কিন্তু এই যাত্রায় তাহার আগ্রহ ছিল না। তাহার মাদ্রাজী শিষ্যগণ বলেন যে, ঐ উদ্দেশে সংগৃহীত প্রথম পঁচশত টাকা তিনি তৎক্ষণাৎ পূজা ও দানে ব্যয় করিয়া ফেলেন, যেন তাহাকে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করাইবার ভার তিনি জোর করিয়া নিজ অদৃষ্টের উপরেই চাপাইবেন। এমনকি, বোম্বাই পৌঁছিবার পরেও তিনি পাশ্চাত্যে যাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হইবার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন। তাহার মনে দ্বন্দ্ব চলিতেছিল, এমন সময় তিনি অনুভব করেন যে, তাহার শ্রীগুরুর মূর্তি যেন বার বার আবির্ভূত হইয়া তাহাকে যাইবার জন্য উৎসাহিত করিতেছেন। অবশেষে তিনি গোপনে পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরানীকে লিখিলেন, তিনি যেন কৃপা করিয়া তাঁহাকে উপদেশ দেন ও আশীর্বাদ করেন; বিশেষ করিয়া অনুনয় করিলেন, পুনরায় তাহার পত্র না পাওয়া পর্যন্ত এই নূতন যাত্রা সম্পর্কে যেন কাহাকেও কিছু না বলেন। এই পত্রের উত্তরে শ্রীশ্রীমার আন্তরিক উৎসাহ এবং ভগবৎসমীপে তাহার জন্য সর্বদা প্রার্থনা করিবেন এই আশ্বাসবাণী লাভ করিয়া তবে তিনি ভারত পরিত্যাগ করিয়া পাশ্চাত্যে যাত্রা করেন। শেষ পর্যন্ত আর অদৃষ্টকে পরিহার করিবার উপায় রহিল না। যে অভিপ্রায়ে তিনি মঠ পরিত্যাগ করেন, সেই আত্মগোপনের আকাঙক্ষাতেই তিনি ভারতে প্রত্যেক গ্রামে পৌঁছিবামাত্র নাম পরিবর্তন করিতেন। বহু বৎসর পবে এক ব্যক্তি তাহার নিকট শ্রবণ করেন, কিরূপে শিকাগো নগরীর সেই প্রথম বিখ্যাত বক্তৃতার পর তিনি সারারাত্রি ধরিয়া এই ভাবিয়া মমর্যাতনা ভোগ করেন যে, তাহার এই বিজয়-গৌরবের ফলে আত্মগোপনের আশা একেবারে নির্মূল হইয়া গেল। এখন তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে লোকচক্ষুর সম্মুখে দণ্ডায়মান। অজ্ঞাত ভিক্ষুক আর অজ্ঞাত থাকিতে পারিলেন না। যে সত্যসমূহ আমার গুরুদেব উপলব্ধি করেন এবং যাহা তাহার জীবনে প্রমাণীকৃত ও প্রত্যক্ষ হইয়াছিল, ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তাহার এই ভ্রমণের মধ্যেই তাহার তৃতীয় ও শেষ উপাদান নিহিত।
আমার মনে হয়, একথা নিঃসন্দেহ যে, তাহার জীবনগঠনের মূলে ছিল ত্রিবিধ প্রভাব, প্রথমতঃ, তাঁহার ইংরেজী ও সংস্কৃত সাহিত্যে শিক্ষা লাভ; দ্বিতীয়তঃ, সমুদয় শাস্ত্র যে জীবনকে একবাক্যে আদর্শ বলিয়া ঘোষণা করিয়া থাকে, সেই জীবনের উদাহরণ ও প্রমাণস্বরূপ তাঁহার গুরুদেবের অলৌকিক চরিত্র; এবং তৃতীয়তঃ, আমার যতদূর মনে হয়, এক বিপুল প্রাণধর্মী অধ্যাত্মশরীরের অঙ্গরূপে ভারত ও ভারতবাসিগণ সম্পর্কে তাহার প্রত্যক্ষ জ্ঞান। তাহার অশেষ মহিমান্বিত গুরুদেবও ছিলেন উহার সাকার বিগ্রহ ও বাণী মাত্র। আমার মনে হয়, তাহার বিবিধ বক্তৃতা হইতে উপরি-উক্ত ত্রিবিধ প্রভাব স্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়। যখন তিনি বেদান্ত প্রচার ও জগৎ সমক্ষে স্বদেশবাসীর দর্শনের পক্ষ সমর্থন করেন, তখন প্রধানতঃ প্রাচীন যুগের সংস্কৃত গ্রন্থ হইতেই উপাদান সংগ্রহ করিয়া থাকেন; যদিও ইহা সত্য যে, ঐরূপ প্রাঞ্জলভাবে ও দৃঢ় নিশ্চয়তার সহিত উহার ব্যাখ্যা করা তাহার পক্ষে এই কারণেই সম্ভব হয় যে, ঐ সকল গ্রন্থপ্রতিপাদ্য সত্যগুলি উহার গুরুদেবের বিস্ময়কর জীবনে একাধাবে সমষ্টিভূত হইতে দেখিয়াছিলেন। ভক্তির প্রসঙ্গে যখন তিনি বলেন, “প্রেমেই ভক্তির আরম্ভ, স্থিতি ও পরিণাম,” অথবা যখন তিনি কর্মযোগের বিশ্লেষণ করিতে গিয়া বলেন, “কর্মের রহস্য, তখন আমরা যেন তাহার গুরুদেবকেই দেখিতে পাই; আমরা উপলব্ধি করিতে পারি যে, শিষ্য অপর একজনের পদতলে যে জ্যোতির্ময় রাজ্যে বাস করিয়াছেন, তাহারই কথা বলিতে যথাসাধ্য প্রয়াস পাইতেছেন মাত্র। কিন্তু যখন আমরা তাহার শিকাগো সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতা, অথবা ঠিক ঐরূপ অসাধারণ ‘মাদ্রাজ অভিনন্দনের উত্তর’, কিংবা ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে হিন্দুধর্মের মুখ্য ও সাধারণ লক্ষণগুলি চিত্রিত করিয়া লাহোরে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলি পাঠ করি, তখন এমন কিছুর পরিচয় পাই, যাহা তাহার নিজের পরিশ্রমলব্ধ অভিজ্ঞতা হইতে প্রসূত। এই সকল বক্তৃতার পশ্চাতে অবস্থিত শক্তি তাহার ভারতব্যাপী দীর্ঘভ্রমণের ফল। মনে হয়, এই ভ্রমণকাহিনী বলিয়া শেষ করিবার নহে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, স্বদেশ ও স্বদেশবাসিগণের প্রতি তাহার শ্রদ্ধা এই প্রত্যক্ষজ্ঞান হইতেই উৎপন্ন হইয়াছিল, উহা কোন ফাঁকা ভাবুকতা বা ইচ্ছাকৃত অন্ধতার ফল নহে। অধিকন্তু ইহাও বলা যায় যে, তাহার অনুমান-প্রক্রিয়া ছিল সতেজ ও ক্রমবর্ধমান, নূতন নূতন তথ্যের জন্য সর্বদা উন্মুখ এবং প্রতিকূল সমালোচনায় নির্ভীক। একবার তিনি বলেন, “হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তিগুলি কি, তাহাই তাহার সমগ্র জীবনের আলোচনার বিষয় হইয়াছে।” কেবল তাহা নহে, এই সর্বাঙ্গসম্পন্ন ও প্রত্যক্ষজ্ঞান ছিল বলিয়াই স্বদেশ ও স্বজাতি সম্পর্কে তাহার যে সব ধারণা তাহাতে হিন্দু সভ্যতার প্রাচীনতর ও অপেক্ষাকৃত সাদাসিধা উপাদানগুলিও এত মহৎ দেখাইত। তাহার স্বদেশে যতদূর সম্ভব আধুনিক শিক্ষায় অগ্রণী হইয়াও কোন কোন নব্যপন্থীর ন্যায় তিনি সন্ন্যাসী বা কৃষকসম্প্রদায়কে, অথবা যাহারা প্রতিমা পূজা করেন, বা যাহারা জাতিভেদপ্রথা দ্বারা পীড়িত, তাহাদিগকে এই বলিয়া উড়াইয়া দেন নাই যে, “উহারা অখণ্ড ভারতের অঙ্গবিশেষ” নহে। আর এই যে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইবার দৃঢ় সঙ্কল্প, উহা তাহাদের সহিত বহু বৎসর ধরিয়া একত্র জীবন যাপনেরই ফলস্বরূপ।