়ং টার্নারেরও, কারণ তিনি নিউটন জনের মধ্যে এক ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী শনাক্ত করেছিলেন। আর তিনি রুষ্টও হয়েছিলেন নিউটন জনকে ‘ড্রইং রুমের টার্নার’ বলে বর্ণনা করায়।
জীবনে বীতশ্রদ্ধ নিউটন জন এরপর আত্মহত্যা করেন। মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে। তার আগে তাঁর সব কাজ পুড়িয়ে ফেলেন। ওরা পায় শুধু ‘দ্য আনএণ্ডিং পার্টি’, যেটি তাঁর প্রেয়সীর বাড়ি থেকে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়। কারও কারও ধারণা, সেই প্রেয়সীর খানসামা টোনি হ্যারিককে ছবিটা তিনি নষ্ট করতে দেন, কিন্তু হ্যারিক সেটি নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই পাড়ি দেন ভারতে। সেই থেকে ইংল্যাণ্ডের বিশ্রুত, বিতর্কিত ব্ল্যাক আর্ট ছবিটি নিখোঁজ।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে অরুণ ড্রাইভারকে বলল স্টেনরের নিলাম অফিসে নিয়ে যেতে। পৌঁছেই ম্যানেজারকে ধরল অরুণ : যে করেই হোক ছবিটা আমার চাই। ওর জন্য আমি তিরিশ হাজার টাকা দাম দেব। বাবার কালেকশন ওই ছবি নিলাম করে মস্ত ভুল করেছি।
ম্যানেজার ক্লান্তভাবে চোখ তুলে বলল, একটু দেরিই করলেন মনে হচ্ছে।
-মানে?
–আমার ফ্রেমার গিয়েছিল আরবুথনট সাহেবের বাড়িতে কাল বিকেলে। সাহেব নতুন ফ্রেম করবেন বলেছিলেন ছবিটার। কিন্তু…
উত্তেজনা চাপতে না পেরে অরুণ বলল, কিন্তু?
তিনি আর নেই। মিসেস আলবুথনটের বক্তব্য, রাতে ছবিটা স্টাডি করতে করতে সাহেবের হার্ট অ্যাটাক হয়।
—আর ছবিটা?
—মিসেস আরবুথনট ওটা ইংল্যাণ্ড নিয়ে যেতে চান। জানি না, আপনার ব্যাপারটা শুনলে আর ভালো দাম পেলে দিয়েও দিতে পারেন। চান? ফোন করব?
অরুণ কী একটা ভাবল কিছুক্ষণ, তারপর দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, না, থাক। মনে মনে ভাবল, দু-বার দুর্ঘটনা থেকে বেঁচেছে ও, তৃতীয়বার অত সৌভাগ্যবান নাও তো হতে পারে। ওঁর বরাদ্দ মৃত্যুটাই যে আরবুথনটের কপালে ঠেকল না, কে বলতে পারে? তার চেয়ে আপদ বিদেয় হওয়াই শ্রেয়। ইংল্যাণ্ডের ব্ল্যাক আর্ট ইংল্যাণ্ডেই ফিরুক, টিঙ্কুর ঘরে বরং দুফি-র নিরাপদ প্রিন্ট ঝুলুক!
ক্যারন্ত এ আঁ
‘ক্যারন্ত এ আঁ! ক্যারন্ত এ আঁ!’ অর্থাৎ ‘একচল্লিশ!’ একচল্লিশ আমার ঘরের নম্বর। একতলার রিসেপশানে আমার ফোন এলে এভাবে করিডর মাইকে ঘরের নম্বর ঘোষণা করে হাঁক পাড়েন আমাদের ছাত্রাবাসের কেয়ারটেকার মাদাম কার্মস। ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে অনেক সময় এই ডাক শোনাও যায় স্পষ্ট, কিংবা শুনেও মনে হয় ও ডাক আমার জন্য নয়। তখন আশপাশের কোনো ঘরের ছেলে বা মেয়ে এসে দরজায় টোকা দিয়ে ডাকে, ‘রাজীব!’ অন্য সবার বেলাতেও এই রীতি। বিশেষত আমার পাশের ঘরের গ্রিক মেয়ে মারিয়া পাপালুসের ক্ষেত্রে। যতক্ষণ ঘরে আছে হয় মন দিয়ে অঙ্ক কষছে নয়তো বিয়ার খেয়ে ঘুমাচ্ছে। মাদাম কামসের ডাক কখনো তার কানে পৌঁছোয় না।
আজ কিন্তু এই নিয়ে তিনবার ডাক এল আমার। এবার লিফটে নামতে নামতে আমার কেবলই মনে হচ্ছে এ ডাকটাও ভুল। ক্যারন্ত এ আঁ’ নম্বর চাইছে হয়তো কিন্তু সে আমাকে চাইছে না। আগের দু-বারই টেলিফোনের মহিলা কণ্ঠটিকে ‘রং নাম্বার’ বলে চলে এসেছি। কিন্তু তারপরেও এই ডাক। সত্যিই ও কাকে চায়?
ফের রিসিভার তুলে বললাম, হ্যালো! আর অমনি ও প্রান্ত থেকে সেই সুরেলা ফরাসিনী কণ্ঠ, ক্যারন্ত এ আঁ?’ ফের কিছুটা বিরক্তি দমন করে বললাম, হ্যাঁ। তবে আমার মনে হয় ওই ঘরের আগের বাসিন্দাকেই আপনি চাইছেন। কী নামের লোককে আপনি চাইছেন বলুন তো?
মেয়েটি এবার বেশ দুষ্টুমির স্বরেই বলল, ক্যারন্ত এ আঁ! হঠাৎ ভীষণ রাগ চড়ে গেল মাথায়, ভাবলাম দড়াম করে ফোনটা নামিয়ে দিই! মানুষের কাজের সময় ঘন ঘন ফোন করে নওছল্লা! পরমুহূর্তে ভাবলাম, আহা, থাক। ও কী চায় দেখি। এবার ‘আপনি’ সম্বোধনকে ‘তুমি’তে নামিয়ে এনে বললাম, একচল্লিশ বলছি, বলো কী করতে হবে?
সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে এক দমকা হাসি ওপারে। সহসা লজ্জা হল, মেয়েটা বুঝিবা আমাকে নিয়ে মশকরা ফাঁদছে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনটা আর নামাতে পারলাম না। বললাম, কী হে মাদমোয়াজেল, এত হাসি কীসের? ওপার থেকে আওয়াজ এল, ভয় কেটেছে তাহলে, মসিয়ূর? এবার আর আমি কোনো জবাব দিলাম না। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে বেশ ঠ্যাটা মেয়ে। হয়তো রসিকও।
একটু থেমে ও-ই বলল, বিকেলে কী করছ মসিয়ূর? বললাম, কিছু না। কাফেতে বসে সময় কাটাব।
—আমার পছন্দসই একটা কাফেতে আসবে?
–সেটা কোথায়?
—শালে লে-আলের কাছে। খুব খোলামেলা জায়গা। তোমার ভালো লাগবে।
–সেটার নাম কী?
–কাফে দ্রুজো।
–বুঝলাম। ও কাফে আমি চিনি। বাজে মেয়ের ভিড় হয় বড্ড।–
-তা হোক না। আমিও তো বাজে মেয়ে। মন্দ লাগবে না। এবার দু-জনেই আমরা টেলিফোনের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম, বাপরে! এ মেয়ের সঙ্গে কথায় পারা মুশকিল। তারপরেই মনে ফের প্রশ্ন উঠল, ওকে চিনব কী করে? তাই জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু অতশত মেয়ের মধ্যে তোমায় চিনব কী করে?
—সে দায়িত্ব তোমার। যাকে তোমার আমি বলে মনে হবে তার পাশেই গিয়ে বোসো।
-বসে কী নাম ধরে ডাকব?
মেয়েটি হঠাৎ করে নামটা উচ্চারণ করতে গিয়েও করল না। বলল, দেখি কী নামে তুমি ডাকো আমাকে। আর প্রায় তৎক্ষণাৎ ফোনটা নামিয়ে রাখল ওদিকে। আমি হতবুদ্ধির মতন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম ফোন হাতে। যে মেয়ের নাম জানি না, জীবনে কখনো দেখিনি, কী বয়স সে আন্দাজও নেই, তাকে একরাশ মেয়ের মধ্যে থেকে বারই বা করব কী করে? গলার স্বর যদিও বা শুনেছি তাও টেলিফোনে। আর যাকে-তাকে যা-তা নামে সম্বোধন করে কি মার খাব নাকি শেষে? ভাবলাম, দূর ছাই! যাবই না। আমার কী এত তাড়া? আলাপ করার এত রস থাকলে ও নিজেই ফোন করবে।
‘যাব না, যাব না’ এটা শুধু ভাবনাতেই থেকে গেল, যত দুপুর গড়াতে থাকল হৃদয়ের একটি তাড়না শুরু হল একটিবারের মতন মেয়েটিকে চাক্ষুষ করার। ক্রমে না যাওয়ার চিন্তা উবে গিয়ে প্রবল কৌতূহল আর আবেগ দাপাতে লাগল বুকের ভেতরটায়। একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম বটে, কিন্তু সমস্ত মন ছেয়ে রইল ওই না-দেখা মেয়েটার কথা ও কণ্ঠধ্বনি। আমি মাঝে মধ্যে ঘড়ি দেখতেও আরম্ভ করলাম।
ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমি সিতে উনিভার্সিত্যার মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেন ধরলাম শালে লে-আলের। আমার কামরায় ক’টি যুবতী ছিল, তাদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখছিলাম এদের মধ্যে সেই মেয়ে যদি থাকে। কাজটা যে কত অবান্তর, কিছুক্ষণ পর সেই জ্ঞান হতে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম নিজেই। এভাবে আদেখলের মতন মেয়েদের দিকে তাকালে মেয়েরাও মজা পায়। একটি মেয়ে তো ফিক করে হেসেই দিল, আর দিয়েই মুখ ঘুরিয়ে নিল জানলার দিকে। আমি বুঝলাম এটা আমার হাভাতেপনার জবাব।
লে-আলে এসে ভূমধ্যস্থ কনভেয়ার স্ট্রিপে চেপে শালের দিকে চলে গেলাম। পরে এস্ক্যালেটরে চড়ে যখন রাস্তায় উঠে এলাম, তখন ঘড়িতে বাজে ছ-টা আর আকাশের আলো মিলিয়ে যায়-যায়। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগলাম কাফে জোর দিকে।
এর আগে কাফে জোতে যে কখনো বসিনি তা নয়। লে-আলে বাজারের এক বিশেষ প্রান্তে পাথুরে রাস্তার এক কোণে সারাদিন ভিড়ে জমজমাট এই কাফেতে কয়েকবার টু মেরেছিলাম বাংলাদেশি বন্ধু রশিদের সঙ্গে। এখানে কোন মেয়ে যে বারবনিতা আর কোন মেয়ে যে তা নয়, সেটা খুব অভিজ্ঞ চোখ ছাড়া ঠাউরে ওঠা দায়। রশিদ তো বিশ্বাসই করতে চায় না যে, এসব মেয়ের কেউ কেউ দেহপসারিণী। সমানে বলছিল, আমারে কইলে তো আমি যেডারে খুশি বিয়া করতে পারি। তখন ওকে প্রায় নিরস্ত করার জন্যই বললাম, তা মিঞা, তোমায় বিয়ে করছেটা কে? তখন কিছুটা আহত বোধ করে রশিদ বলল, তা ব্যাশ্যারে বিয়া নাই বা করলাম। ক্ষতি কী?
দ্রুজোতে আজও বেশ ভিড়। সামনে রাস্তায় একজন যাদুকর শীতের মধ্যেও খালি গায়ে আগুন গেলার খেলা দেখাচ্ছে। অন্ধকার আকাশের পটে সেই লেলিহান শিখা একটা চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। জিপসি গোছের একটি দম্পতি ব্যাঞ্জো বাজিয়ে স্প্যানিশ গান গাইছে। টেবিলে টেবিলে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের জটলা, পানাহার। আমি দেখেশুনে একটা দূর প্রান্তের খালি টেবিল বেছে নিয়ে ওয়েটারকে অর্ডার করলাম, দু ভ্যাঁ ব্ল। অর্থাৎ সাদা ওয়াইন। এই সাদা ওয়াইন জিনিসটা আমার খুবই প্রিয়, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে একলা একলা সময় কাটাতে পারি কিছু সাদা ওয়াইন আর কড়া তামাকের সিগারেট নিয়ে। আমি ওয়াইন আসতে পকেট থেকে মার্লবরোর প্যাকেটটা বার করে একটা সিগারেট ধরালাম।
দু-চুমুক ওয়াইন পেটে পড়তেই নিজেকে খুব সুখী-সুখী লাগছিল। ভুলেই যাচ্ছিলাম আমি কেন এখানে এসেছি। হঠাৎ পাশের টেবিল থেকে একটা খিলখিলে হাসি। আমি চমকে উঠে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, গোলাপি গাউন-পরা এক সদ্য যুবতী তার পাশের ছেলেটির সঙ্গে হাত-মুখ নেড়ে ঢলে ঢলে কথা কইছে। একবার ভাবলাম গলাটা সেই ফোনের গলা নয়তো? তারপরেই ভাবলাম, ধুস। সে মেয়ে পুরুষের সঙ্গে বসে থাকবে কেন?
আমি আবার ঝিম মেরে বসলাম। এবার হঠাৎ চোখ পড়ল একটি নিঃসঙ্গ মেয়ের দিকে। কালো সোয়েটার পরে একমনে সিগারেট টানছে আর আগুনের খেলা দেখছে। আমার ঘোর সন্দেহ হল এই মেয়েই হয়তো সেই মেয়ে। আমি উঠে গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালাম, যেমন খদ্দেরের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়ায় ভালো ওয়েটার। মেয়েটা কিন্তু একমনে জাদুকরের কান্ড দেখে যাচ্ছে। জাদুকর ভুক ভুক করে আগুন খাচ্ছে আর হাঁ করে সেই আগুন ছুড়ে দিচ্ছে শূন্যে। আমি শুধু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবছি মেয়েটিকে কী নামে সম্বোধন করি। মেয়েটিও দেখি কিছুতেই মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে না আমার দিকে। আমি শেষে একটা দুটো ঢোক গিলে বললাম, ক্যারন্ত এ আঁ।
মেয়েটি এবার মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল বটে কিন্তু সেই চাহনির কোনোই মানে নেই। স্পষ্ট বুঝলাম আমার ছুড়ে দেওয়া কথাটার কোনো মানেই দাঁড়ায়নি তার কাছে। তখন তাড়াতাড়ি বললাম, পারদোঁ মাদমোয়াজেল, জে এম্পে। অর্থাৎ, সরি ম্যাডাম, ভুল করে ফেলেছি।
ফের এসে নিজের জায়গায় বসলাম আর একটু বিষণ্ণও বোধ করলাম। কোন এক পাগলির টেলিফোন শুনে কী ঝঞ্ঝাটেই না পড়েছি। ফের চুমুক দিলাম ওয়াইনে আর নতুন একটা সিগারেট ধরানোর উপক্রম করলাম। হঠাৎ আমার কানের পাশেই সেই আধাপরিচিত খিল খিল হাসি আর নীচু স্বরে ডাক, ক্যারন্ত এ আঁ?
আমি ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেলাম কালো সোয়েটার আর সাদা স্কার্ট-পরা সেই মেয়েটাকেই, যে একটু আগে আমার ডাক শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমি ভয়ানক অবাক বোধ করে প্রায় তোলাতে তোলাতে বললাম, তুতু–তুমি? মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ, আমি বুন্ধুরাম।
-তা তখন ওরকম হাবাগোবার ভাব করলে কেন?
–দেখছিলাম তোমার মনের কতটা জোর। ভড়কে যাও কি না।
—তা ভড়কে তো একটু গেছিলামই। যাক গে, তুমিও তো আমায় চিনতে পারোনি।
—কে বললে চিনতে পারিনি? চিনতে পেরেছি বলেই তো না-চেনার ভাব করছিলাম।
এবার আমি সত্যি সত্যি দমে গিয়ে বললাম, ও! মেয়েটি তখন ওর ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হাতটা ধরে অন্তত বসতে তো বলো। কতক্ষণ আর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?
খুব লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে পাশের চেয়ারে বসলাম। আর জিজ্ঞেস করলাম, কী পানীয় নেবে মাই ডিয়ার? মেয়েটি আমার সাদা ওয়াইনের গেলাসের দিকে তাকিয়ে বলল ওইটা। আমি ওয়েটারকে ডেকে আরও একটা সাদা ওয়াইনের অর্ডার দিলাম। তারপর টেবিলের ওপর আলতো করে রাখা ওর হাতটার উপর আমার হাতটা পেতে বললাম, এবার তোমার নাম জানতে পারি কি, প্রিয়তমা?
সঙ্গে সঙ্গে ফের সেই বিদ্রুপাত্মক খিলখিলে হাসি। এবার লজ্জা নয়, রাগই হল আমার। আমি ওর হাতটা সজোরে চেপে ধরে বললাম, তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো? এভাবে দু জনে দু-জনের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত থেকে গেলে কি কোনো বন্ধুত্ব হতে পারে? আর কেনই বা প্রয়োজন তেমন বন্ধুত্বর।
মেয়েটি আমার হাতের তলা থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মুখের ওপর চাপা দিয়ে বলল, শ-শ-শ। চুপ! এত রাগ করার কী আছে। নাম বলার কি সময় পার হয়ে গেছে? বরং তোমার নামটাই বলো আমাকে।
আমি রাগে গজরাতে গজরাতে বললাম, আমার নাম ‘ক্যারান্ত এ আ’। আর অমনি উচ্চতরালে হাসতে লাগল মেয়েটি। রাগ আমারও একটু একটু চড়ছিল আর হঠাৎ তা এমনই বিশ্রী পর্যায়ে উঠে গেল যে ওয়েটার যখন ওয়াইন নিয়ে টেবিলে এল, আমি একটা দশ ফ্রাঁ-র নোট তার প্লেটে ছুড়ে দিয়ে খুব রূঢ় একটা মের্সি’ অর্থাৎ ধন্যবাদ মেয়েটিকে উপহার দিয়ে প্রচন্ড জোরে পা চালিয়ে কাফের থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর সেই অদ্ভুত গতিতে হাঁটতে থাকলাম নদীর দিকে। মাথাটা আমার অসম্ভব গরম হয়ে উঠেছে, নদীর পাশে না গেলে তা আর ঠাণ্ডা হওয়ার উপায় নেই। নাম-না-জানা এই উটকো মেয়েটিকে আমার এখন একটি বেশ্যা বলেই মনে হচ্ছে।
আমি জোরে হাঁটলে সেটা সত্যিই খুব জোরে হাঁটা হয়। বড় অল্প সময়েই তখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাই। এক্ষেত্রেও হাঁটার স্পিড এত অস্বাভাবিক বেশি হয়ে গিয়েছিল যে নিজে ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই দেখি স্যেন নদীর উপর প ন্যফ বা নতুন ব্রিজের গোড়ায় চলে এসেছি। আমার সম্বিৎ ফিরে এল নদীর ওপারে আলোর মালা, নদীর কালো জলে প্রতিফলিত আলোর সারি, একটুকরো চাঁদ আর নদীর দূর কোণ থেকে ভেসে আসা স্টিমারের যান্ত্রিক ধ্বনিতে। নদীর পাশে বা নদীর ওপর সেতুতে দাঁড়িয়ে আমি কখনো রাগী থাকতে পারি না। নদীর জল আমার রাগ গলিয়ে জল করে দেয়। হঠাৎ নিজের শরীরটা বেশ হালকা বোধ হল, আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সেতুর রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তক্ষুনি আমার কানের পাশে বেজে উঠল ফের সেই ধ্বনি, তুমি রাগ করেছ সোনা?
আমি মাথা না ঘুরিয়েও টের পাচ্ছিলাম এ গলা কার। আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না রাগব না কাঁদব। নাকি সপাটে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দেব মেয়েটির গালে। কিন্তু না, আমি কিছুই করলাম না, কারণ আমার শরীর ভয়ে কাঠ হয়ে আসছে। এত দ্রুত যে মেয়ে আমার পিছু নিতে পারে এই সন্ধের অন্ধকারে, তার মাথায় কিছু জটিল মতলব আছে। সে সহসা নিস্তার দেবে না আমাকে। আমি রেলিং ছেড়ে শরীরটাকে সোজা করবার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু তার আগেই মেয়েটি আমার মুখটা ওর বুকের মধ্যে ঠেসে ধরে আমার মাথায় চুমুর আদর দিতে লেগেছে। ওর হাতের ও মুখের স্পর্শ ওর কালো সোয়েটারের চেয়েও উষ্ণ। তার চেয়েও উষ্ণ আমার মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়া ওর নিঃশ্বাস। আমার মনে হল, ওই ভালোবাসায়-ভরাডুবি বুকে মাথা রেখে আমার মৃত্যু হলেই ভালো হয়। এই আলিঙ্গন থেকে কোনোদিন যেন আমার মুক্তি না হয়। আনন্দে, সোহাগে সম্পৃক্ত আমি এই অযাচিত, অকল্পনীয় ভালোবাসায় ভেতরে ভেতরে এতটাই দ্রব হয়ে উঠলাম যে, আমার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ল। আমি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কেবলই বলতে থাকলাম, আমি আর তোমার নাম জানতে চাই না, প্রিয়তমা। কোনোদিনও জানতে চাইব না। তুমি শুধু আমায় ছেড়ে যেয়ো না কোনদিন।
এবার মেয়েটি আমার মুখটা তুলে ধরল ওর মুখের দিকে আর গভীরভাবে তাকাল আমার চোখের দিকে। আমার চোখের জল গিয়ে লেগেছিল আমার চশমায়, কিন্তু সেই ভিজে কাচের মধ্যে দিয়েও আমি দেখতে পেলাম, মেয়েটি কাঁদছে। দু-টি অশ্রুর ফোঁটা টলটল করছে ওর চোখের কোণে আর এক অব্যক্ত বেদনায় কুঁকড়ে উঠছে ওর পরম সুন্দর মুখটি। আমার নামও জানে না ও, তাই অস্ফুট স্বরে শুধু আমায় ডাকছে, ‘ক্যারন্ত এ আঁ! জ্য তেম। ক্যারন্ত এ আঁ! জ্য তেম।’ ‘একচল্লিশ! আমি তোমায় ভালবাসি।’ আমার কিন্তু মুখ দিয়ে আর কোনো কথা সরছে না, যা বলতে চাই সবই যেন নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে, সবই কীরকম বরফ হয়ে গলার মধ্যে খকখক করছে। আমি ফের মুখ ঘসতে লাগলাম ওর মুখে, আমার ডান হাত দিয়ে অনুভব করতে লাগলাম ওর স্তন, তারপর ক্লান্ত শিশুর মতো ঢলে পড়লাম ওর কোলে।
একটু বাদে যেন গলার জমা বরফ আরও জমে উঠে পাথর হতে লাগল। বাকরুদ্ধ নই শুধু, আমি ক্রমশ যেন শ্বাসরুদ্ধও হচ্ছি। আমি মাথা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে উঠতে গিয়ে অনুভব করলাম দুটো শক্ত হাত আমার গলায় বসে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আমি আতঙ্কে চোখ মেলে দেখতে পেলাম সে হাত কার, কিন্তু চোখের সামনে সেই সুন্দর বেদনাকম্পিত মুখটাই দেখলাম। শুধু একটা সামান্য হাসির ঝিলিক যেন ওই দুঃখী মুখে। আমি হাত দিয়ে গলার হাত দুটিকে জোর করে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই সুন্দরীর হাসি আরও পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠল ঠোঁটে। চোখের জলটাও যেন কখন উবে গিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে একটা কঠিন, নির্মম আক্রোশ। আমি আরও জোরে চাপ দিলাম গলার হাত দুটোয়, কারণ আমার সমস্ত দমই প্রায় শেষ হতে চলেছে। আমার হাতের চাপে মেয়েটির হাত সরে গেল ঠিকই, কিন্তু সেই মুখে ওর চোখের কোটর থেকে মণি দুটোও কীভাবেই জানি অন্তর্হিত হল। একটি অনুপম সুন্দর মুখে কোনো চোখ নেই! —এই সুরিয়ালিস্ট দৃশ্য যে জীবনে কখনো দেখতে পাব এ আমার সমস্ত কল্পনার অতীত! আমি আমার ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মনটাকে নিঙড়ে কোনো মতে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, কে? কে তুমি? বলো তুমি কে? এই কথার সঙ্গে সঙ্গে আমার অবসন্ন হাত দুটোও এগিয়ে গেল রূপসীর গলার দিকে। আমি সজোরে চেপে ধরলাম ওর সরু, নরম সুন্দর গ্রীবা। আমার আকাঙ্ক্ষা হল ওর গলা সেভাবেই কিছুক্ষণ টিপে ধরি যেভাবে এতক্ষণ ও টিপে রেখে ছিল আমার কণ্ঠ। কিন্তু ওই পর্যন্ত! ওর গলা স্পর্শ করামাত্রই ওর সুন্দর দাঁতের পাটি হাসিতে জ্বলে উঠল। তারপর সেই হাসি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল গোটা মুখে, যেন কঙ্কালের হাস্য। সেই খিলখিলে আওয়াজটা ফিরে এল কণ্ঠে, এবং আমি যত চাপ দিতে থাকলাম ততই উচ্চতরালে হতে থাকল ওই হাসি। কতক্ষণ এভাবে চেপে ধরেছিলাম ওর গলা আমার স্মরণ নেই। শুধু এটুকুই অনুভব করেছিলাম যে মেয়েটি ক্রমশ রেলিং ভেদ করে পিছিয়ে যাচ্ছে জলের দিকে এবং সেই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। রেলিং থাকতেও ওর শরীর ওপারে নদীর মধ্যে ঢলে গেল এক সময়, রেলিঙে বাঁধা পড়ল আমার শরীর। আমার দুটো হাটু মাথা রেলিঙের ওপর, আরেকটু এগোলেই গোটা শরীরটা তলিয়ে যেতে পারত। কিন্তু গেল না।
আমি হোস্টেলে ফিরে এসে লিফটের দিকে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মাদাম কার্মস আমায় জিজ্ঞেস করলেন, খুব রূঢ় কণ্ঠে, আবার নিশ্চয়ই খুব নেশা করে ফিরছ, রাজীব? এভাবে কি পড়াশুনো হবে তোমার?
মাদাম কার্মস আমার অভিভাবিকা নন যে এমন সুরে কথা কইতে পারেন। কিন্তু তাহলেও আমি কোনো প্রতিবাদ করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, কেন আমাকে কি খুব রুখুসুখু লাগছে? মাদাম ফের ঝাঁঝের মাথায় বললেন, সেটা বললে কমই বলা হয়। তোমার দেখে মনে হচ্ছে বার্বেসের কোনো বেশ্যার বিছানা থেকে উঠে আসছ।
মাদামের এই কথাটা শেলের মতন বিধল বুকে। আমি লিফটে না উঠে একতলার টয়লেটে ঢুকে পড়লাম আর বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। আমারসারা মুখে ও জামার কলারে লিপস্টিকের ছোপ। গলায় দু-তিনটে কালশিরের দাগ। চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে। ঠোঁটের এক পাশে খানিকটা ছড়ে গিয়েছে। চুল উশকোখুশকো আর বুকের কাছে দুটো বোম ছেড়া। কীভাবে, কী কাজে এমনটা হয় সে প্রশ্ন তোলারও অবকাশ নেই। নিজেকে দেখে নিজেরই করুণা হচ্ছে।
হঠাৎ দরজায় ধাক্কা আর মাদাম কাসের হাঁক, রাজীব! রাজীব! টেলিফোন!
আমার রক্ত ফের জমে বরফ হচ্ছে। আমি জানি এ ফোন কার। আমি জানি এবার ও আমায় কোথায় যেতে বলবে। এবার গেলে যে আমি ফের আসতে পারব তারও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তাও যেন যাওয়ার জন্য বাসনা জাগছে ভেতরে। শরীর ফের উষ্ণ হচ্ছে, মাথায় একটা ঘোর সৃষ্টি হচ্ছে। আমি চোখে মুখে সামান্য জল ছিটোতে ছিটোতে চেঁচিয়ে বললাম, যাচ্ছি, মাদাম কামঁস!
যখন দরজা ঠেলে বেরুলাম, দেখি দরজার পাশেই মাদাম গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে। আমি এগোতে যাব, হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, রাজীব, ফোনের ওই মেয়েটির গলা আমি চিনি। মনে হয় বেশ্যা। ওর পাল্লায় পড়ে তোমার ঘরেরই আগের বাসিন্দা পিটার মাথা খারাপ হয়ে হাসপাতালে। ও-ও একদিন ফিরে এসেছিল এই তোমার মতন চেহারা করে। তখন বুঝিনি ও কোন পথে গেছে। তারপর একদিন নতুন ব্রিজের মাঝখানে ওকে আধমরা অবস্থায় পাওয়া গেল। সেই থেকে হাসপাতালে।
মাদামের কথাগুলো ভীষণ খাঁটি বলে মনে হল, কিন্তু আমার ভেতর থেকে প্রবল প্রতিরোধ ওই উপদেশ মেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে। আমি আস্তে আস্তে কাউন্টারে এসে ফোনটা তুলে নিলাম আর খুব আদরের স্বরে বললাম, হ্যালো!
আর ওপারে সেই প্রিয়, পরিচিত খিলখিল হাসি আর প্রশ্ন, ক্যারান্ত এ আঁ? আমার মনে হল, এই কণ্ঠস্বরটির জন্য আমি মরতেও প্রস্তুত আছি।
গান্ধীর আততায়ী
বেয়াল্লিশ বছর বয়সি উদয় চৌধুরী আজকের খেলাটা আগে মাত্র একবারই খেলেছে। সেই খেলার দিনটা আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। ৩০শে জানুয়ারির ওই ভোরবেলায় পুরোনো ট্রাঙ্কের কী না কী ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ ক্রিস হারডিকের ছবিটা বেরিয়ে পড়েছিল। সেইসঙ্গে ক্রিসের উপহার এক প্যাকেট তাস আর একটা রিভলবার। রিভলবারটায় টোটা ভরা ছিল না। পাশের এক কৌটোয় গুলিগুলো ছিল। টোটাগুলো খুঁজতে গিয়েই উদয়ের ভারি লোভ হল ক্রিসের শেখানো খেলাটা খেলে দেখে। ক্রিসের বক্তব্য ছিল যে, হয় ভয়ংকর দুঃখ অথবা ভয়ানক আনন্দের দিনগুলোতে মানুষের উচিত নিজের সঙ্গে একবার লড়ে নেওয়া। যে ভাগ্যের জটিল পথে দুঃখ কিংবা আনন্দ আসে সেই ভাগ্যকেই সাক্ষী মেনে নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড়াতে হয়। একটা টোটা ভরে নিতে হয় রিভলবারে। তারপর তাসের প্যাকেট চোখ বুজে শাফল করে তিনটে তাস বার করে নিতে হয়। বলতে হয় এই রংটা উঠলে আমার মৃত্যু হবে। আর সত্যি সত্যি যদি সেই রং উঠে আসে হাতে তুমি জানবে গুলিটা তোমার নিজের খুলির জন্যই ভরা হয়েছিল। নিয়তি তোমাকে চায়।
যেদিন ক্রিস এই খেলাটা শেখায় উদয়কে ঠিক সেদিনই ওদের মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টে একটা চিঠি এসেছিল। তাদের প্রথম পরিচয়ের সাত বছর পর লিজা ক্রিসকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। বড়ো ঘরের মেয়ে, পাবলিক স্কুলে পড়া মেয়ে লিজার সঙ্গে ক্রিসের আলাপ নেহাতই আকস্মিকভাবে। একটা ফুটবল গ্রাউণ্ডে। সদ্য স্কুল-পাস করা ক্রিস বিয়ের জন্য উন্মাদ হয়ে উঠল। ভুলে গেল তার জন্ম লিভারপুলের এক শ্রমিকের ঘরে। আর লিজা কিছুটা লতায়-পাতায় এক পড়ন্ত ব্যারন ফ্যামিলির কন্যা। লিজা নিজেই এই ব্যবধানটাকে খুবই বড়ো বলে জানত। ওর অভিভাবকরা তো নিশ্চয়ই। প্রেমের বিষম দংশনে উন্মত্তপ্রায় ক্রিস প্রথম খেলেছিল এই টোটা-তাসের খেলা। তাও তিন তিন বার। কিন্তু একবারও ওর মৃত্যুর রংটা উঠল না। ভীষণ মনমরা হয়ে ক্রিস যুদ্ধে চলে গেল।
তারপর সাত বছর ধরে এখানে-ওখানে বাহিনীর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে ক্রিস। যেখানেই গেছে সুবিধেমত চিঠি দিয়েছে লিজাকে। কিন্তু কখনো বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি। ইচ্ছে হলে কখনো কখনো ওর গভীর ভালোবাসা নিবেদন করেছে। অতএব সেদিন যখন ক্যান্টনমেন্টে লিজার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে রঙিন খামটা এল, ভয়ংকর উত্তেজনা এবং আনন্দের জোরে ক্রিস ঠিক করল যে, ওর পুরোনো খেলাটা ফের খেলবে। এতখানি অবাক উদয় তার আগে কখনও হয়নি। ছেলেটা কি পাগল? এরকম সুসংবাদ পেয়ে কেউ কি নিজের ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলে? দৈবাৎ যদি মৃত্যুর রং ওঠে!
সেদিন সন্ধ্যায় ক্রিসের কপালে মৃত্যুর হরতন উঠল। ক্রিস ওর মৃত্যুর রং দিয়েছিল হরতন। কারণ হরতনে মৃত্যু এবং ভালোবাসা একই সঙ্গে থাকে। খেলার শেষে রিভলবারে টোটা ভরতে ভরতে এক গেলাস রাম খেল ক্রিস। তারপর তাসের প্যাকেটটা উদয়কে দিয়ে বলল, আমার এই উপহারটা রইল। কোনো না কোনোদিন হয়তো তোমারও কাজে লাগবে। তবে যেদিনই খেল, খেলার সম্মানটুকু রেখো। জানি, নিজেকে খুন করা খুব কঠিন। সেক্ষেত্রে নিজের প্রিয়তম কোনো কিছুর ওপর বাজি ধরতে পার।
ক্রিসের কথাটায় উদয় চমকে উঠল। নিজের প্রিয়জনের জীবনের ওপর কেউ কি বাজি ধরে? আর সেখানেও যদি ভয়ংকর রংটাই উঠে আসে? সে তো আত্মহত্যার চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই উদয় কোনো একসময় ক্রিসের হাত থেকে তাসের প্যাকেটটা তুলে নিল। তারপর ছয় ঘোড়ার কোল্টটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওটা?
আমার লাশের পাশে ওটা পড়ে থাকবে। তুমি ক্যাপ্টেনকে বলে নিয়ে নিয়ো। আমি তোমাকেই দিলাম ওটা। আমার পোস্টমর্টেম রিপোর্টের সঙ্গে আমার একটা চিঠি তুমি লিজাকে পাঠিয়ে দিয়ে। সম্ভবত রিপোর্টে বলবে টেম্পোরারি ইনস্যানিটি। তুমি কিন্তু আসল কথাটা লিখবে ওকে। যে কথা আমিও চিঠিতে লিখেছি।
সেদিন মাঝরাত্তিরে টেন্টে টেন্টে অ্যালার্ম বেজে উঠল। যা হোক কিছু একটা গায় চাপা দিয়ে সবাই বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ চাপা দেওয়া আছে। ক্যাপ্টেন রাগে থরথর করে কাঁপছেন। সিভিয়ার ইনডিসিপ্লিনের অভিযোগে পারতপক্ষে সবাইকেই দায়ী করলেন ক্যাপ্টেন এগার্ট। এতগুলো লোকের কেউ কি জানত না ক্রিস মানসিক রোগে ভুগছিল? তাহলে তাঁকে সে-কথা জানানো হয়নি কেন? কেন একটা মানসিক রোগীকে দিনের পর দিন প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে? কেউ কি তার মনের খবর রাখার চেষ্টা করেনি?
যন্ত্রচালিতের মতন একসময় উদয় এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি জানতাম।
পোস্টমর্টেমের সিদ্ধান্ত হল ক্রিস আত্মহত্যাই করেছে। তার অস্থায়ী উন্মাদনার সময় তার বন্ধুরা তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তাকে বোঝায়নি। ক্যাম্প রিপোর্ট জানাল একটা তাস এবং রিভলবারের লোভে উদয় চৌধুরী তার প্রিয় বন্ধুর আত্মহত্যা নির্দ্বিধায় বরদাস্ত করেছে।
যুদ্ধ শেষ হতেই উদয় স্বেচ্ছায় অবসর চাইল। ডাক্তারের সার্টিফিকেটে দেখাল মেন্টাল ইনস্ট্যাবিলিটির। জমা টাকা তুলতে গিয়ে উদয় ক্রিসের বাজেয়াপ্ত রিভলবারটার খোঁজ করল। ওটা ক্রিসের নিজস্ব অস্ত্র ছিল। বেআইনিভাবে রাখা। নিজের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র একে একে সারেণ্ডার করার পর উদয় যখন রিভলবারটার জন্য অ্যাপ্লিকেশন লিখল তখন ক্যাপ্টেন এগার্ট বললেন, তোমার ডক্টরস সার্টিফিকেটের ব্যাকগ্রাউণ্ডে, আমি তোমায় আর আইনত এই অস্ত্র দিতে পারি না। তবে বন্ধুর একটা উপহারের থেকেও আমি তোমায় বঞ্চিত করব না। আমি জিনিসটা হারিয়ে গেছে বলে রেকর্ড বুকে দেখাব। আর আমার অনুরোধ তুমিও এই যন্ত্র আর কোনোদিন কাজে লাগাবে না, একটা স্মৃতি হিসেবেইই রেখো। বাট বি কেয়ারফুল।
তার চার বছরের মধ্যে একবারও উদয় ওর ট্রাঙ্ক খুলে জিনিসটা দেখেনি। ১৯৪৮ এর ৩০ জানুয়ারির সকালটায় নেহাতই দুর্ঘটনার মতন তাস এবং রিভলবারটা বেরিয়ে পড়ল। উদয়ের যেসব কোল্ট টোটা ছিল সেগুলোও যে কেন ও ক্যাপ্টেনের কাছে সারেণ্ডার করেনি সেটা ভেবেও অবাক হয়ে গেল। নিজের রিভলবারটা দিয়েও কেন সেদিন গুলিগুলো দেয়নি? চকিতে ওর মনে পড়ল ক্রিসের কথা। ভাগ্য খুব রহস্যময়। তার আনন্দ এবং দুঃখ দেবার পথও রহস্যে ঢাকা। না হলে এতদিন পরই বা ওর গুলির কথা মনে আসবে কেন? এতকাল তো ও জানত ওর কেবল রিভলবারটাই আছে।
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে উদয়ের মনে হল যে, মারণাস্ত্রেরও একটা নিজস্ব প্রাণ আছে। একটা চরিত্র আছে। যে প্রাণ, যে চরিত্র সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেই একেক সময় মানুষের ভাগ্য স্থির করে। সেই পর্যায়ে কোনো অস্ত্র এসে পৌঁছেলে একটা মানুষ তখন নিতান্তই যন্ত্র। সে তখন যন্ত্রের মতোই একটা মারাত্মক প্রাণীকে ব্যবহার করে।
একবার অন্তত ক্রিসের খেলাটা খেলার ইচ্ছে হল উদয়ের। নিজেকে বাজি রেখে নয়। অথচ ওর প্রিয়জন বলতে বিশ্বসংসারে কে-ই বা আছে? অন্তত সেরকম কেউ নেই। এক স্কুলের বন্ধু ছিল। কিন্তু সেও তো বহু দিন ধরে সুখী গৃহস্থ। তাকে মেরে একটা সংসার নষ্ট করার ইচ্ছা ওর হওয়া কঠিন। তা ছাড়া একটা ঘৃণ্য খুনি হওয়ার চেয়ে আত্মহনন শ্রেয়। অথবা…অথবা, তার চেয়েও শ্ৰেয় কাজ কাউকে ভালোবেসেই হত্যা করা। যে হত্যা সম্ভবত নিহত মানুষটিকে অনেক বড়ো গৌরব এনে দেবে। সম্ভবত তাঁকে শহিদের বেদিতে বসাবে।
যে মৃত্যুর ফলে তিনি বৃহত্তর এক শক্তি হিসেবে সমাজে কাজ করবেন। উদয়ের মনে পড়ল গান্ধীজিকে। সেদিনের কাগজেই গান্ধীজির ছবিটা হাসি হাসি মুখ করে জ্বলছে। হাজারো সমস্যা, অশান্তি এবং অঘটনের মাঝখানেও সে হাসিটুকু অম্লান আছে। তাস বার করে গান্ধীজির নামেই বাজি ধরল। রং নিল রুহিতন। কারণ ওর ধারণা রুহিতন চাইলেই আসে না। এভাবেও অন্তত গান্ধীর হত্যা এড়ানো যেতে পারে।
বার বার শাফল করে তিন-তিনটে তাস চোখ বুজে টানল উদয় চৌধুরী। এবং চোখ মেলে দেখল তিনটে তাসই রুহিতন।
একটা তীব্র বিদ্যুৎ খেলে গেল উদয়ের গোটা শরীরে। কিন্তু সে নিরুপায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল সকাল সাতটা। চটপট করে সে দাড়ি কামাল, তারপর বহুক্ষণ ধরে তার জীবনের সেরা লাক্সারি সেই স্নানটুকু শেষ করল। ততক্ষণে ওর মনে হতে শুরু করেছে এই বুঝি তার শেষ স্নান। বিড়লা হাউসে সে যদি ধরা পড়ে তবে তার ফাঁসি নির্ঘাৎ। কাল হয়তো খবরের কাগজে গান্ধীজির সঙ্গে ওর নিজের ছবিই বেরুবে। কোটি কোটি লোককে কাঁদিয়ে সে একজনকে অমর করবে আজ বিকেলে। ভাগ্যবিধাতাই সেটা নির্ধারণ করে রেখেছেন, নতুবা পর পর তিন টানেই রুহিতন উঠল কোন নিয়মে? একসময় সহসা উদয়ের মনে হল হয়তো স্বয়ং ঈশ্বরই চান এইভাবে গান্ধীকে মানুষের মাঝখানে ব্যাপ্ত করে দিতে। এবং সেই কাজের জন্যই তিনি নির্বাচন করেছেন উদয় চৌধুরীকে।
উদয় যেটুকু রাজনীতি বোঝে তাতে ওর গান্ধীজির ওপর অগাধ শ্রদ্ধা। বাঙালি হিসেবে যেটুকু রাগ ওর হয়েছিল তার সবটাই ধুয়ে মুছে গেছে গান্ধীজির নোয়াখালি অভিযানের পর। অথচ এতখানি শ্রদ্ধা নিয়ে কি কাউকে আঘাত করা যায়? পুরো ব্যাপারটা ক্রমশ ওর কাছে একটা মার্সি কিলিং-এর মতন ঠেকল। এবং সেই করুণার সূত্রে অমোঘ এবং করণীয়।
দুপুরের খাওয়ার আগে উদয় গান্ধীজির ফটোতে মালা-চন্দন পরাল। নিজের বেসুরো গলায় একটা ভজন গাইল। তারপর খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বইয়ের তাক থেকে হাউ টু কমিট আ পারফেক্ট মার্ডার থ্রিলারটা নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা তিনটে। পলসনের কৌটো ভেঙে কফি বানাতে বানাতে উদয়ের মনে পড়ল ওর ছোটোবেলার প্রেমিকা পৃথাকে। খানিকক্ষণ ওর কথা ভাবতেই উদয়ের একটা ঘোর সৃষ্টি হল মনে। পৃথা এবং ওর স্বামী কালকের কাগজ পড়ে কী ভাববে? সারাজীবন ধরে উদয়ের যে একটা সাড়া জাগানো কান্ড করার ইচ্ছে ছিল এই বুঝি সেই সাড়া জাগানো মহাকাজ!
রিভলবারে তিনটে টোটা ভরল উদয়। পকেটে দুটো সিগারেট নিল রাস্তায় ফুকতে ফুকতে যাবে। দিল্লিতে শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ট্যাক্সি ডেকে যখন উদয় বিড়লা হাউস নামটা উচ্চারণ করল তখন ওর চোখের সামনে ভাসছে ক্রিসের মৃতদেহের ছবিটা। ভীষণ ইচ্ছে হল ওর ট্যাক্সি ছেড়ে উলটোদিকে দৌড় লাগায়। একসময় দরজার হাতলেও হাত রাখল। অমনি ড্রাইভার গর্জে উঠল, দরওয়াজা মৎ খিচিয়ে সাব! উদয় চোরের মতন হাত গুটিয়ে নিল।
বিড়লা হাউসের অনেক দূরেই গাড়ি থামল। তখন বেলা চারটে পঞ্চাশ। উদয়ের ধারণা ছিল গেটে পাহারাদাররা তার সমস্ত শরীর সার্চ করবে। তাই রিভলভারটা সে ধুতির কোঁচায় এঁটেছিল। এমনিতে উদয় প্যান্ট-শার্টই পরে। কিন্তু প্যান্ট-শার্টে বন্দুক লুকোনো মুশকিল। এ ছাড়া কিছুদিন ধরেই গান্ধীজিকে হত্যা করার একটা চক্রান্ত চলছে কোনো এক বিশেষ মহলে। তাই পাহারাদারিও খুব কড়া পর্যায়ের হচ্ছিল। অথচ সেদিন বিকেলে উদয়কে কেউই কিন্তু কোনোরকম জিজ্ঞাসাবাদ বা সার্চ-টার্চ কিছুই করল না। ভিড়ের সঙ্গে উদয় বিড়লা হাউসের বাগানে গিয়ে হাজির হল। সেখানে মহাত্মাজির জন্য একটা ডায়াসও বানানো হয়েছে। উদয় যতখানি পারল তার কাছে যাবার চেষ্টা করল। কারণ বহুকাল সে আর রিভলবার ব্যবহার করেনি। টিপটা আর আগের মতন নেই বলেই ওর ধারণা।
বিকেল পাঁচটায় গান্ধীজির প্রার্থনাসভায় আসার কথা অথচ পাঁচটা দশ বেজে যেতেও তাঁর দর্শন পাওয়া গেল না। উদয়ের ভয় হল, গান্ধীজি বুঝি অসুস্থ। না হলে ওঁর মতন সময়ানুবর্তী মানুষের তো এরকম দেরি হওয়ার কথা নয়। ওর একটু সন্দেহও হল, এই বুঝি পুলিশ এসে প্রত্যেককে আপাদমস্তক সার্চ করতে শুরু করে। উদয়ের ইচ্ছে ছিল গান্ধীজি প্রার্থনাসভা শুরু করলে সবাই যখন চোখ বুজে মন্ত্র আওড়াবে ঠিক সে-সময় এক মওকায় গুলিটা ছুড়বে। ভয়ের ভাবটা ঝেড়ে ফেলতে উদয় ইতি-উতি চাইতে থাকল। এবং ওর নজরে পড়ল পৃথার বৃদ্ধ বাবা অবসরপ্রাপ্ত জজ ব্রজেন্দ্রনাথ সান্যালকে। যাঁর পাশে তখন তৃতীয় স্ত্রী আবেদা খাতুন। বসে ঝিমুচ্ছেন। দপ করে জ্বলে উঠল উদয়ের মাথাটা। প্রচন্ড ইচ্ছে হল ওর জীবনের সমস্ত বিপন্নতা এবং দুঃখের মূল ওই ব্ৰজেন সান্যালের মাথার খুলিটা উড়িয়ে দেয়। পৃথার পাণিপ্রার্থী হয়ে যে চরম অপমান পেয়েছিল উদয় ব্রজেন সান্যালের কাছে তা এখনও ওকে থেকে থেকে সাপের ছোবলের মতন দংশন করে। রাগের চেয়েও অনেক বেশি ঘৃণা লুকিয়ে আছে উদয়ের মনে ওই বিশেষ অধ্যায়টির ব্যাপারে।
নিজের গায়ে অসম্ভব জোরে একটা চিমটি কেটে রাগ সংবরণ করল উদয়। আজ হেলাফেলার দিন না। আজ ওর একটা মিশন আছে। নরকের কীটপতঙ্গকে গুলি করে সে কাজ ভেস্তে দেওয়া যায় না। ঘড়িতে যখন পাঁচটা তেরো তখন কিছুটা আশ্বস্ত হল উদয়। ইতিমধ্যে একটা শোরগোল শুনতে পেল সে। বিড়লা হাউসের বুগেনভিলিয়ার আচ্ছাদনের সড়ক দিয়ে না এসে সটান লনের ওপর দিয়েই গান্ধীজি আসতে শুরু করেছেন। তাঁর দুই হাত আভা এবং মানুর কাঁধে ছড়ানো। মানুর হাতে একটা পিকদানি, মহাত্মাজির চশমা এবং সেদিনের তৈরি তাঁর বক্তৃতার কাগজপত্র। দুই মহিলার কাঁধে ভর করে গান্ধীজি যতখানি সম্ভব এস্ত পায়ে আসছেন। দেরি করিয়ে দিয়েছে বলে ক্রমাগত বকছেন তাঁদের। জীবনে গান্ধীজি এই দেরি করাটাই সবচেয়ে ঘৃণা করেছেন। বলছেন, তোমরাই না আমার ঘড়ি। তোমরাই তো আমায় মনে করিয়ে দেবে সময় কত। জানো না, আমি প্রার্থনায় দেরি করা সহ্য করতে পারি না?
গান্ধীজি তখনও বকে চলেছেন যখন তিনি প্রার্থনাসভায় ঢোকার চার ধাপ সিঁড়ির গোড়ায়। গান্ধীজির মাথায় তখন ডুবন্ত সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি মেয়েদের কাঁধ থেকে হাত তুলে জনতাকে নমস্কার জানালেন। তারপর যখন সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়ালেন তখন…তখন উদয়ের মনে হল সে একটা স্বপ্ন দেখছে। না, এ হতে পারে না। উদয় তার রিভলবারের জায়গাটায় হাত দিয়ে দেখল সেটা যথাস্থানেই আছে। কোনো অনিয়ম হয়নি সেখানে। অথচ স্পষ্ট শুনল তিন তিনটে গুলির আওয়াজ। তিনটে আওয়াজই ওর নাড়ি ভেদ করে শরীরের অভ্যন্তরে চলে গেছে। মনে হল ওই গুলিগুলো কেউ ওকেই তাক করে মেরেছে। উদয় উদভ্রান্তের মতো গান্ধীজির দিকে ছুটে গেল। তখন ‘হে রাম’ বলে বুকে রক্তমাখা গান্ধীজি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। মানু তাঁর পিকদানি আর বক্তৃতার কাগজগুলো অন্ধের মতো মাটিতে হাতড়াচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য উদয় একটা খাকি জামা পরা রোগাটে লোককে দেখতে পেল। উদয়ের নজরে পড়ল লোকটার হাতের ‘বোর’ পিস্তলটাও। তারপর সবটাই অন্ধকার দেখল উদয় চৌধুরী।
সেদিন কার সাহায্যে, কীভাবে বাড়ি ফিরেছিল তা আর ওর মনে পড়ে না। আজ সকালের কাগজে সেই খাকি পোশাকের মানুষটার কথা লেখা আছে। নাথুরাম গডসের ফাঁসি হয়েছে। আজ উদয় জানে না সে ভয়ংকর দুঃখী না সুখী। আজ তার এমন কোনো কারণ নেই ফের নিজের মুখোমুখি হওয়ার। গান্ধীজির মৃত্যুর সঙ্গে সে কোনোভাবেই জড়িত না। গান্ধীজিকে শহিদ হতে সে কোনোই সাহায্য করেনি। ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ, সে কেন গুলি আর তাসের খেলা খেলেছিল সেটুকুও ওর আর মনে নেই। অথচ কী এক অজ্ঞাত আকর্ষণে ফের ওর সেই খেলাটা খেলে দেখতে ইচ্ছে জাগছে। তবে আজ ও বাজি রাখতে চায় কেবল নিজেকেই। ওর ভীষণ জানা দরকার ওর মৃত্যু এবং ভালোবাসার রং হরতন ওঠে কি না। এরকম এক রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাতে ওর হাতে হরতন উঠলেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা হবে না। জীবনের গুটি কয়েক দিনে নিজের মাথায় গুলি ভরে দেওয়া খুবই সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে যায়।
কোনো পিছুটান থাকে না, কোনো আফশোস থাকে না। মনে হয় পুরো জিনিসটাই একটা নিরুপদ্রব খেলা।
উদয় বহুক্ষণ শাফল করে চোখ বুজল। এবং একটা একটা করে তাস টানতে লাগল।
ঘুমঘোরে
শহরের প্রায় প্রতিটি বাঁক আমার চেনা, এই উঁচু-নীচু রাস্তা, রাস্তার ধার ঘেঁষে পাইনের সারি, বালকের চোখে দেখা সেইসব আমুদে দোকানপাট কেভেন্টার্স, গ্লেনারিজ, সাংরিলা, ছবির মতো সেইসব ছোটখাটো হোটেলবাড়ি, লজ, দূরের সেই পাহাড়শ্রেণী, রাস্তার গা বেয়ে উঠে যাওয়া, নেমে-যাওয়া সিঁড়ির অলিপথ, এমনকী, ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে নীচে চোখ চালিয়ে দেখা সেই ময়লা জলধরা ঘিঞ্জি বাজার। কিছুক্ষণ ধরেই পৃথা বলছিল, কই গো তোমার সেই নিত্যবাবুর বোর্ডিং হাউজ? পা যে আর চলে না। ছ-বছরের কন্যা মিশা বলল, বাবা, তুমি হোটেল খুঁজে পাচ্ছ না?
হঠাৎ করে আমার সংবিত ফিরে এসেছে মিশার কথায়। আমি সত্যিই ছেলেবেলার সেই বোর্ডিং হাউজটা খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ স্থির জানি সেটা এখানেই দাঁড়িয়েছিল। সামনে বে উইণ্ডো করা অ্যালা রঙের সাবেক চেহারার হোটেল। কলকাতার বাঙালিদের কাছে দার্জিলিংয়ের কালীবাড়ি। কেউ বলত ধর্মশালা। মালিক নিত্যবাবুর নামেই ডাকসাইটে। আসল নামটা-ক্যালকাটা বোর্ডিং—কারও খেয়ালেই আসত না। বাবাকেও চিরকাল বলতে শুনেছি ‘নিত্যবাবুর ডেরা’।
কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে সেই ডেরার কোনো হদিশ পাচ্ছি না। বউকে যে গর্ব করে বলতাম আমার মাথাটা কম্পিউটার, যা ঢোকে তা চিরদিনের মতো গাঁথা হয়ে যায়, যে গর্বের গুড়ে এবার বালি ঝরছে। আমি ফের দেখলাম ‘সানি ভিলা হোটেল’-এর কাছে-ঘেরা লবিটার দিকে। ভেতর থেকে কে যেন বলল, ভেতরে ঢোকো। আমি হাতের স্যুটকেস জমিতে নামিয়ে তরতর করে হেঁটে গেলাম লবির ভেতর এবং বাঁকের সিঁড়ির প্রথম ধাপিতে পা রাখতে ডান পাশের কাচ দিয়ে দেখতে পেলাম সেই দৃশ্য, যা পুরো চব্বিশটা বছর সমানে যাতায়াত করছে। আমার স্মৃতির আয়নায়। আমি দেখলাম পিছনের সবুজ ঘাসের জমি দ্রুত গড়িয়ে নেমে গেছে। কয়েকশো ফুট আর তারপর কিছু শাল, পাইনের গাছে ঘেরা একটা শান্ত, ঘুমন্ত জমিতে উদাসভাবে দাঁড়িয়ে আছে একটা ভারিক্কি চেহারার, ছড়ানো-বিছানো সাহেবি ইমারত। ক্যালকাটা বোর্ডিংয়ের দোতলার বারান্দা থেকে বাবা ওই বাড়ির দিকে আঙুল তুলে বলতেন, ওই দেখো রাজভবন। গ্রীষ্মকালে ওখানে হরেন মুখুজ্জে, বিধান রায়রা এসে থাকেন।
হরেন মুখুজ্জে বা বিধান রায় যে কে বা কারা তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না আমার, কিন্তু সেটা কবুল করলে বাবা চটে যাবেন, তাই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলতাম, তাই বুঝি! মনে পড়ল এক সন্ধ্যায় জোনাকির মতো আলো জ্বলতে শুরু করেছে যখন সারা দার্জিলিংয়ে আর আকাশের একপাশে দেখা দিয়েছে আধখানা শুক্লপক্ষের চাঁদ, আমি হঠাৎ বারান্দায় মাকে ডেকে নিয়ে বললাম, দেখো ওইটা হল হরেন মুখুজ্জে, বিধান রায়দের বাড়ি। মা কিন্তু সত্যি অবাক হয়ে গিয়ে বলেছিল, তাই বুঝি!
আমি থমকে ছিলাম ওই ধাপিতেই। পিছন থেকে একটা তরুণ কণ্ঠ শুনলাম, লুকিং ফর রুমজ, স্যার? আমি থতোমতো খেয়ে বললাম, আসলে আমি একটা চেনা হোটেল খুঁজছিলাম। কিন্তু পাচ্ছি না।
তরুণটি এবার বাংলায় জিজ্ঞেস করল, কোন হোটেল? বললাম, ক্যালকাটা বোর্ডিং। আর অমনি তরুণটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়ে স্টাইলের ওপর বলল, আপনি সেই হোটেলেই দাঁড়িয়ে আছেন এই মুহূর্তে।
আমার বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি, কোনো মতে জড়ানো গলায় বললাম, এটা সানি ভিলা নয়?
তরুণটি আশ্বস্ত করার টোনে উত্তর করল, অবশ্যই এটা সানি ভিলা, তবে বারো বছর আগেও এটা ছিল ক্যালকাটা বোর্ডিং। ইতস্তত করে বললাম, তার মানে নিত্যবাবু এটা বেচে দিয়েছেন? তরুণটি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, না, তাঁর মৃত্যুর পর এটা এভাবে রেনোভেট করে নিয়েছি আমি।
—আপনি?
—ওঁর ছেলে। বিক্রম মজুমদার।
আমি কীরকম একটা আফশোসের ভঙ্গিতে সবে বলতে শুরু করেছি কিন্তু আগের হোটেলটা তো খারাপ ছিল না যখন মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিক্রম বলল, না। ওভাবে আর চালানো যাচ্ছিল না। যুগ পালটে গেছে। পিপল ওয়ন্ট কামফর্ট, নট নস্টালজিয়া। বাবা তো শেষ দিন অবধি কাপ-ডিশের চেহারাই বদলাতে দিলেন না।
আমার মনের ভেতর কয়েকটা সাবেকি কাপ-ডিশ ঝনঝন করে গড়িয়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমার মুখ ফুটে শুধু কোনোক্রমে বেরিয়ে এল দুটো শব্দ—আই সি!
কিন্তু আমি বাইরের কিছুই আর দেখছি না, মনের মধ্যে একটা চব্বিশ বছরের পুরোনো ফিলম চালু হয়ে গেছে। গরম গরম লুচি আর আলু-টম্যাটোর তরকারি। সকালে বাবা-মা-র সঙ্গে গরম চা আর টোস্ট। রাতে রুটি-মাংস। ঘরে এসে পাথর বেচছে এক ফেরিওয়ালা। বাবা গরম জলে চান করতে করতে হাঁক দিচ্ছেন, সাহেব, মাকে তোয়ালে দিতে বলো! মা রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভূতের গল্প শোনাচ্ছে। আর সকালে নিত্যবাবু এসে বাবাকে বলছেন, সাহেব, আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো এখানে? উত্তরে বাবা বলছেন, চাইলে তো আমি এভারেস্ট হোটেলেও উঠতে পারতাম। এই নিয়ে পনেরোবার এলাম এখানে, যতদিন বাঁচি আপনার এখানেই উঠব। নিন, এবার আপনি একটা খবরের কাগজের বন্দোবস্ত করুন।
বাবার আর আসা হয়নি এই হোটেলে বা দার্জিলিংয়ে। সে-বছর ডিসেম্বরেই দেহরক্ষা করলেন তিনি। আসা হয়নি আমারও, কারণ বাবা থাকবেন না, মা থাকবে না, অথচ আমি দার্জিলিংয়ে থাকব এটা মেনে নিতে চাইত না মন। কিন্তু এবার আর স্তোক দিতে পারা গেল না মিশাকে। হঠাৎ একদিন জিজ্ঞেস করে বসল, বাবা, সবচেয়ে সুন্দর পাহাড় কোথায়? মাস্টারি চালে বললাম, দার্জিলিংয়ে। তখন শিশুর মতো সরলভাবে জিজ্ঞেস করল, সেখানে কি আমি গেছি? বললাম, না।
-তুমি?
—হ্যাঁ।
—আমি আর মা যাব না?
শুনলাম বিক্রম জিজ্ঞেস করছে, তা হলে কি থাকা হচ্ছে এখানে?
আমি এক গভীর ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বললাম, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আমার মেয়ে-বউ মালপত্তর নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ডেকে আনি।
বলেই বেরিয়ে আসছিলাম। বিক্রম বলল, কীরকম ঘর পছন্দ স্যারের? হেঁটে যেতে যেতেই জানিয়ে দিলাম, দোতলার পিছনের বড়ো বারান্দা দেওয়া ঘরটা। বিক্রম বলল, পিছনের ঘরটা আপনি পাবেন, তবে বারান্দাটা নেই।
আমি ঘরটার সঙ্গে স্মৃতির ঘরটা মেলাতে পারছিলাম না কিছুতেই। আলমারিতে কাপড় ঝোলাতে ঝোলাতে পৃথা বলল, তোমার সেই বোর্ডিং মনে হচ্ছে খুঁজে পাচ্ছ না এখানে?
আমি বললাম, কী করে পাব, এটা তো হোটেল। সেটা ছিল কীরকম বাড়ি বাড়ি মতন। সিঁড়ি দিয়ে ব্যোমবাহাদুরের পিঠে চড়ে নামতাম। রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে মটরশুটি খাওয়াত। এইসব বেয়ারা স্রেফ চাকরি করে।
মিশা আমার কথা শুনে লাফিয়ে উঠল—আমি তোমার পিঠে চড়ে নামব সিঁড়ি দিয়ে বাবা! কিন্তু আমি সাহস পেলাম না। সরু সিঁড়ি দিয়ে যদি পা হড়কে পড়ি। ব্যোমবাহাদুর আমাকে ওভাবে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করলে মা খুব ভয় পেত, কিন্তু বাবা বলতেন, কিসসু ভেব না! এরা পাহাড়ি লোক, পাহাড় বেয়ে ওঠে-নামে। তোমার ছেলে বেশ থাকবে ওর সঙ্গে।
আমি মিশাকে রাজভবন দেখাব বলে কোলে করে জানালায় নিয়ে গেলাম। দেখি সেই দৃশ্য ঠিক তেমনই আছে, সেই শান্ত, নীরব রৌদ্রলোকে ঝলমলে, একটেরে। মিশা বলল, ওটা কী বাবা? আমি বললাম, ওখানে গ্রীষ্মকালে জ্যোতিবাবুরা থাকেন। ওটা রাজভবন। মেয়ে বলল, কলকাতায় যখন খুব গরম পড়ে আর লোডশেডিং হয় তখন? বললাম, অন্য সময়েও থাকেন, যখন কাজ হয়। মেয়ে বলল, তুমি ওখানে গেছ বাবা? বললাম, না যাইনি। তোমার ঠাকুরদা আমাকে এইখান থেকে দেখিয়েছিলেন। মেয়ে বেশ রোমাঞ্চিত হয়ে বলল, এইখান থেকে আর কী দেখিয়েছিলেন ঠাকুরদা? আমি বললাম, আকাশের অনেকগুলো তারা, যাদের বলে সপ্তর্ষিমন্ডল। আর ওইদিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার পিক। এখন তো সেই বারান্দা নেই তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে না। আমি অন্য জায়গা থেকে সেটা তোমার দেখাব।
বলতে বলতে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল বেয়ারা, পিছন পিছন বিক্রম। আর ঢুকেই সরবে প্রশ্ন করল, কী স্যার, কেমন বুঝছেন সানি ভিলা? সব দিক থেকেই আগের চেয়ে কত মডার্ন, কত এলিগ্যান্ট? কিন্তু বাবা বুঝতে চাইতেন না।
আমি বিক্রমকে একটা চেয়ার টেনে বসতে বললাম। পৃথা ওকেও এক কাপ চা দিল। ছোকরা তো হাঁ! হাঁ! করে উঠল।
-বলেন কী স্যার? আমার হোটেলে বসে আমাকে এন্টারটেন করছেন। ওটি হচ্ছে না।
আমি বললাম, আপনার বাবা কিন্তু আমার বাবার সঙ্গে বসে সকালের চা-টা খেতেন।
বিক্রম বলল, সে কি! আপনারা এতদূর ঘনিষ্ঠ আমাদের সঙ্গে? ইন দ্যাট কেস এই চায়ের বিলটা আপনার বিলে জুড়ছি না। ইটস ফ্রম মাই সাইড। যাকে বলে অন্য দ্য হাউস।
ছোকরার খুব প্রাণস্ফুর্তি আছে দেখছি, ডজনে যোলোটা করে কথা ফোটে। ওকে আমার ভালো লাগছে, আবার নিত্যবাবুর মতো আপনার জন মনে হচ্ছে না। আমি একটু মৌতাত। করে চা খেতে খেতে উদাস হয়ে পড়ছি দেখে ও ওর এই হোটেল বিষয়ে প্রোপাগাণ্ডা শুরু করল পৃথার কাছে। কখন যেন শুনলাম বলছে, আপনার স্বামী লেখক। ওঁর পক্ষে আইডিয়াল লেখার জায়গা আমার এই হোটেল। বাগানে নেমে দেখবেন কীরকম ফুলের বাহার। ওসব আমার নিজের হাতে কালচার করা।
পৃথা বলল, রাতে ঘর গরম করার কী ব্যবস্থা?
-কেন, রুম হিটার লাগিয়ে দেব। বাবা তো কিছুতেই ফায়ারপ্লেস বদলে ইলেকট্রিক করতে দেননি।
—আমার কর্তার কিন্তু ফায়ারপ্লেসের ওপরই দুর্বলতা।
—হবেই তো! লেখক না? ওঁরা চেঞ্চকে রেজিষ্ট করেন। কিন্তু ফায়ারপ্লেসের ধকল সামলাতে বাবা তো হিমশিম খাচ্ছিলেন। কে অত কাঠকয়লা জোগাড় করবে? সে ছিল এক ব্যোমবাহাদুর, ওই সব নিয়েই থাকত। আজকাল…
বিক্রমকে কথার মধ্যে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সেই ব্যোমবাহাদুর কি নেই এখন?
—তা বছর আষ্টেক হল। শেষ দিকে খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। কিছুতেই মন ভরে না, সারাক্ষণ হম্বিতম্বি। তারপর তো বউ মরতে মাথাই খারাপ হয়ে গেল।
.
-মাথা খারাপ হয়ে গেল! ব্যোমবাহাদুরের!
–ওই আর কি! একা হয়ে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঘুম স্টেশনে গিয়ে বসে থাকত।
–কেন, ওর ছেলেপুলে ছিল না?
—কোথায়? ওর বউয়ের তো একটার পর একটা মিসক্যারেজই হল চিরকাল। সবাই বলত, ফের সাদি করা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বোর্ডিংয়ে যত ছেলেপুলে আসত তাদেরই বানিয়ে ফেলতে নিজের বাচ্চা। তারপর একবার একটা বাচ্চাকে লোফালুফি করতে করতে ব্যালান্স হারিয়ে ফেলল। সে-বাচ্চা পড়ে গিয়ে পায়ে বেদম চোট পেল। তখন আবার বাবা নেই, আমি সবে কাজ দেখছি। কাস্টমার আমাকে এই মারে তো সেই মারে। শেষে ক্ষমা চেয়ে, বিল থেকে দুশো টাকা মাইনাস করে রেহাই। তারপর আই লস্ট মাই টেম্পার। ভুলে গেছি কী না কী বলেছিলাম ব্যোমবাহাদুরকে। অ্যাণ্ড মাই ফুট! হি সিম্পলি ওয়াকড আউট দ্য হোটেল অ্যাণ্ড নেভার কেম ব্যাক!
আমি সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করলাম, ডু ইউ মিস হিম?
বিক্রম আজকালকার পরিচিত স্টাইলে ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, নট রিয়েলি! ও একটা অন্য সময়ের লোক। খুব ভালো ছিল ও নিজের সময়ে। তবে এখন অচল। মোরওভার হি ওয়জ কোয়াইট ওল্ড। চোখেও ভালো দেখত না।
আমি হতাশ হয়ে বললাম, ওল্ড? ব্যোমবাহাদুর? তারপর নিজের মনে মনে বললাম, বাট আই মিস হিম!
বিকেলে ম্যালে গিয়ে ঘোড়ায় চড়াচ্ছিলাম মিশাকে। আর এক কোণে দাঁড়িয়ে পৃথাকে দেখাচ্ছিলাম আশপাশের লোকালয়। হর্সরাইড শেষ করে মিশা ছুটে এসে বায়না ধরল, বাবা কাল টয় ট্রেন চড়াবে? বললাম, নিশ্চয়ই। তার আগে আজকে এখানে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখো। ও বলল, সেটা কোথায়? আর আমিও দেখলাম, তাই তো! একটা বিরাট মেঘ এসে আকাশের একটা দিক অন্ধকার করে ফেলেছে। মেঘের থেকে ঠিকরে কিছুটা রোদের ছটা বেরুচ্ছে, কিন্তু হঠাৎ করে কীরকম সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব চারদিকে।
আমার মনে পড়ল বাবা আর মা-র সঙ্গে ম্যালের সেই সন্ধ্যে। আমি মিশার চেয়ে আরেকটু বড়ো তখন। হঠাৎ বাবা বললেন, একটা কবিতা শোনাও তো সাহেব! আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম। বাবা বললেন, তা হলে আমার কবিতাটি শোনো। এ কবিতার নাম কালী দ্য মাদার’। লিখেছেন স্বামী বিবেকানন্দ।
বাবা যে কী বলছে গম্ভীর কণ্ঠে আমি তার কিছুই বুঝছি না। শুধু দেখছি মা কীরকম হাঁ হয়ে শুনছে। যেভাবে মা কখনো আমার কথা শোনে না। আমার খুব হিংসে হচ্ছে বাবার প্রতি। পৃথাকে বললাম, জানো তো, বাবা এখানে দাঁড়িয়ে কী কবিতা শুনিয়েছিলেন আমাদের? পৃথা বলল, না তো! আমি আর ভণিতা না বাড়িয়ে আবৃত্তি করতে লাগলাম
দ্যা স্টারস আর ব্লটেড আউট,
দ্য ক্লাউডস আর কাভারিং ক্লাউডস,
ইট ইজ ডার্কনেস ভাইব্রান্ট, সোন্যান্ট,
ইন দ্যা রোরিং, হোয়ার্লিং উইণ্ড…
আবৃত্তি শেষ হতে দেখি পৃথা মা-এর মতো সেই অবাক নেত্রে আমাকে দেখছে, হাঁ হয়ে দেখছে আমাকে মিশা। আর ওদের দুজনের মুখের উপর কমলা রঙের রোদ এসে পড়েছে। স্বামীজির কবিতা বলতে বলতে, মনে মনে বাবা সাজতে সাজতে খেয়ালই করিনি কখন যে মেঘ সরে আকাশ, পাহাড়, প্রকৃতি ফের ঝলমলিয়ে উঠেছে। একটা নেশাও চেপেছে মিশা আর পৃথাকে একটা নতুন কিছু দেখানোর। অথচ মনে কোথায় যেন একটা ব্যথা ব্যথা ভাব। বললাম, চলো, তোমাদের ঘুম দেখিয়ে আনি। সে দার্জিলিংয়ের থেকেও উঁচুতে। একটু ঘুমিয়ে থাকার জায়গা।
একটা ট্যাক্সি করে ঘুম স্টেশনে এসে পড়েছি। সেটা যে কীসের টানে তা এতক্ষণে খেয়ালে এল। আমার ভীষণ দরকার পড়েছে ব্যোমবাহাদুরকে। সে নাকি এই ঘুম স্টেশনেই বসে থাকে। ওকে পেলে ওর কোলে আমি মিশাকে ছুড়ে দেব। চাপিয়ে দেব পিঠে, বলব, যত পারো লোফালুফি করো। ও তোমার বাচ্চা।
কিন্তু মেঘে-জড়ানো ঘুম স্টেশন ঘুমিয়েই আছে। আর আমি পৃথা আর মিশাকে নিয়ে খুঁজছি। একটা স্মৃতির মানুষকে, যাকে প্রথম এবং শেষ দেখেছি চব্বিশ বছর আগে। কিন্তু জায়গা শুনশান, জনমানবহীন। আমি বউ, মেয়ে নিয়ে বসে পড়লাম স্টেশনের বেঞ্চিতে। মিশাকে বললাম, এখন আমরা ট্রেন দেখব। বলে পকেট হাতড়ে সিগারেট বার করে ধরালাম।
আর ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা ভারী, কেশো, বৃদ্ধ গলায়–বাবু, একটো সিকরেট হবে? মাথা ঘুরিয়ে দেখি এক বৃদ্ধ নেপালি, জীর্ণ কোট আর কম্বলে জড়ানো, চোখে মোটা কাচের চশমা, কোনো মতে ডান তালুটা বার করে রেখেছে সিগারেটের আশায়। আমি একটা সিগারেট বার করে দিতে গিয়ে দেখলাম যে দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ, করুণা নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার মেয়ের মুখের দিকে।
মোটা চশমার ওপারে ওর চোখের বিশেষ কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে ওর চাহনির মধ্যে একটা ব্যোমবাহাদুর ছেয়ে আছে। ওই ঘাড় হেলানো চাহনি আর মৃদু হাসি। আমি চট করে গোটা প্যাকেটটাই তুলে দিলাম ওর হাতে। বৃদ্ধ বলল, আগ, বাবু। আমি দেশলাই দিলাম। দিয়ে বললাম, তুমি ব্যোমবাহাদুর? বৃদ্ধ হ্যাঁ, ‘না’ কিছুই বলল না। আমি মিশাকে ডেকে ওর সামনে এনে বললাম, আমার মেয়ে।
বৃদ্ধ সেই সমানভাবে ঘাড় হেলিয়ে দেখে যাচ্ছে মিশাকে। কিন্তু স্পর্শ করছে না। এ কি সেই হাত থেকে বাচ্চা ফসকানোর ফল? কিন্তু ও মিশাকে কোলে না নিলে আমি জানব কী করে যে ও-ই ব্যোমবাহাদুর? যে বাচ্চা লোফে না সে কি ব্যোমবাহাদুর হয়? এদিকে বাল্যের স্মৃতিও বড়ো ঝাপসা, জটিল হয়ে উঠছে। ভাবছি ব্যোমবাহাদুরের হাইট কত ছিল? সে কি সত্যি সত্যি ঘাড় হেলিয়ে আমাকে দেখত? সে কি সিগারেট খেত? সে কি সিগারেট ধরাতে গিয়ে বার বার কাঠি নিভিয়ে ফেলত? সে কি নাম জিজ্ঞেস করলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত বৃদ্ধের মতো?
আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ব্যোমবাহাদুর? লোকটা দেশলাইটা ফেরত দিয়ে পিছন ঘুরে গুটগুট করে হাঁটতে লাগল অন্যদিকে। এবং একটু পরে হারিয়ে গেল মেঘের আড়ালে।
চোখ
আচমকা ঘুম ভাঙতে রাখাল দেখল নতুন বউ মাধবী বড়ো করে ঘোমটা টেনে খাটের এক কোণে বসে আছে। ও কি কাঁদছে? ওর কি মন ভার? নাকি বাপের বাড়ির লোকদের মনে পড়ছে একে একে? রাখাল পর পর এইসব কথাই ভাবল, অবশেষে ওর মনে এল ভয়ংকর প্রশ্নটাই। বিপত্নীক স্বামীদের কি সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করতে মেয়েদের একটু সময় লাগে? কথাটা অর্থহীন নয়। অফিসের বন্ধু রথীনের কাছে এমন একটা কথা রাখাল শুনেছিল দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করার পূর্বে। তা বলে মাধবীর মতন আধুনিক মেয়ের মধ্যেও এসব সংস্কার থাকবে? রাখাল নিজেও আস্তে আস্তে উঠে বসল বিছানায়, আর নরম করে ডাকল
–মধু!
মাধবী একটু চমকে গিয়েছিল। ও ঘোমটা সরিয়ে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা ভয় নিয়ে তাকাল রাখালের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। রাখাল একটু বিব্রত বোধ করছিল। ঈশ্বরীর সঙ্গে দেড় বছর ঘর করলেও মেয়েদের সম্পর্কে ও তেমন বেশি কিছু জানে না বললেই চলে। সামান্য খানিকটা কেশে গলাটা ছাড়িয়ে নিয়ে রাখাল বলল— মধু, তোমার কি ঘুম আসছে না? উত্তরে মাধবী শুধু মাথা দোলাল, মানে না।
রাখাল মাধবীর ধার ঘেঁষে বসল গিয়ে। আলতোভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, কেন? ঘুম
আসার কী হল? ওর এই প্রশ্নের কোথায় যেন একটা উৎকণ্ঠার স্বর ছিল। মাধবী বলল,
চোখ বোঁজার পর থেকেই আমি সব আজেবাজে স্বপ্ন দেখছি। আর সমানে ঘুম কেটে যাচ্ছে।
–আজেবাজে স্বপ্ন? ভয়ের?
— ভয়ের না। কীরকম তবু!
— কী দেখেছ একটু মনে করতে পারো?
মাধবী এবারই যেন সত্যি সত্যি ভয় পেল। কী দেখেছে স্বপ্নে তাই বলতে গিয়ে ওর মুখটা সামান্য কুঁকড়ে উঠল। আর নতুন বরের সামনে সেই অবান্তর স্বপ্নের কথা ভাবতে গিয়ে খানিকটা হাসিও পেল। ওর মনে হল ওই ভয় কিংবা এই হাসি কোনোটারই কোনো মানে হয় না। ও শুধু ধ্যাৎ!’ বলে বালিশ টেনে রাখালের বুকের মধ্যে ঠেস দিয়ে শুয়ে পড়ল। এবং গায়ে গা ঠেকায় ওর টের পেতে ভুল হল না যে রাখালের বুকের ভেতরটায় সজোরে শব্দ হচ্ছে ‘ধকধক ধকধক’।
ওর ওই স্বপ্নের কথা শুনে ওর বরও তাহলে ভয় পেয়েছে। মাধবীর মনে হল স্বপ্নের কথাটা ও রাখালকে না বললেই ভালো করত।
স্বপ্নে মাধবী তেমন কিছু-একটা দেখেনি। শুধু দুটো চোখ। শুধু চোখ দেখে বোঝা যায় না সেটা কোনো ছেলের না মেয়ের। আবার বোঝা যায়ও। মাধবীর ধারণা ওই চোখ দুটো কোনো মেয়ের। যে মেয়ের ভেতরে খুব জ্বালা, রাগ আর হিংসে আছে। ওই চোখ দিয়ে মাধবীর গোটা শরীরটা সে পুড়িয়ে দিতে চাইছিল। স্বপ্নের মধ্যে মাধবী একবার ওই চোখকে লক্ষ করে বলেছিল, যা ভাগ! কিন্তু চোখটা তবু যেখানে ছিল সেখানেই স্থির হয়ে রইল। এরকম বার তিনেক বকাবকি করার পর স্বপ্নের মধ্যেই বিষয় ভয় পেল মাধবী, আর শেষমেশ অজ্ঞান হয়ে পড়ল। আসলে তখন স্বপ্ন কেটে, ঘুম ভেঙে মাধবী উঠে বসেছিল বিছানায়। আর ওর গা দিয়ে দরদর করে ঘাম বইছিল।
মাধবী বেশ ভোরেই ওঠে। মুখ-চোখে জল দিয়ে চা বানায় রাখালের জন্যে। চা নিয়ে না ডাকলে রাখাল ওঠে না। শেষ রাতের দিকে রাখাল ঘুমোয় নিঃসাড়, অচৈতন্য হয়ে। আজ কিন্তু বিছানা ছাড়তে গিয়ে মাধবী দেখল রাখাল নেই। তাহলে নিশ্চয়ই কলতলায় মুখ ধুচ্ছে। কিন্তু তাও না। রাখাল গোটা বাড়ির কোনোখানেই নেই। মাধবী তবু মুখ ধুয়ে উনুন জ্বেলে চা বসাল। তারপর ফুল ঝাড়টা তুলে নিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে এল।
ঘরের এক কোণে গোটা চারেক তোরঙ্গ আছে। তার দুটো ওর বাবা বিয়ের সময় দিয়েছেন। বাকি দুটো রাখালের আগে থেকেই ছিল। এ ছাড়া একটা চামড়ার সুটকেসও আছে খাটের তলায়। যাতে রাখাল বাড়ির দলিলপত্র আর অন্য যাবতীয় কাগজ রাখে। ওই সুটকেস মাধবী কখনো খোলেনি। স্বামীর ঘরে ওরা পুরো এক পক্ষকালও হয়নি। নিজের থেকে ও স্বামীর কোনো জিনিসই দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ ওর ইচ্ছে হচ্ছে সুটকেসের ডালাটা একবার উঠিয়ে দেখে ওতে কী আছে। কারণ এইমাত্র ওর নজরে পড়ল যে, রাখাল তাড়াহুড়োর মাঝে সুটকেসের আংটায় তালা লাগাতে ভুলে গেছে। তালাটা আলগাভাবে পড়ে আছে সুটকেসের ডালার ওপর।
মাধবী হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকল। তারপর বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সুটকেসটা টানল। ওমা! কী ভারি সুটকেস রে বাবা! একটা সামান্য চামড়ার সুটকেস একটানে এক বিঘতও নড়ল না! এবার মাধবী দু-হাত দিয়ে সেটাকে প্রায় জাপটে ধরে একটু একটু করে বার করে আনল। ওর সন্দেহ জাগল এর ভেতর নিশ্চয় ভারি থালা-বাসন, গয়নাগাঁটিও আছে, যার কথা রাখাল ওকে বলেনি এতদিনেও। বরের ওপর সামান্য ক্ষোভও হল মাধবীর। রাখালের আগে বিয়ে হয়েছিল জেনেও মাধবী যদি ওকে বিয়ে করতে সম্মত হয়ে থাকতে পারে তবে রাখালেরও কি উচিত ছিল না ওকে একটু খুলেভেলে ঘরসংসারের কথা বলা? রাখালের সোনাদানা তো আর মাধবী খেয়ে ফেলবে না। স্বামীর যা থাকে স্ত্রীরও তো সেটুকু সম্পদ। মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ক-ফোঁটা ঘাম মুছে এক ঝটকায় ডালাটা খুলে ফেলল আর ভূত দেখার মতো চমকে উঠে আবিষ্কার করল যে, সুটকেসে সত্যিই সামান্য ক খানা ফাইলই আছে। সোনাদানা বাসন-কোসনের লেশমাত্র নেই!
অথচ অত ভারী লাগল কেন সুটকেসটা তখন? মাথার মধ্যে সব কিছুই যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাধবীর। ওর মনে হল গত রাত্রে ঘুমের অভাবেই অতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল ও। তাই প্রথম টানে বাক্সটাকে অতখানি ভারী লেগেছিল। এবার ও বাক্সটাকে এক হাতে সামান্য জোরে ঠেলতে সেটা সড়সড় করে সরে গেল অনেকখানি। নিজের ওপর ভয়ংকর রাগ গিয়ে পড়ল মাধবীর। ওর কানে এল কেটলিতে চায়ের জল ফোঁটার শব্দ। হাঁটুর ওপর হাতের ভর দিয়ে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে মাধবী উঠোনে গিয়ে চায়ের জলটা নামাল। তিন কাপ চা বানিয়ে তার দু-কাপ রাখালের জন্য ঢেকে রেখে একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের কাপে নিজের চা-টুকু নিয়ে মাধবী এসে বসল ফের সুটকেসের পাশে। চায়ে চুমুক দিতেই শরীরটা হঠাৎ বেশ ঝরঝরে লাগল। ও আরও দুটো চুমুক দিয়ে কাপটা পাশে রেখে ফের তুলে ধরল সুটকেসের ডালাটা। ওর চোখে পড়ল বড়ো একটা ফাইলের কোণে এক রাশ পিপড়ে কোত্থেকে জড়ো হয়েছে।
সত্যি, বরটা ভীষণই ভুলোমনা, ভাবল মাধবী। না হলে পিঁপড়ের চাক বসেছে দামী কাগজপত্রে সেটাও তার চোখে পড়ে না? এভাবে কাগজগুলো নষ্ট হলে ক্ষতি কার হবে? মাধবীর? না গোটা সংসারের? মাধবী চট করে ফাইলটা তুলে দিয়ে যেখানটায় পিঁপড়ে জমেছে সেখানে সজোরে ঝাড়তে লাগল। পিঁপড়েগুলো পড়ক না পড়ুক ওই ঝাড়াঝাড়িতে ফাইল থেকে একটা খাম গলিয়ে পড়ল মাটিতে। সেটা তুলে জায়গামতন রাখতে গিয়ে মাধবীর মনে হল ওতে দুটো দুল আছে। একটু ভারী দুলই হবে হয়তো। স্বামীর আগের পক্ষের জিনিস। তবে মেয়ে বলেই হয়তো সেটা না দেখে যথাস্থানে ফিরিয়ে রাখতে মন সরল মাধবীর। ও খামের একটা দিক ফাঁক করে উঁকি মেরে সেটা দেখল। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ও আতঙ্কে ওর চোখ দুটো প্রায় ঠিকরে কোটর থেকে বেরিয়ে আসছিল। দুটো কানপাশা বা দুলের জায়গায় খামের মধ্যে হাজির ছিল দুটো মানুষের চোখ! জ্যান্ত, জ্বলজ্বলে, হিংস্র। ওই খামের ফাঁক দিয়েই চোখ দুটো চেয়েছিল মাধবীর দুই চোখের দিকে! কোটরমুক্ত, নিষ্পলক ওই চোখ দুটো যে কোনো মহিলার, মাধবীর তাতে কোনোই সন্দেহ রইল না। এই চোখ দুটোই সে গতকাল রাত্রে স্বপ্নে দেখেছে। ও তীব্র এক চিৎকার করে খামশুদ্ধ চোখ দুটো ছুড়ে দিল দরজার দিকে। আর পরক্ষণেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
মাধবী জ্ঞান ফিরে দেখল ওর মাথার পাশে মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে রাখাল। সঙ্গে আরও কে একজন। মাধবীর চোখ খুলেছে দেখে রাখালের পাশে বসা লোকটি বেশ জোরে জোরে বলে উঠল, যা কইছিলাম রাখাল, দ্যাখলা তো? এ হল গিয়া পিত্তজ্বর। রাত্তিরে দুঃস্বপ্ন হয়, দিনের বেলা মাথাঘুরা। এসব আমার নখদর্পণে। কয়েক লক্ষ সারাইছি অ্যাদ্দিনে। নাও, নাও এবার এই বড়িখান বউরে খাওয়াও দিকিনি। বলে ওর ময়লা ধুতির খুঁট থেকে একটি কালির বড়ির মতন কী বার করে রাখালের হাতে দিল লোকটা। রাখাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বড়িটা মাথায় ঠেকাল, যেন দেবতার প্রসাদ। আর মাধবীর হাড়পিত্তি জ্বলে গেল ওইসব বুজরুকির ওষুধ দেখে; ও বেশ বিরক্ত হয়েই বলল, হ্যাঁ গো, আমার তো কিছু হয়নি। আমায় ওষুধ দিচ্ছ কেন?
রাখাল মাধবীর মাথায় ওর হাতের তেলোটা আলতোভাবে রেখে বলল, তোমার কী হয়েছিল মধু? মাথা ঘুরছিল? মাধবী আস্তে আস্তে উঠে বসে বলল, না, মাথা ঘোরেনি। তোমার একটা দরকারি খাম পড়ে গিয়েছিল বাইরে। সেটা তুলতে গিয়ে দেখলাম তার ভিতরে মাধবী এতটুকু বলে যেন দম নিতে গেল। একটু চুপ করে রইল। তাতে উদবিগ্ন হয়ে রাখাল বলল, এই খামটা?
বলে সুটকেসের সেই খামটাই মাধবীর সামনে মেলে ধরল রাখাল। যে খাম মাধবী আতঙ্কের সঙ্গে ছুড়ে ফেলেছিল দোরগোড়ায়। মাধবী বলল, হ্যাঁ।
–তা এতে কী দেখলে?
–চোখ।
–চোখ!
— হ্যাঁ, দুটো চোখ।
হায় কপাল। বলে মাথা চাপড়াতে লাগল রাখাল। তুমি এর মধ্যে চোখ কোথায় পেলে? এতে তো ঈশ্বরীর দুটো কানপাশা আছে। তোমার জন্য নতুন করে গড়িয়ে দেব ভাবছিলাম। অথচ আজ সকালে তন্নতন্ন করে খুঁজেও খামটা সুটকেশের মধ্যে পেলাম না। তাইতো ছুটে গেছলাম তারকের বাড়ি। একবার এ দুটো ওর কাছে বন্ধক রেখে কিছু টাকা নিয়েছিলাম। ভাবলাম টাকা শোধ করলেও জিনিসটা বোধ হয় ফেরত আনিনি। কিন্তু তারক বলল, জিনিস তো আমি টাকা দেওয়ার দিনই ফেরত এনেছি। তারপর ঘরে ঢুকে দেখি দোরগোড়ায় দুল দুটো গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এতক্ষণে সুযোগ বুঝে রাখালের পাশে বসা কবিরাজ ফের মুখ খুলল— আরে হ, ইডাই তো কইতে আছিলাম রাখাল। পিত্তজ্বরে দৃষ্টিভ্রম হয়। লাঠিরে সাপ দ্যাখে, সাপেরে ব্যাং। বুঝলা? অখন ওই ওষুধটা খাওয়াও অরে।
অমনি মাধবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, না না। আমার কোনো ওষুধের দরকার নেই। আমার কিছু হয়নি। কবিরাজ বলল, হইলেই বা তুমি বুঝবা ক্যামনে? তুমি তো নাবালিকা। মাধবী আরও রেগে গিয়ে জায়গা ছেড়ে উঠে গেল দালানে। স্বামীর জন্য রাখা দু-কাপ চা ফের কেটলিতে ঢেলে উনুনে বসালো গরম করার জন্য। আর সেখান থেকে শুনতে পেল কবিরাজ রাখালকে বলছে, দ্যাখলা তো রাখাল! এইডা হৈল গিয়া ভূতি ধরার লক্ষণ। ঘুণাক্ষরেও অরে জানতি দিও না যে আমি ওঝা; তাহলে ভয় পাবে, ভূতেরও পোয়া বারো ঘটব। এইডা খ্যাল রেইখো।
বলে ওঝামশাই ওরফে কবিরাজ ঘর ছেড়ে বেরোতে যাচ্ছিল। মাধবী বলল, বসেন বসেন। এক কাপ চা তো খেয়ে যান। কবিরাজ বলল, আমি মা হরতুকির জল খাই। চা আর খালাম কবে? বলে মাটির দিকে স্থির নজর রেখে ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। কবিরাজ বেরিয়ে যেতে মাধবী রাখালকে বলল, আমি কিন্তু ভুল দেখিনি। ওই দুল কিন্তু সত্যি চোখ হয়ে গিয়েছিল। রাখাল উদাসভাবে তাকিয়ে রইল মাধবীর দিকে। আর প্রায় অন্যমনস্কভাবেই অস্ফুট স্বরে একটা শব্দই উচ্চারণ করল, জানি।
দুপুরে মাছ কাটতে গিয়ে মাধবী দেখল মরা মাছের চোখ দুটো ওর দিকেই চেয়ে আছে। ঠায়। আর চোখ দুটোও ওর চেনা চেনা। গত রাত্রে স্বপ্নে দেখা। ও মাছটাকে সাততাড়াতাড়ি বঁটির পাশের ছাইয়ের গাদায় নামিয়ে রেখে স্বামীকে ডাকল, হ্যাঁ গো, শুনছ? রাখাল সবে স্নান করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল! মাধবীর ডাক শুনে চিরুনি হাতেই বেরিয়ে এসে বলল, কী ব্যাপার?
–দ্যাখো, মাছের চোখটা দ্যাখো।
রাখাল উবু হয়ে বসে মাছটার চোখ এপাশ-ওপাশ করে দেখে বলল, হুম! একটু বেশি লাল। মাধবী বলল, তা বলছি না। ওগুলো একেবারে মানুষের মতন কিনা বল? রাখাল বলল, ধ্যাত! যত আজেবাজে চিন্তা তোমার। বলে ফের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ফিরে গেল আয়নার সামনে। আর আয়নায় নিজের মুখ দেখে নিজেই ভয় পেল। ও দেখল আয়নায় প্রতিফলিত ওর চেহারাটা একজন ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের। আয়নার ওই মানুষটা ভয় পেয়েছে, কারণ ও জানে মাধবীর কথাটা মিথ্যে নয়। মাছের চোখ দুটো বাস্তবিকই মানুষের চোখ। চোখ দুটো ঈশ্বরীর। তাতে কোনো ভুল নেই। তবু নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য রাখাল চিরুনিটা তাকের ওপর ছুড়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে খুলে ফেলল ওর সুটকেসটা। দ্রুত হাত চালিয়ে ফাইল আর কাগজের বাণ্ডিল ঘেঁটে বার করে আনল ওর আর ঈশ্বরীর বিয়ের পর তোলা যুগল ছবিটা। আর মাছের চোখ ও ঈশ্বরীর চোখের সাদৃশ্য পরখ করার জন্য সরাসরি দৃষ্টি ফেলল নতুন বউ ঈশ্বরীর সুন্দর, ডাগর, প্রায় পটল চেরা চোখ দুটোর ওপর। আর দেখল এই মুহূর্তে এই ছবির ঈশ্বরীর চোখ দুটো একেবারে গর্তের মতন। কালো, অন্ধকার। ওখানে কোনো চোখ নেই!
শিরদাঁড়ায় প্রচন্ড একটা ব্যথা সহসা অনুভব করল রাখাল। ওর মনে পড়ল গ্রামের মেয়ে ঈশ্বরী কী পরিমাণ স্বামীগত প্রাণ এবং অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে স্বার্থপর ছিল। হাসপাতালের বেডে শুয়েও ও বলেছিল, আমি ও-বাড়ি ছেড়ে কোনোদিন যেতে পারব না। প্রেসারের রোগী ঈশ্বরীর চোখ দুটো মৃত্যুর আগের দিন সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। ওর মাথায় নাকি রক্ত চড়ে মাথাটাকেই লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। রাখাল সেদিন ওর মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ে যে নিথর, দৃষ্টিহীন চোখ দেখতে পেয়েছিল কিছুক্ষণ আগে সেই চোখই দেখেছে ও বাজার থেকে আনা ত্রিশ টাকা মূল্যের ইলিশটার মধ্যে। রাখালের মাথা ঘুরছিল। ও হাতের ছবিটা নামিয়ে রেখে মাধবীর নাম ধরে ডাকল কিন্তু গলা দিয়ে এতটুকু আওয়াজ বেরুল না। আর বেরোলেও মাধবীর তা শোনার মতো ক্ষমতা ছিল না, কারণ ভয়ে আর আতঙ্কে মাধবী ততক্ষণে ইলিশের চোখ দুটো বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে কোটর থেকে বার করে ফেলেছে। আর অসাড় হয়ে দেখছিল কীভাবে চোখ দুটো গড়াতে গড়াতে ঢুকে গেল ওদের ঘরে। যেন ঢালু জমিতে গড়িয়ে দেওয়া কাচের গুলি সমানে ধেয়ে যাচ্ছে।
রাখাল দেখল গুলির মতন গড়াতে গড়াতে মাছের চোখ দুটো এসে ঢুকে পড়ল ঈশ্বরীর চোখের কোটরে। আর অমনি ছবিটা একেবারে পূর্বের সেই চেহারায় ফিরে গেল। নতুন বর রাখালের পাশে নতুন বউ ঈশ্বরী বসে। বড়ো বড়ো পটলচেরা চোখে সলজ্জভাবে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার লেন্সের দিকে।
ছুরিকাঘাত
জগুদার হাতের লম্বা ছুরিটার সঠিক বর্ণনা আমি আর দিতে পারব না। ফলাটা নিশ্চয়ই ছ ইঞ্চির একটু ওপরেই ছিল, কিন্তু সেটা তার বিশেষত্ব ছিল না। শহরের সব মস্তানই যখন তাদের চাকুর ব্লেডগুলোকে দু-আঙুলে টিপে ঘ্যাড়ঘ্যাড়, খ্যাড়খ্যাড় করে টেনে বার করত খাপ থেকে, জগুদা তখনই ঝটকা মেরে ছুরিটা তুলে আনত কোমর থেকে। আর তারপর তার চিতাবাঘের মতন চোখ যখন দপদপ করে জ্বলতে থাকত, আতঙ্কের সম্মোহন বিস্তার করত প্রতিদ্বন্দ্বী মস্তানের ওপর, ততক্ষণে তার ডান হাতের তালুর মধ্যে ক্লিক করে ধাতব শব্দ উঠত। আর অমনি অটোম্যাটিক্যালি, ছ-ইঞ্চিরও বাড়তি দৈর্ঘ্যের ফলাটা কড়াৎ করে বেরিয়ে আসত খাপ থেকে। ছুরির এই স্বয়ংক্রিয় ঔদ্ধত্য সে-সময় বহু মস্তানের হৃৎপিন্ডে দারুণ ধাক্কা দিত ভয়ের। আমরা বহু মস্তানকে সে-সময় হতবুদ্ধি থাকতে দেখেছি শুধুমাত্র এই ছুরির ফলাটার দিকে।
তবে জগুদা কখনো ওই ছুড়ির ভড়কির সুযোগে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে আঘাত করেনি। কারণ জগুদার আস্থা ছুরির চেয়েও বেশি ওর নিজের দেহের শক্তি ও কবজির কায়দার ওপর। তা ছাড়া পূর্বের দিনের মস্তানদের মতন জগুদার ভেতরও অনেকখানি ন্যায়পরায়ণতা ও আত্মম্ভরিতা কাজ করত। একবার চাকু খুললে প্রতিপক্ষের কিছুটা রক্তপাত না ঘটিয়ে সে ছাড়ত না। অথচ পরাস্ত প্রতিপক্ষকে প্রাণে মারারও ঘোর বিরোধী ছিল জগুদা। বহুদিন মস্তানির সুযোগ না পেলে জগুদা দুপুরে স্নানের আগে গায়ে তেল মেখে হাতে ছুরি নিয়ে শ্যাডো-ফাইটিং করত। আমরা পাড়ার বালকরা, বহুবার জগুদার কাছে, ওর ছুরিটা দেখার বাসনা ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু ওই একটা ব্যাপারেই জগুদার স্বভাবত স্নেহশীল প্রাণটাকে টলানো যায়নি।
আমরা জগুদার ছুরিটা হাতে নিয়ে কখনো দেখিনি, কিন্তু দূর থেকে অনেকবার দেখেছি, এমনকী ইন অ্যাকশান। কারণ পাড়ায় তখন মাসে, দু-মাসে একটা না একটা মস্তানির ঘটনা ঘটতই। দলবদ্ধভাবে কোনো অভিযানে গেলে জগুদা রিভলবার, সোর্ড, লাঠি নিয়ে বেরোত। আশপাশের বহু পাড়াকে জগুদা এমনভাবে ঠাণ্ডা করে রেখেছিল। কিন্তু অন্য কোনো উঠতি বা ডাকসাইটে মস্তানের সঙ্গে জগুদা মুখোমুখি ডুয়েল পছন্দ করত। এবং এভাবে বহু মস্তানকে রাস্তায় পেড়ে ফেলে তার টুটি টিপে জগুদা তাকে ক্ষমা চাওয়া ও নতি স্বীকার করিয়েছে। ছুটির দিন দশটা এগারোটা নাগাদ, কিংবা এমনি দিনে পড়ন্ত দুপুরে এইসব লড়াই জমত পাড়ায়। তখন পাড়ায় মান্যগণ্য ব্যক্তিরা পুলিশে ফোন করার বদলে বারান্দায় ঝুঁকে এই গ্ল্যাডিয়েটরীয় যুদ্ধ দেখায় মেতে উঠতেন।
বলা বাহুল্য, জগুদা আমাদের হিরো ছিল। এবং জগুদা কখনো কোনো ব্যক্তিগত, সম্মুখ সমরে হারেনি, বা পেছপা হয়নি। ছুরি ছাড়াও জগুদা বহুবার খালিহাতে লড়েছে। এবং তেমন ক্ষেত্রেও রক্তপাত কিছু কম ঘটেনি।
ছেলেবেলা থেকেই রক্ত দেখলে আমার মাথা ঘোরে, শরীর কাঁপে। কিন্তু মন ও শরীরে কোনো বিপত্তিই আমাকে জগুদার লড়াই দেখা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। প্রথম প্রথম যে মাথা ঘোরেনি তা নয়। কিন্তু ক্ৰমে ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেল। এবং আরও কিছুদিন যেতে সেটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। যে আমি ইশকুলের মিসট্রেসের আঙুল বেয়ে রক্ত গড়াতে দেখেলে প্রায় ভিরমি খেতাম সেই আমিই তখন অপার আহ্লাদে পাড়ার মস্তানি দেখছি। সে আহ্লাদ কিছুটা যেন টারজেনের ছবি দেখার মতন। লড়াই দেখার মুহূর্তে আমি নিজেও তখন মনে মনে জগুদা। জগুদার ছোড়া প্রত্যেকটা ঘুষি কিংবা চাকুর চালের সঙ্গে কিছুটা মিশে যাচ্ছে আমার নিজের শক্তি ও কল্পনা। জগুদার শরীর লক্ষ করে নিক্ষিপ্ত তার প্রতিপক্ষের কিছু কিছু আঘাতও যেন আমার গায়ে এসে পড়ছে।
একেক দিন আমরা সকাল থেকেই খবর পেয়ে যেতাম অমুক পাড়ার তমুককে পাড়ায় এনে পিটবে জগুদা। সেদিনটা তৎক্ষণাৎ পাড়ার ছেলেছোকরাদের কাছে উৎসবের দিন হয়ে যেত। আমরা আকাশের সূর্যের দিকে তাকিয়ে গভীর প্রত্যাশায় থাকতাম কখন দিনমণি পশ্চিমে কিছুটা হেলে পড়ে যুদ্ধের সময় আগিয়ে আনবেন। আমরা নিজেদের মধ্যে জল্পনাতেও ব্যস্ত হতাম মল্লবীর দারা সিং-এর সঙ্গে আখড়ায় নামলে জগুদা বিজয়ী হবে কি হবে না। কিন্তু জগুদার পকেটের স্বয়ংক্রিয় ছুরিটির কথা ভাবলে আমরা নিজেরাও মনে মনে শিউরে উঠতাম। জগুদার খোলা ছুরির সামনে আমরা নিরস্ত্র দারা সিংকেও ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম না।
সেদিনও এমনি একটা শীতের সকাল। হয়তো ছুটির দিন। আমরা খবর পেলাম জগুদাকে ফাইটে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বেপাড়ার উঠতি মস্তান কেলে বিশে। কেলে বিশে আমরা শুনেছিলাম রোগা, লম্বা ও বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন। তাকে মুঠোয় আনা কোনো মানুষের কম্ম নয়। তার হাতে ছুরিও খেলে বিদ্যুতের মতন। এতাবৎ সে অনেক মস্তান ও পুলিশ অফিসারের দেহে তার হাতের সূক্ষ্ম কাজের প্রমাণ রেখেছে। কিছু নরহত্যার দাবিও সে করে থাকে। সে এখন জগু সিংহকে তার পয়লা নম্বর শত্রু মনে করে। তাই ছুরি মোলাকাতে আসবে।
আমাদের পাড়ার সবারই রক্তের গতি সেদিন ভয়ানক দ্রুত হয়ে গেছিল। আমাদের মধ্যে অনেকে এ মতও পোষাণ করতে শুরু করেছিল যে জগুদা হয়তো শেষমেশ কেলে বিশেকে বাগে আনতে পারবে না। হয়তো আহত হবে, নচেৎ আসর ছেড়ে সরে দাঁড়াবে। একমাত্র নির্বিকার ছিলাম আমরা। যাদের কাছে জগুদা চাকু হাতে টারজেন, চাবুক হাতে জোরো কিংবা অন্য কোনো কমিক স্ট্রিপের হিরো। জগুদা হারছে, এমন কথা আমাদের কোনো গল্পের বই বা কমিকসে লেখা নেই।
আমি শুধু উৎকণ্ঠার সঙ্গে নজর করছিলাম আকাশের সূর্যটাকে। কখন সেটা রঞ্জুদের বাড়ির পিছনে হেলে পড়বে। আমি ধৈর্যহীনতার বশে একবার রাস্তায় গিয়ে উঁকি দিয়েছিলাম এবং তার বাড়ির সামনে পায়চারিরত জগুদার কোমরে ছুরিটা দেখে নিশ্চিন্তও হয়েছিলাম। চার্চিলের মতন দুটো আঙুল দিয়ে বিজয় চিহ্ন ‘ভি’ এঁকে দেখিয়েও ছিলাম জগুদাকে। জগুদা সে-দৃশ্য দেখেছিল কি না মনে নেই। তবে জগুদাকেও সেদিন অযথা উত্তেজিত বলে মনে হয়নি। সে শুধু হাওয়ার মধ্যে বোলারদের মতন তার দুটি হাত লম্বা করে সামনে পিছনে ঘোরাচ্ছিল। যেন এইমাত্র ভিনু মাঁকড়কে একটা ইন-সুইংগার নিক্ষেপ করবে। কিন্তু আসলে, জগুদা ওর হাতটাকে একটু ব্যায়াম করাচ্ছিল।
কখনো কখনো ওর ঝাঁকড়া কেশরাশি ঝাঁকিয়ে নিচ্ছিল জগুদা। আর অদূরে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য এক নাগাড়ে চোখ দিয়ে পান করছিল জনা ত্রিশেক ছেলেছোকরা। এপাড়ার ও আশেপাশের এলাকার উঠতি মস্তানরা।
শীতের দিন বলে সূর্যদেব আমাদের বেশিক্ষণ প্রতীক্ষায় রাখেননি। তাড়াতাড়ি হেলে পড়লেন রঞ্জুদের বাড়ির পিছনে। রোমানদের আমল হলে একটা ভেরি বেজে ওঠার প্রয়োজন হত। সেদিন সেই কাজটা করল ছনাদা। একটা ফুটবলের বাঁশি জোগাড় করে বার কয়েক বাজিয়ে দিল। ইতিমধ্যে শতখানেকেরও বেশি লোক জমে গেছে আমাদের বাড়ির সামনে। আমার উকিল বাবা পাড়ার এই নিয়মিত এন্টারটেনমেন্টের ব্যাপারে ছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ। বাড়ির সামনে অত ভিড় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে অত ভিড় কীসের? কিন্তু সত্যি কথাটা বলার সাহস আমার কোনো মতে জোগাল না। পাছে আমায় নিযেধ করেন রক্তারক্তি ব্যাপার দেখায়। আরও মুশকিলের হবে বাবা যদি রাস্তায় গিয়ে জগুদাকে লড়াই করতে বারণ করেন। জগুদা বাবার খুব অনুগত, মামলায় জড়ালেই বাবার কাছে পরামর্শ নেয়। বাবা বললে জগুদা কিছুতেই লড়বে না।
অথচ জগুদা না লড়লে গোটা পাড়ার সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। অগত্যা বাবাকে বললাম, বাবা, আজ এখানে ভাল্লুক খেলা হবে। বাবা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভাল্লুক খেলা?
বাবা তখন বিরক্তির মুখ করে বললেন, দিন দিন পাড়ার বাড়ি লোকগুলো সব গাধা হয়ে যাচ্ছে। ধুত্তোর! এই বলে বাবা খড়মের খটখটাশ আওয়াজ করে নিজের সেরেস্তায় চলে গেলেন! আর ঠিক তখনই রণাঙ্গনে উপস্থিত হল উঠিত রংবাজ কেলে বিশে।
আমি গুটি গুটি বাড়ির গ্যারেজের ছাদে গিয়ে বসলাম। আর এক লহমা কেলে বিশেকে দেখে আমার রক্ত হিম হওয়ার জোগাড় হল। প্রায় ছ-ফুট লম্বা কালো জল্লাদের চেহারা তার। একরাশ কোঁকড়া চুল। ঠোঁট দুটো পান খেয়ে রক্তের মতন লাল। চোখ দুটো অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতন। ওরকম দড় পাকানো শরীরে হালকা সিল্কের সাদা সার্ট। কালো প্যান্টটা ওর এতই আঁটো সাঁটো যাতে মনে হয় ওকে পরিয়েই সেটার সেলাইকর্ম করা হয়েছে। কোমরের বেল্টটা চওড়া, তাতে কয়েকটা লোহার বন্টু আঁটা আছে। আর ওর পা চাপা, কোমর ঠাসা প্যান্টের হিপ পকেট থেকে বেরিয়ে আছে ওর চাকুর বাঁট। ও একটা হুংকার ছেড়ে চার পাঁচজন দর্শককে গোঁত্তা মেরে ঢুকে পড়ল লড়াইয়ের আখড়ায়। সেখানে ততক্ষণে খালি গায়ে তার ট্রাউজারে উদাস নেত্রে দাঁড়িয়েছিল জগুদা।
বিশে সড়াক করে ওর চাকু বের করল। তারপর ছুরির ভোঁতা দিকটা দিয়ে কপালের কিছুটা ঘাম আঁচড়ে স্বেদবিন্দুগুলো ছিটকে দিল দর্শকদের গায়ে আর মুখে বলল, জগু, আজ তুমি থাকবে আর না হয় আমি।
এবার জগুদার তৈরি হওয়ার পালা। জগুদা ওর উদাস দৃষ্টিকে ক্ষণিকের মধ্যে চিতা বাঘের মতন হিংস্র করে বলল, কালকা যোগী, আগে বাঁট সিধে করে ধর। বিশে ওর বাঁটের দিকে তাকাতে জগুদা নিমেষের মধ্যে কোমর থেকে বার করে ফেলল ওর ছুরিটা। কিন্তু সেটাকে না খুলেই তেড়ে গেল বিশের দিকে। বিশে জগুদার মুখ লক্ষ করে চাকু চালাল, কিন্তু জগুদা বসে গিয়ে আঘাত এড়াল। বিশে ফের নিজেকে সোজা করার আগে জগুদা ওর বিশাল বাঁ হাতটা দিয়ে ওর চুলের মুঠি ধরে ওকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেল ফুটপাথের দিকে। কিন্তু, তখনও জগুদা ওর চাকু খোলেনি। উলটে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে জগুদা ওর চাকুটা ফের গুঁজে নিল কোমরে। আর ভারমুক্ত ডান হাত দিয়ে বিশের চোয়ালে একটা ঘুষি মারল। বিশে ছিটকে পড়ল সানের ওপর। আর তখনই ওর গলার ওপর হাঁটু টিপে বসে পড়ল জগুদা।
যতদূর মনে পড়ে সেসময় বিশের গলা দিয়ে কান্নার মতন একটা ধ্বনি নিঃসৃত হয়েছিল। কেন? কেননা ওর গলার ওপর হাঁটু গেড়ে বসার পর জগুদা আস্তে আস্তে ওর প্রিয় ছুরিটা বার করে ‘ক্লিক’ ধ্বনি সৃষ্টি করে ছুরির ব্লেডটাকে পড়ন্ত রোদের আভায় লাল করে তুলেছিল। বিশে বুঝেছিল ওই ছুরি রক্ত পান না করে খাপে ফিরে যাবে না।
‘জগুদা, বাঁচাও। বলে একটা ডাকও ছেড়েছিল বিশে। সেই মুহূর্তে জগুদার মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছিল কেলে বিশেকে খুন করতে চায় সে। কিন্তু আত্মসমর্পণ করার পরেও জগুদা কাউকে মেরেছে বলে শুনিনি। কিন্তু সেদিন যেন নিয়মভঙ্গ হতে চলেছিল। জগুদা তার ছুরিটাকে মুড়ে ফেলল না। কিন্তু বুকে স্ট্যাব না করে হালকা ভাবে বিশের গলা থেকে নাভি অবধি ক্ষত এঁকে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে টান-টান হয়ে পড়ে থাকা কেলে বিশের মুখের উপর থুতু দিয়ে বলল, শুয়ারের বাচ্চা চাকু খোলা অব্দি টিকতে পারলি না শালা মস্তান।
জগুজা রণাঙ্গন ত্যাগ করার পরও বহুক্ষণ রাস্তায় শুয়েছিল কেলে বিশে। আস্তে আস্তে ওর সাদা শার্ট ভেদ করে ফুটে উঠল একটা দীর্ঘ রক্তের রেখা। সে-রেখা ক্রমশ জেবড়ে যেতে থাকল গোটা বুকে ছড়িয়ে গিয়ে। তারপর একসময় ওর জনা চারেক সাঙ্গপাঙ্গ যখন ওর ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরটা কাঁধে চাপিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হল তখন সূর্য অস্তাচলে। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে ব্যাপক জয়োল্লাস, যেন আমাদের ফুটবল টিম শিল্ড জিতে এসেছে। কিন্তু আমার নজর তখনও আটকে আছে কেলে বিশে যেখানে শুয়েছিল তার সামান্য দূরে রাস্তার ড্রেনের ঝাঁঝরিটার দিকে। সেখানে তখনও খোলা অবস্থায় পড়েছিল জগুদার রক্তমাখা ছুরিটা। বিশেকে ক্ষতবিক্ষত করে সেটিকে তাচ্ছিল্যের হাসির সঙ্গে জাগুদা ছুড়ে দিয়েছিল নর্দমার দিকে। যাতে মনে হয় জগুদা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল বিশের প্রাণ না নিলে ওই ছুরি সে বাড়ি নিয়ে ফিরবে না।
আশ্চর্য, কেউ কিন্তু সেটা যথেষ্ট নজর করেনি। তাই লড়াই শেষ হতে সবাই হই হই-তে মাতল, কেউ ওই সাধের ছুরিটা একবার তুলে নিয়ে পরখ করল না। আমি বুঝেছিলাম আমার এটাই একমাত্র সুযোগ ছুরিটাকে অন্তত স্মৃতি হিসেবে হস্তগত করার। তাই সবাই যখন তখনও সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের উন্মাদনা ও বিশ্লেষণে মত্ত আমি চুপচাপ গ্যারেজের ছাদ থেকে নেমে গেলাম রাস্তায়। আর ড্রেনের কাছে উবু হয়ে পেচ্ছাব করার ভণিতা করে কুড়িয়ে নিলাম ঐতিহাসিক চাকুটা। তারপর নিঃশব্দে বাড়ি ফিরে সেটিকে ধুয়ে ফেলে বিশের রক্তমুক্ত করে ছাদের চিলেকোঠায় পায়রার বাসার পিছনে খড় চাপা দিয়ে এলাম। এসব বহু আগের কথা। তারপর বহু জল গড়িয়েছে গঙ্গা দিয়ে। আরও ঢের রক্তপাত ঘটে গেছে আমাদের পাড়ায়। মস্তানির উত্থান-পতন ঘটেছে, রাজনীতির রং ও ঢং বদলেছে, জগুদার গৌরবের দিন অস্তমিত হয়েছে বহুকাল। আরও বহু মস্তান জেগেছে, কিন্তু তারা কেউ জগুদার ছিটেফোঁটা মর্যাদাও পায়নি। বহুদিন হল বাবা পরলোকগমন করেছেন এবং ওই পাড়ার বাড়ি বিক্রি করে আমরা অন্য পাড়ায় চলে এসেছি। বাবার বহু শখ ছিল আমি বিলেতে যাব, ব্যারিস্টার হব, কিন্তু আমি ভীত হয়েছি। বাবা অনেক কিছুই চাইতেন, কিন্তু আমি কোনো কিছুই হইনি। আমার ওপর রাগ করলে বাবা বলতেন, শেষকালে তোকে জগুর দলেই ভরতি হতে হবে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি টের পেয়েছি যে, আমার সেইটে হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই। আমি যথাকালে দর্শনের অধ্যাপক হয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে এক কলেজে যোগ দিলাম। আমার একটিমাত্র সুনাম সমাজে রটেছিল—আমি অত্যন্ত ভদ্রলোক। বাড়ির চাকর রাখলে প্রথমে দু-দশদিন ‘আপনি’ করে কথা বলি। পাশের ঘর থেকেও কেউ কোনোদিন আমার কণ্ঠ শুনতে পাবে না। এমনকী কলেজেও ক্লাস নিলে পিছনে বসা ছাত্রছাত্রীরা আমার গলা শুনতে পায় না। তারা তখন নিজেদের গল্পগুজবে মন দেয়। তাদের চেঁচিয়ে বারণ করা মতন কণ্ঠশক্তিও আমার নেই।
এবং এরকম পরিস্থিতিতে একজন মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক কী করেন? তিনি তাঁর যাবতীয় লাঞ্ছনা ও অমর্যাদার প্রতিশোধ নিতে গল্প, উপন্যাস লেখায় ব্রতী হন। এবং আমিও তাই হলাম। তেমন আহামরি সাহিত্য রচনার ক্ষমতা আমার নেই, তাই নিজের পক্ষে যতখানি জটিল করে কিছু লেখা যায় আমি সেই চেষ্টাই করলাম। কিছু সম্পাদকের ধারণা হল আমি একেবারে প্রথম শ্রেণির জিনিয়াস। কারণ আমি লিখতাম মানুষের জটিল মনস্তত্ব নিয়ে, যার সম্পর্কে আমার কোনো জ্ঞান আছে কি না আমারও সন্দেহ, সমাজের নীচুতলার মানুষের হাহাকার নিয়ে (এই দ্বিতীয় ব্যাপারটি ছিল ওই জাতের ওপর আমার সবচেয়ে বড়ো ধোঁকাবাজি)। যা জানি না তাই লিখতাম বলে আমার স্পর্ধারও অন্ত ছিল না। শেষে একদিন আমার গুণমুগ্ধ এক সম্পাদক এসে বললেন, রাজীববাবু দলিত সমাজের ওপর আপনার লেখাগুলো এত চমৎকার হয়, তাই একটা অনুরোধ জানাতে এলাম। আপনি কলকাতার গুণ্ডা-মস্তানদের নিয়ে একটা উপন্যাস আমাকে দিন। যত সময় লাগে নিন, কিন্তু দিন।
এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না, সেদিন আমার শিরদাঁড়া দিয়ে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে লাগল। মানছি, আমি গরিব মানুষের সমাজ নিয়ে কিছুই জানি না। মানছি আমি বানিয়ে লিখি, এবং তেমন ভালো বানাতেও পারি না। এ দেশে এই ভাষায় এইসব ফালতু লেখা চলে। কিন্তু মস্তানি! আমি তো মস্তানদের দেখেছি। তাদের জগৎ তো আমার চেনা। এখন না হয় বহুদিন আমি ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। তা হলেও ওদের নাড়িনক্ষত্র সবই তো আমার নখদর্পণে। আমি সত্যি তো ওদের চিনতাম! আমি ওদের নিয়ে বানাব কী করে? ভালো করে কিছু জানলে তাই কি লেখা যায়? অন্তত আমি কি লিখতে পারি?
সম্পাদক মহাশয় চলে গেলে আমি আমার পুরোনো বইয়ের আলমারির একটা খাঁজ থেকে জগুদার ছুরিটা বার করলাম। কালে কালে এর সমস্ত বিশেষত্ব চলে গেছে। এখন বোতাম টিপে এই ছুরি খুললে একটা ছ-বছরের শিশুও অবাক হবে না। বড়ো কথা এটাকে টিপলেও হয়তো ফলাটা বেরুবে না, কারণ ব্লেডের আশপাশে মরচে ধরেছে। আমি ছুরিটা নিয়ে তেল দিয়ে রগড়ে এর চেহারা ও স্বভাব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। সামান্য চেষ্টাতেই ছুরির তেজ ফিরল, কিন্তু তার মধ্যে কিছু বিশেষত্ব ধরা দিল না, যাতে কিনা কাউকে ডেকে বলা যায়—দ্যাখ, জগু মস্তানের ছুরি! কিংবা এই কথাটুকুও কেউ মেনে নিলে তাকে বলা যায়, এতে ঢের ঢের মস্তানের রক্ত লেগেছে! এত দিন পরে বার করে বুঝলাম যে, আমার নিজের কাছেও এই চাকুর রহস্য হারিয়ে গেছে।
কিন্তু আমি ছুরিটাকে ফের আলমারিতে চালান দিলাম না। আমি কলেজ যাওয়ার সময় সেটিকে পকেটে নিয়ে বেরুলাম। এবং সেদিনই জীবনে প্রথম ক্লাসের দু-চারটে বেয়াড়া ছেলেকে গলা ছেড়ে বকুনি দেওয়ার নতুন সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম। দেখলাম তাতে আমার অনুরক্ত ছাত্র-ছাত্রীরাও রীতিমতন মুগ্ধ বোধ করল। কলেজ শেষ করে আমি বাড়ি ফিরলাম না। এক কুখ্যাত মদের আড্ডায় দু-পাত্র মদ পান করতে গেলাম। সমাজে আমার অনেক ভদ্রলোক হিসেবে সুখ্যাতি হলেও এইসব জায়গা যে আমার কাছে পুরোপুরি অচেনা ছিল তা কিন্তু নয়। কলকাতা আসলে খুব বড়ো শহর। একপ্রান্তের এলাকায় চরিত্র স্খলন হলেও অন্য প্রান্তের বাসিন্দাদের কাছে তা খুবই অটুট রাখা যায়। আমি বহুবারই অবাক হয়ে ভেবেছি যে, শুড়িখানার বহু তাৎক্ষণিক বন্ধুদের দিনমানে আর অন্য কোথাও কখোনো দেখিনি কেন? নাকি আমি চোখে কম দেখি বা দেখেও চিনতে পারি না? আমার বরাবরই ভয় ছিল যে, মাঝেমধ্যে আমি যেসব পল্লিতে যাই সেই খবরও আমার কলেজে পৌঁছে যাবে। ছাত্র-ছাত্রীদের গার্জেনদের কানে উঠবে। তাও ওঠেনি। অর্থাৎ আমার দিনের এবং রাতের জীবনের মধ্যে দিন ও রাতের মতনই একটা দুস্তর ব্যবধান থেকে গেছে।
আর আজ আমি মস্তান অধ্যুষিত এই মদের আখড়ায় এলাম কারণ আমাকে মস্তানদের নিয়ে গবেষণা করতে হবে, কিছু লিখতে হবে। আমি রাজীব মিত্র, জগুদার পাড়ার মানুষ, জগু সিংহের একনিষ্ঠ ভক্ত। আজ মস্তানদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এলাম। কারণ মস্তান বিষয়ে যা আমি জানি তা জীবনেও লিখে দাঁড় করাতে পারব না। সত্য কথা দিয়ে সাহিত্য করার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই আমার। অতঃপর না জানি সে সবকে ভোলার জন্যই নতুন করে কিছু শিখতে হবে।
আমি একটা বাংলা পাঁইট টেবিলে রেখে কিছু ছোলা আর লেবুর রসের ফোঁটা মেলাচ্ছিলাম। যা আমার কখনো হয় না আজ আমার তাই হল। এক গেলাস গেলার আগেই নেশা নেশা ভাব হল। আমি ইতিউতি তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আজকাল কারা মস্তান, তাদের চেহারা আর চরিত্র কেমন। তারা কী ভাষা বলে। কিন্তু যতই দেখছিলাম একটা ক্লান্তি ও হতাশা আমার মনের মধ্যে ছেয়ে যাচ্ছিল। আমি বুঝছিলাম যে, এইসব কালকা যোগীদের নিয়ে উপন্যাস লেখা আমার দ্বারা হবে না। কারণ আমি সত্যিকারের মস্তান চোখে দেখেছি। তাদের চিনেছি, আর ভালোবেসেছি। জীবনে এই প্রথমবার হয়তো আমাকে সম্পূর্ণ বাস্তব থেকে সংগ্রহ করে একটা উপন্যাস লিখতে হবে এবং এইবারেই প্রথম সব সম্পাদকরা এককাট্টা হয়ে ঘোষণা করবেন, এ কিছু হয়নি। এ অতিবাস্তব অতিনাটকীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে ওই সত্যগুলোই লিখতে হবে। শুধু আমার লেখার জন্য ওই স্মৃতি ও সত্যগুলো আছে।
আমার পাঁইট শেষ হয়ে এসেছিল। আর একটা আনব বলে উঠতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ওঠার আর দরকার হল না, তার আগেই শুড়িখানায় ধুন্ধুমার কান্ড। গত রাত্রের এক ঝামেলার বদলা নিতে বেপাড়ার মস্তানরা রেড করেছে। এই আড্ডায় একেকজন মস্তানকে একেক করে তুলছে আর পিটছে। আমার চারপাশে বসে থাকা মস্তানগুলো দুদ্দাড় করে পালাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু গেটের মুখেই ধরা পড়ে পিটুনি খাচ্ছে। রডের বাড়ি, চেনের চাবকানি খাচ্ছে। দোকানদার ঝাঁপ বন্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। হঠাৎ একটা জোরালো কণ্ঠস্বর ভেসে এল বাইরে থেকে। ভদ্রলোক যাঁরা আছেন আপনারা বেরিয়ে আসুন। কারো গায়ে হাত তোলা হবে না। অপনারা দেরি করবেন না। আমরাও ভদ্রলোক।
এই আওয়াজে অবশিষ্ট সমস্ত খদ্দেরই প্রায় ভদ্রলোক সেজে বেরুতে লাগল। আমি তাদেরই একজনের গোটা পাঁইট হাতিয়ে একদৃষ্টে টেবিলের দিকে তাকিয়ে চুক চুক করে মদ খেতে থাকলাম। আমি সমস্ত জোর দিয়ে মনকে বোঝালাম, আমি ভদ্রলোক নই। এক সময়ে পকেট থেকে জগুদার ছুরিটা বার করলাম, ওটার মান বজায় রাখতে হবে। কারণ শুড়িখানার বাইরে থেকে যে হুংকার এইমাত্র শুনেছি, সেটা আমার স্মৃতি বলছে কেলে বিশের ডাক।
আমি একা বসে আছি, বাইরে লঙ্কাকান্ড চলছে। কেলে বিশে শোর তুলেছে এই ভাটিখানা লন্ডভন্ড করবে। দোকানের মালিক এক কোণে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে। তাদের দিকে আমি তাকাইনি। কিন্তু ওদের দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ আমি পাচ্ছি। আমাকে হয়তো ওরা পাগল কিংবা মৃত বলে ঠাউরে নিয়েছে।
কেলে বিশের এক অনুচর ভেতরে উঁকি মেরে ঘোষণা করল, বিশেদা, ঠেক ফাঁকা। শুধু এক শালা ভদ্দরলোক বসে মাল টানছে। বিশে বলল, বার করে দে ওকে। তারপর কী ভেবেই বলল, তুই থাক, আমি যাচ্ছি। তোরা শালা ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্যবহার করতে জানিস না।
আমার কাঁধে একটা মৃদু টোকা পড়েছে। একটা ভদ্র আহ্বান, দাদা বাড়ি যান। কিন্তু এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমার শরীর আর মাথা রাগে কাঁপছে। আমার সামনে বাল্যের দেখা সেই বিশে মস্তান। ছ-ফুটেরও বেশি লম্বা! কিন্তু সেই কালো ঝাঁকড়া চুল আর নেই। সেখানে মস্ত টাক আর টাকের চারপাশে গোল হয়ে সাদা কোঁকড়া চুলের অপসৃয়মান রেখা। বিশের মুখে বুকে কাটা-ছেড়া দাগ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর গোঁফ। চোখের সেই চাহনি আর নেই। ছিপেছিপে শরীর মোটা কদাকার, চর্বির ঢিপি। আর নোংরা জালি গেঞ্জির নীচে ঢলঢলে ট্রাউজারটাও বিবর্ণ। কিন্তু আমি যা দেখতে চেয়েছিলাম সেটা বলা চলে অক্ষতই আছে অর্থাৎ জগুদার ছুরি দিয়ে গলা থেকে নাভি অব্দি এঁকে দেওয়া ক্ষত।
আমি জগুদার মতন হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছি বিশের চোখ লক্ষ করে। ঠিক জগুদার মতন অবলীলায় ‘ক্লিক’ ধ্বনি করে তার ছুরিটা খুলে ফেলেছি। আর বলছি, বিশে তোমার মনে পড়ে এই ছুরি? নাহলে নিজের বুকের দাগটা একবার দেখে নাও। কোন সাহসে তুমি শালা আমাকে ভদ্দরলোক ভেবে টিটকিরি দাও। রুস্তমি দেখাতে চাও তো বার করো চাকু!
জগুদার মুঠিতে যেমন, এখন চাকুটা সেইরকম রাগী হয়ে উঠেছে। ও কিছু রক্তপান করবেই। ও যেন আপনা থেকেই কেলে বিশের দিকে এগোচ্ছে। আমি শুধু ওকে ধরে আছি। আমি হাত ঘুরিয়ে দিকপরিবর্তনও করতে পারছি না। আমি মুঠো খুললেও বুঝি ও হাত থেকে পড়ে যাবে না। কেলে বিশেও একে চিনেছে। তাই একটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে সে। বিশে তার বাঁহাত দিয়ে ওর সাঙ্গপাঙ্গদের নিষেধ করছে। আর মুখে শুধু বলছে, দাদা আপনি ভুল করছেন। আপনাকে আমি মারতে আসিনি। আপনাকে তো আমরা চিনি। নামকরা লেখক আপনি। ছিঃ। আপনি আমাদের এত ছোটোলোক ভাবছেন?
ছুরির সঙ্গে সঙ্গে আমিও বেরিয়ে এসেছি অন্ধকারে, এখনও ছুরিটা হাত থেকে খসেনি। জগুদার ছুরি রক্ত পান না করে ক্ষান্ত যায় না। আমি আমার বাঁহাতে একটা খোঁচা দিলাম ফালাটা দিয়ে। ভীষণ যন্ত্রণায় একটা ‘আঃ’ ধ্বনি বেরিয়ে এল আমার। চাকুটাও যথারীতি ছিটকে গিয়ে পড়ল একটা ড্রেনের ঝাঁঝরির পাশে যেরকম একটা জায়গা থেকে ওকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম বহুকাল পূর্বে।
ছোট্ট একটু রাত্রিসংগীত
আজ সকালেও ২৭ কি ২৮ ডিসেম্বর, ট্রিনকাসের ব্যাণ্ডের ছেলেগুলো এসে ধরেছিল, সনি, প্লিজ এই একটা মাস বাজিয়ে দাও। ক্লায়েন্টরা মিস করছে তোমার বাজনা। এভরিওয়ান ইজ আস্কিং, হোয়্যার ইজ লোবো? রিয়েলি, ইউ কান্ট ডু দিস টু আস!
লোবো বসেছিল ওর দোতলার ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে। সিঁড়িটা ফ্ল্যাটের বাইরে দিয়ে তিনটে বাঁকে নেমেছে। রাস্তা থেকে উঠতে প্রথম যে বাঁকটা, ওইখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল বাবা, টোনি লোবো, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে। প্রথমে বুক চেপে ধরল, একটা প্রবল চিৎকার দিল ‘সনি!’ আর তারপর ওই যে শুয়ে পড়ল সিঁড়িতে আর উঠল না। বড়ো বড়ো, ঢেলা ঢেলা চোখে মাতাল বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল রাতের আকাশে তারামন্ডলীর দিকে। সনি গিয়ে যখন মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, কী হল, বাবা? শরীর খারাপ করছে? বাবা আঙুল তুলে তারা দেখিয়ে বলল, ওরা আমায় ডাকছে, সনি। তারপর ওই তারা দেখতে দেখতে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল।
সিঁড়ির দ্বিতীয় বাঁক থেকে শেষ হাত নেড়েছিল প্রিসিলা। ওহ কী অপূর্ব হাত নাড়ার দৃশ্য সেটা, লোবো কোনো দিনও ভুলবে না। দৃশ্যটা মনে মনে তারিফ করতে করতে কী আফশোস তখন ওর—শিট! কেন আমার একটা ক্যামেরা নেই দৃশ্যটাকে ধরে রাখার জন্য! জড়িয়ে ধরে আদর, চুম্বন ও চোখের জলের পালা তো শেষই হয়ে গিয়েছিল, হাত নাড়ার বাইরে আর তো কিছু করার নেই তখন। বাইরে গেটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, প্রিসিলা হাওড়া স্টেশনে যাবে। সেখান থেকে বম্বে। একটা শীতের মরসুমের জন্য ও গাইবে বম্বের শেরাটনে। তারপর ফিরে এসে…
না, ফিরে এসে বিয়েটা হয়নি লোবোর সঙ্গে, কারণ প্রিসিলা ফিরেই আসেনি। পরিবর্তে একটা চিঠি এসেছিল :
প্রিয়তম সনি, এই চিঠি পড়ে তোমার বুক ভেঙে যাবে জানি। তবু লিখছি, কারণ তোমাকে আমি এখনও সেভাবেই চাই যেভাবে বিদায়ের দিনে চেয়েছিলাম। আমি জানি কলকাতা ছেড়ে আসা তোমার পক্ষে নিঃশ্বাস নেওয়া ছেড়ে দেওয়ার মতন। তবু বলছি, প্লিজ বম্বে এস, শুধু আমার জন্য। আমাদের ভালবাসার জন্য। এখন আর কী আছে কলকাতায় তোমার? তোমার মা তো দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন বৃদ্ধাবাসে। মাঝেমধ্যে আমরা নিশ্চয়ই কলকাতা ফিরব, ওঁকে দেখব, সব বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে মিশব, একটু-আধটু গান-বাজনা করব ট্রিনকাস, মুল্যাঁ রুজ, প্রিন্সেসে…কী বলো? কলকাতা চিরকাল আমাদের কলকাতাই থাকবে। কিন্তু এখন, ফর নাও প্লিজ চলে এসো বম্বে। যা-কিছু ঘটার সব এখানেই ঘটছে, আমাদের গান-বাজনার জন্য টাকা উড়ছে হাওয়ায়, এখান থেকে এঙ্গেলবার্ট হাম্পারডিঙ্ক নামে একটা ছেলে লণ্ডনে গিয়ে কী নামটাই না কামিয়েছে! আর আমি শুধু ভাবি তোমার কথা, ঈশ্বর কী জাদুভরা আঙুলই না তোমায় দিয়েছেন! বম্বের সমস্ত নামকরা পিয়ানিস্টকেই তুমি ফিঙ্গারিঙ্গের লেসন দিতে পারো। ইউ ক্যান রিয়েলি বি দ্য বেস্ট পিয়ানিস্ট অব ইণ্ডিয়া। তা হলে কেন পড়ে আছ কলকাতায়? আর এই সবও যদি কিছু না হয় তোমার কাছে, অ্যাটলিস্ট তোমার প্রিসিলা তো আছে। কাম ফর মি, ডার্লিং, ডিয়ারেস্ট, জাস্ট কাম, আই অ্যাম ওয়েটিং।
সেদিনও ঠিক এইখানে বসে চিঠিটা পড়েছিল লোবো। শেষে রাগে, দুঃখে, অবরুদ্ধ কান্নায় সেটাকে দুমড়ে-মুচড়ে, দলা পাকিয়ে টেনিস বলের মতো ছুড়ে দিয়েছিল অদূরে বাঙালি খ্রিস্টানদের বস্তির চালে।
সেই থেকে লোবো এইখানে বসে চোখ রাখে সিঁড়ির তৃতীয় বাঁকটার উপর। ওর জীবনে এর পরের কোনো বড়ো ঘটনা ঘটলে হয়তো ওইখানেই ঘটবে। হয় ওখান থেকেই কেউ গড়িয়ে পড়বে নীচে, নয়তো উঠে আসবে উপরে। বস্তুত, ওইখানে দাঁড়িয়েই ট্রিনকাসের ছেলেগুলো আজ মিনতি করছিল, সনি, প্লিজ ফিরে এসো।
সিঁড়ির তৃতীয় বাঁকে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল ওরা, কিন্তু লোবোর একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি ব্যাপারটাকে। ও সিগারেট খেতে খেতে ওদের কথা সব শুনল, তারপর পুরো প্রসঙ্গটাকে বদলে দিয়ে খুব ক্যাজুয়ালি জিজ্ঞেস করল, মোরিন কেমন আছে? কেমন গাইছে?
ছেলেদের মধ্যে একজন উত্তর দিল, ফাটাফাটি গাইছে এখন মোরিন। যা কে সেরা সেরা করে! ইস তুমি যদি সঙ্গে থাকতে পিয়ানোয়!
লোবো তখন জিজ্ঞেস করল, বুড়ো সিলভিওর পায়ের বাত কীরকম? টিবেটান ওষুধে কিছু কাজ হল?
ছেলেরা তখনই বুঝে গিয়েছিল একে ফেরানো দায়। ওরা ওর জন্য আনা দুটো ‘লাকি স্ট্রাইক’-এর প্যাকেট ওর হাতে জমা দিয়ে চলে গেল। লোবো ফের মন দিয়ে দেখতে লাগল সিঁড়ির তৃতীয় বাঁকটাকে…আর ওরকম অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎই মনটা কীরকম কান্নায় ভরে গেল। ওর মনে পড়ল ওই তৃতীয় বাঁকটায় দাঁড়িয়ে সেই ছোট্টখাট্টো বাঙালি কলেজ যুবার আড়ষ্ট নিবেদন, মিস্টার লোবো, ক্যান আই কাম আপ অ্যাণ্ড টেক টেন মিনিটস অব ইয়োর প্ৰেশাস টাইম?
লোবো সেদিন প্রভূত মদ্যপান করেছিল, ভালো করে দেখেওনি ছেলেটার দিকে। তার উপর সন্ধ্যেকাল, পিছন ঘুরে ছেলেটার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে কথা বলারও সৌজন্য দেখায়নি লোবো। চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে বলেছিল, দশ মিনিট? এমন ভর সন্ধ্যেবেলায় দশটা মিনিট কি চাট্টিখানি ব্যাপার? না বাপু, তুমি পরে একসময়…।
লোবো কথা শেষ না করেই ঢুকে গিয়েছিল ঘরে। যখন সুইচ টিপে অন্ধকার ফ্ল্যাটে আলো জ্বালল, দেখল ছেলেটাও গুটি গুটি এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজায়। হাতে কী সব চৌকো চৌকো খাতাপত্তর, সেগুলো দেখিয়ে বলল, আপনি একবারটি এগুলো দেখুন, তারপর পছন্দ না হলে আমি চলে যাব।
লোবোর বেশ মেজাজ চড়ছিল, সেটাকে সংযত না করেই বলল, দ্যাখো বাপু, গান-বাজনা আমার কাজ। বাড়িতে রেকর্ড রাখার জায়গা নেই। দয়া করে আমাকে এর-তার পুরোনো রেকর্ড গচাতে চেষ্টা কোরো না।
লোবো একটা সিগারেট ধরিয়ে ধপাস করে বসে পড়েছিল বেতের সোফায়। প্রথম ধোঁয়াটা হাওয়ায় ভাসিতে দিয়ে উপরে চাইতে দেখল যুবকটি মাথা নীচু করে কীরকম অভিমানী চোখে চেয়ে আছে মাটির দিকে। লোবোর সঙ্গে চোখাচোখি হতে বলল, আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই। আমি আপনাকে রেকর্ড বেচতে আসিনি, দেখাতে এসেছি। আর এসব রেকর্ড এর তারও নয়, আমার বাবার। আর এগুলো কিছু গানের বই যা, আমার ধারণা, আপনার দেখা দরকার।
লোবো ছেলেটার হাতের পুরোনো ৭৮ আর পি এম রেকর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এসব তো খুব পুরোনো রেকর্ড, এতে কাদের গান?
ছেলেটা রেকর্ডগুলো লোবোর সামনের সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, মোজার্ট, শুমান, ফ্রানজ লিস্ট। আর এই বইগুলো…
ছেলেটার কথা তখনও শেষ হয়নি, তড়াক করে ওর সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে লোবো বলল, তুমি আগে প্লিজ বসো, হোয়াট এভার ইয়োর নেম…
ছেলেটা উত্তর দিল, অমিত রে। বাট সিম্পলি কল মি অমিত।
লোবো ওকে বসিয়ে, নিজে বসে, সিলিঙের দিকে চোখ তুলে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলল, আমি সত্যি জানি না কেন এমন ব্যবহার করলাম তোমার সঙ্গে। এই সিঁড়ি দিয়ে আমার পিছন পিছন উঠে এসে কত লোকই যে আবদার করে একটু বাজনা শোনাও। আমার প্রথম এবং একমাত্র বান্ধবী প্রিসিলার পর এই তুমিই এলে আমাকে কিছু শোনাতে। দিস ইজ আ গ্রেট ডে ফর মি, অমিত।
অমিত ওর লাজুক মুখ তুলে আস্তে আস্তে বলল, আমিও, লোবো মাস্টার, তোমার কাছে শুনতেই এসেছি।
একটা বিকট আর্তনাদ করে উঠেছিল লোবো, অ্যাঁ! তাতে রীতিমতো চমকে গিয়েছিল অমিত।
লোবোর আর্তনাদের দুটো কারণ ছিল। এক, এই ছোকরাও সেই অন্যদের মতোই হল শেষে! এরও উদ্দেশ্য কিছু প্রশংসা উগরে ফোকতায় পিয়ানো শুনে নেওয়া। আর দুই, এই প্রথম কেউ ওকে সম্মান করে মিস্টার লোবো না বলে লোবো মাস্টার বলল। বুকটা যেন কীরকম জুড়িয়ে এল ডাকটায়। যেমন আহ্লাদ হয় ভালো বাজনার পর কেউ যখন ওকে স্টাইল করে মায়েস্ত্রো’ বলে। কিন্তু তার চেয়েও যেন এই লোবো মাস্টার ডাকটায়…।
লোবোর চিন্তা কেটে গেল অমিতের কথায়, আমি কিন্তু রেস্তরাঁর ওইসব বাজনাই এখানে শুনতে আসিনি। ও তো হোটেল রেস্তরাঁয় গেলেই শোনা যায়।
লোবো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তা হলে কী শুনবে?
অমিত বলল, এইসব। বলে রেকর্ডগুলো এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দিজ আর অল গ্রেট পিয়ানো পিসেজ। আমি তোমার হাতে শুনতে চাই।
আমার হাতে! দ্বিতীয়বারের মতো আর্তনাদ করে উঠল লোবো।
মুখে একটা সরু মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে অমিত বলল, ইয়েস, মাস্টার লোবো।
এবার বেপরোয়া হয়ে পড়েছে লোবো—তুমি কী করে ভাবছ আমি ও সব বাজাতে পারব? আমি জীবনে ক্ল্যাসিকাল বাজিয়েছি?
আর তখনই, ঠিক তখনই, অমিত ওই কথাটা বলেছিল যা আজও লোবোকে তাড়া করে ফেরে। বলেছিল, দ্য ক্ল্যাসিক ইজ ইন দ্য মাইণ্ড। সব ক্ল্যাসিকই মগজে ভর করে থাকে। তাকে ধরার জন্য চাই কণ্ঠ, মুখ বা আঙুল। সেরা পিয়ানোর জন্য চাই সেরা আঙুল, অ্যাণ্ড ইউ হ্যাভ ম্যাজিক ফিঙ্গার্স, মাস্টার।
—কিন্তু আমার মাথায় যে কিছু নেই অমিত! ফের আর্তনাদ করে উঠল লোবো।
অমিত বলল, সেজন্যই তো এইগুলো তোমায় শোনাব।
লোবো এবার রীতিমতো বিরক্ত—শুনে শুনে ও সব বাজানো যায়? ওগুলো কি ‘কে সেরা কেরা’ না ‘হামটি ডামটি’?
ক্ল্যাসিকাল পিস-এর কয়েকটা স্টাফ নোটেশন বই সামনে মেলে ধরে অমিত বলল, এর থেকে।
—আমি নোটেশন পড়তে জানি না।
–আমি তোমায় শিখিয়ে দেব।
–তুমি!
প্রায় আকাশ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়েছিল লোবো। তোতলাতে তোতলাতে শুধোল, তু…তু…মি স্টা…স্টাফ নোটেশন পড়তে জানো?
অতি করুণভাবে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ জীবনে শেখার মধ্যে ওইটাই শিখেছি, কলেজের পড়াশুনো আমার ভালো লাগে না।
-তা গাইতে, বাজাতে শেখোনি?
–না, আমার সব গান, সব বাজনা মাথার মধ্যে।
এই বলতে বলতে অমিত ওর পোলিয়োবিধ্বস্ত সরু ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল সামনে। এতক্ষণ রেকর্ড দেখানো, বই মেলেধরা সব কাজই ছেলেটা বাঁ-হাতে সেরেছে, সেগুলো বয়েও এনেছিল ও বাঁ-হাতে, বাঁ-বগলে চেপে। ডান হাতটার দিকে লোববার নজরই যায়নি।
লোবো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অমিত, আমার বাড়িতে এই তোমার প্রথম আসা, কিন্তু শেষ আসা নয়। তোমার এই আসার সম্মানে আমি একটা ছোট্ট বাজনা বাজাতে চাই। তুমি ফরমানা করো।
অমিত বলল, ব্লু ড্যানিউব।
—রু ড্যানিউব? দ্যাটস মাই ফেভারিট ওয়ালজ!
—হয়তো পৃথিবীর সেরা ওয়ালজ পিসও, মাস্টার।
—কী করে জানলে আমি ওটা বাজাতে পারব?
—কারণ দু-মাস আগে এক সন্ধ্যায় ট্রিনকাসে তুমি এটা বাজিয়েছিলে। আমি দিদির সঙ্গে বসে সেই বাজনা শুনে বলেছিলাম, এর হাতে তো জাদু খেলে। হি ইজ টু প্ৰেশাস ফর হোটেলজ অ্যাণ্ড রেস্টোরান্টস। এর উচিত মোজার্ট, বেটোফেন বাজানো। তো দিদি বলল…
উৎকণ্ঠার সঙ্গে ললাবো বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তো দিদি কী বলল?
অমিত বলল, ও বলল ওরা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। হালকা-পলকা জিনিসেই জীবন কাটিয়ে দেয়। ক্ল্যাসিকালচৰ্চার টেম্পারামেন্টই ওদের থাকে না।
মুখটা হঠাৎ ভার হয়ে গেল লোবোর। পিয়ানোর ঢাকনাটা তুলে কি-বোর্ডের উপর আলতো করে একটু আঙুল বুলিয়ে বলল, খুব ভুল বলেনি তোমার দিদি। তাঁর মৃত্যুর আগে মা-ও এই কথাটাই বলত দেখা হলে। বলত, বাজনা অনেক বাজিয়েছিস সনি, এবার আসল বাজনাটা ধর। আসল বাজনা বলতে মা বুঝতেন মোৎজার্ট, যার একটা পিস বাজিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াত মা। এই পিয়ানোয়। মার নিজস্ব পিয়ানোয়। বলত, এ হল ছোট্ট একটু নৈশসংগীত।
অমিত বলল, আইনা ক্লাইনা নাখটমজিক। আ লিটল নাইটমিউজিক।
লোবো অবাক হয়ে বলল, তুমি জানো?
-কেন, তুমি জানো না?
খুব ক্লান্তভাবে মাথা নেড়ে লোবো বলল, মার বাজনার যেটুকু স্মৃতি, শুধু ওইটুকুই। খুব মনে হত একসময় রেকর্ড কিনে পুরোটা তুলে নিই, কিন্তু ভয় হয়েছে। ওতে ছেলেবেলার স্মৃতিটুকু আলগা হয়ে যাবে।
অমিত প্রতিবাদ করল, তা কেন, লোবো মাস্টার? মার স্মৃতিতে একটা প্রার্থনার মতোও তো হতে পারত বাজনাটা।
জড়তা ভেঙে কোনো মতে লোবো বলল, তুমি বলছ?
তারপর পিছন ফিরে অমিতের দিকে না তাকিয়ে আপনমনে লোবো ধরে বসল ‘ব্লু ড্যানিউব’-এর সুর নয়, আনন্দ-ফুর্তির নীল স্বর্ণিল-স্বপ্নিল সুর ‘আইনা ক্লাইনা নাখটজিক।
স্বল্পক্ষণের বাজনাটা শুনে অমিত বলল, এই অসাধারণ বাজনাটা কিন্তু পিয়ানোর বাজনা নয়। ইটস অ্যা আনফরগেটেবল অর্কেস্ট্রাল পিস প্লেড অনবদ্য ভায়োলিন। তুমি পিয়ানোয় যেটা বাজাও তা হল পিসটার মূল সুর। বলতে হয়, জাস্ট দ্য থিম টিউন। বাট দেন ইট ওয়জ মার্ভেলাস। সুরটা শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়।
আজ সকালে ট্রিনকাসের ছেলেগুলো যখন সিঁড়ির তৃতীয় বাঁকে দাঁড়িয়ে অত কথা বলছিল হয়তো লোবোর মধ্যে একটু করে শত বছর আগের সেই রাতটা ফুটে উঠছিল যেদিন অমিত ওর পিছু নিয়ে ঠিকই বাঁক অবধি উঠে এসেছিল।
অথচ, হায় কপাল, সেই দৃশ্যটারই কোনো স্মৃতি নেই লাোবোর। কারণ মদে ভারাক্রান্ত ছেলেটিকে সে দেখলই না। কথায় বলে দেবদূতেরা খুব নম্র চরণে যাতায়াত করে। তাদের যাওয়া আর আসা সবই খুব নীরব।
ন-মাস আগে অমিতের চলে যাওয়াটাও চিঠির পাতা ওড়ার মতোই খুব নিঃশব্দে ঘটল। বসন্তের সোনালি সকালে একটা হালকা ইনল্যাণ্ড খামে করে এসেছিল খবরটা, অমিতের নিজের হাতে লেখা :
মাস্টার, এই চিঠি শুধু তোমাকেই লেখা যায়। কারণ তুমি সব দুঃখকেই সুরে ব্যক্ত করতে চাও, যা আমারও খুব মনঃপুত। এই যে আমি রেকর্ডে মোজাটের মৃত্যুগীত ‘রিকুইয়ম’ শুনছি আর চিঠি লিখছি শেষবারের মতো এর আনন্দ পৃথিবীর আর কাউকে বোঝাতে পারব না। বিশেষ করে এই দিল্লি শহরের অপোগন্ডদের, যারা ভাবতেই পারে না মানুষ কত বড়ো আনন্দের সঙ্গে দুঃখ জয় করতে পারে। এই শহরে দিদির সুইসাইডের পর থেকেই ভাবছিলাম একটা কথা : দুঃখ জয় কাকে বলে? দুঃখকে অন্য দশ ভাবনার চাপে দূর করা, না এত বেশি আনন্দ উপলব্ধি করা যায় তোড়ে দুঃখের আর লেশমাত্র থাকে না চিত্তে।
আমি দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলাম। বিরাট আনন্দের সন্ধানে দুটি জিনিসের মধ্যে এসে পড়েছি আমি—সংগীত আর মৃত্যু। আমি দু-টিকেই গ্রহণ করেছি। ভাবতে পারো, এই চিঠি ডাকে ফেলে এসে যখন হুইস্কি আর ঘুমের বড়িগোলা জল পান করব তখন আমার কানের কাছে রেকর্ডে বেজে চলবে মোজার্টের রিকুইয়ম’? পৃথিবীর আর কেউ বুঝুক, না বুঝুক তুমি নিশ্চয়ই জানবে কী সুখে আমি চলে গেলাম। আশা করব আমাদের বন্ধুত্বের স্মরণে একটু ছোট্ট রাত্রিসংগীত বাজিয়ে নেবে।
চিঠিটা পড়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মুড়ে ভাঁজ করে রাখা হয়নি। চিঠিটা হাওয়ায় উড়ে মাটিতে পড়ল, লোবোর আঙুলের গাঁটগুলোয় তখন অসহ্য যন্ত্রণা। বাতের অ্যাটাকের মতো। ও অনেকক্ষণ আঙুল মটকাল, পরে গরম জলে হাত ডুবিয়ে বসল। সেদিন আর হোটেলে বাজাতে যাওয়া হল না। রাতে পিয়ানোয় বসে মনে হল কবজি থেকে আঙুল অবধি হাতের কোনো সাড় নেই। চোখ দুটো ক্রমশ ভিজে আসছে, স্কোরশিট পড়া দুষ্কর। একটু একটু করে ভয় জাগল—এরপর স্টাফ নোটেশন পড়া ভুলে যাব না তো?
লোবো পিয়ানো থেকে উঠে বাইরে সিঁড়িতে বসে তার দিকে চেয়ে রইল। মনে পড়ল বাবার মৃত্যু, প্রিসিলার চলে যাওয়া, ইস্কুলের মাস্টারের মতো অমিতের ওকে স্কোর পড়া শেখানো। মনে পড়ল বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুশয্যায় মার কথা—সনি, আসল বাজনা বাজাতে শেখো।
ওই সিঁড়িতে শোয়া অবস্থায়—লোবোর মনে পড়ে না সিঁড়ির তৃতীয় বাঁকে না শেষ ধাপিতে—ওর হার্ট অ্যাটাকটা হয়। পরে হাসপাতালে ডাক্তারের মুখে শুনেছিল সকালে হাতের যন্ত্রণাটা অ্যাটাকের পূর্বাভাস ছিল হয়তো।
কিন্তু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেও সনি লোবো যে হোটেলে ব্যাণ্ডে ফিরল না এটাতেই সবাই খুব অবাক হয়ে গেল। লোকটার হাতটাও কি গেল তা হলে? নাকি মগজটা ধসল? মদ আর গাঁজার কম্বিনেশন তো অনেক দিনের। কেউ কিন্তু একবারটি ভাবল না মানুষটার হৃদয় নিয়ে। নাকি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানের হৃদয় হয় না?
সনি লোবো কি-বোর্ডে হাত বুলোতে বুলোতে নিজের আঙুলগুলোকেও দেখছিল। কতকাল ঘুমিয়ে আছে ওরা, যেন সাপের ঘুম। তবে সাপ নয় বলেই হয়তো শীতে জাগল, ভর শীতে, একেবারে ক্রিসমাস উইকে। লোবো একটু হালকা সুর ধরল, তারপর ‘ডক্টর জিভাগো’ ছবির টাইটেল মিউজিক, তারপর ‘ব্লু ড্যানিউব। পাশের বাড়ির রেচেলদের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে ক্রিসমাস ক্যারেলজ। লোববার বাসনা হল অমিতের উপহার দেওয়া শ্যমানের পিয়ানো ‘ফান্টাজিয়া’-র স্টাফ নোটেশন দেখে পিসটা একবার বাজায়। তাই ‘ব্লু। ড্যানিউব’ শেষ করেও স্বরলিপির বইটা খুঁজতে উঠল, আর তখনই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেল।
বলতে নেই বেশ ভালো রকম বিরক্তই হল লোবো। সন্ধ্যেকালে আবার কী উৎপাত! ট্রিনকাসের সেই ছোকরাগুলোই আবার ফিরে এল না তো। নাকি পাড়ার ছোকরাদের চাঁদার আক্রমণ? ইদানীং হিন্দুদের পুজোর মতো খ্রিস্টানদের ক্রিসমাসে, নিউ ইয়ার্স ডে ইত্যাদিতে চাঁদা তোলা চালু হয়েছে। কিংবা, কে জানে, ডিকিই এল হয়তো বগলে রামের বোতল নিয়ে। সে-ক্ষেত্রে ওকেও আজ ফিরিয়ে দিতেই হবে; ন-মাস পর আজ ওর আঙুলগুলো পিয়ানোর রিডের স্পর্শ চাইছে। এত পিপাসা যে জমতে পারে আঙুলের ডগায় তা ওর ধারণাতেও ছিল না। কি-বোর্ড আঙুলগুলো শুধু নেচে বেড়াচ্ছে না, ওরা রিড থেকে যেন সুর পান করছে। সুরগুলো যেন সুরা হয়েছে আজ আঙুলের ঠোঁটের ডগায়।
‘আঙুলের ঠোঁটের ডগা!’ কথাটা মনে হতেই একটা সরু হাসি ফুটল লোহোর মুখে। অদ্ভুত অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মানুষের কল্পনায় কত কীই যে ঘটে! লোবো মুখের সেই হাসির ঝিলিক নিয়েই ফ্ল্যাটের দরজাটা আস্তে করে খুলল।
খোলার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ হিমেল হাওয়ায় ঘর ভরে গেল। হালকা একটা সোয়েটার গায়ে লোবোর, তাতে ওই ঠাণ্ডা রোখা মুশকিল। ও দরজা খুলেই ঠাণ্ডার প্রতিক্রিয়ায় এক পা পিছিয়ে এল। কিন্তু ততক্ষণে ওর চোখ পড়ছে দরজার বাইরে দাঁড়ানো আগন্তুকের উপর। আর তৎক্ষণাৎ গায়ের শীতভাবটা যেন বুকের ভিতরে ঢুকে এল। ফুসফুঁসে নয়, সরাসরি হৃদয়ে শীত বসা যেন। লোবো কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল, ও হেসে কিছু বলবে, না শীতে আরও কুঁকড়ে যাবে বুঝতে পারল না। বস্তুত, ও হাসলও না, কুঁকড়ে মূক হয়েও গেল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়িয়েই বিস্ফারিত নেত্রে আগন্তুককে দেখতে দেখতে শুধু বলল, তুমি!!!
ক্রিসমাস উইকের এক রাত, হিমেল হাওয়ার রাত, বাইরে মধ্যরাত্রি নীল আকাশ, দূরে কিছু কিছু বাড়ির জানলায় আলো জ্বলছে জোনাকির মতো, বাড়ির সামনের বটগাছটা অন্ধকারে ভূতের মতো ডালপালা ছড়িয়ে রাস্তা পাহারা দিচ্ছে, আশপাশের বাড়ি থেকে ক্রিসমাস ক্যারলজ ভেসে আসছে, ভেসে আসছে রাস্তার রোয়াক থেকে বাঙালি খ্রিস্টান ছোকরাদের মাতাল গান, আর দরজার ফ্রেমে ছবির মতো ধরা এক নারীমূর্তি।
২.
প্রিসিলা!
জানো প্রিসিলা, এই যে তুমি অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে আছ আমার ছোট্ট খাটে, এভাবে আগে তুমি কখনো ঘুমোওনি আমার বিছানায়। সত্যি বলতে কি, তুমি আগে কখনো শোওইনি আমার বিছানায়। শুধু একবার ছাড়া। সেই শোওয়াটা কী যথার্থ শোওয়া? …না। ও কথা আমি এখন ভাবতেও চাই না। পরে যদি মনে পড়ে তোমাকে মনে করার…
হ্যাঁ, প্রিসিলা, তুমি সেই প্রিসিলাই আছ। তোমাকে অন্য কেউ বলে ভুল করতে পারব না।
না প্রিসিলা, তুমি কিন্তু সেই প্রিসিলা নেই। তোমাকে সেই প্রিসিলা বলে ভুল করতেও পারছি না।
কী অদ্ভুত সমস্যা বলো দিকিনি। একই সঙ্গেই তুমি প্রিসিলা প্রিসিলা নও। একই সঙ্গেই তুমি আছ এবং তুমি নেই। তুমি ক্লান্ত দেহে গভীর ঘুমে মগ্ন আছ, আর আমি তোমায় অক্লান্তভাবে দেখছি। এত কাছে তুমি, তবু তোমাকে আমি স্পর্শ করছি না। তোমার ওই পরিচিত লাল ঠোঁটে চুমে রাখছি না। কারণ আমি এই মুহূর্তে ভাবছি তুমি প্রিসিলা, তার পরমুহূর্তে ভাবছি তুমি সে নও। শুধু যখন তুমি অনুরোধ করলে তোমাকে একটা ঘুমপাড়ানি সুর-লালাবায়—শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই তখনই তীব্রভাবে মনে হয়েছিল তুমি আমার সেই পুরাতন প্রেম। ইচ্ছে করছিল তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, কপালে চুমো দিয়ে আমার এই বিছানায় শুইয়ে দিই। তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে ছেড়ে আসার আগে যেমনটি দিতাম মাকে।
কিন্তু এসব যখন ভাবছি তখন কী দেখলাম? দেখলাম তুমি আমার অফার করা রাম দিয়ে পটপট দুটো ঘুমের ওষুধ গিলে ফেললে। আর অমনি তুমি প্রিসিলা থেকে সম্পূর্ণ অচেনা কেউ একটা হয়ে গেল। যে-কেউ ঘুমের বড়ি খাচ্ছে এ আমি স্বপ্নেও আনতে পারি না। আমি ভেবে উঠতেই পারছি না তোমার এত ঘুমের দরকার হল কেন? তুমি কত দিন, কত মাস, কত বছর ঘুমোওনি প্রিসিলা? এই আমি তোমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে তোমাকে দেখছি, যেন তুমি গানের স্বরলিপি। কত সুর তোমার মধ্যে আহা! আবার কত কত সুর মরেও গেছে, ইস।
তুমি ঘুমোও প্রিসিলা, আর আমি তোমায় দেখি। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই তোমাকে চিনে উঠতে পারব কি না। নাকি মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে অন্য মানুষ হয়ে যায়!
আমি এখনও ভুলতে পারি না বিদায় দিনে দেখা সেই তোমাকে। একটা আকাশি নীল ফ্রক ছিল তোমার পরনে। হালকা করে কাঁধের এক পাশে ফেলা ছিল একটা গাঢ় নীল স্কার্ফ; আর তোমার পায়ে ছিল সাদা হাইহিল জুতো। সেদিনই প্রথম তোমাকে লাল বা উজ্জ্বল গোলাপির বদলে ফ্রস্টেড পিঙ্ক লিপস্টিক ব্যবহার করতে দেখেছিলাম। যখন আমার পিয়ানোর গায়ে হেলান দিলে তুমি আমায় চুমু দিয়ে, আমি অবাক চোখে তোমার ঠোঁটের ওই হিমশীতল রংটাই দেখছিলাম। তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি তোমার ঠোঁটের ওই হিমশৈত্য একদিন আমাদের সম্পর্কেও ঢুকে পড়বে। পরে আমার ফ্ল্যাটের দ্বিতীয় বাঁকটায় দাঁড়িয়ে তুমি যখন হাত নাড়ছিলে ক্রমাগত আমি তোমাকে সব চেয়ে বেশি চাইছিলাম, ভালোবাসছিলাম ভেতরে ভেতরে। শুধু একটা ক্যামেরার অভাবে দৃশ্যটা ধরে রাখতে পারিনি সেদিন।
আর আজ তুমি আমার সামনে, এইখানে, এত কাছে শুয়ে, অথচ আমার ভিতরটা কীরকম ফাঁকা ফাঁকা। এ তোমার কী কালঘুম প্রিসিলা, যে তোমাকে ডেকে তুলতেও সাহস হবে না আমার? এই মদ আর ঘুমের বড়ি মেশানো ঘুমকে বড্ড ভয় পাই জানো, প্রিসিলা? অমিত যখন ওর শেষ চিঠি লিখছিল আমাকে, ও হুইস্কির সঙ্গে ঘুমের বড়ি মেশাচ্ছিল। ও হো, তুমি তো অমিতকে চেনোই না, ও আমার জীবনে এসেছিল তুমি চলে যাওয়ার পর। জানি তুমি কষ্ট পাবে তবু আজ আমি সত্যি কথাটাই বলব—অমিতকে পেয়ে আমি তোমাকে ভুলেই গিয়েছিলাম।
না, না, না। তুমি যা ভাবছ, তা না। অমিত ওয়জনট গে। আমাদের কোনো সমকামিতা ছিল না। তবু আমরা একে অন্যের উপর নির্ভর করতাম স্বামী-স্ত্রীর মতো। অমিতের ডান হাতটা পোলিয়োয় নষ্ট ছিল, তাই আমার দুটো হাত ছিল ওর হাত। আর আমার সাদামাটা মগজের মধ্যে ও একটু একটু করে সংগীতের রহস্য ঢোকাচ্ছিল। পরে আমি যখন ওর রেকর্ড শুনে, ওর সাহায্যে নোটেশন পড়ে ক্লোদ দেবুসির রচনা ক্ল্যারিনেট ও পিয়ানোর জন্য ‘র্যাপসোডি’-র পিয়ানো-অংশ বাজিয়েছি ও আনন্দে এতই দিশেহারা হয়ে গেছে যেন ও নিজের হাতে বাজনাটা বাজাল। দেখতে দেখতে একটা সময়ও এসেছিল যখন আমি কী বাজাচ্ছি ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাকে দিয়ে কী বাজিয়ে নিতে চায়। আমি একদিন অভিমান করে বলেওছিলাম ওকে, তুমি আমার আঙুলগুলোকে ম্যাজিক ফিঙ্গার্স বলল ঠিকই, কিন্তু এরা আসলে তোমার মগজের দাস। দ্য প্লে দ্য টিউনজ ইউ ওয়ান্ট দেম টু প্লে।
কিন্তু এই দাসত্বই আমি চেয়েছিলাম, প্রিসিলা। হাত-পা-চোখ-নাক-কান সবই তো মগজের দাস, নয় কি? অমিত ছিল আমার মগজ, এবং আস্তে আস্তে হয়ে উঠছিল আমার মন ও হৃদয়। আর এইখানেই যত গোল বাঁধল শেষে। কিন্তু সেকথা থাক। সে অনেক পরের কথা। তোমাকে দেখতে দেখতে ফের একটু তোমার কথাই বলি বরং…
তুমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলছিলে বম্বে তোমাকে সব কিছু দিয়ে সবই ফের কেড়ে নিয়েছে। চোদ্দো বছর পর তুমি ফিরে এসেছ, প্রিসিলা, একটা বিধ্বস্ত বারবনিতার চেহারা নিয়ে। প্লিজ ডোন্ট মাইণ্ড মাই ল্যাঙ্গোয়েজ, বাট দ্যাট ইজ হাও আই ফিল অ্যাট দিস মোমেন্ট। এই ক্রিসমাস উইকের গভীর রাতে। বম্বে থেকে যেন এক শুষ্ক, বিবর্ণ উপহারই হাওয়া হয়ে বয়ে এল ক্রিসমাসের সপ্তাহে। তবু…তবু প্রিসিলা আমি তোমাকে দু-হাত ভরে নিতে চাই কারণ কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়ে অমিত আমাকে একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে—যে, শেষবিচারে সংগীতের চেয়েও বড়ো সম্পদ মানুষ। যদিও ওর মৃত্যুর দিনের চিঠিতে কেন শুধু সংগীত আর মৃত্যুর কথা বলল আমি জানি না। …কিন্তু আমি ফের কেন অমিতের প্রসঙ্গে যাচ্ছি? ওর বিষয়ে তুমি তো প্রায় কিছুই জানো না। কিন্তু তোমাকে শুনতে হবে ওর কথা। তার আগে আমি শুধু তোমার কথা বলব।…
কিন্তু কী বলব?
বম্বে থেকে লেখা সেই ভয়ংকর চিঠিটার পর তুমি আরও কুড়িটা চিঠি লিখেছিলে, যার কোনোটাই আমি খুলে পড়িনি। কী লিখতে সেসব চিঠিতে তুমি? ভালোবাসার কথা? অনুরাগের কথা? বম্বের সিনসিনারি? ওখানকার বন্ধুবান্ধব, প্রেমিকদের কথা? একবার কাগজ পড়েছিলাম তোমাদের একটা দল লণ্ডনে গিয়ে কনসার্ট করেছে। ওখানকার কাগজে লিখেছে তোমার কণ্ঠ নাকি ডিভাইন, ঐশী। প্রিন্সেসের ব্যাণ্ডের বন্ধুরা তা নিয়ে একটু টীকাটিপ্পনীও কেটেছিল আমার বুকে জ্বালা ধরানোর জন্য। কেউ বললে তোমার গলা কনি ফ্রান্সিসের মতো, কেউ বললে ন্যান্সি সিনাট্রার মতো, আবার কেউ বললে তোমার পাশে কলকাতার রেস্টোরান্ট গায়িকাদের কোকিলের পাশে কাক মনে হয়। আমি নীরবে হেসে পিয়ানো বাজিয়ে গেছি, আমার বুকে তখন কোনো আঁচড়ই কাটে না এই সব কথা। একটাই টান তখন আমার—কখন বাড়ি ফিরে অমিতের শেখানো স্টাফ নোটেশন লেসনগুলো নিয়ে বসব। তখন যে আমি আবিষ্কার করেছি ছাপার হরফে নিদ্রিতত সুরকে জাগিয়ে তোলার খেলা।
তোমার চিঠিগুলো কিন্তু আমি ফেলেও দিইনি প্রিসিলা। কেবল সেই প্রথম ভয়ংকর চিঠিটা ছাড়া; কিন্তু সেটা তো আমার পড়াই হয়ে গিয়েছিল। বাকি সব চিঠি পরিপাটি করে সাজানো ছিল দেরাজে। একদিন সেখান থেকেই একটা চিঠি বার করে পড়েছিল অমিত, আমি ট্রিনকাস থেকে ফিরতে জিজ্ঞেস করল, প্রিসিলা কে?
আমি কোনোমতে রাগ সংরবণ করে যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম, তুমি আমার চিঠি পড়েছ?
ও প্রথমে খুব থতমতো খেয়ে গেল, তারপর বেশ বিব্রত স্বরে বলল, লোবো মাস্টার, সংগীত কি শুধু শরীর, যন্ত্র আর বই দিয়ে হয়?
আমি ব্যঙ্গের সুরে বলেছিলাম, তার জন্য অন্যের চিঠি পড়তে হয় বুঝি? ও তখন বলল, আমি লোবো মাস্টারের মনের হদিশ করছিলাম।
আবার দেখতে পাচ্ছ প্রিসিলা, অমিত কীভাবে মিশে যাচ্ছে আমার সব কথাবার্তা, কল্পনা, ভাবনায়? আমি তোমার কথা বলব ভাবছি, আর ও চলে আসছে। ও-ই আমাকে শুনিয়েছিল মোজার্টের মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা, বেটোফেনের বধির হয়ে যাওয়ার কথা, সুমানের উন্মাদ অবস্থায় রাইন নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা, তারপর নদী থেকে উদ্ধার পেয়ে জীবনের শেষ আড়াইটা বছর পাগলা গারদে কাটানোর কথা। আমি যখন স্নমানের জীবনের ট্র্যাজেডির কথা ভেবে মুষড়ে আছি, ও বললে, এখনই সময় ওঁর পিয়ানো কনচের্ত নিয়ে বসার। বলে খুলে বসল ১৮৪৭-এ গড়া মানের ডি মাইনরের পিয়ানো ট্রায়ো।
আমি তখন প্রশ্ন তুলতাম, একটা পিয়ানোয় কী করে ট্রায়ো হবে? ট্রায়োতে তো তিনটে পিয়ানো চাই।
অমিত বলত, সেজন্য তো আমার রেকর্ডই আছে। আমি শুধু দেখতে চাই লোবো মাস্টারের হাতে এসব জিনিস কী দাঁড়ায়।
তুমি ভাবতে পারছ প্রিসিলা, কী এক ভীষণ নির্জন খেলায় আমরা গোপনে মেতেছিলাম দু-জন? আমি ক্ল্যাসিকাল পিস শিখছি কোনো আসরে বাজাব বলে নয়, শুধু আমি আর
অমিত নির্জন কিছু সুর আবিষ্কার করব বলে। ও যেমন একদিন বলল, তুমি পিয়ানোয় আইনা ক্লাইনা’-র সুর তোল কেন? ওটা তো পিয়ানো পিস নয়।
আমি বললাম, মা আমায় ওভাবেই শুনিয়েছে বলে।
অমিত উল্লাসে ফেটে পড়ে বলল, দ্যাটস দ্য পয়েন্ট! মার পিয়ানোর তুলে দেওয়া সুরটাই তোমার কাছে ‘আইনা ক্লাইনা’, ইউ প্লে ইট অ্যাজ ইফ ইট ওয়জ মেজ ফর দ্য পিয়ানো। ‘আইনা ক্লাইনা’ বাস্তবিকই তোমার জীবনে রাত্রিসংগীত, কারণ তোমার মা তোমাকে বিছানায় শুইয়ে ওই সেরিনাড বা প্রেমগীতিটি বাজাতেন। ওই নিপুণ, নিখুঁত প্রেমের সুরটা তাই তোমার কাছে লালাবায় বা ঘুমপাড়ানি গানও। নয় কি?
আমি অগত্যা বলতে বাধ্য হলাম, হ্যাঁ।
অমিত তখন বলল, আমি তোমার চিঠি পড়ছিলাম তোমার মনের প্রেমের সুরটা জানার জন্য। এনি প্রবলেম?
আমি বলেছিলাম, তার জন্য চিঠি পড়ার দরকার নেই। আমি তোমায় শুনিয়ে দিচ্ছি… বলে ধরে ফেলেছিলাম ডরিস ডে-র গানটা।—কে সেরা সেরা, হোয়াটএভার উইল বি উইল বি, দ্য ফিউচার নট আ ওয়ার্স টু সি হোয়াট উইল বি, উইল বি।
জানো প্রিসিলা, এই গানটা আমি তোমার চেয়ে ভালো কাউকে গাইতে শুনিনি। আমার মনে পড়ে প্রিন্সেসের সেই সন্ধ্যেটা যেদিন প্রথম তুমি গাইলে গানটা। আমার মনে হল তুমি অন্য কারও গান গাইছ না। তোমার নিজের জীবনের কথা শোনাচ্ছ। ক্ষণিকের জন্য মনেও হয়েছিল বুঝি-বা তোমার চোখের কোণে একবিন্দু জল দেখলাম। ব্যাণ্ডের শিফট শেষ হতে তোমাকে গিয়ে যখন গানটার প্রশংসা করলাম তুমি আমায় কী বলেছিলে, মনে আছে? বলেছিলে দিনটা তোমার জীবনের এক অন্ধকার দিন। কেননা তার আগের রাতে তোমার ছেলেবেলার বয়ফ্রেণ্ড, তোমার ন-বছরের স্টেডি লাভার ক্লাইভ তোমায় ছেড়ে চলে গেছে। ও শুধু জানাতে এসেছিল যে ইভন বলে একটা অন্য মেয়ের সঙ্গে ও জীবন গড়তে চায়। তুমি ওকে ওর দেওয়া পান্নার আংটিটা ফেরত দিয়ে বলেছিলে, গুড লাক! তারপর মাঝরাতে ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে ফালা ফালা করেছিলে।
তুমি কালো গাউনের লম্বা হাতা সরিয়ে সেই সব কাটা-ছেড়া আমায় দেখালে। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ফাঁকে ফাঁকে চাপাস্বরে গাইলে কে সেরা সেরা। আর ঠিক তখন, সেই মুহূর্তে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। ভুলে গেলাম তোমার সঙ্গে আমার বয়সের বেশ বড়োসড়ো ফারাক। ভুলে গেলাম আমার জীবনের প্রতিজ্ঞা যে কখনো বিয়ে করব না। সেক্স ইজ ফাইন, একটা দুটো লম্বা সম্পর্কও ঠিক আছে, কিন্তু প্রেম, বিবাহ…ওহ, নো! আই কান্ট হ্যাণ্ডল দ্যাট।
আমি তোমার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে কী বলেছিলাম মনে আছে? বলেছিলাম, আগামী অফ ডে-টা আমার সঙ্গে কাটাবে, প্রিসিলা? তুমি বললে, কাটাব; কিন্তু কোনো হোটেল, রেস্তরাঁ বা সিনেমা হলে নয়।
আমি ভিতরে ভিতরে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, মেয়েটা বলে কী! আমার মতো লোকের জীবনে হোটেল, রেস্তরাঁ, সিনেমার বাইরে আছেটা কী? আর আছে নিজের ফ্ল্যাটটুকু। প্রথম দিনই ফ্ল্যাটে আসার কথা বললে ভাববে বিছানায় নেওয়ার ধান্ধা করছি। আমি হোটেলের নির্জন লবিতে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কত কী আকাশ-পাতাল ভাবলাম। শেষে কী মনে করে দুম করে বলে দিলাম, নো নো, ডোন্ট ওরি, আমি তোমাকে একটা অভিনব অভিজ্ঞতা উপহার দেব তোমায় অফ ডে-তে।
কী ছিল সেই অভিজ্ঞতা, তোমার মনে পড়ে? আমি তোমাকে ঝিরঝিরে বৃষ্টির বিকেলে নিয়ে গিয়েছিলাম সার্কুলার রোডে ওল্ড পিপল হোমে মার কাছে। আমার হাতে কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট আর ওষুধ ছিল মার জন্য। আমি বলেছিলাম তোমাকে সেগুলো তুলে দিতে ওঁর হাতে। আর মনে আছে উনি কী বলেছিলেন বিদায়মুহূর্তে? আমার হাতটা ওঁর হাতে চেপে ধরে বললেন, সনি, তোর জীবনে দুটো অপূর্ব জিনিস আছে, সামলে-সুমলে রাখিস। জিজ্ঞেস করলাম, কী আছে আমার জীবনে মা? মা একবার তোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়েটি। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, আর তোর পিয়ানো।
আমি পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার জন্য বললাম, এই মেয়েটি আমার নয়, মা। সবে পরিচয়টা একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আর পিয়ানোটাও আমার নয় মা। ওটা তোমার।
তখন ওই বারান্দার ইজিচেয়ারে আরও এলিয়ে গিয়ে মেঘলা আকাশ দেখতে দেখতে মা বললেন, কে আর সব কিছু নিয়ে জন্মায়? একটু একটু করে নিজের করে নিতে হয়?
সে-দিন বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেরিয়ে প্রথম কথা বলেছিলে তুমি। কিছু বলার জন্য নয়, একটা কথা জানার জন্য প্রশ্ন করলে—কেন তুমি মাকে বললে আমি তোমার নই?
সত্যি বলছি। সে-দিন এ প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না আমার কাছে। আমি অবাক হয়ে তোমার দিকে চেয়েছিলাম। তুমি বললে, সনি, আমি বাড়ি যাব। আমি তোমাকে তোমাদের রয়েড স্ট্রিটের বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। ফ্ল্যাটের দরজার মুখে তুমি আমার হাত চেপে ধরলে। কী উষ্ণ স্পর্শ সেটা, হাত যেন পুড়ে যাচ্ছে। আমি তোমার ঠোঁটে চুম্বন করলাম, অমন সুন্দর চুম্বন আমি কাউকে করিনি আগে। কারণ তার আগে তো কাউকে হৃদয় দিইনি। প্রথম যৌবনের নেশায় একে-তাকে হাবিজাবি চুমু সব। কিন্তু এই চুম্বন?
ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে তুমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললে, বড্ড একলা লাগছে, সনি। আজ থেকে যাও।
আমি থাকার জন্যই তোমার সঙ্গে ফ্ল্