এবার তামাকে ছ্যাঁদলা পড়া দাঁত বার করে হাসতে লাগল আমাদের ড্রাইভার। কী যে বলেন আপনারা! আপনারা তো স্টুডেন্ট আছেন। বলুন, ঠিক কিনা?
ড্রাইভারের কথায় একটু রাগ হল বাপ্পার। সে বলল, স্টুডেন্ট আছি বলে কি দোষ করেছি?
আরে রাম, রাম! আমি কি সেই কথাই বললাম? বলতে চাইলাম যে, আপনারা স্টুডেন্ট আছেন বলে আপনাদের পয়সাও কম আছে। বেশি পয়সা নাই।
বাপ্পা বলল, সে তো নাই তাতে…
আর সেইজন্যই তো আপনাদের বসিয়ে রাখছি। আরেকটা প্যাসেঞ্জার পেলে আপনাদের অনেক টাকা বেঁচে যাবে।
এবার আমি হোটেল বিষয়ে একটা জরুরি খবর নিতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা ছাই ছাই রঙের প্রিন্স কোট পরা ভদ্রলোক এসে ড্রাইভারের কাছে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলে, শিলং যাবে? আর অমনি আমাদের ড্রাইভার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, হাঁ, হাঁ বাবু আসুন। তিরিশ টাকা লাগবে। ভদ্রলোক খুব গম্ভীরভাবে ছোট্ট করে বললেন, জানি।
বাপ্পা, চন্দন আর আমি এবার সেট হয়ে গেলাম সিটে। ভদ্রলোক টুকুস করে একটা পাইপ ধরিয়ে বসে গেলেন সামনে। ড্রাইভার ছুটে গিয়ে একবার কাপড় দিয়ে উইণ্ডস্ক্রিনটা ঘষে দিয়ে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিল। এতক্ষণ দম বন্ধ হয়ে এক কোণায় বসেছিল চন্দন। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাপরে, বাঁচা গেল।
কিন্তু সেরকম কিছু বাঁচা হল না আমাদের। গাড়ি গৌহাটি শহর তখনও পার হয়েছে কি হয়নি অমনি নামল মুষলধারে বৃষ্টি। সামনের ভদ্রলোক চটপট পাইপ নিবিয়ে জানালার কাচ তুলে দিলেন। কাচ তুলে দিলাম আমরাও। বড়ো বড়ো বৃষ্টির ফোঁটায় ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে উইণ্ডস্ক্রিন। ধারের কাচ দিয়েও কিছু দেখার জো নেই। ড্রাইভার ফের তার সেই দার্শনিক মুখভঙ্গি করে বলল, শিলং পৌঁছোতে এবার বেশি সময় লেগে যাবে স্টুডেন্ট দাদাবাবু। তবে একটা ছোটো হোটেল আমি চিনি শিলঙের বাইরে। বেশ সস্তা আছে। আপনারা চান তো সেখানেই নামিয়ে দেব।
আমার রাগ হচ্ছিল এবার নিজেরই ওপরে। ওই তিরিশ টাকা বাঁচানোর জন্য এতখানি টাইম নষ্ট করার মূলে আমি নিজেই। যেই ড্রাইভার বলল, বসুন, সওয়ারি পাব অমনি তাতে সায় দিয়ে বসলাম। যখন-তখন যা-খুশি ডিসিশান নেওয়ার এই এক-রাগ আমার। এবার তাই রাগে রাগে বললাম, না, না তোমাকে আর উপকার করতে হবে না। তুমি আমাদের শিলঙেই নামিও। পয়সা কম আছে সে আমরা বুঝব। তোমাকে সর্দারি করতে হবে না।
আমার এই শেষের উক্তি শুনে এবার বেজায় অভদ্রমতো হা-হা হা-হা করে হাসতে লাগলেন সামনের লোকটা। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, কী মশাই, আপনারা কলকাতার লোক। স্টুডেন্ট? পকেটে পার হেড দুশো টাকা? সস্তার হোটেল খুঁজছেন? রাইট?
কী আশ্চর্য! আমাদের চেনে না, জানে না, অথচ এতগুলো অসম্মানজনক প্রশ্ন একটার পর একটা করে গেল? লোকটার কি মাথা খারাপ নাকি? আমি কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আমাকে থামিয়ে চন্দন বলল, আপনি ঠিক ধরেছেন মশাই। আমরা স্টুডেন্ট, পকেট গড়ের মাঠ, সস্তার হোটেল চাই, পারলে দু-দশ টাকা ধার দেবেন?
আর অমনি মাথা ঘুরিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আলবত! দেব না মানে কী! কলকাতার ছেলে আপনারা; দেব না! ইচ্ছে হলে জোর করে দেব। তা কোথায় উঠছেন আপনারা?
সত্যি বলছি আমরা তিনজনেই একেবারে ক্যাবলা হয়ে গেলাম ভদ্রলোকের এইসব কথাবার্তা শুনে। ভাবলাম, এমনও বাঙালি আছে তা হলে, যে না চাইতে অন্যকে পয়সা দেয়! তাও না চিনে, না জেনে। বাপ্পারও মনের ভাবখানা প্রায় একইরকম হয়েছিল। সে রীতিমতো গদগদ হয়ে বলল, আপনি একটা দারুণ লোক মশাই। বিজ্ঞানমনস্ক ছেলে চন্দন বলল, কিন্তু আপনি লোকটা কে দাদা?
আবার একটা লম্বা হাসি শুরু করলেন ভদ্রলোক? নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি তো! তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, আমার নাম প্রতাপ গুহ। কলকাতায় সলিসিটার্স ফার্ম আছে। শিলং পিকের পথে আমার দাদুর মকান আছে। আমি সুযোগ পেলেই এখানে এসে দু-চারদিনের বিশ্রাম নিয়ে যাই। আমার এই বাড়িতে একটি নেপালি কেয়ারটেকার আছে। তাঁর বয়স ষাট, নাম ব্যোমবাহাদুর। এই বুড়ো বয়সে সে একটা বিয়েও করে বসেছে। বাড়ির ডেক বারান্দা দিয়ে আপনারা সারাক্ষণ শিলং পিক দেখতে পাবেন। পিছনে একটা ঝরনা আছে, সারাদিন ঝিরঝির করে জল পড়েই যাচ্ছে। আর আছে রাস্তায় কতকগুলো অসাধারণ পাইন গাছ। দেখলে মনে হবে এগুলো কেউ এঁকে রেখেছে পাহাড় এবং আকাশের গায়ে।
ভদ্রলোক আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাপ্পা ফের ওর সেই ছেলেমানুষি ঢঙে বলল, আপনি মশাই খুব লাকি। ভদ্রলোক যেন এর কথা শুনতেই পাননি এমন ভাব করে বলে চললেন, কিন্তু বাড়িটা খুব নির্জন। থাকার লোক বিশেষ নেই। হয়তো আমি মানুষটা তেমন সুবিধের নয়। কিংবা…
না জিজ্ঞেস করে পারলাম না, এখানে আপনার পরিবার-পরিজন কেউ নেই?
-না!
-কেন, তাদের…
—প্রথমত, বিবাহ করিনি। দ্বিতীয়ত, আত্মীয়বর্গ পছন্দ করি না। তার চেয়ে বরং রাস্তায় আলাপ হওয়া লোকজনকে নিয়ে বাড়িতে রাখব।
-কোনো স্থায়ী বন্ধু করতেও চান না?
—কোনো বন্ধুত্বই স্থায়ী নয় ইয়ং ফ্রেণ্ড। একরাত, দু-রাত, দ্যাটস এনাফ।
আমার বলতে দ্বিধা নেই লোকটার এই ধরনের কথাবার্তায় ভীষণ কৌতূহল বোধ করছিলাম ওর বিষয়ে। তাই বললাম, কাল একবার শিলং পিকে যাব আমরা। যদি আপত্তি না থাকে তখন না হয় আপনার বাড়িটা আমরা দেখে আসব। আমায় কথা তখনও শেষ হয়নি। ভদ্রলোক হঠাৎ বলে উঠলেন, এটা কি একটা কথার কথা মশাই। বিদেশ-বিভুঁইয়ে বাঙালি ছাত্র আপনারা। থাকবেন আমার ডেরায়। অন্যত্র যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। একটা বড়ো কার্পেট শেয়ার করে শুতে পারবেন না?